- 02 October, 2020
- 0 Comment(s)
- 933 view(s)
- লিখেছেন : সর্বাণী গুহ ঘোষাল
হাথরাসের মণীষা মরল। দেশ জানল আবার একটা ধর্ষণ জনিত মৃত্যুর খবর। আরো এক দলিত পরিবার মনুবাদী সামাজিক কাঠামোয় উঁচু জাতের ক্ষমতা দাখিলের অন্যতম কৌশল স্বাভাবিক ধর্ষণের অধিকার আর যৌন স্বেচ্ছাচারীতার ফলে একটা মেয়েকে হারাল। মেয়েটা বড় কষ্টে মরল। পুণ্যভূমি রাম রাজত্বে পুলিশ বড়কর্তা থেকে রাজনৈতিক ফড়েকে মর্যাদা পুরুষোত্তমের নামে শপথ নিয়ে দুধের রঙ কালো বলার ধাঁচে বলতে হল ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। (টিভিতে ভদ্রলোকের প্রেস ব্রিফিং দেখতে দেখতে ভাবছিলাম এখুনি না বলে বসে রেপ কী? কী করে হয়?) মিডিয়াকে শতহস্ত দূরে রাখার চেষ্টা চলল। ফরেনসিক জালিয়াতির জন্য বাজেট তৈরি হল। দলিতের ভাঙা বাসার সুরক্ষায় দুশো পুলিশ নামল।
ভীম আর্মি ও কিছু দলিত সংগঠন প্রতিবাদে রাস্তায় বসল। মায়াবতী স্বাস্থ্য সুরক্ষা সুবিধি মোতাবেক নিরাপদ দুরত্বে মাপা বিরোধিতা জানালেন। Women not capable being left free in India ঘোষণা করলেন রাজ্যাধিরাজ। দেবতার ছোট এই ভার্সানটি মেয়েদের শক্তিকে কীভাবে পরিচালিত করতে হবে তার নিদান দিতেও ছাড়েননি, যা প্রায়শই করে থাকেন ‘বেটি পোড়াও’ নীতির রূপকাররা।
এদিকে রাস্তার প্রতিবাদ থেকে সোশাল প্রতিবাদ সর্বত্র উঠে এসেছে এক ধরনের বিভাজন। প্রতিবাদীদের এক অংশ হাথরাসের নৃশংসতাকে নারীদের ওপর ঘটা সার্বিক অপরাধের অংশ হিসেবে দেখছেন। আবার প্রতিবাদী অন্য এক অংশ মণীষাকে নির্যাতনে মৃত দলিত মেয়ে হিসেবে তুলে ধরার পক্ষপাতী। প্রথম পক্ষের মত এই দেশ সমস্ত ধরনের মেয়েদের জন্যই ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। সেখানে সাধারণ ভাবেই মেয়েদের সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর। কাজেই মেয়েদের ওপর ঘটা অন্যায় আর হিংস্রতাকে যদি আমরা জাতপাত কী ধর্ম বর্ণের নিরিখে বিশ্লেষণ করতে যায়, আদতে নারীদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা, সমানাধিকারের বিষয়টাই দুর্বল হয়ে পড়বে। এই মতের সমর্থক বাম রাজনীতি বা মধ্যপন্থীদের মধ্যেও আছে। দক্ষিণ পন্থীদের মধ্যে তো অতি স্বাভাবিক।
প্রতিবাদী দ্বিতীয় গোষ্ঠী মনে করেন প্রথম প্রতিবাদী গোষ্ঠীরা আসলে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদেরই ধারক। কখনো প্রকট কখনো বা অপ্রকট ভাবে। যারা সীমিত প্রতিবাদ আর একীকরণের কৌশল প্রয়োগে দেশে সাবর্ণ মেজরিটেরিয়ানিজমকেই বৈধতা দেন কার্যক্ষেত্রে।
নিপীড়িত ও দুর্বল মানুষদের ওপর ঘটা অত্যাচারের আলোচনা যেমন সামাজিক-সাংস্কৃতিক নির্ধারক বাদ দিয়ে করলে ষোলো আনা ভুলের সম্ভাবনা, তেমনি নারী সমস্যাও কোনোভাবেই এই নির্ধারকগুলোকে সরিয়ে রেখে করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। এতে বিশ্লেষণ থাকবে অসম্পূর্ণ, প্রতিবিধানের প্রয়াস যাবে ঘেঁটে, মওকা বুঝে সুবিধেবাদী নেপোয় মারতেই থাকবে দই। যা চলছে নিরন্তর এই তিয়াত্তর বছরের অস্বাবলম্বী দেশে।
আমাদের দেশের এই বৃহৎ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নানাবিধ উপসম্প্রদায়ের স্বরূপটা ধরতে না পারলে দেশের আত্মাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যাবে না আর তার ফলে নিরন্তর দিকভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা। এখানে শ্রেণীর ভিতর উপশ্রেণী, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, জাত, ভাষার মধ্যের যে অজস্র বিভাজন, অসংখ্য ইন্টারসেকশন— সেগুলোকে উপযুক্ত গুরুত্ব না দিলে সম্ভব নয় ক্ষোভ প্রশমন আর যথার্থ ভাবে বৈষম্য দূরীকরণ। প্রসঙ্গত মনে রাখা যেতে পারে গত শতকের বামপন্থী আন্দোলন এদেশে একটা সময়ে বেশ বিস্তার পেয়েও পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয় শেষ পর্যন্ত অনেকটাই এই উপসম্প্রদায়ের প্রশ্নটিকে ঠিকমতো মোকাবিলা না করতে পারার জন্য।
মনে রাখতে হবে ধর্ষণ কখনোই ব্যক্তি পুরুষের আবেগগত বা যৌনতা জনিত অসংযম নয়। প্রতিটা ধর্ষণের ঘটনাই আদতে ক্ষমতা, আধিপত্য আর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার হাতিয়ার। বশ্যতা লাগু রাখার কৌশল। বিকাশশীল, স্বাধীনচেতা ও অনঅবদমনীয় যে কোনো প্রচেষ্টাকে ভেঙে দেবার মন্ত্র। আর এই জন্যেই হাথরাসের মণীষা নিধন কাহিনী যতবার বলব প্রতিবার ‘‘দলিত’’ মেয়ে শব্দটি ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে কোনো মেয়েই সুরক্ষিত নয় একথা মনে রেখেই। দলিত মেয়ে শব্দটির ব্যবহার ঠিক ততটাই দরকার যতটা ধর্ষক হিসেবে রাম, লবকুশ, সন্দীপ ঠাকুরের নাম ব্যবহার করা। পরিপূর্ণ ভাবে জেনে যে সমস্ত ধর্ম বর্ণ ভাষা, আর্থিক সঙ্গতির পুরুষ ধর্ষণে লিপ্ত হয় আর সমস্ত মেয়েই ধর্ষিত হয়, সামাজিক সব ক্যাটিগরি নির্বিশেষে।
দলিত মেয়ে শব্দটি ব্যবহার দরকার নানা ধরনের ক্ষমতা বৈষম্য চিহ্নিতকরণের জন্যে। ধর্ষণ ব্যক্তি পুরুষের অপরাধ অবশ্যই, কিন্তু তার সামাজিক রাজনৈতিক তাৎপর্যটা মাথায় রাখতে হবে। ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায় বারবার যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা উঠে এসেছে তা হল শিক্ষা দেবার প্রবণতা। একক ধর্ষণে অনেক সময়ে একক ভাবে মেয়েটি বা তার পরিবারকে ঢিট করার বা শিক্ষা দেবার প্রবণতা থাকলেও গণধর্ষণ সাধারণ ভাবে পুরো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে শিক্ষা দেবার সুস্পষ্ট বার্তা থাকে। আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই যে মুহুর্তে গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের বিষয়টা জড়িয়ে যায় অপরাধীদের নিজেদের স্বপক্ষে সমর্থন জোগাড় করতে সুবিধে হয়।
হাথরাসের মণীষা বাল্মীক সম্প্রদায়ের মেয়ে। জাতপাতের নিক্তিতে যারা নাকি মহাদলিত। মেয়েদের যেখানে ঘর থেকে বেরোনোর অধিকারটুকুও দেয় না সমাজ। আর সেকারণেই মণীষা নিধন পর্ব এই সমাজ আর সম্প্রদায়ের আলোচনা ছাড়া পূর্ণতা পাবে না। ধর্ষণের মুক্তাঙ্গন উত্তরপ্রদেশে আমরা দেখেছি কীভাবে ২৯শে সেপ্টেম্বরের নারকীয় ঘটনার পর থেকেই রাষ্ট্রীয় সাবর্ণ পর্ষদ দোষীদের আড়াল করতে সক্রিয়, অবশ্যই প্রশাসনিক সহায়তায়।
এছাড়াও, দলিত বা অন্যান্য যে কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষের প্রতি ক্ষমতাভোগী ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির ধারকবাহকরা এক ধরনের natural impunity বা স্বাভাবিক দায়মুক্তির মনোভাব পোষণ করেন। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একধরণের অন্যীকরণ বা otherization এর ধারণা। আর নিঃসন্দেহে এই অন্যীকরণের বোধ সম্পৃক্ত সমাজে ন্যায় বা সমানাধিকারের মূল্যবোধকে আমরা নিজেরাই বারবার অস্বীকার করি। সংবিধানের ১৫ নম্বর ধারাকে মিথ্যে করে তুলি।
যে কোনো ধর্ষণ আর তদজনিত হত্যা নৃশংস, নিন্দনীয় আর কষ্টের। তবু বুকে হাত রেখে নিজেকে প্রশ্ন করুন ২০২০-তে হাথরাসের মণীষা, ২০১২-র দিল্লির নির্ভয়া, ২০১৯-এর হায়দ্রাবাদের প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি, ২০১৮-র কাঠুয়ার নাবালিকা আসিফা বানু, ২০০৫-এর মুজফ্ফর নগরের ইমরানা অথবা ২০০৬-এর মহারাষ্ট্রের ভান্ডারা জেলার দলিত মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ভুতমাঙ্গে আর তার মায়ের ধর্ষণের ঘটনা আর তারপরে মা মেয়ে আর প্রিয়াঙ্কার দুই নাবালক ভাইকে কেটে নালায় ভাসিয়ে দেবার ঘটনা, এই প্রতিটা ঘটনায় আপনি নিজে কি মানসিক ভাবে সমান পীড়িত হয়েছেন? আপনার ক্ষোভ কি সমান ছিল? আচ্ছা হায়দ্রাবাদের প্রিয়াঙ্কার কেসে যতটা সীমিত প্রতিবাদে অভিযুক্তদের নিকেষ করা গেল নির্ভয়া কেসে বিচারালয়ের রায় থাকা সত্ত্বেও তার প্রয়োগে অত সময় লাগলো কেন? এই প্রত্যেকটা কেসে রাষ্ট্রের ভূমিকাগত তারতম্যও যে কোনো ধর্ষণ সংক্রান্ত আলোচনায় গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করা দরকার। একই সঙ্গে আক্রান্ত আর অভিযুক্তর সামাজিক অবস্থানও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আর এই তফাৎগুলো যতদিন রাষ্ট্রের তরফে থাকবে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনায় রাষ্ট্রীয় মদতে মান্যতা পাবে, ততদিন মণীষার ধর্ষণের ঘটনাকে আমরা শুধু নারী ধর্ষণ না বলে দলিত মেয়ের ধর্ষণই বলবো।
লেখক :অধ্যাপক
ছবি: নেট থেকে সংগৃহীত—পুলিস পাহারায় মণীষার শেষকৃত্য।
0 Comments
Post Comment