আকাশ-ছুঁতে চাওয়া বেসি কোলম্যানের ইতিহাস

  • 18 April, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 174 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
‘বাদামী অথবা কৃষ্ণকায়া নারীদের প্রতিনিধি’ হিসেবে আকাশ-ছোঁয়ার প্রচেষ্টাগুলো তো আদতে অনেক আগে থাকতেই শুরু হয়ে যেতে পেরেছে। অথচ এখনও আমরা গায়ের রঙ, অথবা পুরুষ-নারীর ভেদাভেদ উল্লেখ করেই সামাজিক, রাজনৈতিক ফায়দা কুড়িয়ে নেবার সুযোগ খুঁজে বেড়াই। আমার খুব লজ্জা বোধ হয় তখন, যখন কি না আমরা কল্পনা চাওলা অথবা মে জেমিসনের মতোই একেকজন মানুষকে, একেকজন বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী, প্রযুক্তিবিদকে তাঁদের গায়ের রঙ অথবা লিঙ্গের ভিত্তিতেই চিহ্নিত করতে চাই।

চন্দ্রপৃষ্ঠে মহাজাগতিক অভিযান বরাবরই বিজ্ঞানের পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও পরিচালিত হয়েছে। ১৯৬৯ সালের জুলাইতে যখন নীল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন মানবতার ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রাখলেন, সেই উচ্ছ্বাস যে কেবল বিজ্ঞানীদের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছিল এমনটা নয়। রাজনৈতিক ভাবেও সোভিয়েত রাশিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারের জন্য চাঁদে পৌঁছতে পারার সাফল্যকে সেসময়ের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের আবহাওয়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথোপযুক্ত ভাবেই নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রচারে ব্যবহার করেছিল। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়াও তাই প্রথমবারের জন্য ইউরি গ্যাগারিনকে মহাকাশে পাঠিয়েও চন্দ্রবিজয়ের লক্ষ্যে শেষমেশ হার স্বীকার করে নেয়। এমনধরনের একেকটি মহাজাগতিক অভিযান যখনই সংঘটিত হয়, সংশ্লিষ্ট দেশের শাসকবর্গ সেগুলি থেকে পরোক্ষে কোনও কোনও রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার বা ফায়দা তোলারও চেষ্টা করেই যান। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীর যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা, তারই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তরফে কিন্তু আবারও চাঁদে মানুষ পাঠানোর বিষয়ে নতুন ঘোষণা করা হয়েছে। তদুপরি, অনেকগুলি অভিযান বা মিশনের মধ্যে প্রথম যে ‘ক্রিউড মিশন’ বা মহাকাশচারী সহযোগে চাঁদে গবেষণাযান পাঠানোর উদ্যোগ, সেই ‘আর্টেমিস ২’ উড়ানের মহাকাশচারীদের বিষয়ে (যা কি না নভেম্বর ২০২৪এ বাস্তবায়িত হতে চলেছে) আগে থাকতেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল এই প্রথমবারের জন্য চাঁদে অভিযানের ক্ষেত্রে অন্তত একজন মহিলা মহাকাশচারী, ও একজন আফ্রো-আমেরিকান মহাকাশচারীকে অভিযানের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যদিও ‘আর্টেমিস ২’ মিশন চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করবে না, চাঁদকে ঘিরে একবার আবর্তিত হয়ে সে আবারও পৃথিবীতে ফিরে আসবে। পূর্ব-ইঙ্গিত মতোই গত ৩এপ্রিল এই অভিযানের চারজন মহাকাশচারীর নাম ঘোষণা হয়েছে। আফ্রো-আমেরিকান প্রতিনিধি হিসেবে ভিক্টর গ্লোভার ও মহিলা প্রতিনিধি হিসেবে ক্রিস্টিনা কচের নাম এই তালিকায় ঘোষিত হয়েছে। এদের কথা পড়তে পড়তেই মে জেমিসনকে মনে পড়ছিল, মনে পড়ছিল কল্পনা চাওলা, সুনীতা উইলিয়মসের ইতিহাস। ‘বাদামী অথবা কৃষ্ণকায়া নারীদের প্রতিনিধি’ হিসেবে আকাশ-ছোঁয়ার প্রচেষ্টাগুলো তো আদতে অনেক আগে থাকতেই শুরু হয়ে যেতে পেরেছে। অথচ এখনও আমরা গায়ের রঙ, অথবা পুরুষ-নারীর ভেদাভেদ উল্লেখ করেই সামাজিক, রাজনৈতিক ফায়দা কুড়িয়ে নেবার সুযোগ খুঁজে বেড়াই। আমার খুব লজ্জা বোধ হয় তখন, যখন কি না আমরা কল্পনা চাওলা অথবা মে জেমিসনের মতোই একেকজন মানুষকে, একেকজন বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী, প্রযুক্তিবিদকে তাঁদের গায়ের রঙ অথবা লিঙ্গের ভিত্তিতেই চিহ্নিত করতে চাই। হয়তো এই চিহ্নিতকরণ বন্ধের জন্য অনেক সময় লাগবে, হয়তো বা এখনও অনেকটাই পিছনে পড়ে আছে আমাদের এই সভ্যতা, বিজ্ঞান! কিন্তু এই লজ্জা বোধটুকুকে বারংবারে নিবন্ধন না করতে পারলে পরে এগোনোর পথে আমাদের যাত্রাটাই যে আর শুরু হতে পারবে না।

