- 07 March, 2021
- 0 Comment(s)
- 754 view(s)
- লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
৮ই মার্চ যেমন একটি আন্তর্জাতিক নারীঅধিকার আন্দোলনের মত বহু প্রাচীন একটি সাম্যবাদী আন্দোলনকে স্মরণ করায় ঠিক তেমনি ভারতেরও নিজস্ব নানারকমের ‘নারীদিবস’ আছে। ২৪ জানুয়ারি ২০০৮ সালে প্রথমবার ভারত সরকারের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর উদযাপিত করেছিল ‘জাতীয় শিশুকন্যা দিবস’। তারপর ২২ জানুয়ারি ২০১৫ সালে ভারতের বুকে ‘বেটি বাঁচাও’ নামের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ততধিক সস্তা স্লোগানটির জন্ম হল। এটাও নাকি যুগান্তকারী এক ‘দেশি’ নারী-আন্দোলন। এদের নাকি লক্ষ্যই ছিল ভারতে লিঙ্গবৈষম্যকে দূর করে কন্যাজন্মকে সুরক্ষিত ও সুনিশ্চিত করা।
ফলাফল— ২০২০ সালে ভারতের লিঙ্গানুপাত হয়েছে ১০০০ (পুং) : ৯২৪ (স্ত্রী), যেখানে ২০১১ সালের লিঙ্গানুপাত ছিল ১০০০ (পুং) : ৯৪৩ (স্ত্রী)। সুতরাং ভারতের বেটিরা ঠিক কতগুণ সুরক্ষিতভাবে বেঁচে উঠেছে তা সহজবোধ্য!
বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে জীব মাত্রেই বেশ কিছু কঠিন প্রতিবন্ধকতা আসে, আর তা নিরসনের জন্যই মানুষের ক্ষেত্রে রয়েছে বিচারালয়। দেখা যাক গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ভারতের ‘বেটি’দের জন্য এই বিচারালয়গুলি কী উপহার সাজিয়ে রেখেছে।
নারী দিবসের প্রাক্কালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট দুটি চরম ‘নারীবিদ্বেষী’ রায়ের মাধ্যমে প্রমাণ করল নারীর জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের সবচেয়ে উঁচু বিচারশালাও সুরক্ষা প্রদানে অপারগ।
১লা মার্চ সকালের খবরে সারা দেশের তাবৎ পুরুষকে এক অদ্ভুত ছাড়পত্র দিলেন প্রধান বিচারপতি এস এ বোবড়ে। মহারাষ্ট্রের সরকারি (বিদ্যুৎ দপ্তর) কর্মী মোহিত সুভাষ চৌহানের বিরুদ্ধে পকসো মামলা চলছিল একটি স্কুল পড়ুয়া নাবালিকা ধর্ষণের ঘটনায়। গ্রেফতারি এড়াতে বড়লোক অভিযুক্ত সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় যেখানে অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রধান বিচারপতি তাকে ধর্ষিতাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে কার্যত ‘মিউচুয়াল সেটলমেন্ট’ করে নিতে পরামর্শ দেন। এর ফলে গোটা দেশের ধর্ষকামী পুরুষের প্রতি তিনি সরাসরি একটি বার্তা দিলেন যাতে বিকৃতকাম চরিতার্থের পরে মেয়েটিকে নিয়ে সাতপাক ঘুরে ফেললেই যাবতীয় অপরাধ থেকে মুক্তি মিলবে ।
অথচ পকসো আইনে পরিষ্কার বলা আছে, এটির শুনানিসহ যাবতীয় বিচার প্রক্রিয়া ‘বিশেষ আদালতেই’ সম্পন্ন হবে এবং এটি সম্পূর্ণভাবে জামিনঅযোগ্য কেস হিসেবে প্রথম থেকেই গণ্য হবে। স্পেশাল কোর্টেই যেখানে ধর্ষিতকে এতটাই যত্ন নিয়ে, সংবেদনশীলতার সাথে ধৈর্য্য ও সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনোভাবেই সে অভিযুক্তের মুখোমুখি না হয় কিম্বা সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি তাকে আতঙ্কিত না করতে পারে। সেখানে একজন প্রধান বিচারপতি অবলীলায় তাঁর মত পুরুষদের তীব্র নারীবিদ্বেষী জিঘাংসাকে তোল্লাই দিয়ে বুক ফুলিয়ে বলেন ‘‘মেয়েটিকে ফুঁসলেছেন আপনি। ধর্ষণ করেছেন। বিয়ে করতে চাইলে, আমরা সাহায্য করতে পারি। তা না হলে চাকরি তো যাবেই। জেলেও যেতে হবে।’’.... will you marry her? ‘আমরা জোর করছি না। ভেবেচিন্তে জানান।”
ধর্ষিতাকে বিয়ে করার পরামর্শ দিয়ে সমস্ত অভিযুক্তকে এবং ভবিষ্যতের ধর্ষকদের ‘আইনের ফাঁক’ গলে পালাবার একটা নয়া রাস্তা দেখিয়ে আদপে গোটা আইনটিকেই সর্বসমক্ষে ধর্ষণ করলেন!
যে বয়সের হোক না কেন, মেয়েদের উপর ঘটা যেকোনো অপরাধের দাওয়াই যে একমেবাদ্বিতীয়ম বিয়ে সেটা আরও একবার প্রধান বিচারপতি প্রমাণ করলেন অন্য একটি অভিনব রায়ে। স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছিলেন এক মহিলা। প্রধান বিচারপতি বোবড়ে বলে দেন, “স্বামী-স্ত্রী যখন এক ছাদের তলায় বসবাস করেন, তখন স্বামী যতই নৃশংস হোন না কেন, তাঁদের মধ্যেকার শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা উচিত নয়।”
অথচ এই সুপ্রিম কোর্টই ২০১৮ সালে একটি ঐতিহাসিক রায়ে বলেছিল যৌনকর্মীদেরও ক্ষেত্রবিশেষে যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘না’ বলার অধিকার আছে, সেটি অমান্য করলে অভিযুক্ত ব্যক্তির ১০বছর অবধি জেলও হতে পারে। অর্থাৎ যৌনকর্মীরাও ক্ষেত্রবিশেষে ‘ধর্ষিতা’ বলে গণ্য হতে পারেন এবং আদালত তাদের ন্যায় দিতে বাধ্য। অথচ নৃশংস স্বামীর বেলায় সেই একই উচ্চআদালত বলছে, যেহেতু নিগৃহীতা মহিলাটি অত্যাচারীরই বিবাহিত স্ত্রী, সুতরাং সে ধর্ষিতা হতেই পারে না! এহেন দ্বিচারী রায় দিয়ে পুরো আইন ব্যবস্থা নিয়েই ছেলেখেলা করছে আমাদের মহামান্য উচ্চন্যায়ালয়!
বারবার প্রতিটি ক্ষেত্রে মহিলাদেরই আইনের দ্বারস্থ হয়ে আর্জি জানাতে হচ্ছে যে, তার শরীরের মাংস, গ্রন্থী ও কোমল পেশীর ভেতরে একটি স্বতন্ত্র ‘মানুষ’ সত্তা বাস করে— যেটির স্বীকৃতি এই সমাজ ব্যবস্থা দিচ্ছে না। আর প্রতিবারই তাকে সেই বিচারালয় ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে এই বলে যে, ‘মেয়ে’ প্রিফিক্স যুক্ত থাকলে শব্দের বাকি অংশের ওসব মানুষ-ফানুস লেজুড় ধর্তব্যই নয়!
নইলে কি চলতি বছরেই বম্বে হাইকোর্ট পরপর দুটি বিকৃত রায় দিতে পারে—
১। নাবালিকার ত্বক সরাসরি স্পর্শ না করলে তা যৌন নির্যাতন নয়।
এবং
২। পোশাক না খুলে করা ‘হেনস্থা’ পকসো আইনে যৌন নির্যাতন বলে গণ্য হবে না।
যেখানে পকসো আইনের দুই নাম্বার চ্যাপ্টারে ১১ নং ধারায় পরিষ্কার বলাই আছে, যেকোনো রকম যৌন ইঙ্গিত, অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ, যৌনাঙ্গ প্রদর্শন, পোষাক খুলতে বাধ্য করা,পর্ণগ্রাফি ছবি দেখানো এমনকি দীর্ঘদিন ধরে স্রেফ ‘ফলো করা’ বা ‘স্টক করা’ও অভিযুক্তর জেল-জরিমানার পক্ষে যথেষ্ট ।
আর সুপ্রিম কোর্ট এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, নারী ও শিশু অধিকার বিনষ্টকারী রায়গুলোর উপর কেবল একটি স্থগিতাদেশ জারি করেই দায় সারে, সরাসরি খারিজ করার সাহস দেখাতে পারে না !
প্রশ্ন জাগে এই যে নারীসুরক্ষার আধার বলে যে আইনের কেতাবগুলি লেখা হয়, তাবৎ আদালতে থুতু ছিটিয়ে ঝড় তোলা হয়, সেগুলি কি নিছকই ‘বেটি বাঁচাও’ প্রপাগান্ডার কাউন্টার পার্ট, মানে পাতি বাংলায় আইওয়াশ! আসলে বাঁচাবার প্রশ্ন তো তখনই ভ্যালিড হয়, যখন মারণাস্ত্রে শান দেওয়া ঠিকেদার স্বস্থানে নিয়োজিত থাকে— আমাদের দেশের আদালতগুলোর একের পর এক রায় থেকে তো একথা জলের মত স্পষ্ট!
কোনো সভ্যতা কেবলমাত্র কিছু মানুষের শিক্ষা–রুচি কিম্বা সচেতনতার উপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারে না। এগুলি মহত গুণ নিঃসন্দেহে। কিন্তু কুশিক্ষায় নিমজ্জিত ক্ষয়গ্রস্থ পঙ্গু সমাজে এসব মুষ্টিমেয়র কুক্ষিগত গুনাবলী স্রেফ ক্রাচ হিসেবেই কাজ করে, উন্নতির রাস্তায় সেই সমাজের মসৃণ গতির জন্য একটি সুষ্ঠু প্রশাসন চাই। আইনব্যবস্থা যেকোনো দেশের মানবাধিকার রক্ষার সবচেয়ে বড় আধার। সেটি যদি অকেজো কিম্বা তুঘলকি মেজাজে চলে তবে নারীদিবস, শিশুকন্যা দিবস, কন্যাশ্রী দিবস কিম্বা ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’— স্লোগান উদযাপন নিছক প্রহসন (কিছুক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি অপমানজনক খিল্লী) ছাড়া আর কিছুই না। ওসব দিয়ে রাজনৈতিক সভার মাঠ কিম্বা সোশ্যাল মিডিয়ার পেজ ভরানো যায় ঠিকই, তবে তাতে সোসাইটিতে কোনো বদল আসে না ।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৭ মার্চ ২০২১
0 Comments
Post Comment