- 01 December, 2023
- 0 Comment(s)
- 264 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
অনেক আগেই বোধহয় এই বিষয়ে লেখা উচিত ছিল। হয়তো কোনও আলোচনায় বিচ্ছিন্ন ভাবে বিষয়টি এর আগেও উঠে এসেছে। কিন্তু সরাসরি নোবেল-মঞ্চে বিষয়টি যে এই বছরে স্বীকৃতি পেল, তা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন। কয়েকটি কথা শুরুতেই বলে নেওয়া জরুরি। প্রথমত, অর্থনীতি আমার বিষয় নয়। কাজেই বিশেষ যে দুইটি গবেষণাপত্রকে বেছে নিয়ে, যাদের ভিত্তিতে এই আলোচনা সাজাতে চেয়েছি, সেগুলি সম্পূর্ণ পড়ে বুঝতে গেলে যতখানি পূর্ব-জ্ঞান থাকা প্রয়োজন তা আমার নেই। কেবল রাশিতথ্য, সংখ্যা ও ইতিহাসকে মনে রেখে এই আলোচনার অনুচ্ছেদগুলিকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয়ত, সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে অনেকেই এখন ‘অর্থনীতিতে নোবেল’ বলে কোনও বিষয় বা বিজেতাকে উল্লেখ করলেই, “অর্থনীতিতে কোনও নোবেল নেই, ওটা আসলে অমুক পুরষ্কার,” ইত্যাদি বলে রে রে করে তেড়ে আসতে চান। সামাজিক মাধ্যম যে আদতে বহুদিন ধরেই এক খুল্লমখুল্লা মল্লযুদ্ধের আখড়াতে পরিণত হয়েছে সে বিষয়ে আমি সম্যক রকমে ওয়াকিবহাল। কাজেই, ‘অর্থনীতিতে নোবেল’ নয়, ২০২৩এর ‘Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences’ পুরষ্কারে ভূষিত গবেষক-অধ্যাপক ক্লদিয়া গোল্ডিনের গবেষণা-অবদান ইত্যাদি বিষয়েই এই পরিসরে সামান্য দু’চার কথা বলতে চাইব।
নারীর কথা যে পরিসরে বলা হয়, সেখানে দাঁড়িয়ে বিশেষ করে ক্লদিয়ার কথাই বা কেন? কেবল অর্থনীতিতে Sveriges Riksbank পুরষ্কার জিতেছেন বলেই নয়, ক্লদিয়ার আরও এক পরিচয় হল – ১৯৮৯ সালে, বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড স্কুল অব ইকনমিকসের ইতিহাসে, তিনিই প্রথম পূর্ণ-সময়ের মহিলা অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হন। এছাড়াও, এর আগে নারী হিসেবে মাত্র দুইজন অর্থনীতিতে Sveriges Riksbank পুরষ্কার জিতেছেন, এবং ক্লদিয়াই প্রথম যিনি একক ভাবে, মহিলা হিসেবে এই পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর গবেষণার বিষয় মূলত অর্থনীতির ইতিহাস ও সেই ইতিহাসের নিরিখে নারীর অবস্থান নির্ণয় করা। জটিল তত্ত্বের চেয়েও আর্থ-সামাজিক পরিসরে নারীর অবস্থান সঠিক ভাবে নির্ণয় করা, সংখ্যা ও যুক্তির সাহায্যে তাকে প্রতিষ্ঠা করা, তদুপরি এর ফলে আধুনিক সমাজব্যবস্থা ও মানসিকতার পরিবর্তনের পরবর্তীতেও বিশেষ করে পেশাগত ক্ষেত্রে কর্মী-নারী বা working femaleদের সঠিক অবস্থান কোথায়, সেই সমস্ত বিষয়গুলিকে সকলের সামনে গাণিতিক পরিসংখ্যানে তুলে আনতেই ক্লদিয়ার গবেষণা সাহায্য করেছে।
যে বিশেষ শব্দবন্ধটিকে বারংবার ক্লদিয়া গোল্ডিনের এই পুরষ্কারের প্রেক্ষিতে উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে, সেটি হল gender pay gap অথবা যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়াবে ‘পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য’। অনুবাদ অক্ষম হলেও সঠিক পরিভাষা না জানার কারণে আপাতত এটিকে নিয়েই কাজ চালাতে চাইব। ১৯৯১ সালে প্রথম অধ্যাপক গোল্ডিন এই বিষয়ে তাঁর গবেষণা প্রকাশ করেন। প্রায় ১০০ বছরের পূর্ব-ইতিহাস ঘেঁটে তিনি তথ্যের সাহায্যে দেখান, ১৮৯০ সালে যেখানে মোট বিবাহিত শ্বেতাঙ্গ মহিলা জনসংখ্যার মাত্র ২.৫% বাড়ির বাইরে কাজ করতে বেরুতেন, সেখানে ১৯৯০ সালে মোট বিবাহিত শ্বেতাঙ্গ মহিলা জনসংখ্যার প্রায় ৬০% বাড়ির বাইরে কোনও না কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত। লক্ষণীয় যে একই সময়ে দেখা যাচ্ছে, মোট বিবাহিত শ্বেতাঙ্গ পুরুষ জনসংখ্যার প্রায় ৭৮% বাড়ির বাইরে কোনও না কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ১৮৯০ সালে যে শতাংশের হিসেবটি ছিল প্রায় ৮২%। অর্থাৎ কাজের নিরিখে বা শ্রম-অংশগ্রহণের নিরিখে শতাংশের হিসেবে অতীতে সামাজিক ক্ষেত্রে মহিলা-পুরুষের যে বিপুল বিভাজন বা বৈষম্য ছিল, তা গত ১০০ বছরে অনেকটাই কমে আসতে পেরেছে। কিন্তু এরই পাশাপাশি অধ্যাপক গোল্ডিন আরও একটি তথ্য তুলে আনেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে (যে সময়ে বাড়ির বাইরে শ্রমদানের নিরিখে, মোট বিবাহিত শ্বেতাঙ্গ মহিলা জনসংখ্যার, অংশগ্রহণের শতাংশ ২০% থেকে বেড়ে ৫০%এ পৌঁছয়) সেই সময়েও একজন মহিলার সাপেক্ষে একজন পুরুষের গড় আয়ের যে অনুপাত তা কেবল ৬০%এর আশেপাশেই ঘোরাফেরা করেছে। অর্থাৎ, ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ – এই ত্রিশ বছরে শতাংশের হিসেবে মহিলাদের শ্রম-অংশগ্রহণ ৩০%এর কাছাকাছি বৃদ্ধি পেলেও পুরুষদের তুলনায় তাঁদের গড় আয় যতখানি কম ছিল (মহিলারা আয় করতেন পুরুষের গড় আয়ের ৬০%), তার বড় একটা ফারাক ঘটেনি। এখান থেকেই gender pay gap অথবা ‘পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য’এর ধারণার সূত্রপাত।
২০১০ সালের জুলাই মাসে অধ্যাপক গোল্ডিন আরও একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেই গবেষণা অনুসারে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সবধরনের এমবিএ পাঠ্যক্রমে ভর্তির নিরিখে, মহিলা ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪% থেকে ৪৩%এ। এমনকি এমবিএ ডিগ্রি লাভের পর, শুরুর সময়ে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও পুরুষ ও মহিলা পেশাদারদের পারিশ্রমিকের বিষয়ে তেমন একটা বৈষম্য চোখে পড়ছে না। কিন্তু ক্রমশ যত সময় বেড়েছে, সামাজিক পরিসরে বিভিন্ন বিষয়ের বিপরীতে একই সঙ্গে যুঝতে যুঝতে পুরুষের তুলনায় নারীর শ্রম-অংশগ্রহণের পরিমাণ কমে এসেছে। বেড়েছে gender pay gapএর হিসেব। পারিশ্রমিকের বিষয়টিতে যাওয়ার আগে কিভাবে সময়ের সঙ্গেও নারীকে যুঝতে হচ্ছে সেই বিষয়টিকেই আগে দেখা যাক বরং। আমরা জানি মাতৃত্ব থেকে শুরু করে সাংসারিক কাজ, (যার প্রায় সমস্তটাকেই আমরা ‘অবৈতনিক শ্রম’ হিসেবে ধরি, সামাজিক পরিসরে যার গুরুত্ব অসীম – এবং সেই গুরুত্বটুকুও অনেকক্ষেত্রে দেওয়া হয় না বলেই হয়তো বিশেষ ভাবে এই বিষয়গুলিকে আজকে ‘অবৈতনিক শ্রম’ বলে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন), তার প্রায় সমস্তটাকেই একা একজন নারীকে মাথায় বয়ে নিয়ে চলতে হয়। আজ সেই ‘অবৈতনিক শ্রম’এর সবকটি ক্ষেত্রকে যদি বা মোটামুটি সমান অনুপাতে, ব্যবহারিক ভাবে নারী ও পুরুষে ভাগ করে দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো নারীবাদীদের এভাবে ‘অবৈতনিক শ্রম’ শব্দবন্ধটিকে তৈরি করার প্রয়োজন পড়ত না। দেখা যাচ্ছে এমবিএ পরবর্তী ১৫ বছর সময়ের মধ্যে মাতৃত্বসুখ লাভ করা মেয়েরা পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় গড়ে ৮ মাস কাজ করেছেন। সেখানে মাতৃত্বের স্বাদ না পাওয়া বা না পেতে চাওয়া মেয়েরা গড়ে পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় ১.৫ মাস কম কাজ করেছেন। একই রকম ভাবে দেখা যাচ্ছে বিবাহিত ও সন্তান রয়েছে, এমন মেয়েরা গড়ে প্রতি সপ্তাহে পুরুষদের থেকে ২৪% কম সময় কাজ করেন। সেখানে বিবাহিত কিন্তু মা নন, এমন মেয়েরা গড়ে প্রতি সপ্তাহে পুরুষদের থেকে ৩.৩% কম সময় কাজ করেন। কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে সামাজিক ও জৈবিক কারণে এই সময়-বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে নারী-পুরুষের গড় আয়ের নিরিখে কতখানি বৈষম্য তৈরি হয়, আমরা কি তার খবর রেখেছি?
তথ্য বলছে, এমবিএ করার পর চাকরি শুরুর সময়ে একজন নারীর গড় পারিশ্রমিকের পরিমাণ থাকে ১,১৫,০০০ ডলার প্রতি বছরে। নয় বছর পর যা বেড়ে দাঁড়ায় গড়ে প্রতি বছরে ২,৫০,০০০ ডলারের কাছাকাছি। এর বিপরীতে, শুরুর সময়ে একজন একজন পুরুষের গড় পারিশ্রমিকের পরিমাণ থাকে ১,৩০,০০০ ডলার প্রতি বছরে। নয় বছর পর যা বেড়ে দাঁড়ায় গড়ে প্রতি বছরে ৪,০০,০০০ ডলার! এখানেই শেষ নয়, অভিজ্ঞতার নিরিখে আরও যত সময় যায় – ১০ থেকে ১৬ বছর অবধি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মেয়েরা যারা কি না কর্মক্ষেত্রেও সবচেয়ে উপরের দিকের কর্মচারী/আধিকারিকদের সমগোত্রীয় হয়ে উঠতে পেরেছে, তাদের গড় বার্ষিক আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪,৩৮,০০০ ডলার। একই স্তরের পুরুষ সহকর্মীদের বার্ষিক পারিশ্রমিক তখন ১০,০০,০০০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। আজ, ২০২৩এ দাঁড়িয়েও সারা পৃথিবীতে, গড়ে পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা একই কাজ করলেও ১৩% কম পারিশ্রমিকেই তাঁরা সেই কাজ করতে বাধ্য হন। ক্লদিয়ার গবেষণা এই সমস্ত অপ্রিয় তথ্যকেই পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত করেছে।
রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু এই তথ্যকে অনুধাবন করা জরুরি। ক্লদিয়া অথবা তাঁর সহযোগী গবেষকেরা প্রাথমিক ভাবে এই তথ্যকেই সামনে আনতে চেয়েছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এবারে শুরু হওয়া উচিত আরও নির্দিষ্ট করে এই ‘পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য’এর যে ঘটনা, তার সুনির্দিষ্ট কারণগুলিকে চিহ্নিত করা। কিভাবে, নারীর বিবিধ ও বিস্তৃত সামাজিক-সাংসারিক ভূমিকাগুলিকে মাথায় রেখে (বা আরও স্পষ্ট করে বললে, তাকে স্বীকৃতি জানিয়ে) এই ‘পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য’এর কিভাবে অবসান ঘটানো যায় – সেই সমাধান খুঁজতে সচেষ্ট হওয়া। ক্লদিয়ার গবেষণা আদতে বৃহত্তর আরও অনেক গবেষণারই এক সূচনাবিন্দুকে নির্দেশ করে মাত্র, যে পথ ধরেই আশা করব আমাদের আগামী অনুসন্ধান জারি থাকবে।
সূত্রঃ
[১] M. Bertrand, C. Goldin, L. F. Katz, ‘Dynamics of the Gender Gap for Young Professionals in the Financial and Corporate Sectors’, American Economic Journal: Applied Economics, Vol. 02, No. 03, July, 2010, pp. 228-255
[২] C. Goldin, ‘Gender Gap’, The Concise Encyclopedia of Economics, Ed. 1, Curated by the Library of Economics and Liberty, 1991
0 Comments
Post Comment