ছুট

  • 01 March, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 495 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
তামান্নাদের বারান্দায় অনেকগুলো ফুলগাছ ছিল; আর সেগুলো ছিল পুরনো মর্টারের শেলে বসানো। ফাটা অথবা না ফাটা মর্টারের শেল – গোটা কাবুল শহর জুড়েই অজস্র হয়ে একসময়ে ছড়িয়ে থাকত। এই দেশ আফগানিস্তান, এই শহর কাবুল - কেবল যুদ্ধই দেখেছে। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ভেঙে যাওয়া একেকজন ক্ষমতাসীন মানুষ, একেকটা গোষ্ঠীর পিছনে নেমে আসা হঠাৎ আন্তর্জাতিক সমর্থন। তামান্না এই মর্টারের শেলগুলোতে ফুল ফুটলে পরে বলত, ফ্লাওয়ার অব ওয়ার। সালেমা অবাক হয়ে ভাবত এই মেয়েটা কিছু কল্পনা করতে পারে।

ঘরগুলো সারি বেঁধে চলে গিয়েছে। পাশাপাশি একটার পর একটা সাজানো। ভাঙাচোরা রাস্তার দুপাশে এমন অনেক কটা সারি চলে গিয়েছে। উপর থেকে হঠাৎ করে দেখলে যেন বা সৈন্যশিবির বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাড়িগুলো তেমন নয়। বাড়িগুলো পুরনো। ছাদ ভাঙা কয়েকটার। টিন অথবা এ্যাসবেস্টসের ছাউনি। দূরের দিগন্তে ঢেউ খেলানো পাহাড় দেখা যায়। জায়গাটা কাবুল শহরের উপকণ্ঠে। শোনা যায় আশির দশকে, দিগন্তের ওই পাহাড়গুলো থেকেই নাকি হেকমতেয়ারের জঙ্গিরা কাবুল শহরের উপরে রকেট হামলা চালাত। এখন তালিবানের শাসন। বিশ বছরের অপেক্ষার অবসান। মার্কিনি বিমানবহর আর সৈন্যেরা কোনওমতে ল্যাজ গুটিয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়েছে।

 

সালেমা জল আনতে বেরিয়েছিল। আপাদমস্তক কালো পোশাক চাপিয়ে। ত্রিশ বছর আগেও একবার বেত খেতে হয়েছিল সালেমাকে, সঠিকভাবে এই পোশাক না পরার জন্য। রাস্তায় বেরুনোর জন্য। সেই থেকে শরিয়ত সম্পর্কে সালেমা বুঝদার হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আরও বুঝতে পেরেছে, এমন শরিয়তের খিলাফে সামনাসামনি দাঁড়াতে গেলেপরে ‘হঠাৎ বিপ্লব’ চলে না। বিকেলের এই সময়টায় কালো পোশাক, শরীর ঢাকা পোশাক পরে বেরুনোটাই শ্রেয়ঃ। তাতে দীর্ঘমেয়াদে সালেমাদেরই সুবিধে। প্রকাশ্যে আনুগত্য দেখাতে পারলে সন্দেহের বোঝাটা খানিক পরিমাণে হলেও হালকা হয়।

 

সালেমা জলের লাইনে এসে দাঁড়ায়। ওপাশে তাকিয়ে সে রুবিকেও দেখতে পেল, আর রাবেয়াকে। দুই বোন। বয়স অল্প। রাবেয়া ওর দিকে তাকাল। বোরখার আড়ালে চোখের গতিবিধি ভালো করে বোঝা যায় না। সালেমা রাবেয়ার হাতের দিকে তাকায়। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারে। আলতো করে, খুব আলতো করে সে মাথা হেলায়।

 

বাবরের গত সপ্তাহে বাড়ি ফেরা হয়নি। কাবুল ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে সে দরোয়ানের কাজ করে। বাবর সালেমার স্বামী। বেচাল দেখলেদু’ঘা লাগিয়ে দিতেও কসুর করে না। ওর পায়ে একটা সমস্যা আছে। ডান পা’টা বাঁ’পায়ের থেকে সামান্য ছোট। কখনও পা ভেঙেছিল বোধহয়। নূরউদ্দিনের কল্যাণে বাবরের হোটেলের চাকরিটা হয়েছে। নূরউদ্দিন এই এলাকার মোল্লাদের মধ্যে হোমরাচোমরা; অসম্ভব নিষ্ঠুর আর তেমনই তার মেজাজ। বাড়িতে স্বামীর সঙ্গে মোল্লা-তালিবদের ওঠাবসা আছে জেনেও, কোন সাহসে ভর করে সালেমা যে ওই রুবি, রাবেয়া, হেনা, তামান্নাদের দলে নাম লিখিয়েছে সে খোদায় মালুম। সে যা হোক, আজ রাত্তিরেও বাবরের বাড়ি ফেরার সম্ভাবনা কম। সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন। রাত আরেকটু বাড়লে সালেমা বেরুবে। চাঁদ রয়েছে আকাশে। আলোর অসুবিধে হবে না। পাশের সারিটা ছেড়ে দুনম্বর সারিতেই রাবেয়াদের ঘর। আজকের আলোচনাটা রাবেয়াদের ঘরেই বসবে। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে সালেমা মোমবাতির আলোটা নিভিয়ে দেয়।

 

মেয়েদের মধ্যে তামান্নাই সবচেয়ে শিক্ষিত। এখানকার ইউনিভার্সিটিতে সে পোষ্টগ্র্যাজুয়েট করেছে। পিএইচডি করতে আমেরিকা যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার আগেই এসে পড়ল ১৫ই আগষ্ট, ২০২১। তালিব-জঙ্গিদের হাতে কাবুলের পতন ঘটল। ইউনিভার্সিটিতেও তালা পড়ল অনির্দিষ্টকাল। মাসদুয়েকের মধ্যেই মেয়েরা বুঝে গেল, তাদের পড়াশোনার ভবিষ্যৎ আপাতত অন্ধকার। তখনই তামান্না বা রাবেয়াদের মতো দু’একজন মহল্লাতে মহল্লাতে জোট পাকাতে শুরু করল। মেয়েদের শিখিয়ে পড়িয়ে তোলার জন্য গড়ে উঠল এমন একেকটা গোপন ‘আড্ডা’ঘর। আজ এর বাড়িতে, তো কাল আবার ওর বাড়িতে ক্লাস বসতে শুরু করল। বাড়ির পুরুষদের ইছে-অনিচ্ছে’র তোয়াক্কা না করে, কখনও বা জানিয়ে, কখনও বা লুকিয়ে মহল্লার মেয়েরা এমন সমস্ত ‘আড্ডা’তে এসে এসে জড়ো হতে শুরু করল। সালেমার ইতিহাসও তেমন। বিশবছর আগেকার তালিবানকে যারাই বা দেখেছে, আমৃত্যু তারা কোনওদিনও ভুলতে পারবে না সেই অন্ধকার। তামান্না সালেমার মেয়ে, বা বলা যেতে পারে নাতনিরই বয়সী প্রায়। সালেমার বয়স ষাট পেরিয়েছে। এমন অনেকগুলো আফগানি বসন্ত পেরিয়ে, সালেমার এখনও তবু খোলা হাওয়াতে শ্বাস নিতে ভালো লাগে। খোলা হাওয়াতে হাত পা ছড়িয়ে বাঁচতে ইচ্ছে হয়।

 

পড়াটা দিব্যি চলছিল। আজকের পড়ানোটা দারুণ ভালো লাগছিল সালেমার। সকলের পিছনে বসে গলা উঁচিয়ে সে তামান্নার পড়ানো শুনছিল। রাত অনেক। আজকে আর বেশীক্ষণ ক্লাস চলবে না। ক্লাস শেষ হওয়ার কথা ভাবলেই সালেমার মন খারাপ হয়ে যায়। সে একটু নড়েচড়ে, নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বসল। তামান্নাও তখন একটু থেমেছে, হঠাৎই সশব্দে দরজাতে কড়া নেড়ে উঠল কেউ। রাতের নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে সেই শব্দ যেন দূরে, অনেক দূরে অবধি কোথাও ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েরা সকলে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে। রুবি, রাবেয়ার বাবা আজকে বিশেষ কাজে শহরে গিয়েছেন। ওদের মা নেই। গোটা বাড়ি ফাঁকা থাকবে জেনেই, আজকের জন্য ওদের বাড়িতে এই ‘আড্ডা’ বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই রাত্তিরে হঠাৎ দরজাতে কড়া বেজে ওঠার অর্থ যে কি হতে পারে সেকথা আঁচ করেই সকলের মুখ তখন শুকিয়ে এতটুকু হয়ে এসেছে। আবারও দরজাতে সশব্দে কড়া নড়ে উঠল।

 

তামান্না সাহস করে গলা তুলল, “কে ওখানে এত রাত্তিরে ?”

ফ্যাসফ্যাসে কড়া গলায় উত্তর এল, “আমি বাবর। সালেমাকে নিতে এসেছি। দরজা খোল বলছি!” আবারও কড়া বেজে ওঠে।

“আচ্ছা আচ্ছা খুলছি,” তামান্না হতাশ চোখে সালেমার দিকে তাকায়। “বেশি মার খেও না যেন,” সালেমার হাতদুটো চেপে বলে তামান্না। সালেমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বোরখাটাকে মাথার উপরে জড়িয়ে নেয়।

 

[***]

 

প্রচণ্ড ভাবে মার খেল সালেমা। মাটির উপরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে থাকতে সে বুঝতে পারছিল মুখের জায়গাতে জায়গাতে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে গিয়েছে। ডান চোখটা প্রায় খুলতেই পারা যাচ্ছে না। এভাবে তো বাবর কোনওদিন ওকে মারেনি। একটু আধটু গায়ে হাত উঠলেও, এইভাবে! সালেমার মনে পড়ছে না। অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে। এখনও রাত বাকি। আকাশটা কি অল্প অল্প করে হলেও ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে ? তাদের বাড়ির দরজাতেও কড়া নড়ে উঠল। ঘোরের মধ্যে সালেমা প্রায় কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। দুজন এসেছে। মাটিতে পড়ে থাকা সালেমাকে দেখিয়ে বাবর কিসব যেন বলে যাচ্ছে। কথাগুলো শুনতে চেষ্টা করছিল সালেমা। বিশ্বাস হচ্ছিল না কোনওভাবেই। এখন ভোর।

 

গুলি-বন্দুকের আওয়াজ শোনাটা সালেমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আজ সকালেও তাই পরপর যখন গুলির আওয়াজে গোটা মহল্লাটা থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছিল সালেমার প্রথমটায় কোনও অস্বস্তি হয়নি। কিন্তু তার ঠিক পরেপরেই ওর মনটা হঠাৎ কু গাইতে শুরু করেছিল। গতরাত্রে বাবরের অস্বাভাবিক আচরণ, আরও গভীর রাত্রিতে তালিব জঙ্গিদের ওদের বাড়িতে হামলা, সকালের এই গুলির আওয়াজ, মনটা উত্তাল হয়ে উঠছিল সালেমার। সে বিছানা ছেড়ে কোনওমতে উঠতে চেষ্টা করল। পাশের ঘরে গিয়ে সে দেখল বাবর ওর পুরনো বাপের আমলের সিন্দুকটাকে, হঠাৎ শোয়ার খাটের তলা থেকে টেনে বের করে এনে, তার ভিতর থেকে কিসব যেন তুলে তুলে দেখছে। সালেমা নিঃশব্দে দরজার কাছ থেকে সরে গেল। বিকেল না হওয়া অবধি কিছুই করার নেই। জল আনতে বেরুলে হয়তো বা কিছু জানা গেলেও যেতে পারে। দম আটকানো এই নীরবতাই সবচেয়ে কষ্টের। শরীরের চেয়েও মনের যন্ত্রণাই অধিকতর অসহনীয় বলে বোধহয়। সালেমা তাই উপুড় হয়ে আবারও বিছানার উপরে লুটিয়ে পড়ল।

 

তামান্নাদের বারান্দায় অনেকগুলো ফুলগাছ ছিল; আর সেগুলো ছিল পুরনো মর্টারের শেলে বসানো। ফাটা অথবা না ফাটা মর্টারের শেল – গোটা কাবুল শহর জুড়েই অজস্র অজস্র হয়ে একসময়ে ছড়িয়ে থাকত। আবারও থাকছে। এই দেশ আফগানিস্তান, এই শহর কাবুল - কেবল যুদ্ধই দেখেছে। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ভেঙে যাওয়া একেকজন ক্ষমতাসীন মানুষ, একেকটা গোষ্ঠীর পিছনে নেমে আসা হঠাৎ আন্তর্জাতিক সমর্থন, হেকমতেয়ার, তালিবান, মুজাহিদিন। তামান্না এই মর্টারের শেলগুলোতে ফুল ফুটলে পরে বলত, ফ্লাওয়ার অব ওয়ার, যুদ্ধের কুসুম। সালেমা অবাক হয়ে ভাবত এই মেয়েটা কিছু কল্পনা করতে পারে। চারপাশের ধুলোময়, শব্দময়, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের মাঝে দাঁড়িয়েও এই মেয়েটা যেন কোনও এক অবাক উপায়ে সজীব থাকতে পারে। গলা শুকিয়ে আসত তার। কাল রাত্তিরে ওরা তামান্নাকেই তুলে নিয়ে গিয়েছে।

 

রুবি, রাবেয়াদের বাড়ি থেকে শেষ পর্যন্ত সকলেই বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু তামান্নাই সবচেয়ে দেরী করে বেরিয়েছিল। পথেই তালিবরা ওকে তুলে নেয়।

 

আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একেকটা গুলির শব্দ। সালেমা জলের বালতিটাকে আর বইতে পারছে না। খুব, খুব কষ্ট হচ্ছে তার।

 

বাড়ি এসে সালেমা দেখল বাবর বেরিয়েছে। বুকটা ধুকপুক করছিল। বাবর ফিরলেই কথাগুলো ওকে বলতে হবে। মানুষটাকে এত বছরেও সালেমা চিনে উঠতে পারল না। ওর সারা শরীরে যন্ত্রণা। চোখটা ফুলে রয়েছে এখনও। দেওয়ার মতো কোনও ওষুধও নেই। কিন্তু কিসের যেন এক অজানা উচ্ছ্বাসে ওর শরীরটা মাঝেমাঝেই কেঁপে উঠছিল। আবার পরক্ষণেই ভারী হয়ে আসছিল। গরম একটা হাওয়া উঠেছে। এই দেশ মরুভূমির দেশ। এখানে মহাদেশীয় জলবায়ু লক্ষ্য করা যায়। বাবর কখন ফিরবে ? আজকের দিনে এত বেলা অবধি বাড়িতে থেকেও সে হঠাৎ এখনইবা বেরুতে গেল কোথায় ?

 

ঘরে বসে থাকতে থাকতেই সালেমা শব্দটা শুনতে পেয়েছিল। রাস্তা দিয়ে কোনও একটা ভারী জিনিসকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে। ঘষটানির শব্দটা ওদের বাড়ির সামনেটায় এসে থেমে গেল। শার্শির ফাঁক দিয়ে সালেমা দেখল চারজন কালো পোশাক পরা জোয়ান ছেলে, হাতে আধুনিক রাইফেল। নিঃসন্দেহে তালিব। একটু দূরে দাঁড়ানো মাঝবয়সী লোকটাকেও সে চিনতে পারল। নূরউদ্দিন। চিৎকার করে সে বাবরকে কিছু জিজ্ঞেস করছে। মাটিতে লুটিয়ে থাকা অবস্থাতেও বাবর জবাব দিচ্ছে না। বন্দুকের বাঁটগুলো আছড়িয়ে পড়ছে। সালেমা ঠোঁটের উপরে দাঁত চাপল। রক্ত বেরুচ্ছে। নূরউদ্দিন কিছু একটা বলল কাছের ছেলেটাকে। কটকট করে গুলি ছুটে গেল। বাবরের দেহটা আরও একটু ন্যুব্জ হয়ে ওদের দরজার উপরে লুটিয়ে পড়ল। সালেমা কাঁদতেও ভুলে গেছে। অথচ ওরা কিন্তু বাড়ির ভিতরে এল না। নূরউদ্দিন বিশ্রী হেসে কিছু একটা বলল বাকি তালিবদের। ওরা চলে যাচ্ছে। সালেমা জ্ঞান হারায়।

 

সন্ত্রাস এভাবেই চারপাশ বেয়ে নেমে আসে। সন্ত্রাস এভাবেই তার রাজত্ব সাজায় ...

 

[সব গল্পেরই শেষে একটা চমক থাকে। এই গল্পেও থাকবে। আফগানিস্তান সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তাঁরা পঞ্জশিরের সিংহের বিষয়ে জানেন। হয়তো এও জানেন মার্কিনভূমে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে - ৯/১১র সেই কুখ্যাততম জঙ্গি-হামলার মাত্র দিনদুয়েক আগেই ছক কষে সাংবাদিক সেজে তালিব-জঙ্গিরা পঞ্জশিরের সিংহ আহমদ শাহ মাসুদকে খুন করেছিল। সোভিয়েত-বিরোধী মুজাহিদ গোষ্ঠী হিসেবে আহমদ শাহ মাসুদ এবং তাঁর দলবলকে আমেরিকা অস্ত্র জোগালেও, আহমদের মৃত্যু (অথবা বামিয়ান বুদ্ধের ধ্বংসপ্রাপ্তি) নিয়ে কখনই মার্কিন প্রভুরা বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। আসলে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রাখাটাই বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিগুলির একমাত্র উদ্দেশ্য – এই সহজ, সাধারণ সত্যটিকে আমরা বারেবারেই বিস্মৃত হই। কিন্তু বিগত প্রায় তিন-চার দশক ধরে তালিব মোল্লাদের বিরুদ্ধে আফগান প্রতিরোধের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছিলেন (বা উঠেছেন) এই আহমদ শাহ মাসুদ, এবং পরবর্তীতে তাঁর পুত্র আহমদ মাসুদ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন নর্দান এ্যালায়েন্স জোট। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, তালিবানদের বিরুদ্ধে মুজাহিদিন। আফগান ভবিষ্যৎ ... গতবছরেও পঞ্জশির প্রদেশকে আহমদ মাসুদ ও তাঁর নর্দান এ্যালায়েন্সের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে গিয়ে তালিবানকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু এভাবে আর কতদিন ? সালেমাদের কাছে কোনও উত্তর নেই।]

 

সালেমা ভাবছিল। ট্রাকের পিছনে বসে পালাতে পালাতে সে ভাবছিল। নিশার ওর পাশে বসে রয়েছে। এতবছর পর ছেলের গা ঘেঁষে বসে থাকতে থাকতে সালেমার কেমন যেন একটা বোধ হচ্ছিল। এই উথালপাথাল দেশের ইতিহাসে এমন সব আশ্চর্য ঘটনারই জন্ম হয়। যে ঘটনাপ্রবাহের কোনও শুরু বা শেষ থাকে না।

 

বাবরের পায়ে চোটের কারণটাও বিয়ের পরে আজ অবধি কোনওদিনও সালেমা জানতে পারেনি। আজ পারল। নিশার বলেছে বাবরও নাকি কম বয়সে মুজাহিদদের দলে নাম লিখিয়েছিল। ওর ওই পায়ের চোট আসলে গুলির জন্য। কিন্তু নিশার ঘরছাড়ার পরেপরেই - খানিকটা বাধ্য হয়েই বলা যেতে পারে, বাবর আশেপাশের তালিবদের সঙ্গে কিঞ্চিৎ সুসম্পর্ক তৈরিতে সচেষ্ট হয়েছিল। নিজের, সালেমার এবং হয়তো বা নিশারের নিরাপত্তার কথা ভেবেই। এতবছর পর পঞ্জশিরে লুকিয়ে থাকা ছোট মাসুদ এবং তার নর্দান এ্যালায়েন্সের সৈন্যরা যখন দাঁতে দাঁত চিপে তালিবদের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে, তাদেরই একটা গোপন অপারেশনের দায়িত্ব নিয়ে নিশার গতমাসে কাবুলে আসে। হোটেলে বাবর নিশারকে দেখে ফেলে। কি করে যেন নিশারই বাবরকে জানিয়ে দেয় যে তাদের মহল্লাতে রাত্তিরে তালিবরা তল্লাশি চালাবে।

 

তাই বাবর অত রাত্তিরেও তড়িঘড়ি করে ফিরে এসে সালেমাকে রাবেয়াদের বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাই সে সালেমাকে অমন চোরের মার মেরে তল্লাশি করতে আসা তালিব জঙ্গিদের বলেছিল, রাত্রে বাড়ি ফেরার পর বউ দরজা খুলতে দেরী করেছিল বলে অমনি ভাবে সে নিজের বউকে পিটিয়েছে। তালিব জঙ্গিরা তখনকার মতো সন্তুষ্ট হয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু বেশীক্ষণ নিশারের কাবুলে আসার খবর অথবা বাবরের সঙ্গে তার যোগাযোগ হওয়ার ব্যাপারটা চাপা থাকেনি। জানাজানি হওয়ার পরেই নূরউদ্দিন বাবরকে ডেকে পাঠায়। এরই মধ্যে জল আনতে চলে আসায় সালেমা সে খবর পায়নি।

 

জল আনতে এসে দূর থেকে লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল সালেমার। পরপুরুষের সঙ্গে খোলা রাস্তার উপরে কথা বলতে নেই। লোকটা তার পিছু পিছু আসছিল। গলিতে ঢুকতেই লোকটা পিছন থেকে এসে সালেমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ঝনঝনশব্দ করে জলের বালতিটা সালেমার হাত থেকে পড়ে গেল। তিরিশবছর আগেকার সেই আলিঙ্গন। সেই একইরকমের উষ্ণতা, নরম। বয়সটা তখন কম ছিল অনেক ... নিশার যেদিন ঘর ছেড়েছিল, সেদিনও বাবরকে ছাড়াই একলাটিই বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল সালেমা। সন্ধ্যে পেরিয়ে যাওয়ার পরেও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিল। ওই কারণেই সালেমার প্রথম বেত খাওয়ার অভিজ্ঞতা। তালিবরা তখন ক্ষমতার মধ্যগগনে। বাবর সালেমাকে কিচ্ছুটি বলেনি। কিচ্ছুটি জানতে দেয়নি। উলটে আরও আরও শাসন করেছিল। অদ্ভুৎ এই দেশের অন্ধকার। জড়িয়ে ধরা লোকটা সালেমাকে ছেড়ে দিয়ে আবারও চলে যেতেই, সালেমা টের পেয়েছিল লোকটা ওর হাতের ভিতরে একটা দোমড়ানো কাগজ গুঁজে দিয়ে গেছে। সেখান থেকেই এই ট্রাকে চেপে পালানোর খবর ... সালেমারা পালিয়ে যাচ্ছে।

 

আবারও একটা যুদ্ধক্ষেত্রের অভিমুখে পালিয়ে যাচ্ছে ...

 

তামান্নার ক্লাসগুলোকে সালেমার খুব মনে পড়ে। শেষদিন ওরা জেন অস্টেনের প্রাইড এ্যাণ্ড প্রেজুডিস থেকে পড়তে চেষ্টা করছিল। ইংরেজি শেখার ক্লাস। জেন অস্টেনের উপন্যাস। বাইরে রাত, অথবা দুপুর। আফগানি গ্রীষ্ম, আফগানি বসন্তকে সালেমারা চিরটাকাল ভালোবেসে এসেছে। দূরে, বহুদূরে সারি বেঁধে চলে যাওয়া একেকটা গিরিমালা, একেকটা নদীর অববাহিকা। নিজেদের দেশ, হু হু করে ছুটে আসা ধুলোর ঝড়। সালেমা, রাবেয়ারা আরও কতদিন, কতবছর ধরে এভাবে - এভাবেই ছুটে চলবে, কোনও হদিস নেই। কেবল তারা এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রের অভিমুখে পালিয়ে যায়। হু হু হাওয়াতে বালিয়াড়িরা সরতে থাকে। ইতিহাস অপরিবর্তিত থাকে।

 

সামনের ট্রাকটাও বিকট শব্দ করে থেমে গেছে হঠাৎ ...

লেখক  : গবেষক, প্রাবন্ধিক

ছবি  : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment