চিয়েন-শিউং য়ু!

  • 20 September, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 484 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
কেবল সেবারেই নয়, পরবর্তীতে আরও অন্তত সাতবারের জন্য তাঁর নাম নোবেল পুরষ্কারের মঞ্চে বিবেচিত হলেও – কোনওবারেই তাঁর কপালে শিকে ছেঁড়েনি। পরে ১৯৭৮ সালে উলফ পুরষ্কারে সম্মানিত করে বিজ্ঞানীমহলের তরফে চিয়েন-শিউং য়ুর প্রতি অবহেলার কিছুটা পাপস্থালনের চেষ্টা করা হয়। নারীর প্রতি অবহেলা বিংশ শতকের শেষ লগ্নে এসেও ফুরোতে পারে না। উৎকর্ষ তার কাজ করে চলে, কিন্তু স্বীকৃতি? সে খবর অনন্তে বিরাজমান! নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক (পর্ব ২৯)

“আমি অবাক হয়ে ভাবতে চেষ্টা করি, পরমাণু অথবা তার ভরকেন্দ্রে থাকা নিউক্লিয় বস্তুগুলির তো কোনও লিঙ্গভেদ হয় না, লিঙ্গভেদ হয় না গাণিতিক চিহ্নগুলিরও – অথবা ডিএনএর পরমাণুগুলির। তাহলে কেনই বা মানবসমাজে পুরুষত্ব এবং নারীত্বের প্রশ্ন নিয়ে এত বিতর্ক আসে ?” জীবনের শেষভাগে দাঁড়িয়ে কোনও এক বক্তৃতামঞ্চ থেকে সরাসরি এই প্রশ্নকেই শ্রোতৃবর্গের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন চিয়েন-শিউং য়ু, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রথম মহিলা অধ্যাপক। এই চিয়েন য়ুকে অনেকেই ‘চীনদেশের মাদাম কুরি’ বলে সম্বোধন করে থাকেন। সুদূর প্রাচ্যের প্রতিনিধিস্বরূপ এই চিয়েন য়ু-ই একসময় পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন জগদ্বিখ্যাত ম্যানহাটান প্রজেক্টের অলিন্দে। গ্যাসীয় ব্যাপনের তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে ইউরেনিয়াম আইসোটোপগুলির পৃথকীকরণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। পরে আবার য়ুর আরও একটি গবেষণাকে ব্যবহার করে তাঁর সহকর্মীরা নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হবেন। যদিও, য়ুর কপালে শিকে ছিঁড়বে না। লিজা মেইৎনারের মতোই, একাধিক বার নোবেল পুরষ্কারের জন্য বিবেচিত হলেও – শেষমেশ তাঁর কাছে নোবেল অধরাই থেকে যাবে। অথচ তিনি এমনই একজন চরিত্র, ‘মহান’ মাওয়ের হাতে নিজের পরিবারকে হারিয়েও মার্কিনভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হবেন তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। স্ফুলিঙ্গের মতোই তাঁর উপস্থিতি। পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁর অধিকার এতটাই সুদৃঢ় ছিল যে সমসাময়িক সময়ে ইউরোপের বিখ্যাত গবেষণাকেন্দ্র সার্নের অধিকর্তা একবার য়ুয়ের সম্পর্কে বলেছিলেন, “কোনও একটি পরীক্ষা যদি অধ্যাপিকা য়ুয়ের দ্বারা সম্পন্ন হয়ে থাকে, তবে তার সত্যতা সম্পর্কে আমরা একেবারে নিঃসন্দেহ হতে পারি।” আজ সেই চিয়েন-শিউন য়ুয়ের গল্প শোনাবো।

১৯১২ সালের ৩১শে মে, চীনের জিয়াংশু প্রদেশে য়ুয়ের জন্ম। বাবা উ-ঝং-য়ি ছিলেন পেশাগত ভাবে একজন এঞ্জিনিয়র, এবং তারই সঙ্গে নারীর সমানাধিকার প্রাপ্তির বিষয়ে একজন সরব ব্যক্তিত্ব। সেই সময় চীনদেশে সুন-ঝংশানের নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত হলে, উ-ঝং-য়ি এই বিপ্লবের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন। তিনি উন্নত এবং আধুনিক চীনের স্বপ্নে বিশ্বাস করতেন। বিপ্লবের সময় নিজের অনুগামীদের সাহায্যে তিনি এলাকার দস্যু-উপদ্রবকে প্রতিহত করেছিলেন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সমস্ত নাবালিকা মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য তাদের পরিবারবর্গকে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি নিজেই মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন। এমনই একটি পরিমণ্ডলে চিয়েন য়ুয়ের ছোটবেলা অতিবাহিত হয়। নানজিংয়ের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি স্নাতকস্তরের পড়াশোনা শেষ করেন। কেবল বিজ্ঞানের চর্চাই নন, য়ু সেই সময় কবিতা লিখতেন – ক্যালিগ্রাফি করতেন। এমনকি ছাত্র-রাজনীতির ক্ষেত্রেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জাপানের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে পালটা চীন সরকারকেও কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে এই দাবিতে তিনি একাধিক ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি নানজিংয়ের রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনেও ধর্ণায় বসেন। সেই পরিস্থিতিতে স্বয়ং চিয়াং কাই-শেক তখন ছাত্র নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য হন। ঝড়ের মতোই এমন এক ছোটবেলা কাটিয়ে অবশেষে য়ু মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমান। মিশিগান অথবা বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করবেন, এই তাঁর মনোবাঞ্ছা ছিল।

কিন্তু প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে পাড়ি দিলেও প্রথম দর্শনেই য়ুর স্বপ্নভঙ্গ হয়। খোদ মার্কিন মুলুকেও যে এমন পরিমাণে নারীবিদ্বেষের সম্মুখীন হতে হবে য়ু তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। শেষ অবধি এই চূড়ান্ত রক্ষণশীল পরিবেশের কারণেই মিশিগানের পরিবর্তে ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলেতে পিএইচডি ছাত্রী হিসেবে য়ু তাঁর নাম নথিভুক্ত করেন। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ আর্নেস্ট লরেন্সের ছাত্রী হিসেবে য়ু তাঁর পিএইচডির কাজ শুরু করেন। পরমাণুর কেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণের বিষয়ে তাঁর গবেষণা বিশেষ গুরুত্ব পেতে শুরু করে। এছাড়াও তেজস্ক্রিয় জেনন গ্যাসের মাধ্যমে ক্যানসার চিকিৎসা সম্ভব কিনা সেই নিয়েও তাঁর গবেষণা চলতে থাকে। এই গবেষণারই অংশ হিসেবে তিনি বার্কলের রেডিয়েশন ল্যাবরেটরিতে সাইক্লোট্রন-সহ আরও অন্যান্য জটিল সমস্ত যন্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ১৯৪০ সালে চিয়েন-শিউং য়ু অবশেষে তাঁর পিএইচডি শেষ করেন। সুদূর প্রাচ্যদেশ থেকে আসা ছোট্টখাট্টো দেখতে এই মহিলার এমন অসম্ভবকে সম্ভব করার খবর সেই সময় আমেরিকার একাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। য়ু ভেবেছিলেন যে পিএইচডি শেষ করে স্বদেশে ফিরে গিয়ে সেখানে বসেই তাঁর গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সেই আশাকে হতাশায় পরিণত করে, স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দেশে ফেরা হল না য়ুর।

পিএইচডি শেষ করে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে য়ু তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনিই ছিলেন প্রিন্সটনের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রথম মহিলা অধ্যাপক। ১৯৪৪এর মার্চে চিয়েন-শিউং য়ু, ম্যানহাটান প্রজেক্টে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। এই ম্যানহাটান প্রজেক্টেরই একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনার কথা এই সূত্রে না বললেই নয়। প্রকল্পের অন্তর্গত প্রথম যে পরীক্ষামূলক পরমাণু চুল্লিটিকে তৈরি করা হয়েছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল হ্যানফোর্ড সাইট – সেই চুল্লিটি ভালো ভাবে কর্মক্ষম হতে না হতেই, আবার করে বারে বারেই বিকল হয়ে পড়ছিল। জন আর্চিবল্ড হুইলার এবং এনরিকো ফার্মি সন্দেহ করেন, সেই সময় চিয়েন য়ু যে বিষয়টিকে নিয়ে গবেষণা করছেন, সেই গবেষণার মধ্যেই এর উত্তর লুকিয়ে থাকতে পারে। দুজনে সেই কথা সরাসরি য়ুকে জানান। সত্যিই দেখা যায় যে, সেই সময় য়ু যে গবেষণাপত্রটি লিখছিলেন তার পর্যবেক্ষণগুলির মধ্যেই পরমাণু চুল্লিটির যে সমস্যা, তার সম্ভাব্য সমাধানও লিপিবদ্ধ রয়েছে। কড়া নিরাপত্তার কারণে য়ু সেই গবেষণাপত্রটির প্রকাশ পিছিয়ে দেন। স্রেফ সেই বিশেষ তত্ত্বটি জেনে ফেলার কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় পরমাণু গবেষণার ক্ষেত্রে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে যায় স্যাম চাচার দেশ। যুদ্ধের পর পরমাণু অস্ত্রের বিভীষিকা অন্যান্য অনেক বৈজ্ঞানিকদের মতো য়ুকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “মানুষ কি এভাবেই নিজের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করবে ? আমি মানবতার উপরে বিশ্বাস রাখতে চাই।” একই সময় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে মাও সে তুং চীনের ক্ষমতায় আসেন।

১৯৫৮ সালে চিয়েন-শিউং য়ু, পরমাণু-কেন্দ্র থেকে বিটা নিঃসরণের বিষয়ে যুগান্তকারী গবেষণা শুরু করেন। এছাড়াও সাম্যের সংরক্ষণ সূত্রকে তিনি ভুল বলে প্রমাণ করেন। এই দ্বিতীয় গবেষণাটিই পরে য়ুর দুই সহকর্মীকে নোবেল পুরষ্কার পেতে সহায়তা করবে। যদিও য়ুকে কেন নোবেল দেওয়া হয়নি, সেই নিয়েও যথেষ্ট বিতর্কের সূত্রপাত হয়। কেবল সেবারেই নয়, পরবর্তীতে আরও অন্তত সাতবারের জন্য তাঁর নাম নোবেল পুরষ্কারের মঞ্চে বিবেচিত হলেও – কোনওবারেই তাঁর কপালে শিকে ছেঁড়েনি। পরে ১৯৭৮ সালে উলফ পুরষ্কারে সম্মানিত করে বিজ্ঞানীমহলের তরফে য়ুর প্রতি অবহেলার কিছুটা পাপস্থালনের চেষ্টা করা হয়। নারীর প্রতি অবহেলা বিংশ শতকের শেষ লগ্নে এসেও ফুরোতে পারে না। উৎকর্ষ তার কাজ করে চলে, কিন্তু স্বীকৃতি ? সে খবর অনন্তে বিরাজমান!

পরমাণু সংক্রান্ত গবেষণায় একের পর এক দিগন্তকে উন্মোচিত করেছিলেন য়ু। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে একের পর এক শোক সংবাদ আসছিল তাঁর জীবনে। ১৯৫৮ সালে তিনি যখন বিটা নিঃসরণের যুগান্তকারী গবেষণাটিকে নিয়ে ব্যস্ত, সেই বছরই তাঁর ভাইয়ের মৃত্যু হয়। ১৯৬২ সালে তাঁর মা এবং বাবার মৃত্যু হয়। কিন্তু কমিউনিস্ট শাসিত চীনে শেষকৃত্যে যাওয়ার জন্য তিনি মার্কিন প্রশাসনের তরফে অনুমতি পাননি। ‘মহান’ মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় য়ুর কাকা এবং খুড়তুতো ভাই সেই অশান্তির মধ্যে প্রাণ হারান। এমনকি য়ুর মা ও বাবার স্মৃতিসৌধদুটিও দুষ্কৃতীদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অনেক পরে ঝৌ-এনলাইয়ের শাসনকালে য়ু অবশেষে চীনসফরে এলে, ঝৌ-এনলাই নিজে এই ব্যাপারে য়ুর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের রক্তাক্ত ইতিহাসের পর য়ু স্বয়ং বিক্ষোভরত ছাত্রদের সপক্ষে সমর্থন জানান।

১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ – নিউ ইয়র্কে প্রয়াত হন চিয়েন য়ু। নারী-পুরুষ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এমন হাজারো বিভেদকে জয় করে যিনি পরমাণু গবেষণার শিখরে পৌঁছতে পেরেছিলেন। আমরা ইতিহাসে কেবল মারী কুরির কথাই পড়ি। লিজা মেইৎনার, এমি নোয়েদার অথবা চিয়েন-শিউং য়ুদের মতো একেকজনের ইতিহাস ধুলোমলিন ইতিহাস-বাক্সের অন্তরালেই লুকিয়ে পড়ে থাকে। আমরা তখন ধুলোবালিকে সরিয়ে সেই ইতিহাসকে রোদ্দুরে আনতে চেষ্টা করি। মলাটের উপর থেকে তখন চিয়েন য়ুই হয়তো বা সহাস্যে তাকান। বলে ওঠেন, মানবতা কেবল মানবতাই। তার নারীত্ব বা পুরুষত্ব হয় না। মানুষ, কেবল জ্ঞানার্জনের ইচ্ছাতে বেঁচে থাকে।

সূত্রঃ

[১] টি সি চিয়াং, ‘ইনসাইড স্টোরিঃ সি এস য়ু – ফার্স্ট লেডি অব ফিজিক্স রিসার্চ’, সার্ন কুরিয়ার, নভেম্বর, ২০১২

[২] স্টিফানি এইচ. কুপারম্যান, ‘চিয়েন-শিউং য়ুঃ পায়োনিয়ারিং ফিজিসিস্ট এ্যান্ড এ্যাটমিক রিসার্চার’, রোসেন পাবলিশিং গ্রুপ, ২০০৪

[৩] রিচার্ড হ্যামন্ড, ‘চিয়েন-শিউং য়ুঃ পায়োনিয়ারিং নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট’, চেলসি হাউজ পাবলিশার্স, ২০০৭

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

 

 

 

0 Comments

Post Comment