 

আমরা এ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টের কথা শুনেছি। শুনেছি তাঁর অতলান্তিক পেরোনোর ইতিহাস। শুনেছি গোটা পৃথিবীকে সম্পূর্ণ একাকী একজন মহিলা পাইলট হিসেবে পরিক্রম করে আসতে গিয়ে পরে মহাসাগরের অতলে তাঁর হারিয়ে যাওয়া উপাখ্যান। সেই এ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টেরই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা বৈমানিক হিসেবে উঠে এসেছিলেন বেসি কোলম্যান। কৃষ্ণাঙ্গ বলেই কি তাঁর প্রচারের আলোয় উঠে আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে? জন্ম ২৬শে জানুয়ারি ১৮৯২, মৃত্যু ৩০শে এপ্রিল ১৯২৬। কেবল প্রথম আফ্রো-আমেরিকান পাইলটই নন, বেসি কোলম্যান ছিলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিনিধি (নারী পুরুষ নির্বিশেষে) যিনি কি না আন্তর্জাতিক বৈমানিক হিসেবে লাইসেন্স পেয়েছিলেন। টেক্সাসের এক ভাগচাষী পরিবারে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সে সময়ে তাঁকে পড়তে হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের জন্য নির্দিষ্ট আলাদা বিদ্যালয়ে। আমেরিকায় তখন মহিলা অথবা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বৈমানিকের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। পড়াশোনার সময়েও ফসল-তোলার মরসুম শুরু হলে বেসিকে স্কুল ছেড়ে ফসল-তোলার কাজে পরিবারকে সাহায্য করতে হতো। ১৯১৫ সালে বেসি কোলম্যান শিকাগো শহরের একটি সেলুনে পরিচারিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিবরণ কাগজে দেখতে দেখতে তাঁর মনেও বৈমানিক হওয়ার সাধ জেগে ওঠে। ধীরে ধীরে চাকরির বেতন জমিয়ে তিনি ফ্রান্সে পাড়ি দেবার প্রস্তুতি নেন। এই সময় চিকাগো ডিফেণ্ডার কাগজের এক সাংবাদিক বেসির খবর কাগজে প্রচার করে তাঁকে একজন পৃষ্ঠপোষক জোগাড় করে দিতেও সহায়তা করেন। ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে বেসি কোলম্যান ফ্রান্স যাত্রা করেন। ১৫ই জুন, ১৯২১ তারিখে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলে পরে, বেসি কোলম্যান প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক বৈমানিক সংস্থার লাইসেন্স লাভ করেন। আরও কিছুদিন ফ্রান্সে কাটিয়ে, নিজের প্রতিভা ও কুশলতাকে নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে আরও খানিক ধারালো করে নেবার পর সেপ্টেম্বর ১৯২১এ বিজয়ী হিসেবে, সংবাদমাধ্যমের তুমুল উচ্ছাসকে সঙ্গী করে বেসি কোলম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন করেন। যে কারণে তাঁকে শিকাগো শহরে অত কষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়ে, তিল তিল করে অর্থ সঞ্চয় করে ফ্রান্সে পাড়ি দিতে হয়েছিল, সেই লক্ষ্য অর্জন করে কোলম্যানের এই ফিরে আসা। আমরা কেবল উচ্ছ্বাসটাকেই মনে রাখি, যা সাময়িক। পিছনকার দীর্ঘ তিতিক্ষা ও সংগ্রামকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিস্মৃত হই।

 

“আকাশ কাউকে লিঙ্গ, বর্ণ, জাতির ভিত্তিতে বিচার করে না। সেখানে একমাত্র আপন প্রতিভাই কোনও একজনকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে,” বলেছিলেন বেসি। নিজেকে ঝুঁকির শেষ দাগটুকু অবধি টেনে নিয়ে গিয়ে তিনি মার্কিনভূমের বিভিন্ন এয়ার শো’তে অংশ নিতেন। বিমান নিয়ে দুর্ধর্ষ সব কলাকৌশল দেখিয়ে চেষ্টা করতেন তাঁরই মতো আরও অজস্র নারী, সমাজের কৃষ্ণাঙ্গ যুবক-যুবতীদেরকে বিমানচালনায় উৎসাহিত করতে। নিজের প্রতিভাকে আরও শাণিত করতে ১৯২২ সালে বেসি আবারও ইউরোপে ফিরে যান। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি প্রচার ও আদর পেলেও, তাঁকে শেখানোর মতো কোনও বৈমানিককে তিনি পাচ্ছিলেন না। দীর্ঘসময় তিনি আবারও ইউরোপে কাটান ও একাধিক বিশিষ্ট বৈমানিকের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯২৩এ তিনি আমেরিকায় ফিরে আসেন এবং আবারও ঝুঁকিপূর্ণ সমস্ত এয়ার-শো’গুলিতে নিজের প্রতিভা দেখাতে থাকেন। ফেব্রুয়ারি লস এ্যাঞ্জেলসে এমনই একটি শো-চলাকালীন তিনি দুর্ঘটনার কবলে পড়েন, তাঁর পা এবং পাঁজরের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁর স্বপ্ন ছিল স্বদেশ আমেরিকায় তিনি উৎসাহী কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা-পুরুষ বৈমানিকদের জন্য একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলবেন। জীবদ্দশায় সেই স্বপ্ন সফল হয়নি তাঁর। তাঁরই সতীর্থ, অনুরাগী, বৈমানিক ও লেখক, লেফটেনান্ট উইলিয়ম পাওয়েল ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বেসি’র সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, “কেবল যে জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইতে বেসি’র সংগ্রাম পথ দেখিয়েছে বা সাফল্য এনে দিয়েছে তাই নয়, বৈমানিক হিসেবেও বেসি কোলম্যান আমাদেরকে শিখিয়েছেন বিমানচালক হিসেবে কত অসম্ভবকেই না সম্ভব করা যায়। আমরা তাঁর থেকেই আকাশ ছুঁতে শিখেছি।” কৃষ্ণাঙ্গ মহাকাশচারী মে জেমিসন, যার কথা গোড়াতেই বলে এসেছি, তিনিও বলেছেন, “বেসি কোলম্যানের সঙ্গে আমাদের কারোরই তুলনা চলে না। তিনি ছিলেন মানবতার প্রতীক, শক্তি, আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান, সাহস, সততা ও সৌন্দর্যের প্রতীক।”

 

৩০শে এপ্রিল ১৯২৬, নতুন কেনা একটি দুই-আসনবিশিষ্ট কার্টিস জে এন ৪ বিমানে চেপে বসেন বেসি কোলম্যান ও তাঁর সহ-বৈমানিক ও প্রচারসচিব উইলিয়ম উইলস। এর আগে বেশ কয়েকবার সেই নতুন কেনা বিমানটিকেই যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে আপৎকালীন অবতরণ করাতে হয়েছিল। এই বিষয়ে বেসি’র পরিজনেরা তাঁকে বিমানটি ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। কিন্তু বেসি কারোর বারণ মানেননি। পরদিন বেসি’র কোনও একটি এয়ার-শো’তে প্যারাশুটে ঝাঁপ দিয়ে দেখানোর কথা ছিল। তাই এবারের যাত্রাতে চালকের আসনে ছিলেন উইলস, ঝাঁপ দেওয়ার জন্য জমির অংশটুকুকে আগে থাকতে জরিপ করে নেওয়ার জন্য বেসি বসেছিলেন পিছনের আসনে। ওড়বার দশ মিনিটের মধ্যেই বিমানটি গোঁত্তা খেয়ে নীচে নেমে আসে। বিমান থেকে ছিটকে যান কোলম্যান। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু হয়। উইলস বিমানটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও সেটি মাটিতে আছড়ে পড়ে ও তাতে আগুন ধরে যায়। পড়ার অভিঘাতেই উইলসেরও মৃত্যু ঘটে।

 

আকাশ ছুঁতে চাইলে বোধহয় আকাশের বুকেই এভাবে নিয়তির লিখন লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে ... খোদিত হয়ে থাকে বোধহয়। এ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট, বেসি কোলম্যান অথবা কল্পনা চাওলাদের ইতিহাস। হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। এঁরা নারী নন, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ নন, এঁরা আদতে সমগ্র মানব সভ্যতারই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শন, উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি-স্বরূপ। এঁরাই কেবল যুগে যুগে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব উদযাপিত হয় - তাঁর জ্ঞান, পরিশ্রম ও তিতিক্ষার মাধ্যমেই!

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment