- 27 November, 2020
- 0 Comment(s)
- 826 view(s)
- লিখেছেন : অর্ণব ঘোষ
ছোটো ছোটো আত্মপরিচয়ের সমবায় নির্মাণ করে সম্পূর্ণ ‘আমি’কে। বহুমাত্রিক পরিচিতির মধ্যে থেকে যখন একটি মাত্রাকেই কেউ আঁকড়ে ধরে থাকে তখন জন্ম নেয় পরিচয়ের মৌলবাদী প্রবণতা। মতি নন্দীর ‘বিজলিবালার মুক্তি’ উপন্যাসটি কথা বলে সেই প্রবণতার বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক সময়ে চারপাশের মিথ্যা চিৎকারে, গলাবাজির ভ্রান্ত যুক্তিতে, অনুচিতকে সমর্থনের আবদারে, কিংবা নিখাদ অন্যায়ের পৌনঃপুনিকতায় যখন অসহায় বোধ করি, তখন প্রয়োজন হয় ভিতর থেকে সাহস জোগানো কোনও কণ্ঠস্বরের। সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই ‘বিজলিবালার মুক্তি’ বা এই ধরনের উপন্যাস বারবার পাঠের দরকার হয়।
সাতটি পরিচ্ছেদে সম্পূর্ণ ‘বিজলিবালার মুক্তি’ (আনন্দ পাবলিশার্স; ডিসেম্বর, ২০০২) উপন্যাসটি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে উত্তর কলকাতার জয় দত্ত স্ট্রিটের বাসিন্দা, বয়স্কা বিধবা বিজলিবালার গল্প। তাঁর পরিচয়ের একটি মাত্রা— তিনি পরোপকারী, সকলের শুভাকাঙ্ক্ষী। কাজের লোক পদ্ম, ভাড়াটে জ্যোতির্ময়-হাসি আর তাদের সন্তান ছোট্ট ভুটু, পাশের বাড়ির পঙ্গু বউ রাধা, অসহায় তপতী, নেতাজী তরুণদল ক্লাবের ছেলেরা, বুড়ো রিকশাওয়ালা, এমনকি উপোসী হুলো বেড়াল পর্যন্ত তাঁর স্নেহের বিষয়।
পাশাপাশি, বিজলিবালার ‘identity’-র অপর অংশ উদার আধুনিক মানসিকতা। অভিভাবকের দায়িত্ব, মেয়েদের শিক্ষা বা চাকরি, বই পড়া ইত্যাদি সংক্রান্ত আলোচনার সূত্রে; কিংবা দীর্ঘদিন পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকা রাধার ‘আত্মহত্যা’কে স্বেচ্ছামৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করে তাকে সমর্থন করার দৃষ্টিভঙ্গিতে তঁার পরিচিতির আধুনিক মানসিকতার মাত্রাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ধর্মের তত্ত্বাবধানে, সংস্কারের বিধি নিয়ম দ্বারা অনুশাসিত সমাজের মানদণ্ডে সুকুমার, মানবিক পরিচিতির তুলনায় ‘নিষ্ঠাবতী হিন্দু ব্রাহ্মণ বিধবা’ পরিচিতি অনেক বেশি গৌরব বলে বিবেচিত হয়। তাই, বিজলিবালা সেই ‘আদর্শ’ নারী পরিচয় নির্মাণে/অর্জনে, পালনে বা সংরক্ষণে চূড়ান্ত উদ্যমী হয়ে ওঠেন। তাঁর পূজা; পাঁচালি পাঠ; ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার, ‘স্বর্গ লাভের আশায়’ রথের দড়ি টানা, নিজের জন্য শ্রাদ্ধ কিম্বা পিণ্ডদানের জন্য আকুতি— সেই ধর্মকেন্দ্রিক ‘singular identity’-কে প্রকট করে তুলেছিল। হাসি চক্রবর্তীর ‘মুসলমানের মেয়ে’ হাসিনা পরিচয় তাঁকে আদর্শচ্যুত/ধর্মচ্যুত/ ‘পতিত’ হওয়ার ভয়ে উদ্িবগ্ন, হিংস্র করে তুলেছিল।
কিন্তু, শেষপর্যন্ত বিজলিবালার বিশ্বাসের মুক্তি ঘটেছে। ধর্মনির্দিষ্ট পরিচিতির সংকীর্ণ সীমা অতিক্রম করে তিনি বলতে পেরেছেন— “... একটা মেয়ে যখন একটা ছেলেকে ভালবাসে তখন সেটা অন্য ব্যাপার হয়ে যায় আলমবাবু, ধর্মকে তখন পিছু হটতে হয়। ওদের পরিচয় তখন হয় শুধুই মানুষ। আর সেটা স্বীকার করাকে বলে মনুষ্যত্ব”।
কোনোরকম তত্ত্বকথা কিংবা বিদ্যাচর্চা ব্যতিরেকে, শুধুমাত্র মানুষের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসার তাগিদে আচারনিষ্ঠ বিজলিবালা অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছেন। তাঁর শৈশবের উদার সামাজিক পরিমণ্ডলে, কিংবা শরৎচন্দ্র-পড়া-অন্তঃকরণ হয়তো তাঁকে সমাজ/সংস্কারের বাইরে/বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু পদ্মর মনে শেষপর্যন্ত জেগে ওঠা সম্প্রদায়বোধশূন্যতা কেবলমাত্র নিবিড় মানবিক অনুভূতির আকর্ষণে। পদ্ম বা তাঁর মতো ‘খেটেখাওয়া’ সম-আর্থিকযোগ্যতাসম্পন্ন মানুষদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি কিংবা ধর্ম অনুশাসন মেনে চলার বিলাসিতা/সঙ্গতি নেই। সংস্কারের বদলে প্রবৃত্তি তাঁদের কাছে বেশি অনুসরণীয়। তাই, অবলম্বনহীন-সন্তানহীন পদ্মর বাৎসল্য ঘিরে রাখে হাসিনার ছেলে ভুটুকে। ধর্ম নয়, মানুষই সেখানে প্রধান হয়ে ওঠে।
‘বিজলিবালার মুক্তি’ উপন্যাসের ছোটো পরিসরে ঘটনার মতোই চরিত্রের সংখ্যাও প্রচুর। বিচিত্র তাঁদের বিশ্বাস, সংকীর্ণ তাঁদের পরিচিতি। কিন্তু, উপন্যাসের শেষ পর্বে বিজলিবালার সংস্কারমুক্তি অন্য সকল চরিত্রের মধ্যে মুক্তচিন্তা সঞ্চার করেছে। এই বোধ জাগিয়েছে আমাদের পরিচয় আমাদের ধর্মে নয়, আমাদের মনুষ্যত্বে।
0 Comments
Post Comment