গাঁয়ের নাম পাতরডুবা

  • 25 April, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 214 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
 বর্ধমান স্টেশনের প্লাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ একজন মহিলাকে দেখে আমার খুব চেনা বলে মনে হল। কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছিনা। খেয়াল করলাম সেও আমাকে দেখছে। এবার মহিলাটি আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, সে ভাদু। ভাদু তার অনেক কথা বলে যেতে লাগল। কিছুটা আমার কানে যাচ্ছে কিছুটা যাচ্ছেনা। তার ট্রেন এসে গেলে সে চলে গেল। আমি কেন তাকে চিনতে পারলামনা সেটা ভেবে আমার খুব খারাপ লাগতে লাগল। সেই সঙ্গে বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে একটি মুখ আমার স্মৃতিপটে উজ্বল হয়ে উঠল।   

 বর্ধমান স্টেশনের প্লাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ একজন মহিলাকে দেখে আমার খুব চেনা বলে মনে হল। কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছিনা। মনের ভেতর একটা অস্বস্তি কাজ করছে। খেয়াল করলাম সেও আমাকে দেখছে। এবার মহিলাটি আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, সে ভাদু। এতদিন পরেও আমাকে দেখে সে ঠিক চিনে ফেলেছে। পরের স্টেশন গাংপুরে তার বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এখন সেখনেই যাচ্ছে সে। ভাদু তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে অনেক কথা বলে যেতে লাগল। কিছুটা আমার কানে যাচ্ছে কিছুটা যাচ্ছেনা। আমার মনে তখন অন্য ভাবনা কাজ করছে। তার ট্রেন এসে গেলে সে চলে গেল। আমি কেন তাকে চিনতে পারলামনা সেটা ভেবে আমার খুব খারাপ লাগতে লাগল। সেই সঙ্গে বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে একটি মুখ আমার স্মৃতিপটে উজ্বল হয়ে উঠল।

    আমি তখন বেশ ছোটো। আমাদের বাড়িতে একজন মহিলা কাজ করত। তাকে সবাই ভাদুর মা বলে জানত। তার আসল নাম কি সে নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিলনা। ভাদুর মা ঠিক আমাদের গাঁয়ের মানুষ নয়। ভাদুকে পেটে নিয়ে এ গাঁয়ে এসেছিল। তারপর পাকাপাকি ভাবে এখানেই থেকে গেছে। এসব অনেক দিন আগের কথা। আমার জানবার কথা নয়।  মায়ের মুখে শুনেছি। সেই ভাদু এখন দুই মেয়ের মা। পাশের গাঁয়ে তার শ্বশুর বাড়ি।

     ভাদুরমা সরল সাধাসিধে মানুষ। কারো সাতে পাঁচে থাকত না। নিজের কাজ আর ভাদুর কথা ছাড়া অন্য ব্যাপারে সে খুব একটা কথা বলতনা। তবে নিজের গাঁয়ের কথা উঠলে তার কথা শেষ হতেই চাইত না। আমাদের দুই বোনের সাথেই ছিল তার যত কথা। আমরা তাকে ডাকতাম, ‘ভাদুরমা চাচি’ বলে।    

  পশ্চিম বাংলার কোনো এক শ্যামল সবুজ পাথরডোবা গাঁ ছিল ভাদুরমা চাচির জন্মভূমি। বহুকাল সেই গাঁয়ে তার যাওয়া হয়নি। আর কোনোদিন যাওয়া হবে কি না তাও জানা নাই। তবু সেই গাঁটিকে নিয়ে তার গর্বের অন্ত ছিলনা। গাঁয়ের কথায় তার মুখ হাসিতে ভরে উঠত। দুচোখে খুশি ঝিকমিক করত।

    পূর্ব-বর্ধমান জেলায়,বিশেষ করে দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে তাল গাছের আধিক্য। ডাব গাছ খুব একটা দেখা যায়না। নারকোল কিনে খেতে হয়। বাড়িতে নারকোল এলে আমার আর নীলুর মধ্যে গোলমাল বেধে যেত। কাড়াকাড়ি করে আমাদের নারকোল খাওয়া দেখে ভাদুরমা চাচি হেসে আকুল হত। এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড যেন আর হয়না। বলত, “ আল্লারে আল্লা! তুমরা নারকোল লিয়ে এমুন করচো! আমাদের পাতরডুবায় নারকোলের ছড়াছড়ি। বাত্তে বাত্তে (বাড়িতে বাড়িতে) নারকোল সুপুরির বাগান। গাচে গাচে কাঁদি কাঁদি নারকোল। তালের সুমায় তুমরা যেমুন তাল কুড়োও। উখানকার ছেলেপুলেরা তেমুন নারকোল কুড়িয়ে বেড়ায়। ছোটোকালে আমিও কত্তো কুড়ুইচি। বস্তাভত্তি নারকোল। কত খাব? পড়ে থেকে থেকে গ্যাঁজ বেরিয়ে যেত!”

    তালের মত গাছতলায় নারকোল পড়ে থাকার কথা শুনে আমরা ভারি অবাক হতাম। সেই সঙ্গে পাথরডোবার ছেলেমেয়েদের প্রতি একটু হিংসেও বুঝি হত।

 

শীত কালে আমার মা পিঠে বানাত।  ভাপাপিঠে,চিতইপিঠে,সিদ্ধপিঠে,দুধপিঠে,পাটিসাপটা। আমার মায়ের হাতের পিঠে ছিল যেমন নরম তেমনই সুস্বাদু। যারাই খেত তারাই সুখ্যাতি করত। সেবার শীতকালে মা সিদ্ধ পিঠে বানিয়েছে। আমরা খেজুড়গুড়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে সেই পিঠে খাচ্ছি। ভাদুরমা চাচিও খাচ্ছে। পিঠে খেতে খেতে সে ফিকফিক করে হেসেই চলেছে।

  “হাসছ কেন ভাদুরমা চাচি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

  “হাসবুনি? পিটে খাচ্ছি গালে মালুম হচ্ছে কই? এমুন লিকপিকে পিটে দেকলে পাতরডুবার মানুষ নিন্দে করবে বাপু! উখেনে সবাই এ্যাত্তো বড় বড় পিটে গড়ে। প্যাটের ভেতর এ্যাত্খানা করে পুর ভরা”। একচোট হেসে নিয়ে ভাদুরমা চাচি বলল। পিঠেগুলোর আকার এবং পুরের পরিমান হাতের ভঙ্গিতে আমাদের বুঝিয়ে দিল। সেই সঙ্গে একথাও বলল, সময় সুযোগ হলে সেই এক বিঘত লম্বা, এক থাবা পুরভরা পিঠে সে আমাদের খাওয়াবে।

   মায়ের পিঠের নিন্দে শুনে আমাদের খারাপ লাগলেও কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। রাগ করলে ভাদুরমা চাচি যদি পাথরডোবার কথা আর না বলে? পাথরডোবার কথা শুনতে আমাদের খুব ভাল লাগত। আমি বা নীলু কেউ যদি কখনও বলতাম, “তুমি সেখানে যাওনা কেন?” ওমনি কিছু না বলে সেখান থেকে উঠে চলে যেত সে।

   ভাদুর মা চাচি প্রায়ই গুন গুন করে একটা গান গাইত, “একশ একটা সুপুরি মুই দাঁতের কষে ভাঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ”। যখনই শুনেছি কেবল এই প্রথম কলিটিই শুনেছি। পুরো গান কখনও শোনা হয়ে ওঠেনি। আসলে, প্রথম কলির শেষে ‘ইঁ’এর টান এত দীর্ঘ ছিল যে, এর পর আর কোন কথা আছে কি না আমাদের শোনার ধৈর্য থাকতনা। 

  আমাদের এলাকায় দশ-বিশখানা গাঁয়ের মধ্যে কোন নদী নাই। আমাদের গাঁয়ে অনেকগুলো ছোটো বড় পুকুর আর দুটো দিঘি আছে। ‘বামনা’ আর ‘আমড়ালের দিঘি’। কিন্তু পাথরডোবা গাঁয়ের পাশ দিয়ে একটি নদী বয়ে গেছে। সে নদীর কোন নাম নাই। ভাদুরমা চাচির কাছে সে কেবলই “লদী”। সেই নদীর পাড়ে ঝুঁকে পড়া গাছে, বালি হাঁসেরা বাসা বানায়। সদ্য ডিম ফুটে বেরোনো বাচ্ছারা হাঁস মায়ের নির্দেশে বাসা থেকে টুপ টাপ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নদীতে কত রকমের মাছ! আর তার কি স্বাদ! নদীর কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে যেত সে। তার টুকরো টুকরো কথায় সেই শান্ত নদী্টি আমার মনে মুখর হয়ে উঠত।  

