- 10 May, 2022
- 0 Comment(s)
- 981 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
কয়েক বছর আগে আমরা বন্ধুরা বেড়াতে গিয়েছিলাম আরেক বন্ধুর বাড়ি। খুব হইচই করে একটা দিন কাটল। পরেরদিন সকালে যে বন্ধুর (ছেলে) বাড়ি গিয়েছিলাম সেই বন্ধু বাসনকোসন পরিষ্কার করছিল, সেইসময় আমাদের আরেক বন্ধু সহসা তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠে— 'সকালে উঠে মেয়েদের মতো বাসন ধুতে বসেছিস কেন!' অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে আমাদের উচ্চশিক্ষিত বন্ধুর মানসিকতা মান্ধাতার আমল থেকে চলে আসা পিতৃতান্ত্রিক ছকে বাঁধা আছে। সমাজ নির্ধারিত শ্রম বিভাজনের মধ্যে রান্না, ঘরকন্নার কাজ, বাসন পরিষ্কার, খাবার পরিবেশন করা এই কাজগুলো নারীর কাজ। গৃহস্থালির কাজ নারীদের, বাইরের কাজ পুরুষদের। নারীর কাজ এবং পুরুষের কাজ বলে সমাজ যে গণ্ডি নির্ধারণ করে দিচ্ছে এই কর্ম বিভাজনের ফলে কিন্তু নারীকে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার শিকার হতে হচ্ছে। অবশ্য এই ব্যাপারে নারীরা কতটা সচেতন সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে! অফিসের কাজ করে নাভিশ্বাস উঠলেও, অনেক নারী দশটা পদ রান্না করে পতিসেবা করছেন। সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে সেই অদ্ভুত ন্যাকাপনা প্রায় রোজ দেখছি। এছাড়াও আজকাল বেস্ট হোমমেকার, বেস্ট মম ব্লগার, ভ্লগারদের দৌরাত্ম বেড়েই চলেছে। বোঝা যাচ্ছে, অত্যাধুনিক মোড়কে সেই পুরনো নিমের পাচন গিলতে মন্দ লাগছে না নারীদের! যথারীতি মনে প্রশ্ন জাগে সমাজ নির্ধারিত কাজের হাত থেকে কবে মুক্তি পাওয়া যাবে?
ঘরের কাজ জানেনা এবং শিখতে চায়না এরকম অসংখ্য দাম্ভিক পুরুষ অহরহ দেখা যায়। তারা কাজ শিখতে আগ্রহী নন। তাহলে নারীর কাজ, পুরুষদের কাজ বলে সত্যিই কি ভিন্ন কিছু হয়? কেন এই বিভাজন? বেশিরভাগ পুরুষ মা, স্ত্রীদের উপর নির্ভরশীল থাকেন। তারা রাঁধতে পারেন না, কাপড় কাঁচতে পারেন না, বাসন ধুতে পারেন না, ঘর গোছাতে পারেন না, সেলাই করতে পারেন না। কেন পারেন না সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে, এখানে বলে রাখা দরকার কোনও নারীও যদি এইসব আবশ্যক কাজগুলি করতে না পারেন, শিখে নিন। যদি শিখতে না পারেন তবে সাহায্যকারী রাখুন, বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসুন। নারী আন্দোলন, নারী অধিকার, নারী নির্যাতন নিয়ে লম্ফঝম্প করে, নারীবাদী সেজে নিজের আবশ্যক কাজগুলি অনুগ্রহ করে মায়েদের দিয়ে করাবেন না।
নারীপুরুষের শ্রমবিভাজন কিন্তু শুরু হয়ে যায় বাচ্চার গর্ভস্থ অবস্থা থেকে। আমরা অসেচতন ভাবে এই কাজটি শুরু করি। ২০০৯ সালের বিখ্যাত সিনেমা 'থ্রি ইডিয়টস' এ দেখেছি গর্ভস্থ শিশু পেটে বেশি লাফাচ্ছে বলে তার লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়েছিল ছেলে শিশু হিসাবে, সেই একইভাবে বাস্তব জীবনে গর্ভস্থ শিশু বেশি নড়লে ছেলে শিশু, কম নাড়াচাড়া করলে মেয়ে শিশু হিসাবে গণ্য করা হয়। সচেতন ভাবে কোনও বাবা-মা মেয়ে বা ছেলে শিশুদের আলাদাভাবে দেখেন না, কিন্তু তাদের আচরণের মধ্যে দিয়ে বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। জামাকাপড়, রং, খেলনা— সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়। বাচ্চাদের আমরা কেমন ধরনের গল্প শোনাচ্ছি, কোন কার্টুন দেখাচ্ছি, কেমন ধরনের খেলনা দিচ্ছি এ সমস্ত কিছু একটা শিশুর বেড়ে উঠতে এবং ভবিষ্যতে তাদের কোনও কিছুর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আমেরিকার কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্রিস্টিয়া ব্রাউন জানাচ্ছেন— "পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে আমরা দক্ষতা বাড়ানোর উপযোগী খেলনা দিয়ে সেই দিকে পথ চলার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছি। ফলে সেভাবেই তাদের দক্ষতা ও আগ্রহ বিকশিত হচ্ছে বাবামায়েরই উৎসাহে।" (তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা, ৯/৬/২০২১)
আবার ক্রিস্টিয়া বলেছেন—"ছেলেরা খুব শিশু বয়সে ঘর সংসারের কাজে আগ্রহী থাকে। খেলনা পুতুল নিয়ে খেলার মধ্যে দিয়ে ছেলেরাও দেখায় যে তারাও দেখাশোনার কাজে আগ্রহী, কিন্তু আমরাই তাদের শেখাই এগুলো 'মেয়েদের কাজ', ছেলেরা পুতুল নিয়ে খেললে আমরা বিরক্ত হই, তাদের তিরস্কার করি।"
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শিশু ছোট থেকে দেখে মা ঘরের সমস্ত কাজ করছে। ফলে একটি শিশু ছোট থেকে জেনে যায় যে সংসারে কোন কাজের দায়িত্ব ছেলেদের কোনটা মেয়েদের। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জায়গায় মেয়েলি এবং পুরুষালি কাজের তকমা আঁটা থাকে। মেয়েলি কাজ যেহেতু লজ্জাজনক তাই সেই সকল কাজ যেন শিশু পুত্রটি না করে সেইদিকে নজর রাখা হয়, আবার সেই একই ভাবে মেয়েদের শক্তিশালী কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। আবার পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই সমস্যা তৈরি হয়। কোনও শিশুপুত্র মেয়েদের জামাকাপড় পরতে চাইলে, অভিভাবকরা অসন্তুষ্ট হন। আবার কন্যাসন্তানের পুরুষালি আচরণ— যেমন গাছে চড়া, বাইক চালানো, ক্রিকেট, ফুটবল খেলাকে অনেক অভিভাবক প্রশয় দেন কিন্তু পুত্র সন্তানের মেয়েলি আচরণ সমস্ত অভিভাবককে লজ্জিত করে। আজ অবধি কোনও অভিভাবককে গর্ব করে বলতে শুনেছেন আমার ছেলে অসাধারণ সোয়েটার বুনতে পারে! কারণ সোয়েটার বোনা মেয়েলি কাজ হিসাবে তকমা পেয়েছে।
মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, মেয়েদের থেকে ছেলেরা শক্তিশালী এই ভাবনা শিশুমনে গভীর প্রভাব ফেলে। ফলে, পুরুষরা মনে করেন তাদের পৌরুষ অবলীলায় নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাতে পারে।
একটু আগেই বলেছি, আমাদের সমাজ নারীর কাজ, পুরুষের কাজ ভাগ করে দেয়, ফলে ছেলেদের ঘরের কাজ করতে হবে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে তারা বাহানা দেন— 'ঘরের কাজ পারি না, বাইরের কাজে অভ্যস্ত', 'মেয়েদের কাজ কেন করবো', 'কখনো এই রকম কাজ করিনি, ফলে প্রশ্ন নেই ঘরের কাজ করার', 'ধুর, এইসব কাজ করার অভ্যাস নেই।' এইরকম হাজার হাজার অবান্তর অজুহাত পুরুষেরা একের পর এক দিয়ে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে পুরুষদের সর্বৈব দোষ দেওয়া যায় না। একটি পরিবার শিশুপুত্রকে বিশেষভাবে বড় করে তোলে। যেহেতু আমাদের সমাজে মায়েরা শিশুদের প্রাইমারি কেয়ার গিভার তাই তাদেরকে সচেতন ভাবে বাচ্চাকে বড় করে তুলতে হবে। সেকেন্ডারি কেয়ার গিভার বাবা। তাকেও কিন্তু দক্ষ হাতে শিশুদের মনে কখনো যেন ভেদাভেদ না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অভিভাবকরা ছোট থেকে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা কাজের ভাগ করবেন না। মেয়েকেও যে কাজ শেখাচ্ছেন, ছেলেকেও সেই কাজ শেখান। ভাইবোনের কাজের মধ্যে কখনোই বৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। কাজে কোনও নারীপুরুষ ভেদ নেই, সকলেই সব কাজ করতে পারেন এই চেতনা সবার মনের মধ্যে গেঁথে দিতে হবে। আগামীর শিশুরা ভেদাভেদহীন পৃথিবীতে নিজের মতো করে বেড়ে উঠুক। এরজন্য শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন। কেবল মেয়েরা কেন, ছেলেরাও গার্হস্থ্যবিজ্ঞান পড়ুক।
কিছুদিন আগে জনপ্রিয় এক হিন্দি সিরিয়ালে (ক্রাইম পেট্রল ) সংলাপ শুনেছিলাম অনেকটা এইরকম— 'মেয়ে হয়ে যেহেতু জন্মেছো তাই তোমার সার্থকতা গোল রুটি তৈরি করাতে।' খুব অদ্ভুতভাবে সেই একই সংলাপ শুনলাম মুর্শিদাবাদের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর মুখে। তার ইচ্ছা নেই, তাই কোনও প্রকার ঘরের কাজ সে শেখেনি, এখানেই তার প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনদের আপত্তি। তাদের বক্তব্য মেয়ে হয়ে জন্মেছো, তাই তোমাকে তো ঘরকন্নার কাজ জানতে হবে! কিন্ত আজকের মফস্বল প্রজন্ম অনেক এগিয়ে আছে, তাদের হাতে ইন্টারনেট, দেশবিদেশের সমস্ত খবর তাদের নখদর্পণে। কেউ স্বপ্ন দেখে ভাল রেজাল্ট করে সাউথ কোরিয়া BTS এর কনসার্ট শুনতে যাবে, কেউ স্বপ্ন দেখে নার্সিং নিয়ে পড়তে বিদেশ যাবে, আবার কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে পাইলট হবে, এরকম অসংখ্য স্বপ্ন দেখতে থাকুক আমাদের মেয়েরা, ডানা মেলে উড়ে যাক আমাদের প্রজাপতিরা।
গোধূলির আলো ল’য়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা,
স্বপ্ন দিয়ে দুই চোখ একা-একা রেখেছে সে ঢাকি;
আকাশে আঁধার কেটে গিয়েছে যখন ভোর-বেলা
সবাই এসেছে পথে- আসে নাই তবু সেই পাখি!-
নদীর কিনারে দূরে ডানা মেলে উড়েছে একাকী,
ছায়ার উপরে তার নিজের পাখায় ছায়া ফেলে
সাজায়েছে স্বপনের ’পরে তার হৃদয়ের ফাঁকি!
সূর্যের আলোর ’পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে
সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তার ফেলেছে সে মুছে অবহেলে! (অনেক আকাশ, জীবনানন্দ দাশ)
পুনঃপ্রকাশ
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment