পোশাক ফতোয়া ও নারী

  • 11 August, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 791 view(s)
  • লিখেছেন : শর্মিলা ঘোষ
নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া পুরুষের হাজারো ফতোয়ার মধ্যে একটা ফতোয়া হল পোশাক ফতোয়া, যা নিজের পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে পাড়ার মেয়ে, স্কুলের দিদিমণি, অফিসযাত্রী, বৌমা, সবার ওপর জারি করা হয়ে থাকে। অথচ যে পোশাক সমাজ নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে সেটা কতটা বহন করতে পারছে মেয়েটি তা জানার বা বোঝার চেষ্টা করা হয়না। নারীকে পুরুষ কতটা সুযোগ দেবে কিংবা আদৌ কোনো অধিকার ভোগের সুযোগ দেবে কি না সবটুকু পরিবর্তনের সুতো পিতৃতন্ত্র নিজের লাটাইতে গুটিয়ে রেখেছে।

কালের আবহে সবকিছু পরিবর্তন হয়, শুধু নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার ভোগের জন্য পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। নারীকে পুরুষ কতটা সুযোগ দেবে কিংবা আদৌ কোনো অধিকার ভোগের সুযোগ দেবে কি না সবটুকু পরিবর্তনের সুতো পিতৃতন্ত্র নিজের লাটাইতে গুটিয়ে রেখেছে, যতটা সুতো তারা ছাড়বে নারী ততটাই স্বাধীনতা পাবে।

ছোটো থেকেই কন্যা সন্তানের মনে নীতিনৈতিকতার নামে এমন সব বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যেগুলোর জাল ছিঁড়ে বেরোতে মেয়েরা নিজেরাই অস্বস্তি বোধ করে। মেয়েরা ভাবতে থাকে সমাজ কী বলবে! পাড়া প্রতিবেশী কী বলবে! আত্মীয়স্বজন কী বলবে! আর লোকে কী বলবে এই ভয়ে ও দ্বিধায় হারিয়ে যায় নারী মনের নিজস্ব সত্তাগুলি।

একের পর এক ফতোয়া নারীকে মেনে চলতে বাধ্য করা হতে থাকে। আর এটাই তো নিয়ম, এটাই ঐতিহ্য এইসব বলে চাপিয়ে দেওয়া হতে থাকে অযৌক্তিক, অস্বাস্থ্যকর, অস্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ বিষয়।

ঠিক এমনই এক ফতোয়া হল পোশাক ফতোয়া যা নিজের পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে পাড়ার মেয়ে, স্কুলের দিদিমণি, অফিসযাত্রী, বৌমা, সবার ওপর জারি করা হয়ে থাকে। অথচ যে পোশাক সমাজ নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে সেটা কতটা বহন করতে পারছে মেয়েটি সেটা জানার বা বোঝার চেষ্টা করা হয়না।

একটি বিশাল বারোহাত কাপড়ে আমি কোনোদিন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনি। আমার পোশাক সালোয়ার কামিজ, তেমনি আজকাল মেয়েরা নিজের সুবিধার্থে নানা পোশাক ব্যবহার করে। তাই নিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতেও কত বাধা বিপত্তি। অথচ পুরুষ জাতি শখে ধুতি, আর স্বাচ্ছন্দ্যে লুঙ্গি, জিন্স, পাজামা, এমনকি শপিং মলে বারমুডা পরেও চলে যাচ্ছে। ইদানিং তো আবার পার্লামেন্টের সদস্য বারমুডা পরে অনুষ্ঠানে যোগদান করছেন।

বাগানে খালি গায়ে গামছা পরিহিত পুরুষ দেখলে আমার লজ্জা বোধ হয়, পোশাকবিধি কি এখানে খাটে না!
আসলে আমাদের সমাজে অশ্লীলতা পুরুষের শরীরে চাপে না, অশ্লীল একান্তই নারী শরীরের সঙ্গে মানানসই শব্দ।

এই সালোয়ার কামিজ পরে যাবার জন্যই আমাকে শুনতে হয়েছিল, স্কুল মাদ্রাসায় পরিণত হবে, কেড়ে নেওয়া হয়েছিল আমার যাবতীয় অধিকার। চূড়ান্ত অমানবিক আচরণ করা হয়েছিল আমার সাথে।
‘‌শাড়িতে নারী’‌ এই বিজ্ঞাপনের ঝুটা বয়ানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা বিয়ের অনুষ্ঠানে শাড়ি মেয়েদের পরতেই হবে এটা মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষিকা ও অন্যান্য চাকুরিরতা মহিলারা জলে কাদায় ভিড় বাসে ট্রামে অটোতে শাড়ি পরে কতটা অসুবিধায় পড়ে সেটা বাড়ি থেকে বসে বোঝা যায়না। শাড়ি পরে আসা শিক্ষিকাই ভালো শিক্ষিকা আর বাকিরা ভালো নয়, মূর্খ সমাজের এও এক কূপমুণ্ডকতা।

অদ্ভুত ভাবে এই পোশাক বয়স এবং বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেও পরিবর্তন হয়, যেমন বিয়ের পর শাড়ি পরা বা শ্বশুর বাড়ির পচ্ছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। হাঁটু ধরে দানে পাওয়া বউয়ের পোশাক পুরুষসঙ্গীটি বা তার পরিবার নির্দিষ্ট করে দেয়। নারী মেনে নেয়; আর এই মেনে নিতে নিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।

আমার শরীর তা একান্তই আমার। আমি ঠিক করবো আমার পোশাক। আর যদি আমার পোশাক তোমার চিন্তা অনুযায়ী পরতে হয় তবে আমিও তোমার পোশাক নির্দিষ্ট করে দেবো। এই কথাটা স্পষ্ট উচ্চারণে আমরা এখনো বলতে পারি না।

নারী শুধু শরীর একটা, একটা মাংস পিণ্ড, যৌন বস্তু এর বাইরে কবে মেয়েদের একটি স্বাধীন মুক্ত সত্তা হিসাবে ভাবা হবে! 

হ্যাঁ পরিষ্কার করে জানিয়ে দিচ্ছি যে পোশাক আমি বহন করতে পারবো আমি তাই পরবো। আপনার চোখের শান্তি করার জন্য আপনার ধার্য করা পোশাক আপনাকে মোবারক। মেয়েরা তাদের মাথা ঢাকবে কিনা! মেয়েরা শরীরের ওপর অতিরিক্ত চাদর দেবে কিনা এটাও সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব ব্যাপার।

জিন্স, টি-শার্ট, হাফ প্যান্ট, স্কার্ট, সালোয়ার, শাড়ি, বিকিনি নারী যে পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে সেই পোশাক পরবে।
মেয়েদের চুল বড় রাখতে হয় এও এক ধরনের চাপিয়ে দেওয়া রোগ। বর্তমান কর্মব্যস্ত সমাজে চুলের পরিচর্যা করার মতো বাস্তবিক কোনো সময় থাকে না। তাই মেয়েদের চুল ছোট থেকে বড় যেকোনো মাপের হতে পারে, যেটা সে নিজে পরিচর্যা করতে পারবে।
এখন প্রতিনিয়ত মেয়েদের পড়াশুনা, চাকরিবাকরি করতে বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যম ব্যবহার করতে হয়। তাই পোশাক হোক ঝরঝরে সাবলীল, হালকা সর্বোপরি যে পরছে তার রুচি অনুযায়ী এবং অবশ্যই তার সামর্থ্য অনুযায়ী।

নারীর ওপর ফতোয়া বা চাপিয়ে দেওয়া, জোর করা, বন্ধ করতেই হবে তা সে যেকোনো ধর্মেই হোক। আসলে নারী কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের নয়, নারী তার নারী ধর্মের ঋণ শোধ করতে করতে জীবনচক্র শেষ করে ফেলে, নাগরিকের সব অধিকার তার ভোগ করার কথা থাকলেও সে কথা কেউ রাখে না।

পুনঃপ্রকাশ

ছবি :‌ সংগৃহীত
লেখক : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক

0 Comments

Post Comment