 

     চৈত্রমাসে গাজন উপলক্ষে আমদের গ্রামে মেলা বসত। সেই মেলা নিয়ে গ্রামের লোকের আনন্দের সীমা থাকতনা। একবার মেলার সময় আমাদের নাচানাচি দেখে ভাদুরমা চাচি মুচকি হেসে বলল,“আমাদের পাতরডুবায় রতের মেলা হয়। পেরকান্ড মেলা! হাতা-খুন্তি, খাট-বিচানা কি না নাই? তাবাদে লাগোরদুলনা,ছারকাছ। কত মানুষ! আল্লারে আল্লা! একমাস ধরে মেলা চলচে তো চলচেই। মানুষের হাতে পয়সা-কড়ি শ্যাষ। তবু মেলার শ্যাষ নাই। তুমরা যেদি সি মেলা এ্যাকবার দেখতে, তাইলে ই মেলা তুমাদের মুনে ধরতই না!”

  গাজনের মেলাকে হেয় করায় নীলু রেগে বলল, “পাথরডোবায় রথের মেলা হয় তাতে আমাদের কি? আমাদের গাজনের মেলাই ভাল”।

 

      ভাদুর মা চাচির কাছে পাথরডোবার কথা শুনতে শুনতে এমন হল, চোখ বুজলেই আমি সেই গ্রামটিকে দেখতে পাই। ক্লাস সেভেনের হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষায় “তোমার গ্রাম” রচনা লিখতে গিয়ে, আমি আমার মানস পটে আঁকা পাথরডোবার কথা গড় গড় করে লিখে দিলাম। বাংলা খাতা বের হলে দেখা গেল আমি সবার থেকে কম নম্বর পেয়েছি। রচনায় সবাই যেখানে কুড়ির মধ্যে বারো,তেরো করে পেয়েছে। আ্মার নম্বর সেখানে তিন। মৌমিতা দিদিমনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, “নিজের গ্রামে যা আছে সে সব বাদ দিয়ে নদী, রথের মেলা বানিয়ে বানিয়ে এসব কি লিখেছিস?” আমি চুপ করে থাকলাম। দুচোখ জলে ঝাপসা। ভাদুরমা চাচির উপর ভারি রাগ হল, নিজের গাঁয়ের কথা অমন করে বলবার কি আছে?

 

      আমরা তখন একটু বড়। একদিন শোনা গেল, পাথরডোবা থেকে ভাদুর মা চাচির ভাই এসেছে। আহা! মানুষটার নিজের লোক বলতে কেউ কখনো আসেনি। আমরা খুব খুশি। পাড়ার পাঁচ জনও খুশি। কিন্তু সে যা বলে বেড়াতে লাগল তা শুনে সবাই তো তাজ্জব! ভাদুরমা চাচি নাকি তার স্বামীকে খুন করে পালিয়ে এসেছে। পুলিশ অনেক খুঁজেও তাকে পায়নি। তারা নিজেরাও অনেক খোঁজা খুঁজি করেছিল। এতদিন পরে অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ ঘটে গেছে। আমাদের গাঁযের একটা মেয়ের বিয়ের বরযাত্রীদের মধ্যে একজন ছিল(অখন্ড)চব্বিশ পরগনা জেলার পাথরডোবার মানুষ। সে ভাদুর মাকে দেখে চিনতে পারে। সে গিয়ে তার ভাইদের খবর দিয়েছে।

   ভাদুর মায়ের মত মানু্‌ষ যে ঝগড়া বিবাদ তো দূরের কথা, কারো সাথে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলেনা! সে মানুষ খুন করেছে? এও কি সম্ভব? কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, ভাদুরমা চাচি এই কথার কোন প্রতিবাদ করছেনা। উল্টে যে মানুষটা তার বিরূদ্ধে খুনের অভিযোগ করছে, তাকে সে রেঁধে বেড়ে খাওয়াচ্ছে।   

      ভাদুরমা চাচি আমাদের বাড়িতে আগের মতই কাজে আসছে। সব কাজ ঠিকঠাক করছে। কেবল একটু চুপচাপ। আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলছেনা। আমরাও ওর থেকে দূরে দূরে থাকছি। খুন করার কথা শুনে বুঝি একটু ভয় ভয়ও করছে।

   দিন কয়েক পর বাড়ির সবাই মিলে আলোচনা করে ভাদু্রমা চাচিকে কাজে আসতে বারণ করে দিল। কাজ চলে যাওয়ার কথা শুনে সে একটুও অবাক হলনা। এ যেন তার জানাই ছিল। অন্যান্য দিনের মত ধীরে সুস্থে নিজের কাজ সেরে একটা কথাও না বলে বাড়ি চলে গেল।

   ভাদুরমা চাচিকে নিয়ে পাড়ায়-ঘরে আলোচনা চলতেই থাকল। একদিন শোনা গেল, ভাদু্রমা চাচির ভাই চলে গেছে। তবে খালি হাতে যায়নি! ভাদুরমা চাচির যা কিছু সম্বল সবটুকু  হাতিয়ে নিয়ে গেছে। একটি পিতলের ঘড়া, দুটি কাঁসার থালা,কয়েকটি ঘটি,বাটি। কিছু জমানো টাকা, হাঁড়িতে কিছুটা চাল ছিল সেকটিও ঢেলে নিয়ে গেছে। ভাদুরমা চাচি এক রকম না খেয়েই আছে।

 আমার মা একদিন ভাদুরমা চাচিকে ডেকে পাঠাল। এই কদিনেই তার চেহারা ভেঙ্গে গেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে।

   “তুমি  চাইলে আবার আমদের বাড়িতে কাজ কর। তবে তার আগে আসল ঘটনাটা কি, সেটা তোমাকে খুলে বলতে হবে”। ভাদুরমা চাচিকে মা এক রকম আদেশের সুরে বলল।

     ভাদুরমা চাচি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তার পর ধীরে ধীরে যা বলল তা এই রকম- নিজের মাকে তার মনে নাই।  কোন ছোট বেলায় মা মারা যেতে তার বাবা আবার বিয়ে করেছিল। সৎমায়ের সংসারে অনাদরে অবহেলায় বড় হয়েছিল সে। খানিক তফাতে ঝিনকুড়ি গাঁয়ে তার বিয়ে হয়েছিল। তার স্বামী রাজ-মিস্ত্রীর কাজ করত। বছর দুই ভালই কেটেছিল। ভাদুরমা চাচি ভেবেছিল এবার বুঝি তার দুখের দিন শেষ হল। কিন্তু ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়’! একদিন ভারা থেকে পড়ে গিয়ে তার স্বামী ভয়ানক ভাবে জখম হল। সরকারি হাসপাতালে কিছুদিন ভর্তি থেকে তার শরীরটা ওপর ওপর সুস্থ হলেও মাথার ভেতরের আঘাতটা সারলনা। মাঝে মাঝে তার ঝোঁক উঠত। তখন ঘরের জিনিস পত্র ভাঙ্গচুর করত। অকারণে ভাদুরমা চাচিকে মারধোর করত। নানাভাবে তাকে কষ্ট দিত। পুকুরে জলে চুবিয়ে ধ’রে থাকত। গাছে বেঁধে রাখত। তার শ্বশুর শাশুড়ি ছেলেকে বাধা দিতনা। দাঁড়িয়ে তামাসা দেখত। পাড়ার লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করত। এই অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেতে মাঝে মাঝে পাথরডোবায় বাপের কাছে পালিয়ে যেত সে। বাপ মারা গেলে সে আশ্রয়টাও ঘুচল। সৎমা, সৎভাইরা তাকে দেখলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। দিন কতক আগে যে এসে ছিল সে তার সৎভাই।

     এত কিছু সহ্য করেও সেখানে পড়েছিল ভাদুরমা চাচি। একদিন হয়তো মানুষটা আবার আগের মত হয়ে যাবে। ভাদু তখন পেটে, ভাত রাঁধছিল সে। হঠাৎ তার স্বামী উনুন থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে তাকে মারতে আসে। নিজেকে বাঁচাতে স্বামীকে সজোরে ধাক্কা দেয় সে। তার  স্বামীর মাথাটা গিয়ে পড়ে বাটনাবাটা শিলের উপর। তার পর কি হয়েছিল তার জানা নাই। সে তখন ছুটতে শুরু করেছে। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা তাকে পালাতে হবে। ধরা পড়লে তার শ্বশুর শাশুড়ি তাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে।

   ভাদুরমা চাচি কতক্ষণ ধরে এলোপাথাড়ি ছুটেছে হিসাব নাই। একসময় একটা স্টেশন দেখতে পেয়ে, ভিড়ে ঠাসা একটা ট্রেনে উঠে পড়ল সে। এক জায়গায় এসে ট্রেনটা থামলে সবাই নেমে পড়লেও ফাঁকা ট্রেনে সে একাই বসে থাকল। একজন এসে ধমক দিয়ে বলল “ নামো। ট্রেন পরিষ্কার করা হবে”।

   সে ভয়ে ভয়ে শুধোলো “ এটা কোন জায়গা?”

   লোকটি বলল, “বর্ধমান। যাবে কোথায়?”

    আর কথা বাড়াল না ভাদুরমা চাচি। তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। ক্ষিদেয় শরীর অবসন্ন। কয়েকটা দিন কেবল জল খেয়ে কেটে গেল। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত হল, এত দূরে তাকে আর কেউ খুঁজে পাবে না। সে খেয়াল করল, সে একা নয়। এখানে বেশ কিছুজন থাকে। দিনের বেলায় বাইরে গিয়ে চেয়েচিন্তে খায়। বাকি সময় প্লাটফর্মে শুয়ে বসে কাটায়। ভাদুরমা চাচি মরে গেলেও ভিক্ষা করতে পারবেনা। সে কাজের চেষ্টা করতে লাগল। একদিন একটা ভাতের হোটেলের মালিকের হাতে পায়ে ধরে বাসন মাজার কাজ পেল। একরাস বাসন মাজার পরিবর্তে দুবেলা খাওয়া। কিন্তু সে আর কদিন? ক্রমশ তার শরীর ভারী হচ্ছে। একদিন দোকানের মালিক বলল, “ তোমাকে দিয়ে আর চলবে না। কাল থেকে অন্য জন কাজ করবে”। ভাদুর মা চাচির শত অনুরোধেও তার মন গললনা। আবার শুরু হল উপো্স।

    সেদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। এই গাঁয়ের বসানা দাইমা ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মে বসেছিল। এক কোনে অবসন্ন ভাবে পড়ে থাকা আসন্নপ্রসবা ভাদুরমা চাচিকে দেখে তার মায়া হল। সে তাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়িতে নি্যে এল। তার কয়েক দিন পরে ভাদু হয়। সেদিন বাসনা দাইমাকে দেখে মনে হয়েছিল তার মরা মাই বুঝি এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। সে যতদিন বেঁচেছিল মায়ের মত আগলে রেখেছিল তাকে। বাসনা দাইমা ভাদুরমা চাচির অতীতটা জানত। ভাদুরমা চাচিই বলেছিল তাকে। কিন্তু কোনদিন কারো কাছে বলেনি সে। ওই মানুষটার সাথে সেদিন দেখা না হলে কি যে হত ভাবতেও ভয় করে ভাদুরমা চাচির।

  ভাদুরমা চাচি সেদিন স্বামীর হাতে আগুনে পুড়ে মরেনি, তবে তার শরীরের কিছুটা জায়গা ঝলসে গিয়েছিল। পেটের কাপড় সরিয়ে মাকে দেখায় সে। সেখানে খনিকটা বর্ণহীন চামড়া কুঁচকে জড়ো হয়ে আছে।

    আমাদের বাড়ি থেকে ভাদুরমা চাচি চলে গেল। তারপর বেশ কয়েক দিন কেটে গেলেও সে যখন আমাদের বাড়ি এলনা, তখন আমরা গিয়ে তাকে ডেকে আনলাম। সে আবার আমাদের বাড়িতে কাজে বহাল হল। তবে সে তখন অন্য মানুষ। তার মুখের হাসিটি হারিয়ে গেছে। পাথর ডোবার কথা আর সে বলতনা। তার সৎ ভাই শুধু তার জীবনের শেষ সম্বলটুকুই চুরি করে নিয়ে যায়নি। নাম না জানা নদীর কোলে, নারকোল,সুপুরির ছায়াঘেরা,‘পাতরডুবা’গাঁ, যাকে বহু কাল আগে ছেড়ে এসেও গোপনে বুকে করে বয়ে বেড়াত সে, সেটিকেও চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল।

 এতদিন পরে আবার নতুন করে ভাদুরমা চাচির জন্য আমার মনটা ভারী হয়ে উঠলো। 

লেখক : ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত  

0 Comments

Post Comment