- 02 January, 2022
- 0 Comment(s)
- 593 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
[১২]
সবাই ভোলে, আমি কেন ভুলিনি : চৈতি
পড়ন্ত বিকেল। প্রায় জনশূন্য ক্যাম্পাস। নির্জনতা খাঁ খাঁ করছে। নিজ রুমে সুমন। উঠি উঠি ভাব। সকালে এক পসলা বৃষ্টি হয়েছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকে সুমনকে কেমন যেন এলোমেলো ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে। রিমার কথা ভাবে। কেমন যেন রহস্যময়ী হয়ে উঠছে। ক্যালেন্ডারের পাতার মতো পাল্টে ফেলছে নিজেকে। কতটুকু পাল্টাবে রিমা তোমাকে তুমি? নিজেকেও জিজ্ঞেস করে সুমন, নাকি আমিও বদলে যাচ্ছি? কী ভয়ানক বিশ্রী ঝগড়াটাই না করে ঢাকা গেল! এভাবে কথার পৃষ্ঠে কথা বলা, যুক্তি দাঁড় করানো, অমীমাসিংত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা—রিমা কখনই করেনি। সুমনও এতটা বিব্রত হয়নি আগে। জীবন বড় নিষ্ঠুর! মানুষ বড় নিষ্ঠুর! নিজের নাগালের বাইরে গেলেই টুঁটি টিপে ধরে, নিশ্বাস নিতে দেয় না। যদি কিছুতেই না পেরে ওঠে, তখন ওঁৎপাতা শেয়ালের মতো অপেক্ষা করে দুর্বল মুহূর্তের জন্য। সুমন ভেতর থেকে টেনে নিশ্বাস বের করে, ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছি কি আমরা? পরাজয় কি অনিবার্য, আসন্ন। মৃত্যুর মতো।
আত্মমগ্ন সুমন চমকে ওঠে হঠাৎ, কে? কে আপনি।
জোরে দরজা ধাক্কা দিয়ে অনুমতি ছাড়াই দড়াম করে রুমে ঢুকে পড়েছে এক মেয়েমানুষ। তার পেছনে সম্রাট আকবরের মতো ভাব নিয়ে প্রবেশ করে এক ছেলে। মা বসার আগেই ছেলেটি লাফিয়ে বসে চেয়ারে। চেহারায় কঠিন দাম্ভিকতা। ছোট্ট ফর্সা দুটি পা দুলিয়ে দুলিয়ে এলোপাতাড়ি চোখ ফেলে সবকিছু দেখে নিচ্ছে ঝানু গোয়েন্দার মতো।
সুমনদা, কেমন আছেন? পাশের আর একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল মেয়েমানুষটা।
রীতিমত ভড়কে গেল সুমন। অচেনা এক মেয়েমানুষ আচমকা রুমে ঢুকে গেল! আবার পূর্ব পরিচিতের মতো ‘সুমনদা’ সম্বোধন করে বসে গেল সামনে। সুমনের চোখের পাতা কাঁপানো চাহনিতে মেয়েমানুষটি যথেষ্ট বিব্রত। সলজ্জ কণ্ঠে বলে, দাদা, আমি চৈতি! নাম বলার পরেও সুমনের ঘোর লাগা বিস্ময় দেখে কপাল চাপড়ে হতাশার কণ্ঠে বলে, হায় রে ভগবান! সুমনদা আমাকে চিনে না রে! কোথায় পালাই আমি এখন! সুমনের নির্বিকার চাহনি দেখে মেয়েমানুষটি এবার বাস্তবেই বিব্রত, আপনি কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারছেন না, না হেঁয়ালি করছেন? এবার মেয়েমানুষটির কণ্ঠে মৃদু অভিমান, মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, আর বেঁচে থাকলে নাকি বদলায়। তাই বলে এতটা বদলে যায়! আমি বিশ্বাস করি না। সুমনের চোখের নিচে কালি, কপালের ভাঁজে ভাঁজে ক্রোধ-বিষাদের রেখাচিহ্ন মিলে কিম্ভূত একটা দৃশ্য তৈরি করে রেখেছে। টানা অঘুমের কারণে চোখ বুঁজে আছে প্রায়।
সুমনদা, আপনি ঘুমিয়ে আছেন নাকি? মেয়েমানুষটি এবার প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, সুমনদা, আমি চৈতি, আমি আপনার চৈতি।
সুমন এবার অপরাধীর মতো হাত কচলায়, সরি, সরি, এক্সট্রেমলি সরি চৈতি! আমি অন্য একটা চিন্তায় ডুবে ছিলাম তো, তাই। কিন্তু তুমি তো যথেষ্ট পাল্টে গেছ। তোমার চেহারা দেখে চিনে ওঠা কঠিনই বটে। তোমার কণ্ঠস্বর কিন্তু পাল্টায়নি।
আমি না হয় একটু মুটিয়ে গেছি। চিনবেন না এতদূর ভেবে আসিনি কিন্তু। চৈতি গাল ফুলিয়ে বিদ্ধচোখে তাকায়। সুমনের বুকের ভেতরে কাঁচ ভাঙার মতো মচমচ করে উঠল। মাথার মধ্যে বিপুল বিস্ফোরণ ঘটে গেল। সুমনকে যেন কিছু বলছে চৈতির চোখ! বন্যার তোড়ের মতো স্মৃতির স্রোত বইতে লাগল সুমনের অন্তর্রাজ্যে। হাতড়ে হাতড়ে মণিমুক্তা কুড়ানোর মতো পেল এক সন্ধ্যার কয়েকটি সাধারণ চুমু।
হ্যাঁ, কয়েকটি চুমুর বন্ধন সুমনের সাথে চৈতির।
মাস্টার্স পরীক্ষার শেষদিন বিকেল। রিমাকে নিয়ে অন্যরকম আমেজে হাঁটছিল সুমন। ভাবছিল, ক্যাম্পাসটা বড় আজব জায়গা! স্মৃতি জন্মের ইন্ডাস্ট্রি। সুখের স্মৃতি, বেদনার স্মৃতি, বিরহ-মিলনের, যে যেটা নিতে চায়। জুটি ভাঙা-গড়ার খেলা চলে জুয়া খেলার মতো। জেতে দু’একজন, হারে সবাই। খেলা শেষে বালুঘরের মতো সেই জুটি ভেঙে যে যার ঘরে ফিরে যায়। তারপরে আর এক জীবন। বিয়ে। সংসার। একগণ্ডা ছাউপনা। সুমন ফিক করে হেসে ওঠে। দিনের পর দিন মনে মন ঢুকিয়ে, গতরে গতর ঘষে, বিলিয়ে বিলীন হয়ে ব্যবহৃত এই মানুষগুলো বাসর ঘরে ঢুকেই অন্যরকম শুদ্ধ নারী-পুরুষের মুখোশ পরে। সীতার মতো শুদ্ধ পবিত্র দেহ সদ্য ফোটা গোলাপের মতো মেলে ধরে স্বামীর গলা জড়িয়ে শুয়ে পড়ে উচ্চশিক্ষিতা যুবতী। ধনুকের মতো পিঠ বাঁকা করে শরীরকে বিড়ালকুণ্ডলি পাকিয়ে পরস্পরের মধ্যে বিলীন হতে হতে কণ্ঠ কাঁপিয়ে পরম আস্থার সাথে অস্পষ্টস্বরে বলে, এই জীবনে তুমিই প্রথম পুরুষ। যুবকটিও নিশ্চয় দ্বিধাহীনভাবে বলে, এই জীবনে তুমিই প্রথম নারী। ওদের মিলন মুহূর্তে গোপন চুমুর স্মৃতি, ওদের গোপন মিলনের মুহূর্তগুলো কি জেগে ওঠে না মনে? ওদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কি সাক্ষ্য দেয় না? ওদের গোপন প্রেমিক/প্রেমিকারা কি তখন নিঃশব্দে পাশে এসে শুয়ে পড়ে না? পুরোনো পাপ কি ওদের অবশিষ্ট জীবন তাড়া করে ফেরে না? জীবনের প্রথম লজ্জা যাকে দিয়েছে তাকে ভোলা যায়! এত বড় মিথ্যাচারের ভয় নেই সুমনের। ওদের জীবনে অক্ষয় মিলনতীর্থ হয়ে থেকে যাবে এই ক্যাম্পাস।
গাঢ় অন্ধকার ধেয়ে আসছে। রিমাকে হল গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে পুকুরের পাড় ধরে ফিরছে সুমন। যে দিকটা দিয়ে সুমন হেঁটে যাচ্ছিল, দূরের লাইটের আলো সে পর্যন্ত পৌঁছায় না। গা ছমছম করছিল। হাঁটছে তটস্থ পা ফেলে। সুমনদা। মেয়েলি কণ্ঠ কানে এলো হঠাৎ। দাঁড়িয়ে পড়ল।
বেশ সেজেগুঁজে, খোঁপায় একটি টকটকে লাল গোলাপ, আকাশী রঙের সিল্কের শাড়ি পরিহিত চৈতি সামনে দাঁড়ান। সুমন চমকাল, চৈতি! সন্ধ্যার জোনাকির পিটপিট আলো পড়ছে চৈতির উপরে। অন্ধকারে এখানে! আর এরকম রমরমা সাজ দিয়েছো, কারণ?
লম্বা শ্বাস টেনে ফুসফুসের বাতাস বের করে সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেড়ে দিল চৈতি। বহুদিনের পোষা পাখি যেন খাঁচা ছেড়ে বের হয়ে এল। আপনার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি। আপনার জন্যেই সেজেছি। ঘন নিশ্বাসের গরম বাতাস ছুঁয়ে গেল সুমনের শরীর। বিব্রত সুমন অন্ধকারেই চোখ ফেলে দেখে নিল কথার সীমানা অবধি কোন জন মানুষ আছে কি না। কী ব্যাপার? অন্ধকারে! কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে সুমন।
কাল তো হল ছেড়ে দিচ্ছেন, ক্যাম্পাসে আসবেন না আর? চৈতির ভেতরে পুঞ্জিভূত আবেগ, টনটনে কণ্ঠ।
আপাত হল ছাড়ছি, কিন্তু যাব আর কোথায়, রিমা আছে না? এছাড়া ডিপার্টমেন্টে কথা হয়েছে, বোধহয় স্যারেরা নিচ্ছেন আমাকে।
সত্য আর লুকাবো না সুমনদা। মনে প্রাণে আপনাকে কামনা করি। কত রাত যে স্বপ্নে আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি। কিন্তু মুখ ফুটে চাইবার সাহস হয়নি। আপনাকে চিনি, আপনি কোনদিনই রিমা আপুর সাথে প্রতারণা করবেন না।
চৈতি সুমনের নিশ্বাসের নিকটবর্তী হয়।
বাস্তবটা মেনে নেওয়াই উচিত, রুমে যাও, কারো চোখ পড়লে কেলেংকারি...পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল সুমন।
পেছন থেকে হাত টেনে ধরে চৈতি, না, সুমনদা, এভাবে আমার ভালোবাসাকে দুই পায়ে মাড়িয়ে যেও না। আমিও নারী, আমাকে তুমি দ্যাখো, একবার তুমি ভালো করে দেখো সুমনদা, আমার জন্যে কত ছেলে পাগল, কিন্তু আমি কাউকে ভালোবাসতে পারিনি, কারও কাছে যেতে পারি না, তোমার কথা ভাবি শুধু, তোমাকেই শুধু চাই আমি। বলে যাও তুমি, আমি এখন কী করব? এই জীবন নিয়ে আমি কী করব? তোমাকেই বলতে হবে। প্রকাণ্ড নির্জনতা কাঁপিয়ে চৈতি ঝাঁপিয়ে পড়ল সুমনের বুকের মধ্যে। প্রথমে খামছে ধরে শার্টের কলার। অতঃপর কলার ছেড়ে শরীরে সমস্ত শক্তি দিয়ে বাঘিনীর শিকার ধরার মতো জাপটে ধরে সুমনকে। সুমনের গলা, কপালে, ঠোঁটে, গণ্ডদেশে এলোপাতাড়ি চুমুর ঝড়ের উত্তেজনায় টালমাটাল সুমনের দেহযন্ত্র। তখনি সুমন চৈতীর হাত দুটি চেপে ধরে, পাগলামি করছো কেন? খোলা জায়গা, কেউ দেখে ফেললে তোমারই তো বিপদ। মুখটি তুলে ধরে চৈতির, অন্ধকারের মধ্যেই টের পায় সুমন, তৃষ্ণায় শুকিয়ে কাঠ দুটি ঠোঁট। কাঁপছে ভয়ানক। চোখ দুটিতে যেন দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছে! এমন কাঙালকে কে না দরদ করে, তাই চৈতির শরীর পেঁচিয়ে ধরে সুমন। চৈতির ঠোঁটে, গালে, চোখে দুটি করে মোট ছয়টি চুমু দিল। মুহূর্তের মধ্যেই বোধোদয়ও ঘটে, হাতজোড় করে, সরি চৈতি, ক্ষমা করো, ভুল হয়ে গেল।
একটি কথাও বলেনি চৈতি। বিষাক্ত শঙ্খিনীর মতো মাথা দুলিয়ে সেই যে অন্ধকারে হারিয়ে গেল, আজ আবার এত বছর পরে!
এত বছর পরে তুমি কোথায় থেকে উদয় হলে? স্মৃতির ঝাঁপি বন্ধ করে বলে সুমন।
আমি আপনার সব খবরই রাখি। আপনার দুটি বই পর্যন্ত আমি কিনেছি। সেখানেই দেখলাম, আপনি ডিপার্টমেন্টেই আছেন।
হুম। কী খাবে বলো? এতদিন পরে এলে। আমার কাছে আজকাল আর কেউ আসে না। আমাকে আর কেউ মনে রাখে না।
না, কিছুই খাবো না। সুমনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে চৈতি।
এদিকে আর একজনের বর্গী উপদ্রুব ননস্টপ চলছে। টেবিলের ডেস্কডাইরির বেশির ভাগ পাতা আঁকিবুঁকি খেলে নিয়েছে ছেলেটা।
বাহ্! চমৎকার বাচ্চা তো। কী নাম বাবু তোমার? সুমন হাত বাড়িয়ে গাল টেপে।
মাম্মি, সুমন আঙ্কেল আমার নাম জানে না! পোকা খাওয়া দুধের দাঁত বের করে হি হি করে হেসে ওঠে ছেলে।
লজ্জায় পড়ে গেল সুমন। তোমার ছেলে আমার নাম জানে? আমাকে চেনে?
চৈতি গাঢ় শ্বাস ফেলে, সুমনদা, ও তো আমারিই অস্তিত্ব, আমার অস্তিত্ব জুড়ে এখনো যে তুমিই আছো, ঠিক সেই দিনের সন্ধ্যায় যেমন ছিলে।
চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে তাজ্জব সুমন! সেই দিনের সন্ধ্যার মতোই চৈতির চোখ জুড়ে ওকে পাবার আকাঙ্ক্ষা।
ছেলেটির চাহনি, শর্তহীন হাসি, দম্ভভরে পা দুলানো, টেবিলের কলম, বই, মোবাইল নাড়াচাড়া গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখত লাগল সুমন। অধিকার লুটে নেবার এই জায়গাটাতে সে চরম কাঙাল। বিশ্বচরাচরে দু’টো ছোট্ট হাতের কী যে শক্তি, স্তব্ধ সুমনের নির্বাক চাহনিই বলে দিচ্ছে।
চৈতি এই দিনটির প্রহর গুনেছে এতটা বছর। রাজপুত্রের রাজরানীর মন বিজয়ের কাহিনি প্রতিদিন শোনায় কচি বালককে। প্রায় নিজের মুখোমুখি বসে, দু’এক দিন ছেলেকে স্রোতা বানিয়ে মনের কথা বলে মন শান্ত করে। মানুষ তার স্বপ্নকে ভুলে থাকতে পারে না। দিনে দিনে বেড়ে ওঠা, পায়ে পায়ে হাঁটা শেখার মতোই সুমনকে চিনেছে এই ছেলে।
জয়নাল! জয়নাল! বার কয়েক ডেকে সাড়া শব্দ না পেয়ে নিজেই উঠে গেল সুমন।
বাইরে চোখ ফেলে নীরবে বসে ভাবে চৈতি। প্রফেসর চৌধুরির চক্রের আড্ডা, হইচই, আবেগী দিনগুলো হারাল কোথায়? একদিনের স্মৃতি মনে পড়ে চৈতির। সুমনের শরীর ঘেষে বসা ছিল। আড্ডার ভয়ানক বদমায়েশির খ্যাতি ছিল মর্তুজা আলীর। পেছনে বসে একে ওকে গুতো মারা, কাতুকুতু দেওয়া, মানিব্যাগ হতে টাকা পাস করা, মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগের গোপন তথ্য ফাঁস করা ইত্যাদি দুষ্টুমিতে পাকা ছিল। চৈত্রের পড়ন্ত বিকেলে তুমুল আড্ডা চলছে। স্থান কলা ভবনের সামনের বড় আমগাছের ছায়াতল। মাঝে মাঝে টপ টপ করে ছোট ছোট আমের কুঁড়ি পড়ছে এর-ওর মাথায়। চার-পাঁচটা কুঁড়ি গুছিয়ে পেছন দিক হতে চৈতির কামিজের কলারের ফাঁক দিয়ে টকাস করে ছেড়ে দিয়েই চিল্লিয়ে ওঠে মর্তুজা। তখনো প্রফেসর চৌধুরি আসেননি।
