- 02 November, 2022
- 0 Comment(s)
- 1235 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
কিছুদিন আগে তালিবানদের কালো বোরখার ফতোয়ার বিরুদ্ধে #DoNotTouchMyClothes এবং #AfghanistanCulture অনলাইন প্রতিবাদ আমাদের চোখে পড়েছে। তালিবানি, শরিয়তি শাসন কায়েমের পক্ষের আফগানিস্তানের মহিলারা কালো বোরখার সমর্থনে রাস্তায় নামেন। আর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই আফগানিস্তানের ঐতিহ্যময় পোশাক পরে বহু আফগান নারী সামাজিক মাধ্যমে ছবি পোস্ট করেন। বিভিন্ন দেশে বাস করা এই আফগান মহিলারা দেশের বৈচিত্র্যময় আফগানি পোশাককে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন। আন্দোলনের সূচনা করেন আমেরিকায় বাস করা অধ্যাপক বাহার জালালি। তিনি আফগানিস্তান সংস্কৃতির প্রকৃত চেহারা বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য অন্য মহিলাদেরও অনলাইন আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান। ‘আমার পোশাক ছোঁবে না’ আন্দোলনে অংশ নেওয়া আফগান মহিলাদের রঙ বেরং-এর কারুকার্য করা ঐতিহ্যবাহী পোশাক আর এক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দিগন্ত খুলেছে। প্রতিটি দেশের, প্রতিটি সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারক তাঁদের পোশাক। প্রথমত, বোরখা বা কালো বোরখা আবরণটির সঙ্গে সব দেশের মুসলিমদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত, পোশাকের সঙ্গে ভৌগোলিক পরিমণ্ডল, আবহাওয়া ও সামাজিক অবস্থানের সম্পর্ক রয়েছে।
ইসলামের জন্মভূমি আরবের আবহাওয়ায় নারী-পুরুষ সকলকেই আপাদমস্তক ঢাকা পোশাক পরতে হয়েছে বাতাসে উড়ে আসা উত্তপ্ত বালুকণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। এছাড়া কোরানেও বোরখাজাতীয় কোনও পোশাকের কথা নেই। বলা হয়েছে, ‘হে আদমসন্তান। তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদেরকে পরিচ্ছদ দিয়েছি, আর সাবধানতার পরিচ্ছদই সবচেয়ে ভালো।’ (৭ সুরা আরাফ : ২৬-২৭) সাবধানতা শব্দটি নির্ভর করে দেশ-কাল অনুসারে। সামাজিক অবস্থান-কেন্দ্রিক। আবহাওয়া থেকে বাঁচার সাবধানতাও পোশাকের সঙ্গে জড়িত। পরে পারস্যবাসীদের হেরেম এবং পর্দাপ্রথা নিতান্ত সামাজিক প্রয়োজনে আরবসমাজে প্রবর্তিত হয়। ‘আরবদের নীরো, সুলতান মুতাওয়াক্কিলের আমল পর্যন্ত (৮৪৭ খ্রি) আরব নারীদের চলাফেরায় যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল।’(শামসুল আলম, ‘ইসলামী চিন্তাধারা’, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, বাংলাদেশ, ১৯৮৪, পৃ ৩২৬) সামাজিক জীবনের নৈতিক অধঃপতন, ক্ষমতাবান পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টির জন্য শেকলে বাঁধা পড়ল মহিলারা। পুরুষ হচ্ছে অপরাধী। অভিযোগ তো তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু শাস্তি ধার্য হল মেয়েদের প্রতি। যদিও এটাকে শাস্তি না বলে নামকরণ হয়েছে ‘নিরাপত্তা’, ‘আব্রু’। ধর্মের সঙ্গে জুড়ে, শরিয়তসম্মত পোশাক নামে দেশে দেশে ঘটেছে তার বিস্তার। ধর্মীয় রাজনীতি যত মাথাচাড়া দিচ্ছে, ধর্মচিহ্ন প্রকাশের প্রবণতাও তত বাড়ছে। পশ্চিমবাংলার গ্রাম-গঞ্জের বাঙালি মুসলিম মহিলারা বোরখা পরতেন না। শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। একুশ শতকের শুরুর দিক থেকে চোখে পড়ল শাড়ি বা সালোয়ার কামিজের ওপর ওড়না দিয়ে শরীর ঢেকে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি। গৃহবধু থেকে ছাত্রী অনেকের মধ্যেই হঠাৎ এই বাড়তি ঢাকা দেওয়ার রেওয়াজ গড়ে উঠল। ওড়নার পরেই বোরখা এল ব্যাপকহারে। এত বোরখার চল ছিল কলকাতার অবাঙালি মুসলিম বা তাদের পাশাপাশি বাস করে প্রভাবিত হওয়া বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে। বোরখা এখন গ্রামে বাঙালি মুসলিমদের ঘরেও জায়গা করে নিল। বলা ভাল জায়গা করে দিল ধর্মীয় রাজনীতি।
