- 12 July, 2022
- 0 Comment(s)
- 279 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
এই পরিস্থিতি এড়ানোর কিছু সুযোগও স্ত্রীর কাছে আছে। কিন্তু কার্যত সেই সব সুযোগ তাঁর জন্য অনুমোদন করা হয়নি। বিশেষ করে প্রদেশে, বিবাহের শৃঙ্খল যেখানে বেশ ভারী। স্ত্রীকে সেখানে এমন একটি পরিস্থিতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়, যে-পরিস্থিতি থেকে তিনি পালাতে পারেন না। যেমনটা আমরা দেখেছি, কেউ কেউ আছেন যাঁরা নিজেদের গুরুত্বের অহংকারে ফুলে-ফেঁপে ওঠেন এবং দজ্জাল, পরনিন্দুক, অত্যচারী স্ত্রী হয়ে যান। অন্যরা শিকারের ভূমিকায় আনন্দিত হন। স্বামী এবং সন্তানদের বেদনাদায়ক ক্রীতদাসে নিজেদেরকে পরিণত করে একটি মর্ষকামী আনন্দ পান। অন্যরা সেই সব আত্মমুগ্ধতাসূচক বা আত্মরতিমূলক ব্যবহারকে চিরায়ত করেন যেগুলির বর্ণনা আমরা করেছি যুবতী মেয়েদের ক্ষেত্রে। কোনো উদ্যোগেই নিজেদের অংশগ্রহণ নেই বলে তাঁরা ভোগেন। এবং কোনো কিছু করতে সক্ষম না-হওয়ায় তাঁরা লবডঙ্কা হয়ে থাকেন। তাঁদের অবস্থান অস্পষ্ট-অনিশ্চিত বলেই নিজেদেরকে তাঁরা অবহেলিত বোধ করেন এবং মনে করেন যে তাঁদের ভুল বোঝা হচ্ছে। বিষণ্নতার উপাসক তখন তাঁরা। স্বপ্ন, কৌতুক, অসুস্থতা, খ্যাপামি এবং খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন তাঁরা। নিজেদের চারপাশে সমস্যা তৈরি করেন অথবা একটি কাল্পনিক জগতে নিজেকে বন্দি করে রাখেন। অ্যামিয়েলের আঁকা ‘হাসিমুখের শ্রীমতী ব্যোদে’[1]এই ধরনের মহিলা। একজন গোঁয়ার এবং নির্বোধ স্বামীর সঙ্গে একটি প্রাদেশিক জীবনের একঘেয়েমিতে আবদ্ধ হয়ে, কোনো কিছু করা বা ভালোবাসার সুযোগের অভাবে জীবনের শূন্যতা এবং অকেজোতার অনুভূতিতে ক্ষয়ে গিয়ে ক্ষতিপূরণের খোঁজ তিনি করেন রোমান্টিক স্বপ্ন-কল্পনায়, নিজেকে ঘিরে থাকা ফুলের মধ্যে, পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে, নিজের চরিত্রে। এই সব খেলাতেও এমনকি তাঁর স্বামী ঝামেলা করেন। এইভাবে স্ত্রী উপনীত হন স্বামীকে হত্যা করার চেষ্টায়। যে-সমস্ত প্রতীকী আচরণের মধ্য দিয়ে স্ত্রী নিষ্কৃতি পান তা ন্যায়ভ্রষ্টতা ঘটাতে পারে। আর তাঁর এই অত্যাসক্তিগুলির পরিণাম হল অপরাধ। এমন বৈবাহিক অপরাধ রয়েছে যা খাঁটি ঘৃণার চেয়ে বরং স্বার্থ দ্বারা কম পরিচালিত হয়। এইভাবে, মোরিয়াক[2] আমাদের দেখান যে, তের্যাস দেসকিরু[3] চেষ্টা করেছিলেন তাঁর স্বামীকে বিষ দেওয়ার, যেমনটা আগে করেছিলেন শ্রীমতী লাফার্জ[4]। বিশ বছর ধরে একজন জঘন্য স্বামীকে সহ্য করে চলা চল্লিশ বছর বয়সি একজন মহিলা সম্প্রতি খালাস পেয়েছেন যিনি একদিন তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক বড়ো ছেলের সাহায্যে স্বামীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিলেন। অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনো উপায় ছিল না তাঁর কাছে।
একজন মহিলা যিনি স্বচ্ছতার সঙ্গে, অকৃত্রিমতার সঙ্গে তাঁর পরিস্থিতিতে বাঁচতে চান, প্রায়শই দেখা যায় তাঁর কাছে সাহায্যের একমাত্র অবশেষ হল সুখে-দুঃখে অনুদ্বিগ্ন থাকার গর্ব। যেহেতু সবার ওপর এবং সব কিছুর ওপর তিনি নির্ভরশীল, তাই অভ্যন্তরীণ এবং বিমূর্ত স্বাধীনতাটুকুই তিনি কেবল জানতে পারেন। আগে থেকেই তৈরি নীতি এবং মূল্যবোধকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বিচার করেন, প্রশ্ন করেন। ফলে দাম্পত্য-দাসত্ব থেকে রক্ষা পান। তবে তাঁর উঁচু গাম্ভীর্য ও ‘সহ্য করা এবং নিজেকে বিরত রাখা’ এই সূত্রের প্রতি আনুগত্য শুধুমাত্র একটি নেতিবাচক মনোভাবই গঠন করে। নেতিবাচকতা এবং নিন্দাবাদে জড়োসড়ো হয়ে গিয়ে তিনি তাঁর শক্তির ইতিবাচক ব্যবহারের অভাব অনুভব করেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি অত্যুৎসাহী এবং জীবন্ত, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাঁর শক্তি দিয়ে কার্যসাধন করতে পারেন : অন্যদের তিনি সাহায্য করেন, সান্ত্বনা দেন, রক্ষা করেন, কিছু দেন। নিজের কাজকে তিনি বহুগুণিত করে তোলেন। এতদ্সত্ত্বেও তিনি ভোগেন এমন কোনো কাজ করতে না-পারার জন্য যেই কাজের জন্য তাঁকে প্রয়োজন। তিনি ভোগেন কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিজের কাজকর্মকে একান্তভাবে নিয়োজিত করতে না-পারার জন্য। প্রায়শই একাকীত্ব এবং ‘বন্ধ্যাত্বের’ দ্বারা ক্ষয়িত হতে হতে শেষে তিনি নিজেকেই অস্বীকার করে বসেন, নিজেকে ধ্বংস করে ফেলেন। এইরকম ভাগ্যের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণপাওয়া যায় মাদাম দ্য শারিয়্যেরের[5] জীবনের মধ্যে। তাঁকে উৎসর্গ করা নিজের চিত্তাকর্ষক বইতে জিওফ্রে স্কট[6]মাদাম দ্য শারিয়্যেরকে চিত্রিত করেছেন‘একইসঙ্গে আগুন এবং শীতল মস্তিষ্কের সহাবস্থান’ রূপে। শারিয়্যেরের যুক্তিমনস্কতা কিন্তু তাঁর জীবনের প্রদীপ্ত শিখাকে নিভিয়ে দেয়নি। হারমেনচেসের[7] মতে এই প্রদীপ্ত শিখা, ‘একজন ল্যাপল্যান্ডের অধিবাসীর হৃদয়কে উষ্ণ করতে পারে’। দীপ্তিমতী বেল দ্য জুইলঁ[8]-কে বিবাহই ধীরে ধীরে হত্যা করেছিল। এরপর তিনি নিজেকে সমর্পণ করে দেন সংসারে এবং সেটিকেই ঠিক মনে করেন। ভিন্ন একটি ফলাফল উদ্ভাবনের জন্য বীরত্ব বা প্রতিভার প্রয়োজন ছিল। তাঁর উচ্চ এবং বিরল গুণাবলিও যে তাঁকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট নয়--ইতিহাসে পাওয়া দাম্পত্য প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে চমকপ্রদ নিন্দার এটি একটি।
[1]দু-অঙ্কের নাটক। এটি একটি ট্র্যাজি-কমেডি। লেখক : Denys Amiel এবং André Obey। নাটকটির মূল নাম : La Souriante Madame Beudet
[2]মূল নাম ফ্রঁসোয়া মোরিয়াক, François Mauriac।
[3]Thérèse Desqueyrouxহল François Mauriac-এর লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস। এই উপন্যাসের নাম-চরিত্র তের্যাস দেসকিরু।
[4]Marie-Fortunée Lafarge (née Capelle) ছিলেন একজন ফরাসি মহিলা যিনি ১৮৪০ সালে সালে তাঁর স্বামীকে আর্সেনিক বিষ দিয়ে হত্যা করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ফরেন্সিক পরীক্ষার মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
[5]ইসাবেল দ্য শারিয়্যের হলেন আলোকিত যুগের একজন ডাচ ও সুইস লেখক। জীবনের শেষ অর্ধ তিনি কাটিয়েছিলেন ন্যওশাতেলের কলম্বিয়েতে।
[6]একজন ইংরেজ পণ্ডিত ও কবি। স্থাপত্যের ইতিহাসবিদ হিসাবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ইসাবেল দ্য শারিয়্যেরের জীবনী তিনি লিখেছিলেন। সেই জীবনীগ্রন্থের নাম ‘The protrait of Zélide’। Zélide ছিল ইসাবেল দ্য শারিয়্যেরের ছদ্মনাম।
[7]David-Louis Constant d'Hermenches ছিলেন ডাচ প্রজাতন্ত্রের সুইস রেজিমেন্টের একজন কর্নেল এবং কমাড্যান্ট। ভলতেয়ারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। ইসাবেল দ্য শারিয়্যেরের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ সুবিদিত।
0 Comments
Post Comment