সুমন এ কী করলি! সুমনের দিকে তাকিয়ে মর্তুজা বিস্ময়ে চোখ উল্টায়। মুহূর্তের মধ্যেই আড্ডায় মমির মতো নিস্তব্ধতা নামে। ভদ্র ছেলে হিসেবে মেয়েদের কাছে সুমনের ব্যাপক খ্যাতি।
সবাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে মর্তুজা আলী দাঁড়ায়, মুখে শয়তানি হাসি, চৈতি দাড়াও তো দেখি।
চৈতি তখন আরও গুটিসুটি হয়ে বসে। লজ্জায় মাটি চাপা হয়ে বসে আছে বিব্রত সুমন। চৈতি বাঁকা চোখে বিনম্র সলজ্জ সুমনকে দেখে, বুকের ভেতরে টনটন করে ওঠে। লোভে শরীর নেতিয়ে আসে। আহা! লজ্জবতী লতার মতো নুয়ে পড়া এই ছেলেটাকে যদি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারতাম! জীবনে আর কিছু চাই না। মনে মনে মর্তুজা আলীকে বরং ধন্যবাদ দেয় চৈতি।
সবার ঔৎসুক চোখ চৈতির উপরে নির্দিষ্ট। কচি ডালিমের মতো গোল স্তনযুগল কাঁপিয়ে সটান দাঁড়াল। তক্ষুণি যুবকদের বুকে ঝড় ওঠে। ছিপছিপে লম্বা দেহের সলজ্জ চৈতি ফলের ভারে নুয়েপড়া গাছের মতোই লজ্জার ভারে উপুড় হয়ে পড়ে গেল সুমনের কাঁধে। সাথে সাথে মার্বেলের মতো গড়িয়ে আমের কুঁড়ি পড়তে লাগল কামিজের অন্তর্দেশ হতে। হইহুল্লোড় চেঁচামেচিতে আড্ডা নির্বাচনী হট্টগোলে রূপ নিল। যে যার মতো কুঁড়ি কুড়িয়ে পকেটে ভরতে লাগল। এমনিতেই কুঁড়ি কেউ ছোঁয় না। কিন্তু এই কুঁড়িগুলোর আলাদা ভেল্যু। এক সুন্দরী যুবতীর স্তন ছুঁয়ে এসেছে যে! কামিজের নিচের অংশের সাথে সুমনের শার্টের গিঁট মারা টের পেয়ে সুমনের শরীর ঘেঁষে নখ দিয়ে ধীরে ধীরে গিঁট খোলে চৈতি। ভেতরে তখন তুমুল আন্দোলন। শিরা-উপশিরায় আনন্দময় অনুভূতির ছোঁয়া পেয়ে শরীরে সম্পূর্ণ অচেনা এক নৃত্য উঠেছে।
সুমন কখন নিঃশব্দে রুমে ফিরেছে স্মৃতিকাতর চৈতি টের পায়নি। সুমনের লোমশ হাতে কলমের খোঁচা দিয়ে হঠাৎ বলে ওঠে ছেলেটা, জানো আঙ্কেল, আমার বাবা বাড়ি আসে না।।
তোমার বাবা কোথায় থাকেন? সচকিত সুমন।
তুমি জানো না! আমার বাবা কানাডা থাকে। তুমি জানো না? ফের পোকা খাওয়া দাঁত বের করে হি হি করে হেসে ওঠে ছেলেটি।
এতটা অবিন্যস্ত হয়ে উঠবে চৈতি ভেবে আসেনি। এতদিনের তালিম দেওয়া বিদ্যা এভাবে জাহির করবে ছেলে, তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। লজ্জায় নিজের মধ্যে নিজেই হিম হয়ে চেয়ার লেপটে বসে রইল। বাইরে রৌদ্রোজ্জ্বল নির্মল আকাশে এক টুকরো মেঘ খেলা করে যাচ্ছে আপন মনে।
জানালার ফাঁক দিয়ে দূরের আম গাছের ফোটা মুকুল ঝরার দিকে নিবিষ্ট চিত্তে তাকিয়ে ভাবে চৈতি। জীবনের কত বিচিত্র রূপ! যখন সে এই ক্যাম্পাসে ছিল—কোথায় ছিল এই ছেলে? কোথায় ছিল শ্যামল? তখন তো সুমনই ছিল ধ্যান- বাস্তবতা। এ জীবন আর সে জীবনের অর্থ খোঁজে চৈতি।
সুমনের দুই ইয়ার জুনিয়র চৈতি। সাবজেক্ট এক। ওদের পরিচয় ঘটে প্রফেসর চৌধুরির আড্ডায়। সকলেই যখন কবিতা-বক্তৃতা নিয়ে মশগুল তখন চৈতি চোখ ভরে পান করত সুমনের রূপ-যৌবন-ব্যক্তিত্ব। খুব বেশি কথা বলার সুযোগ ছিল না। শেষের দিকে সুপার গ্লুর মতো লেগে ছিল রিমা। রিমাকে মনে মনে ঈর্ষা করলেও প্রকাশ্যে মুখ ফুটে বলেনি কিছুই। দু’জন একসাথে থাকলে কাছেপিঠে যেত না চৈতি। বলা যায় না, যদি রিমা টের পায়, তার প্রেমিক পুরুষের প্রতি চৈতিরও লোভ আছে।
চৈতি তুমি এখন কোথায় আছো, কী করছো? স্বাভাবিক হয়ে চেয়ারে তোয়ালেটা সাট করে ফের বসতে বসতে বলে সুমন। নিজের মধ্যে এতক্ষণ গুটিয়ে শামুকের মতো লুকানো চৈতি নির্লিপ্ত উত্তর দেয়, তেমন কিছুই না। একটা সেকেণ্ড ক্লাস জব। ফ্যামিলি প্লানিং এ। কুষ্টিয়াতেই।
তোমার হাজবেন্ড ।
ঐ যে ছেলে বলল, কানাডায়।
তবে তুমিও তো এক পা কানাডা দিয়ে রেখেছো?
ব্যাঙ্গাত্মক ভঙিতে হাসে চৈতি। মুখ বিকৃত করে বলে, কানাডা! হ্যাঁ, কানাডা যেতাম। কিন্তু পারি না যেতে। কে যেন দুই পা বেঁধে রেখেছে।
কে? স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে সুমন।
আপনি! চৈতির ভেতর থেকে দড়ি ছিঁড়ে যেন বেরিয়ে আসল শব্দটা। লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে ফেলবে কি না কে জানে।
ঠাণ্ডা হিম ঘোলাটে চোখে তাকায় চৈতি সুমনের প্রতিক্রিয়া জানতে। সুমন নিঃশব্দে নখ খুঁটছে টেবিলে ঘাড়গুঁজে। চৈতির ভেতরে থরে থরে সজ্জিত এত বছরের প্রতি প্রহরের বর্ণনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুমনের কাছে বলতে চায়, কী ভীষণ তপস্যা চলেছে তার ভেতরে! পরমুহূর্তেই গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ বলে আর কী লাভ! এক দুর্মর প্রকাশহীন যন্ত্রণায় ছটফটিয়েই একদিন মরতে হবে।
মুখ তুলে চৈতির মুখে তাকাতেই ভয়াবহ শব্দ করে অ্যা করে ওঠে সুমন। চৈতির কণ্ঠাহাড়ের নিচে বুকের উপরের অংশে সূক্ষ একটা দাগ। হাউ ইট পসিবল? সেদিন সন্ধ্যায় জোঁকের মতো জড়িয়ে থাকা চৈতিকে রুখতে গিয়ে নখের আঁচড় পড়েছিল। তখন রক্তও বের হয়েছিল। হাতের মধ্যে রক্ত লেগেছিল। অপারেশনের নির্মম চিহ্নের মতোই সেদিনের নিপীড়নের স্মারক এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে মেয়েমানুষটা!
বুকের দাগে হাত রাখে চৈতি, কী দেখছেন? এ দাগ? এ তো চামড়ার উপরে শুকনো ক্ষত মাত্র। কিন্তু ভেতরের ক্ষত...? বড় করে একটা নিশ্বাস ফেলে চৈতি। উঠলাম বলে দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে আঁচল দিয়ে মুছে নিল। মাপা হাসি ঠোঁটে টেনে বলে, সুখেই আছেন সুমনদা, তাই না? সুমনের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে। রুদ্ধশ্বাসে পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখে চৈতিকে। ধবধবে ফর্সা গালে সাপের মতো পেঁচানো রগগুলো কাঁপছে তিরতির করে। নিশ্বাসের তপ্ত বাতাসে ঘরপোড়ার গন্ধ পায় সুমন। আর কিছু না বলে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেল চৈতি।
অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে বসে রইল সুমন। নারী কী আজব প্রাণী! একরোখা জাত। যাকে মনে ধরে তাকে এমন করেই চিরস্থায়ীভাবে খোদাই করে রাখে মনে। সুমনের মধ্যে নতুন অনুভব জাগিয়ে গেল চৈতি। রিমার কথা ভেবে ভেতরটা ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে।
সুমন যখন বাসায় ফিরছে তখন ঝিম হয়ে বিকেল নামছে। ফেরার সময় একটা বোকার মতো কাজ করেছে সে। একটা সাপ-লুডুর ঘর কিনে এনেছে। কেন এমন ছেলেমি করল ভেবে নিজেরই হাসি পায়। জীবনটাকে এখন সুমনের কাছে সাপ-লুডুর খেলা বলেই মনে হয়। ছোট বড় অসংখ্য সাপ মুখ হা করে আছে মানুষকে গিলতে, ওকে গিলতে, রিমাকে গিলতে, ওদের স্বাধীনতাকে গিলে খেতে। অন্ধ অজগরের মুখে পড়ে গেছে সুমনের নিয়তি। এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে বের করার জন্যেই সাপ-লুডুর ঘর কিনেছে।
রুমে ঢুকেই লম্বা হয়ে পা সাট করে শুয়ে পড়ে সুমন। পড়ন্ত বিকেলের এক টুকরো রোদ্দুর খেলা করে যাচ্ছে বিছানায়। বিছানায় পড়ে রইল জবুথবু হয়ে। উঠার তাড়া বোধ করে না। বর্তমান জীবনকে দাবড় মেরে সরিয়ে দিয়ে ঝেঁকে বসেছে অতীতচারী মন। সেই ক্যাম্পাস, সেই রিমা, সেই ভবন, আমতলা সব যেন চলমান ছবি চোখের সামনে। যতদূর হাতড়ায় তাতে চৈতির কোন জায়গা আছে বলে মনে হয় না। এক সন্ধ্যার পাগলামি ছিল স্রেফ। সেটাও এত চকিত এবং ওর দিক থেকে এত নির্লিপ্ততা ছিল যে, স্মৃতিতে আসেনি এক মুহূর্তের জন্যও। তবে বুকের পাঁজরে এতটা আলোড়ন কেন! নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করে সুমন, কোন সুখবতীকে দেখলেই সুখের অসুখ এমন করে মাথা তুলে ওঠে কেন? চৈতির ছেলেটার কথা মনে পড়ে। এমন একটা ডানপিটে শিশুর লোভ মনের ভেতরে ঘাপটি মেরে আছে। বড় শ্বাস ফেলে। অনুর্বর পতিত জমির মতো কেটে গেল জীবনের এতটা বছর!
[চলবে...]
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)
0 Comments
Post Comment