স্বার্থবুদ্ধি প্ররোচিত নেতাদের প্রচার-প্রচারণার ফলে অসত্য জিনিসও সত্য বলে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে। যে পোশাক আমার বাঙলার নয়, যে পোশাক আমার দেশের নয়, যে পোশাক আফগানিস্তানের মহিলাদেরও নয়, তাকে ধর্মীয় নিগড়ে জুড়ে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিচ্ছেন লাভ ও লোভ দ্বারা পরিচালিত নেতারা। আবার এটাকে প্রচারের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছেন মহিলাদের। আফগানিস্তানের কালো বোরখা পরিহিত একদল মহিলা তালিবানের সমর্থনে বিবৃতি দেন, ‘যেসব আফগান নারী মুখে প্রসাধনী মাখে এবং আধুনিক পোশাক পরে তারা মুসলিম আফগান নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না।... আমরা এমন নারী অধিকার চাই না যা বিদেশ থেকে আমদানি করা এবং ইসলামি শরিয়ার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ।’ (তথ্যসূত্র বিবিসি বাংলা, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১)। ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতিকদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে এই মেয়েরা। মেয়েদের মৌলিক অধিকার হরণ, শ্রমশক্তি শোষণের নীতি নির্ধারক ধর্মীয় রাজনীতিকগণ। শরিয়ত শব্দটা জুড়ে দিয়ে শোষিতকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চমৎকার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। পরিচিত কিছু মেয়ের মুখে শুনেছি, বোরখা পরলে সামাজিক সম্মান জোটে। শরীরের প্রতি ছেলেদের কূদৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বোরখা যে কতটা অসম্মানের ও অস্বাস্থ্যের (আমাদের মতো গ্রীষ্মকালীন ঘর্মাক্ত আবহাওয়ায়) সে ব্যাপারে সজাগ নন তাঁরা। অসম্মানটা বিশেষ করে পুরুষদের। বোরখা মানে পুরুষ শুধুই কামুক। বোরখা মানে পুরুষ বড় উত্তেজক। বোরখা মানে পুরুষ যে ধর্ষক। বোরখা মানেই পুরুষ থেকে তফাৎ রও। প্রকৃত অর্থে বোরখার প্রচলনের সঙ্গে পুরুষের নিম্নে অবস্থানের যোগসূত্র তৈরি করেছে। কিছু ক্ষমতাবান পুরুষ, কিছু আমীর-ওমারহদের উৎশৃঙ্খল আধিপত্যবাদের কবল থেকে কোনও এক সময়, কোনও এক দেশে মহিলাদের কঠোর আবরণে আড়াল করার প্রয়োজনকে আজও মুসলিম মেয়েদের শরিয়তসম্মত পোশাক বলে সব পুরুষকে অসম্মান করা, নীতি বর্হিভূত। ধর্ম বহির্ভূত। রাজনৈতিক চক্রান্ত।
সমাজে বোরখা ও পর্দার কড়াকড়ি লক্ষ্য করে ‘অবরোধবাসিনী’তে (সাতচল্লিশ) রোকেয়া আক্ষেপ করে লিখেছেন-‘কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,/কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে।’ কিন্তু আক্ষেপ করলেই সমস্যার সমাধান হয় না তা জানতেন বাঙলার প্রথম নারীবাদী লেখক রোকেয়া। ‘অবরোধবাসিনী’র লেখাতে পর্দা আর বোরখার ক্ষতিকারক দিকগুলি যেমন স্পষ্ট করেছেন, অপরদিকে কল্পকাহিনী ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এ পর্দা ও বোরখা ভেঙে নারীর ক্ষমতায়নের গল্প বলেছেন। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি নারীস্থান। এখানে নারী-পুরুষের কাজের অবস্থান বদল হয়েছে। ভগিনী সারার মুখ দিয়ে রোকেয়া নারী-পুরুষের শ্রম-বিভাজনের কথা শুনিয়েছেন,- ‘তাঁহারা বিদ্যা, বুদ্ধি, সুশিক্ষায় আমাদের অপেক্ষা কোন অংশে হীন নহেন। আমরা শ্রম-বণ্টন করিয়া লইয়াছি—তাঁহারা শারীরিক পরিশ্রম করেন, আমরা মস্তিষ্ক চালনা করি। আমরা যে সকল যন্ত্রের উদ্ভাবনা বা সৃষ্টি কল্পনা করি, তাঁহারা তাহা নির্ম্মাণ করেন। নর-নারী উভয়েই একই সমাজদেহের বিভিন্ন অঙ্গ...।’ সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সম-অধিকার বোধ জাগ্রত হলে ধর্ম-রাজনীতি আর বিভ্রান্ত করতে পারবে না। তাই দরকার লাগাতার অধিকার-আন্দোলন। আফগানিস্তানের মহিলারা বিদেশ থেকে আমদানি করা কালো বোরখার বিরুদ্ধে, নিজের দেশের ঐতিহ্যময় পোশাক পরার অধিকারের স্বপক্ষে বলছেন ‘ডুনটটাচমাইক্লথস’। নারী-অধিকার হরণকারী মৌলবাদী তালিবানি রাজনীতির অসত্য প্ররোচনার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সত্য উদ্ঘাটন করলেন তাঁরা। এই সত্য দিকে দিকে উদ্ঘাটিত হোক। নারীর শ্রমশক্তি যেন পোশাকের কারণে দুর্বল না হয়, স্বাস্থ্যহানি না ঘটে সেই সচেতনতা গড়ে উঠুক। সব পুরুষকে অবিশ্বাস করার প্রবণতা বন্ধ হোক। বোরখা আত্মরক্ষার অস্ত্র নয়। সম্মানের নয়। ধর্মও নয়। শিক্ষা, সচেতনতা, শ্রমশক্তি আত্মরক্ষার পথ। সার্বিক বিকাশেরও। ধর্ম এখানেই। সম্মানও। নারী-পুরুষের জোট বন্ধনে গড়ে উঠুক প্রকৃত বিকাশ, উন্নয়ন। ব্যক্তির, সামগ্রিকভাবে সমাজের। দূর হোক পোশাক ব্যবধান। দূর হোক লাভের ক্ষতিয়ান কষা মৌলবাদী রাজনৈতিক চক্রান্ত।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৬ অক্টোবর ২০২১
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্মী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment