নবজন্ম

  • 29 April, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 168 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ।
আমার স্কুলবেলার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু আর্য্যার জীবনী নিয়ে যেকোনো বড় মাপের লেখক হলে একটা আস্ত উপন্যাস কিংবা চিত্রনাট্য লিখে ফেলতে পারতেন। তবে আর্য্যার একান্ত অনুরোধ যে আমার মত এক অর্বাচীন লেখক যদি ওকে নিয়ে একখানা ছোটগল্পও রচনা করে তবে তাতেই সে যথেষ্ট খুশি হবে।

আমার স্কুলবেলার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু আর্য্যার জীবনী নিয়ে যেকোনো বড় মাপের লেখক হলে একটা আস্ত উপন্যাস কিংবা চিত্রনাট্য লিখে ফেলতে পারতেন। তবে আর্য্যার একান্ত অনুরোধ যে আমার মত এক অর্বাচীন লেখক যদি ওকে নিয়ে একখানা ছোটগল্পও রচনা করে তবে তাতেই সে
যথেষ্ট খুশি হবে। আর্য্যার বিয়ে হয়েছিল শ্যামবাজারের এক সম্ভ্রান্ত একান্নবর্তী পরিবারে। শ্বশুর, শাশুড়ি, মাসতুতো ননদ,
খুড়শ্বশুর, খুড়তুতো ভাসুর ও সবশেষে নিজের স্বামী ব্যোমকেশ কে নিয়ে তার ভরা সংসার। স্কুলজীবনে একসঙ্গে পড়াশোনা শেষ করার পর আমরা দু’জন দুই বিপরীত দিকে ছিটকে পড়লাম। আমি বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম আর আর্য্যা এক নামী বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। এরপর আর্য্যার সঙ্গে তেমন দেখা
সাক্ষাৎ না হলেও আমাদের বন্ধুত্বে কোনোদিন ভাটা পড়েনি। প্রায়শয়ই ফোন, ভিডিও কল, ম্যাসেজ আদানপ্রদান আমাদের মধ্যে হয়েই চলত। ঐ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াকালীনই ব্যোমকেশের সঙ্গে ওর আলাপ হয়। ব্যোমকেশ ছিল আর্য্যার থেকে এক বছরের সিনিয়র। ওদের আলাপ গড়িয়ে ভালোবাসায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি।আর্য্যা পড়াশোনায় ছিল তুখোড়। তাই ফাইনাল ইয়ারে পড়তে পড়তেই ক্যাম্পাসিং -এ এক চান্সে একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়। ব্যোমকেশকে অবশ্য চাকরির
জন্য আরও একটা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

 

ব্যোমকেশের চাকরি পাওয়ার কয়েক মাস পর পরই দুই পরিবারের সর্ব সম্মতিক্রমে ওরা দু’জন সাত পাকে আবদ্ধ
হয়ে পড়ে। ওদের বিয়ের সময় আমারও নিমন্ত্রণ ছিল। ওদের বিয়ের পর একবারই আমি আর্য্যার শ্বশুরবাড়িতে ঘুরতে
গিয়েছিলাম। কিন্তু এক ব্যোমকেশ ছাড়া ওর শ্বশুরবাড়ির বাকি সদস্যরা প্রত্যেকে মুখে কিছু না বললেও আভাসে ইঙ্গিতে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে আমি আর দ্বিতীয়বার তাদের বাড়িতে পা রাখি তা তাদের মোটেও পছন্দ নয়। তাই আর ওমুখো হইনি কখনও। আর্য্যার সঙ্গে দেখা করতে যেতে না পারলেও সারাদিনের শেষে ফোন বা ভিডিও কল করে দু’জনে রোজই আধঘণ্টা ধরে আড্ডা দিতাম। বিয়ের পর এক হাতে চাকরি আর এক হাতে সংসার সামলাতে গিয়ে যে আর্য্যাকে যথেষ্ট হিমশিম খেতে হচ্ছে তা
ভালোই আন্দাজ করতে পারতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রত্যেকের চা ও জলখাবার বানিয়ে, ব্যোমকেশকে তার অফিসে রওনা করিয়ে দিয়ে নিজে তৈরি হয়ে অফিসে দশটা-
পাঁচটার ডিউটি করতে যেতে আর্য্যা বেশিরভাগ দিনই দেরি করে ফেলত আর বসের কাছে মুখ বুজে কথা শুনত। বিয়ের পর এভাবে কয়েক মাস ওর একপ্রকার চলে যাচ্ছিল। আমি জানতাম আমার চেয়ে আর্য্যা ঢের বেশি ব্যস্ত তাই প্রতিদিন নিয়ম করে আমিই ওকে ফোন বা ম্যাসেজ করতাম। রোজই আর্য্যা আমার সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু হঠাৎ একদিন থেকে কী হল আর্য্যা আর আমার সঙ্গে কোন কথা বলত না। ফোন করলেও কেটে দিত। প্রথমে ভেবেছিলাম ব্যোমকেশের সঙ্গে ঝগড়া-ঝাটি হয়েছে কি না কে জানে? মন মেজাজ হয়ত ভালো নেই। পরে মনে হল ব্যোমকেশ তো ঝগড়া করার মত মানুষই নয়। অত্যন্ত স্বল্পভাষী, গম্ভীর ও শান্ত স্বভাবের মানুষ ব্যোমকেশ। তার চেয়ে অনেক বেশি চঞ্চল আর মিশুকে স্বভাবের মেয়ে ছিল আর্য্যা, সারাক্ষণ তার মুখে যেন খই ফুটছে।

 

বিয়ের দিন ব্যোমকেশের পাশে আর্য্যাকে দেখে মনে হয়েছিল এরা দু’জন সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের মানুষ হলেও কোথাও যেন এদের মধ্যে একটা আশ্চর্য সমতা রয়েছে। এক বেগবতী স্রোতস্বিনী যেমন অতল সমুদ্রের মধ্যে নিজের প্রবাহকে বিলীন করে দিয়ে শান্ত হয়ে পড়ে ঠিক তেমনই একমাত্র ব্যোমকেশই যে কেবল আর্য্যার সব অস্থিরতা দূর করতে পারবে সে বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না। পরক্ষণেই আবার এও ভাবলাম আর্য্যার হয়ত চাকরিতে প্রমোশান হয়েছে তাই এই গরীব লেখকটির সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখতে চায় না। যাই হোক এরপর প্রায় আট মাস কেটে গেছে। নানাপ্রকার কাজের চাপে ও সময়ের প্রভাবে আমার মনের মধ্যে জমে থাকা আর্য্যার স্মৃতির ওপরে ধুলো পড়তে শুরু করে। তারপর হঠাৎই এক রাতের ঘটনার পর আর্য্যাকে নিয়ে মনে ভিড় করে আসা সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে দেখা দেয়।

 

রাত তখন দশটা বেজে পাঁচ মিনিট, আমি সবেমাত্র টেবিলে খাবার সাজিয়ে ডিনার করতে বসেছি এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠলো। আমি একটু বিস্ময় আর বিরক্তি মেশানো ভাব নিয়ে উঠে গিয়ে দরজার আইহোলে চোখ রাখলাম।  এখন তো কারোর আসার কথা নয়। বাইরের ঝাপসা অন্ধকারে কেবলমাত্র সুটকেস হাতে এলোমেলো বেশভূষার এক রমণীর অবয়ব ঠাহর করতে পারলাম। আমার দরজার মাথায় থাকা বালবের সুইচটা অন করে চড়া আলোতে দেখলাম অল্পবয়সী একটা মেয়েকে। তবে মুখটা দেখে ঠিক চিনতে পারলাম না। দ্বিতীয়বার মেয়েটি কলিংবেল বাজালো।
ভাবলাম দরজা খুলে দেখাই যাক কী বলতে চায়। দরজা খুলে মেয়েটার মুখের ওপর চোখ পড়তেই আমার মাথার মধ্যে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। এরপর মেয়েটি ঠোঁটের
কোণে একটা শুকনো হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে একবার গলা ঝেড়ে বলল, ‘কি রে চিনতে পারছিস না?’ সেই অতি প্রিয় কণ্ঠস্বর চিনতে আমার কোনোদিনও ভুল হতে পারেনা। আমার মুখ থেকে অস্ফুটে স্বর বেরিয়ে এল, ‘আর্য্যা!’ তারপর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘এ কী দশা হয়েছে তোর?’
আর্য্যা আমার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আজ রাতটুকু তোর বাড়িতে থাকতে দিবি?’

 

ওর এমন আবদার শুনে আমি হতভম্বের মত দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। এতদিন পর আর্য্যাকে কাছে পেয়ে আমি যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম বটে কিন্তু ওর এই উশকোখুশকো চুল, গায়ের ময়লা রঙ, পরিধানের অগোছালো শাড়ি, চোখের তলায় পুরু কালি আর নীরস মুখমণ্ডল দেখে আমার বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। আর্য্যা ঘরে প্রবেশ করেই আমার সোফাটা অধিকার করে বসলো। তারপর আমার মুখ দেখে মনের ভাবটা অনুমান করেই হয়ত বলল, ‘আগে একটু জল খাওয়া। তারপর তোর সব কৌতূহল মেটাচ্ছি।’ আমি শুধু জলই দিলাম না তার সঙ্গে আমার রাতের খাবার রুটি, তরকারি সব আর্য্যার সঙ্গে ভাগ করে নিলাম। আর্য্যা মুখে একটিও কথা না বলে মন দিয়ে খাবার খেতে শুরু করে দিল। দেখে মনে হল সে অনেকদিন পর এমন শান্তিতে নিশ্চিন্তে খাবার খেতে বসেছে। আমরা খাওয়া-দাওয়া আগে শেষ করে নিলাম। তারপর একটা চেয়ার টেনে এনে আর্য্যার মুখোমুখি বসতেই আর্য্যা বলতে শুরু করল, ‘দীর্ঘ ইতিহাস কোথা থেকে শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না।’ তারপর খানিকক্ষণ চুপ থেকে মনের মধ্যে ক্রমান্বয়ে ঘটনাগুলিকে সাজিয়ে নিয়ে আর্য্যা আবার বলতে আরম্ভ করল, ‘একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে ব্যোমকেশ আমাকে জানালো যে তিনমাসের জন্য ওদের কোম্পানির নাগপুরের অফিসে ওকে একটা কাজের জন্য যেতে হবে। ব্যোমকেশ এতে ইতস্তত করলেও আমিই ওকে আরও বেশি করে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিলাম। বললাম, “বিয়ে নতুন হলে কী হবে, আমাদের সম্পর্ক তো আর নতুন নয়।” আমার কাছে আশ্বাস পেয়ে এর একদিন পরই ব্যোমকেশ নাগপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

 

এরপর বাড়িতে আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়লাম। ব্যোমকেশ না থাকাতে আমার শাশুড়িমায়ের বেশ সুবিধাই হয়েছিল। দিন কে দিন আমার ওপর তার ফাইফরমাশ বেড়েই চলল। আমাকে অফিস থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে কখনও বলতেন ভালো-মন্দ রাঁধতে, কখনো বা কোন কারণে ফিরতে একটু রাত হলে বাইরের গেটে তালা ঝুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। কোনোদিন আবার তার গুরুদেবের শিষ্যরা বাড়িতে আসবে বলে তাদের সেবা করার জন্য অফিসে যেতে দিতেন না। এসব যখন অসহ্য হয়ে উঠত তখন মাঝেমধ্যে রাগের মাথায় ওনাকে দু-চারটে কথা শুনিয়েও দিতাম। তখন শাশুড়িমা আমাকে নির্বিকার চিত্তে বলতেন, “ঐ জন্যই তো বলছি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ঘর সংসারের কাজে মন লাগাও। আজ পর্যন্ত কেউ চাকরি আর সংসার একসঙ্গে সামলাতে পারেনি, তুমিও পারবে না।” শাশুড়িকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না যে চাকরিটাই ব্যোমকেশের অনুপস্থিতিতে আমার সব কিছু। শ্বশুরবাড়ির এই কূটকচালির থেকে মুক্তির একমাত্র ক্ষেত্র ছিল আমার অফিসটা। বাড়ির বাইরে যে রাস্তায় বেরিয়ে আমি একটু খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারতাম সেই পথও যে শ্বশুরবাড়ির সকলে ষড়যন্ত্র করে বন্ধ করে দেওয়ার তালে আছে তা অনুভব করে আমি প্রমাদ গুনলাম। ব্যোমকেশকে ফোন করে এই সমস্যার কথা অনেকবার জানিয়েছি কিন্তু সে কাজের জন্য বাইরে গিয়ে কেমন বদলে গিয়েছিল। আমার সুবিধা-অসুবিধার কথা কিছু কানেই তুলতো না বরং আমাকেই বকাবকি করতো ওর মায়ের মুখে মুখে তর্ক করেছি বলে। এইসব অশান্তির মধ্যেও আমি হাল ছাড়িনি। মন দিয়ে অফিসের কাজ করতে না পারার জন্য আমার প্রমোশান তো দূরে থাক আমার রেপুটেশনের একেবারে দফা-রফা পাকিয়ে গেল এবং আমার কিছু হিংসুটে সহকর্মী কখনো বা আমার সংসারের কাজকর্ম নিয়ে কখনো বা আমাকে ‘আদর্শ গৃহিণী’ বলে বিদ্রুপ করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়ে গেল। আমার মাসতুতো ননদও আমাকে
প্রচণ্ড পরিমাণে ঈর্ষা করতো। বিয়ের পর প্রথমদিকে ওর সঙ্গে বন্ধুর মত মিশে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।
একদিন অফিস থেকে ক্লান্ত শরীরে ফিরে এসে দেখি আমার ঘরের মেঝে ও বিছানা জুড়ে কাগজের অজস্র ছেঁড়া টুকরো পড়ে রয়েছে। ভালো করে সেগুলোকে নিরীক্ষণ করে বুঝলাম
এগুলো আমারই তৈরি অফিসের একটা ভীষণ দরকারি প্রজেক্টের কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। শেষবারের মত বসকে অনেক করে বোঝানোর পর তিনি আমার ওপর ভরসা করে এই বড় দায়িত্বটা দিতে রাজি হয়েছিলেন। কাগজগুলোর ঐ পরিণতি দেখে আমি চোখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়তে পড়তে পিছনে দরজার দিক থেকে কানে এল ননদের কন্ঠস্বর, “এ বাবা! বৌদি এগুলো তোমার দরকারি কাগজ ছিল, আমি না একদম বুঝতে পারিনি।” আমি জানতাম এই চক্রান্তের মূলে রয়েছেন আমার শাশুড়ি। মন প্রাণ দিয়ে যিনি আমার চাকরি করতে যাওয়ার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন। তবে এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত তিনিই জিতে গেলেন। আমি আর ওদের সঙ্গে ঝগড়া করে মুখ খারাপ না করে কাগজের টুকরোগুলো সযত্নে ডাস্টবিনে ফেলে এসে কোনোমতে চোখের জল চেপে রেখে রেজিগনেশন লেটার টাইপ করতে বসে পড়লাম। বসের কাছে সকলের সামনে চূড়ান্ত অপমানিত হওয়ার পর চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে সহকর্মীদের হাসির খোরাক হওয়ার পরিবর্তে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা অনেক বেশি সম্মানের। এতদিন পর বাড়িতে বিনা পারিশ্রমিকের একটা কাজের ঝিকে পেয়ে পরিবারের সকলে অত্যন্ত খুশি হলেন।’
আমি মাঝখানে আর্য্যাকে থামিয়ে বললাম, ‘ব্যোমকেশ এর কোন আপত্তি করেনি তখন? আর্য্যা হৃদয়ের সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলল, ‘কী আবার বলবে সে? আমি বহু কষ্টে কান্না চেপে যখন তাকে সব কথা জানাই তখন সে আমাকে বলেছিল, “মা যা বলছে এখন তাই করো। আমি তো বাড়ি নেই, মা-বাবাকে একটু দেখে রেখো। আমি বাড়ি ফিরে সব সামলে নেব।”

 

অগত্যা আমি চাকরির আশা ছেড়ে আদর্শ গৃহিণী হয়ে ওঠার দিকে মনোনিবেশ করলাম। আমার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে বাড়িতে আর ঝামেলা হত না। তবে আমি সংসারের কাজে এমনই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে চাকরি ছাড়ার দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে নিজের যত্ন নেওয়ার কথাও একেবারেই ভুলে গেলাম। এই ঘটনার মাস দুয়েক পর ব্যোমকেশ একদিন বাড়ি ফিরল। ব্যোমকেশকে ফিরে আসার পর থেকে লক্ষ করেছি আমার প্রতি যথেষ্ট উদাসীন হয়ে থাকত। সকলের সঙ্গে একই রকম ব্যবহার করলেও আমি অনুভব করতাম বিয়ের আগে সে আমাকে যেমনটা ভালোবাসতো এখন আর তেমন ভালোবাসছে না। সারাদিনে সংসারের সকলের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকার ফলে ব্যোমকেশের সঙ্গে আমার বেশি কথা হত না। রাত সাড়ে দশটার পর বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে আমি একটুখানি সময় পেতাম। তখন দেখতাম ব্যোমকেশ ঘুমিয়ে পড়তো কি ঘুমানোর ভান করে চুপচাপ শুয়ে থাকতো কিংবা বইপত্র অথবা ল্যাপটপ নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতো। আমি ব্যোমকেশের পাশে শুয়ে আমার প্রতি তার মনের কোণে জমে থাকা অপ্রকাশিত অভিমান অনুভব করতে পারতাম। কিন্তু আমার অজ্ঞাতে সে যে আমার সঙ্গে
বিশ্বাসঘাতকতা করছে তা আমি তখনও বুঝতে পারিনি। সবকিছু বুঝতে পারলাম যখন একদিন জামা কাচার সময় ব্যোমকেশের শার্টের বুক পকেট থেকে একটা সযত্নে ভাঁজ করা কাগজ পেলাম। ব্যোমকেশের অনুপস্থিতিতে সেটা খুলে পড়ে দেখলাম যে সেটা জাহ্নবী নামের একটি মেয়ের হাতে লেখা প্রেমপত্র। ব্যোমকেশের আমার প্রতি ঔদাসীন্যের কারণ বুঝতে আর দেরি হল না। তার জীবনে নতুন কারোর আগমন ঘটেছে।

 

সারাদিনের মধ্যে নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে রাতের বেলা আমি যতটা সম্ভব স্থির ভাবে ব্যোমকেশের চোখে চোখ রেখে বললাম, “সত্যি করে বলতো তুমি কি এখন আমাকে আর একদমই ভালোবাসো না?” আচমকা আমার এই প্রশ্নে ব্যোমকেশ প্রথমটা কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে। তাকে নিরুত্তর দেখে আমি আবার বললাম, “জাহ্নবী কে, তোমার নতুন প্রেমিকা?” ব্যোমকেশ অপরাধীর মত ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিয়ে আমার সামনে মূর্তিবৎ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর আমি আর রাগ ধরে রাখতে না পেরে ওর ওপর চিৎকার করে বললাম, “ভালোই যখন বাসো না তখন বিয়ে করলে কেন?”

 

ব্যোমকেশ ওর সেই স্বভাব সুলভ শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে জবাব দিল, “আমি এই আর্য্যাকে তো ভালোবাসিনি। একে আমি চিনি পর্যন্ত না। সংসারের কাজ সামলাতে গিয়ে নিজের কী দশা করেছ তা আয়নার সামনে গিয়ে দেখেছ কখনও? রান্নার ধোঁয়ায় গায়ের রঙ ময়লা করে ফেলেছ, না ঘুমিয়ে চোখের তলায় কালি ফেলেছ। বিয়ের আগে যা ডায়েট করতে এখন সবই ছেড়ে দিয়েছ, জিমেও আর যাও না। আমি একজন স্মার্ট, সুন্দরী চাকুরিজীবী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। তাই বাড়ির সকলের অমতে গিয়ে জোর করে তোমায় বিয়ে করি। যদি এমন আলুথালু ঘর বসা মেয়েকেই বিয়ে করার হত তবে আমি কবেই মায়ের পছন্দ করা সেই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলতাম।” ব্যোমকেশের আমাকে ভালোবাসতে না পারার এমন অকাট্য যুক্তি শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তারপর গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসা হৃদয় নিংড়ানো কান্নাটাকে চেপে কোনোমতে বললাম, “এই বাড়ি, এই পরিবার যার জন্য আমি খেটে মরছি এসব কার আমার না তোমার? আমারই ভুল ছিল তোমাকে বিশ্বাস করে ভেবেছিলাম সত্যিই তুমি আমার অন্তরটাকে মন থেকে ভালোবাসো। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি, আখের মত পুরো রস নিংড়ে নিয়ে এখন আমাকে ছিবড়ের মত ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাও। জানি, তোমার মত পুরুষদের জীবনে এমন শত সহস্র নারী আসবে আর যাবে। কিন্তু আমি আর সহ্য করবো না, ডিভোর্সের জন্য প্রস্তুত থেকো।” এই বলে আমি ব্যোমকেশকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাতের কাছে যা পেয়েছি মোটামুটি প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিসপত্র গুছিয়ে সুটকেসটা নিয়ে এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে রাস্তার ওপর একটা কালী মন্দিরের চাতালে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ তোর কথা মনে পড়লো তাই…’ গল্প শেষ করেই আর্য্যা একেবারে ভেঙে পড়লো। আমি আর একটিও কথা না বলে আমার শোওয়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেই ও কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ঘুমিয়ে পড়লো।

 

পরের দিন সকালে আর্য্যাকে নিয়ে ভিক্টোরিয়ার মাঠে প্রাতঃভ্রমণে গেলাম। আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সকালের টাটকা হাওয়ায় আর্য্যার মন থেকে কিছুটা দুঃখের বোঝা নামিয়ে হালকা করা। পার্কের ধারে দু’জনে একটা বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছিলাম এমন সময় আমি আর্য্যাকে বললাম, ‘তুই নিজের জীবনটাকে একটা নতুন দিশা দেওয়ার চেষ্টা কর। এভাবে চুপচাপ আমার ঘরে বসে থাকলে পুরনো স্মৃতিগুলো মাথার মধ্যে বারবার চাড়া দিয়ে উঠে তোকে আরও কষ্ট দেবে। একটা কোন বিষয়ে ব্যস্ত থাকলে তোর পক্ষে সব ভুলে আবার নতুন ভাবে জীবনটাকে শুরু করতে অনেক সুবিধা হবে। এতে তুই সুখেও থাকবি।’ চায়ের কাপটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে আমার দিকে ফিরে আর্য্যা বলল, ‘কী করতে বলছিস তুই?’ আমি বললাম, ‘অন্য কোন কোম্পানিতে আবার চাকরির খোঁজ শুরু কর।’ এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্তই। আর্য্যা আমার উপদেশ মেনে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গিয়ে নতুন
চাকরির সন্ধান শুরু করলো। যেখানে যা ভ্যাকেন্সি দেখতে পেত সেখানে নিজের বায়োডেটা সমস্ত দিন ধরে বসে আপলোড করতো। সারাদিনে আমাদের মধ্যে তেমন কোন কথা হত না। আর্য্যা নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতো আর আমিও লেখালেখির কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতাম। প্রতিদিন
রাতের বেলা ডিনার সেরে দুই বন্ধুতে মিলে বেরিয়ে পড়তাম নৈশভ্রমণে। সেইটুকুই আমাদের নিজস্ব আড্ডার সময়। শহরের বড় রাস্তা থেকে শুরু করে ফুটপাথ, অলি-গলি কিছুই ভ্রমণকালে আমরা বাদ দিতাম না। আর্য্যা সারাদিন আমার বাড়িতেই বসে থাকতো এক রাত্রিবেলা আমার সঙ্গে ছাড়া কোথাও একা বেরাতো না। নিজের বাপের বাড়ির কাউকেও আর্য্যা লজ্জায় কিছু জানাতে পারেনি। আর্য্যা জানতো এসব কথা শুনলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবেন ওর মা। তিনি বলতেন, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ আর্য্যার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে ওর গুণের দাপটেই আজ ওদের দীর্ঘ ছয় বছরের প্রেমের সম্পর্ক এবং ওর সংসার সবই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছে। আমার আর্য্যাকে দেখে দুঃখ হলেও মিথ্যে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে ওকে দুর্বল করতাম না। তবে ওর এই ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে আর্য্যা বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করার একটা
সুযোগ পেয়ে যায়।

 

এভাবে প্রায় একমাস কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলা পত্রিকার অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখি আর্য্যা ঘরে কোথাও নেই। কোথায় গেল এই রাতের বেলা একা একা কে জানে? আমার মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা প্রবেশ করলো। ওর মনের অবস্থা এমনিতেই ভালো নয়। এই ফাঁকা বাড়িতে আমার আর্য্যাকে একা রেখে যাওয়া একদমই উচিৎ হয়নি, আবার না কোন কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। নানা রকম বাজে আশঙ্কায় মনটা ঘিরে রইল। আর্য্যার নম্বরটা দ্রুত ডায়াল করে কানে ফোন চেপে ধরার সেই মুহূর্তেই ডোরবেল বেজে উঠলো। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখি আর্য্যা হাতে একটা বড় কেকের বাক্স আর মুখে একগাল হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি রে, আজ তোর মন খুব খুশি মনে হচ্ছে। আজকে তো আমাদের কারোর জন্মদিন নয়, তা কেক কিনতে গিয়েছিলিস কোন উপলক্ষ্যে?’ আর্য্যা সোফায় ধপ করে বসে পড়ে নিজের ফোন থেকে একটা মেইল বের করে আমাকে দেখালো। দেখলাম ছোট একটা বেসরকারি কোম্পানির একটা মাঝারি ধরনের পোস্টে আর্য্যার চাকরি পাওয়ার মেইল। আনন্দে আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখে আর্য্যা বলল, ‘আজ থেকে আমার একটা নতুন জীবনের সূচনা হল। আজ তারই সেলিব্রেশন বলতে পারিস। নে, চটপট কেককাটা শুরু করা যাক।’

লেখক : শিক্ষার্থী 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment