ফেয়ারওয়েল

  • 11 November, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 231 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
হঠাৎ শ্রীতমার মনে হয় টেবিলের দৈর্ঘ্যটা যেন বেড়ে গিয়েছে। লম্বা হয়ে কাঠ ফেঁপে উঠেছে। বর্ষায় যেমন হয়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। সুরেন্দ্রর চেহারাটা কেমন যেন আবছা হয়ে এসেছে। সুরেন্দ্র হাত বাড়িয়ে শ্রীতমাকে কনগ্র্যাচুলেট করে। ডালের বাটির উপরে বৃষ্টি পড়ছে। মাংসের ঝোলের বাটিটাকেও আর দেখা যাচ্ছে না। ছোটগল্প ‘ফেয়ারওয়েল’ ...

-“কাজটা ছেড়ে দিলে শ্রীতমা? পে হাইকটা তো এই বছরেই দিয়ে দিতাম।” শ্রীতমা নন্দী কাজ ছাড়ছে শুনে তার সুপারভাইজার সনাতন দত্তের এটাই প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল। “আরও ভালো কোনও অফার পেয়েছ বুঝি?”

-“ঠিক তেমন না, একটু নিজেকে সময় দেব ভেবেছি,” ছোট্ট করে শ্রীতমার জবাব। সনাতনের মাথায় ঢোকে এবার, “আচ্ছা! শ্বশুরবাড়িতে কিছু বলেছে বুঝি? তা বেশ, তা বেশ। দায়িত্ব তো একটা থেকেই যায়। তোমারও তো অনেকদিন হল,” সনাতন মাথা নাড়ে। শ্রীতমা থামিয়ে দেয়।

-“অনেক কোথায়? আমার বয়স তো মোটে বত্রিশ, তার মধ্যে চাকরি করেছি সাত বছর।” সনাতন একবার শ্রীতমাকে পা থেকে মাথা অবধি মেপে নেয় চট করে। তার দৃষ্টিতে লোলুপতা নেই। কিন্তু এমন একটা সুযোগ সেই বা ছাড়বে কেন। শ্রীতমা মনে মনে হাসে। অস্বস্তি হয় না তার। মানুষ হিসেবে, সুপারভাইজার হিসেবে সনাতন লোক খারাপ নয়। কোনওদিন কোনওরকম আজেবাজে কাজ করতে বলেনি। শ্রীতমাকে কাজ শিখিয়েওছে সে নিজে হাতে করেই। সাহায্য করেছে খুব। সনাতন না থাকলে সাত বছরের মধ্যে আর্থিক ভাবে শ্রীতমা - এতখানিও সবল হতে পারত না।

-“কবে থেকে আসবে না বলছ?” সনাতন কাজের কথায় চলে যায়। কোভিড-পরবর্তী সময়ে আবেগের চেয়ে আর্থিক লাভের গুরুত্বই প্রত্যেক কোম্পানির কাছে প্রধান হয়ে উঠেছে। ছোট কোম্পানিগুলোর ভিতরে অনেক সময়ে যে ছোট ছোট পরিবারের মতো আন্তরিকতা গড়ে উঠতে পারত, এখন তার দিন ফুরিয়েছে একেবারেই। শ্রীতমাও তো তাই চেয়েছিল। অল্পকথায় কাজ মিটিয়ে সনাতনের কেবিন থেকে সে বেরিয়ে আসে। খবরটা চাউর হতে সময় লাগবে না। বেয়ারা সুকুমার এরই মধ্যে তিন নম্বর টেবিলে গিয়ে অনুরূপাদি আর সুরভি ম্যাডামের সঙ্গে চাপা গলায় কথা বলতে শুরু করেছে। শ্রীতমা মনে মনে হাসে আবার। নিজের টেবিলে গিয়ে বসে। কাজগুলোকে গুছিয়ে নেয়। আর তো মাত্র পনেরো দিন।

... নোটিশ পিরিয়ডটা একটু কম হয়ে গেল বোধহয়। তাহলেও সনাতন আপত্তি করেনি। এতকিছু ভাবারও সময় নেই। লাঞ্চ শেষ হতে না হতেই প্রেয়সী আর সৌরভ এসে ধরল শ্রীতমাকে।

-“ওয়াও শ্রী কনগ্র্যাচুলেশনস ইয়ার! একবারও বলনি আমাদের যে তুমি পেপার ফেলে দেবে?” সৌরভ ওর টেবিলের কোণাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখে ঝলমলে হাসি।

-“সত্যি শ্রী, আমাদেরকে তো এ্যাটলিস্ট বলতে পারতিস। কোথায় লাগালি রে? চ্যাটার্জী এ্যাণ্ড চ্যাটার্জীতে লোক নিচ্ছে শুনছিলাম? ওখানেই?” প্রেয়সীর গলায় স্পষ্ট কৌতূহল।

পাশের টেবিল থেকে সুরভির গলা ভেসে আসে, “অগর পুছনে সে ভি ও কেয়া বতায়েগা তুমকো - ইতনি আসানি সে? ইয়ে কম্পিটিশন কে জেনারেশন হ্যায় ভাই, কম্পিটিশন কে জেনারেশন!” সুরভির এই কোম্পানিতে পনেরো বছর হয়ে গেছে। স্বামীর গাড়ি ভাড়া দেওয়ার বিজনেস। চাকরি না করলেও চলে। কথাটা সে মাঝেমাঝেই আর সকলকে মনে করিয়ে দেয়। “অওর উসকি মরদ তো ভি আচ্ছা কাম করতে হ্যায় না, নৌকরি আচ্ছা হ্যায়। লড়কিওঁ কি কাম করনা তো সির্ফ অপনি টাইমপাস করনে কে লিয়ে হোতা হ্যায়, হ্যায় না?” সুরভি এবারে ডাগর ডাগর চোখ তুলে পান খেয়ে লাল করা ঠোঁটে ওদের সকলের দিকে তাকায়, “কেয়া ম্যায়নে কুছ গলদ বোল দিয়া কেয়া?” শ্রীতমা হেসে তাকায়, “আরে নেহি নেহি। আপনে বিলকুল সহিবাত বোলা হ্যায় দিদি। সত্যিই তো আমরা কাজ করি নিজেদেরই খুশির জন্য। প্রথম শর্ত তো সেটাই,“ সুরভির মনে সে আঘাত দিতে চায় না। সৌরভ আর প্রেয়সী মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

-“বলতে না চাস তো বলিস না ভাই,” প্রেয়সীর গলায় স্পষ্ট অবজ্ঞা, “দেখি আমিও দুচার জায়গায় সিভি ফেলে রেখেছি। লেগে গেলেই ফেলে দেব কাগজ।” সে নিজের টেবিলের দিকে পা বাড়ায়।

বিকেলে ক্যান্টিনে চা খেতে যাওয়ার সময় তার কানে আসে, লেডিস টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে অনুরূপাদি, স্বাগতদা আর প্রিয়াংশু কথা বলছে। সুকুমার সনাতনের কেবিনের বাইরে থেকে টুলে বসে, গলা বাড়িয়ে কান পেতে সেগুলোকে আবার শুনতে চেষ্টা করছে। শ্রীতমা গায়ে মাখে না। কিছু কিছু টুকরো শব্দ ওরও কানে ভেসে আসে। অনুরূপাদিই বলছিল বেশিরভাগ। গলা অস্পষ্ট হলেও বোঝা যাচ্ছিল সেসব।

-“আরে দ্যাখ না গিয়ে সনাতন স্যার আবার কিছু করেছে কি না। গত শনিবারে তো ওভারটাইম ছিল মেয়েটার। আমারও দেখে ভালো লাগছিল না। একে তো সেদিন গরম ছিল প্রচণ্ড, তারই মধ্যে ওইটুকু মেয়ে – তাকেই কি না আটকে রেখে দিয়েছিল বিকেল পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা অবধি। আমরা তো চারটেয় বেরিয়ে যাই। আগের সেই মেয়েটা, কি যেন নাম – নন্দিনী স্যান্যাল, তাকেও তো একইরকম ভাবে চলে যেতে হয়েছিল।” মাস দুয়েক আগে কাজে যোগ দেওয়া প্রিয়াংশু হাঁ করে কথাগুলোকে গিলতে চেষ্টা করে। “সে নাহয় নতুন ছিল, তাই বলে সাত বছর ধরে কাজ করছে একটা লোক। তার সঙ্গে এমন কেউ করে কখনও? হাইক তো দিবি  বড়জোর তিনশো কি সাড়ে তিনশো টাকার। তার আবার কথা!” অনুরূপাদি নিজের বৈবাহিক জীবনের অপ্রাপ্তিগুলোকে অফিসচত্বরে মিটিয়ে প্রমোশন বাগানোর চেষ্টা করে। এরজন্য সনাতনকে ধরে তার কোনও সুবিধা হয়নি। সে গিয়ে পাকড়েছে তারও উপরে মালিকের ডানহাত, কোম্পানির পনেরো শতাংশ শেয়ারের পার্টনার অবিনাশ অগ্রবালকে। খানিক তেষ্টা মিটেছে। কিন্তু পুরোপুরি সে এখনও সন্তুষ্ট নয়। কাজেই মাঝে মাঝেই তার ঝালটা গিয়ে পড়ে সনাতনের উপর। টেবিলে বসতে বসতে শ্রীতমার গা ঘিনঘিন করে ওঠে। আর তো মাত্র পনেরো দিন। সে কম্পিউটারের দিকে মুখ ফেরায়।

অফিস থেকে সে বেরিয়ে এসেছে। শেষ নভেম্বর। শীত পড়ে গিয়েছে। হালকা হালকা হাওয়া দিচ্ছে। এই সময় অফিস চত্বর থেকে বেরিয়ে একটু দূরে একটা বিশেষ চায়ের দোকানে এক ভাঁড় করে চা খায় শ্রীতমা। অফিস থেকে হেঁটে দুতিন মিনিট। মেট্রো স্টেশনে যাওয়ার পথেই পড়ে দোকানটা। বড় ভালো চা করে এখানে। খেতে খেতেই শ্রীতমা দেখতে পায় সুপ্রিয়ও বেরিয়েছে। ওর আবার তাড়া থাকে এই সময়। দমদমে না কোথায় যেন সে আবার টিউশনি পড়াতে যায়। এই ছেলেটির সাথেই বেশ একটু কথা হয় শ্রীতমার, কেন হয় তার কোনও কারণ জানেনা কেউ। সুপ্রিয় আজ একটু দাঁড়িয়ে যায়।

-“তাহলে ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললে দিদি? অল দ্য বেস্ট,” ঝকঝকে চোখে সে শ্রীতমার দিকে তাকিয়েছে।

-“প্রার্থনা করিস ভাই, যেন পারি,” শ্রীতমা উচ্ছল চোখে জবাব দেয়। এই ছেলেটাকেই তার ভালো লাগে। অফিসে আর সকলের মধ্যে। কোনও ভান নেই কোথাও। শ্রীতমা অফিস ছাড়লে এই ছেলেটাকেই সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়বে তার। সনাতনকেও মনে পড়বে। সনাতন লোকটা খারাপ নয়।

আজকে এক ভাঁড়ের জায়গায় পরপর দুভাঁড় চা খেল শ্রীতমা। আরও দু’সপ্তাহ সে আসবে ঠিকই, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অন্যরকম। কার্তিকদার দিকে সে তাকায়। একমনে লোকটা চা বানিয়ে চলেছে। গালময় দাড়ি। পরনে ময়লা গেঞ্জি। এমনিই কত ছোট ছোট ফ্রেম তৈরি হয়। সাজানো পৃথিবী আমাদের। দোকান আর ফুটপাথ ফুঁড়ে একটা বিশাল নিমগাছ আকাশে মাথা দোলায়। অন্ধকার হয়ে গেছে। বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ। চায়ের পয়সা মিটিয়ে শ্রীতমা পা বাড়ায়।

[...]

ঘর অন্ধকার। শাশ্বতী বিছানায় শুয়েছিলেন। শ্রীতমা ঘরে ঢুকতেই চোখ খুলে তাকান। চোখ ছাড়া শরীরের আর কোনও অংশই তিনি নাড়াতে পারেন না। শাশ্বতী সুরেন্দ্র’র মা, শ্রীতমার সম্পর্কে শাশুড়ি। আজ তিন বছর হল পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। শ্রীতমার মনের ভিতরে যে স্বপ্নের অঙ্কুর ছিল, গত সাত বছরের মধ্যে প্রথম চার বছরে সবার অলক্ষ্যে জল হাওয়া বাতাস দিয়ে এই শাশ্বতীই তাকে বড় করে তুলেছেন। নিজের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবরূপে দেখতে চেয়েছেন শ্রীতমার মধ্যে দিয়ে, তারই স্বপ্নপূরণের মাধ্যমে। তেইশ বছর বয়সে স্ত্রী হিসেবে স্বামীর সংসারে এসেছিলেন তিনি। এবাড়িতে বাংলা অনার্স গ্র্যাজুয়েট বউয়ের আলাদা করে কোনও দাম ছিল না তখন। নিজের পাতা ভরে ভরে থাকা ডায়রিগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়েই শাশ্বতী কতগুলো বছর কাটিয়ে ফেলেছেন। তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারেননি। সুরেন্দ্রও কখনও জিজ্ঞেস করেনি। শেষ অবধি শ্রীতমার আসাতে সাধ মেটাবার স্বাদ পেয়েছিলেন শাশ্বতী। তারই বিকাশ ঘটেছে এই সাত বছর।

-“আয়,” বিকৃত উচ্চারণে ঠোঁট কাঁপিয়ে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেন তিনি। শ্রীতমা প্রণাম করে না। শুয়ে থাকা মানুষকে প্রণাম করতে নেই। শুধু হাঁটু গেড়ে শাশ্বতীর ফাউলার বেডটার ধার ঘেঁষে মাটিতে বসে পড়ে। শাশ্বতীর অবশ ডানহাতটাকে তুলে নিয়ে নিজের মাথার উপর দেয়। আয়া মেয়েটি এখন বাথরুমে গিয়েছে।

[...]

সুরেন্দ্র খেতে বসে জিজ্ঞেস করে, “সেই দিল্লিতেই তাহলে যেতে হচ্ছে তোমায়? কলকাতায় আর স্বপ্নপূরণ হল না?”

টেবিলের ওপাশে অনিমেষ তালুকদার বসে আছেন। রাশভারী চেহারা তাঁর। আজ অবধি এবাড়িতে তাঁর গলা দিয়ে একটিও অপ্রয়োজনীয় শব্দ খরচ হতে শোনেনি কেউ। হঠাৎ যেন শ্রীতমার মনে হয় টেবিলের দৈর্ঘ্যটা যেন বেড়ে গিয়েছে। লম্বা হয়ে কাঠ ফেঁপে উঠেছে। বর্ষায় যেমন হয়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। সুরেন্দ্রর চেহারাটা কেমন যেন আবছা হয়ে এসেছে। সুরেন্দ্র হাত বাড়িয়ে শ্রীতমাকে কনগ্র্যাচুলেট করে। ডালের বাটির উপরে বৃষ্টি পড়ছে। মাংসের ঝোলের বাটিটাকেও আর দেখা যাচ্ছে না।

[...]

এক বছর আট মাস পর, ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমে নবাগত মুখ হিসেবে বিশেষ একটি স্কুপ কভারেজের জন্য দিল্লি প্রেস ক্লাবে বিশেষ পুরষ্কার প্রাপক হিসেবে শ্রীতমা মিত্রের নাম ঘোষণা করা হয়। যদিও শ্রীতমা মিত্র সেই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন। শাশ্বতী তালুকদারের প্রয়াণ-সংবাদ পেয়ে তিনি তখন তড়িঘড়ি এরোপ্লেনে চেপে কলকাতার অভিমুখে, মাটি ছেড়ে আকাশে - বত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ে যাচ্ছিলেন।

এর ঠিক এক মাস তেরো দিন পর রেজিস্টার্ড পোস্টে সুরেন্দ্রর তরফে উকিলের চিঠি পান শ্রীতমা। পারস্পরিক বোঝাপড়ায় বিশেষ কোনও অসুবিধে পোহাতে হয়নি কোনও পক্ষকেই। সুপ্রিয় সেদিনই অফিসফেরতা দেখতে পায় দোকান তুলে দিয়ে কার্তিকদাও চলে গেছে কোথায়।

একলা নিমগাছটুকুই ঝুপসি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল।

ছবি : সংগৃহীত

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার

0 Comments

Post Comment