- 27 May, 2021
- 0 Comment(s)
- 1293 view(s)
- লিখেছেন : নার্গিস পারভিন
—মা, আজ রাতে চিলি-পনির আর ফ্রাইড রাইস চাই আমার।
— চাই মানে! একি তোমার রেস্তোরাঁ? যে, যা চাইবে তাই পেয়ে যাবে? আর এই লকডাউনের সময়ে এখন বাইরে বেরোনো যাবে না, এদিকে বাড়িতে পনির নেই।
—তাতে কি হয়েছে মা? তুমি তো দুধ থেকে ছানা কাটতে পারো। এইতো সেদিন, পাপা বলল, ‘রসগোল্লা বানাও তো, অনেক দিন খাইনা’, তুমি অমনি ছানা কেটে বানিয়ে দিলে। ঠাম্মা বলল, ‘ধোকার ডালনা বানাও’, তুমি বানিয়ে দিলে। রোজ রোজই ইডলি-ধোসা আরও কত কিছু বানাচ্ছো ব্রেকফাস্টে, ডিনারে, লাঞ্চে। আর আমি কিছু বললেই তুমি বল, ‘পারবো না’। অমিতা মনে মনে বলতে থাকে, (তোমার পাপার আর কি, ফরমাশ করলেই হল। ফাইফরমাশ করতে তো আর ভাবতে হয়না!)। তারপর বিলুকে বলে, বিলু, তোর দিদিনকে একবার হোয়াটসঅ্যাপ কলে ট্রাই করতো, তখন থেকে ফোনে পাচ্ছিনা। ওরা সব কেমন আছে কে জানে! বাজার ঘাট করতে পারল কিনা, কি রাঁধছে, কি খাচ্ছে ভগবান জানে! পাঁচটা বাজল! চা বসাই।
— হোয়াটসঅ্যাপ কল লাগছে না মা, অফলাইন দেখাচ্ছে।
অমিতা রান্নাঘর থেকে জবাব দেয়, আচ্ছা।
চায়ের জল ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বুদবুদের মত চিন্তা পাক খেতে থাকে অমিতার ভিতর। বাবা-মায়ের সঙ্গে অমিতার শেষ কথা হয়েছে দুদিন আগে। মা তো আর্থারাইটিস, স্পন্ডিলাইটিসে শয্যাশায়ী, বাবারও বয়স হয়েছে। এই দুঃসময়ে কীভাবে যে ওদের দিন কাটছে! হঠাৎ করে কিছু অসুবিধায় পড়লে, বা একটা ডাক্তারের প্রয়োজন পড়লে কী যে করবে ওরা! ভেজানো চা পাতা থেকে কাপে কাপে চা ছেঁকে নেয় অমিতা। ছেলের জন্য পেডিয়াসিওর বানিয়ে গ্লাসটা ট্রেতে উঠিয়ে নেয় সে। ট্রেতে সাজিয়ে নেয় চায়ের কাপ, বিস্কিটের প্লেটও।
—বিলু রান্নাঘরে এসে নতুন তথ্য পরিবেশন করার মত তার মাকে বলে, মা, তুমি নাকি ঘোষের মেয়ে?
—কি!
—আরে বাবা, পাপাকে চিলি-পনির এর জন্য পনির এনে দিতে বলছিলাম, তো তখন ঠাম্মি বলল চিন্তা করিস না বিলু, তোর মা ছানা কেটে নেবে। ঘোষের মেয়ে কিনা, এসব ভালো পারে।
—বিলু! সবসময় তুমি বড়দের কথায় থাকবে না। সবার সব কথা শুনবে না। ভাষার কি শ্রী হচ্ছে তোমার! ধমক খেয়ে বিলু কেঁদে ফেলে, আমি কী করলাম! তুমি কিছু হলেই আমাকে বকো, আমার দোষ নয় তাও আমাকেই বকো। আমি খাব না যাও পেডিয়াসিওর! আমি মাঠে খেলতে যাব, আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। পার্থ ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে, অমিতার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে অত ওভাররিঅ্যাক্ট করছ কেন? মা তো ইয়ার্কি করে বলেছে। শুধু শুধু ছেলেটাকে কাঁদাচ্ছো।
—হ্যাঁ, যা খুশি বললেই হলো, আটকাচ্ছে কে? (অমিতার চাপা স্বরে ক্রোধ)।
—উফ্, ছাড়ো। তর্ক ভালো লাগে না। সামান্য কথা নিয়ে বাড়াবাড়ি! মা কি ভাবছে বলোতো? মা পার্থর পিছনে, আমি কিছু ভাবছি না বাবু। তোমাদের কথার মাঝে হাসতে হাসতেও যে কিছু বলা যাবে না আজ বুঝলাম। পার্থ সামাল দেওয়ার মত করে বলে, ছাড়ো মা ওসব। তুমি ভুল কিছু বলোনি তো। মানুষ ইয়ার্কি, ঠাট্টা করবে না? চা নাও।
বিলু ঘুমিয়েছে? দেখে এলে? পার্থ কথা শুরু করে। অমিতা মোবাইলে কল ট্রাই করতে করতে শুধু বলে, হ্যাঁ। পার্থ জিজ্ঞাসা করে, মা ঘুমিয়ে গেছে? অমিতা শুধু বলে, না। চিলি-পনিরটা কিন্তু দারুণ করেছিলে। আজকের ডিনারটা জমে গিয়েছিল! ফাটাফাটি! অমিতার মৌনতায় বিরক্ত পার্থ, বিকেল বেলার সেই কথা এখনো ধরে রেখেছো! মা বয়স্ক মানুষ। সামান্য একটা মস্করা করেছে, তোমার সহ্য হচ্ছে না! পারোও বটে! ভুলে যেও না এই পার্থ ব্যানার্জির সঙ্গে অমিতা ঘোষের বিয়েটা কিন্তু মা খুশি হয়ে দিয়েছিল।
—জানি। আর সেজন্যই বোধহয় বারবার খোটা দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন! দেখো, আমার ঘোষ হতে কোনো আপত্তি নেই; বিয়ের আগে আমি অমিতা ঘোষই ছিলাম। কোনদিন লজ্জা বোধ করিনি। কিন্তু যে মানসিকতায় উনি বলেন সেটাতেই আপত্তি। যাই হোক সেসব নিয়ে আমি মন খারাপ করিনি। কোনো রাগও পুষে রাখিনি। দুদিন হল বাবা-মার খোঁজ পাইনি, ফোন লাগছে না তাই চিন্তায় আছি। অমিতা স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে, ভাবছি লকডাউনটা উঠে গেলে কিছুদিনের জন্য ওখানে যাব। পার্থ উত্তর দেয়, যাব বললেই কি আর যাওয়া হবে? লকডাউন উঠে গেলেই আমার অফিস শুরু হবে, বিলুর স্কুল।
অমিতা বলে বুঝতে পারছি, তবে বিলু এখন ছোট, কয়েকদিন স্কুল না গেলে অসুবিধা নেই। তুমি আর মা কয়েকটা দিন নিজেরা চালিয়ে নিও। আমি তো বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, আমাদের তো কিছু কর্তব্য আছে ওনাদের জন্য। পার্থর স্বর উষ্ণ, মায়ের অভ্যাস নেই, এখানে মা একা সামলাতে পারবে না। তাছাড়া এক্ষুনি কোনো হেল্পিং হ্যান্ডও বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। সেটা রিস্ক হয়ে যাবে।
অমিতা বিষণ্ণ, একমাত্র সন্তান হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব কর্তব্য ওদের প্রতিও আছে, তাই না? বাবার বয়স হয়েছে, মা বিছানায়, আমি তো ওদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না!
হতবাক পার্থ, এ আবার কি কথা! তোমার বিয়ে থা হয়ে গেছে, অন্য একটা রাজ্যে থাকো তুমি, আর কী করতে পারো? ব্যাঙ্গালোর কলকাতা এপাড়া-ওপাড়া তো নয়! তাছাড়া দূর থেকে যা যা করা সম্ভব তুমি তো করছো!
স্তম্ভিত অমিতা, যা যা করছি তা যদি সাফিসিয়েন্ট না হয়? পার্থর সোজা জবাব, দেখো বিয়েটা আমাদের সামাজিকভাবেই হয়েছে। তোমার এবং তোমার বাবা-মায়ের অমতে কিছু হয়নি। তুমি এখন এই পরিবারের, এই পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্ব কর্তব্য অনেক বেশি। সেগুলো ভুলে যেওনা, গুড নাইট।
অমিতা বুঝতে পারে, একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে সে। পার্থর সঙ্গে যখন বিয়ের সম্বন্ধটা আসে অমিতা তখন এম.এ ফার্স্ট ইয়ার, ইংলিশ। শিক্ষকতা করবে, স্বনির্ভর হবে এটাই ছিল স্বপ্ন তখন তার। বিয়ে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না তখনও। হঠাৎ এই প্রস্তাবটা এসেছিল বাবার বন্ধুর সূত্রে। আই.আই.টির স্টুডেন্ট, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব। কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায়নি অমিতার বাবা-মা। ওদের চাহিদা বলতে সুন্দরী, শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী, মৃদুভাষী পাত্রী। তবে চাকরি করা যাবে না, কারণ পাত্র নিজেই তার কেরিয়ারে ভীষণ সাকসেসফুল। তাই সংসারের সব দায়িত্ব অমিতার। এখন কী করবে অমিতা!
পার্থ ঘুমিয়ে পড়েছে। বিছানায় শুয়েও অমিতার চোখে ঘুম নেই। বয়স্ক দুটো মানুষ, একজন শয্যাশায়ী, অন্যজন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তার বাবা-মা! যাঁরা কিনা নিজেদের দুঃসময়ের পরোয়া না করে, অনায়াসে সবটুকু সুখ দিয়ে ভরিয়ে দিতে চেয়েছিল অমিতার প্রাপ্তির ঝুলি। অত করেও আজ কি অমিতা নিজেকে সুখী ভাবতে পারছে? একটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কখন ঘুমের অতলে তলিয়ে গেছে ক্লান্ত অমিতা সে জানেও না। হঠাৎই সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা সমুদ্রের মাঝে ! সন্তরণ রত। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে সাঁতরে সাঁতরে সে ভীষণ ক্লান্ত। প্রানপণে চেষ্টা করছে ঢেউয়ের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। সে আরও দেখলো, সমুদ্রের এক পাড়ে তার বাবা-মা দাঁড়িয়ে, তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে তারা। মুখে এক বিষণ্ণ হাসি। অন্য পাড়ে দাঁড়িয়ে পার্থ; এক অনুভূতিহীন উদাসীন দৃষ্টি তার চোখে। অমিতাকে মাঝসমুদ্রে রেখে, ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে দুই তীর! সরে যেতে যেতে ছোট হতে হতে একটা বিন্দুতে পরিণত হয়ে গেল তারা। এখন আর তাদের কাউকেই চিনতে পারছে না অমিতা!
পুনর্মুদ্রণ
ছবি: সংগৃহীত
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও ছোট গল্পকার
0 Comments
Post Comment