- 01 June, 2020
- 0 Comment(s)
- 1090 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
লকডাউনে রাখিবিবিকেই সংসার চালানোর হাল ধরতে হয়েছিল। ঘরে রয়েছে এক ছেলে, এক মেয়ে। এখন কিছুটা ছাড় পেয়ে তাঁর স্বামী মাল বইবার ছোট ম্যাটাডোর জাতীয়, যা ছোট হাতি নামে পরিচিত তা নিয়ে কাজে বেরোচ্ছেন। লকডাউনে গাড়ির ভাড়া খাটানো বন্ধ হলে কিছুদিন জমানো টাকাতেই চলে তাঁদের সংসার। রাখিবিবির নিজের চপের দোকান। লকডাউনে সেটিও বন্ধ ছিল কয়েকটা দিন। তবে দোকান তাঁর বাড়িতে বলে ছোট্ট আকারে ব্যবসাটা চালু রাখেন। চপ তৈরি, ভাজা, বিক্রি সব নিজের হাতে করেন রাখিবিবি। করেন না শুধু কত উপার্জন হল সেই আয়ের হিসেব। সেটা তো স্বামীর কাজ। মাসে কীরকম উপার্জন হয় জানতে চাইলে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে বললেন, ‘ন হাজার মতো’। চপ বিক্রির টাকা গুছিয়ে স্বামীর হাতেই তুলে দেন। কোনদিন গুণে দেখেন না। তাঁর নিজের একটা ব্যাংক একাউন্ট আছে। কিন্তু সেখানে জমা পড়ে না টাকা। জমা করা হয় স্বামীর একাউন্টে। চৌদ্দ/পনেরো বছর বয়স তখন রাখিবিবির। বীরভূমের এক গ্রাম থেকে কলকাতায় আসেন গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়ে। থাকা, খাওয়া আর পোশাকটুকু ছিল তাঁর প্রাপ্তি। সারাদিন বাচ্চা সামলানো, ঘরের কাজ, বাজার করার বিনিময়ে কত তাঁর মাস মাইনে ছিল সেদিনও জানতেন না। তাঁর পারিশ্রমিক চলে যেত বাবার কাছে। সেজন্য রাখিবিবি অভিযোগ করতেও শেখেননি। তিনি জানেন টাকা পুরুষদের কাছেই থাকে। স্বামী তাঁর অভিভাবক, তাই তাঁর রোজগার করা টাকারও অভিভাবক।
স্বামীকে অভিভাবক মনে করে মুর্শিদাবাদের স্বাস্থ্যকর্মী রেহেনা খাতুন (পরিবর্তিত নাম) অর্থ পরিচালনার ভার তাঁকেই দিয়েছিলেন। এ টি এম কার্ডও স্বামীর হাতেই। স্বামী মাঝেমধ্যে রেহেনার চাকরিস্থলের ভাড়া বাড়িতে আসতেন। রেহেনাকে প্রয়োজনমতো দিয়েও যেতেন সংসার খরচ। বড় নিশ্চিন্তে ছিলেন রেহেনা। সংসারের এত বড় কঠিন দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন মনে করে। একসময় তাঁর হাতখরচে লাগাম পড়ল। স্বামী জানিয়ে দিলেন ফ্ল্যাট বুক করব। এখন সব দিকের খরচ কমাতে হবে। অর্থ নিয়ন্ত্রণে স্বামীর সাফল্যে খুশি হয়ে রেহেনা তাঁর দুই সন্তান ও নিজের খরচ কমাতে শুরু করেন। এদিকে স্বামীরও বাড়িতে আসার মেয়াদ কমতে থাকে। ব্যবসার বিভিন্ন কাজে নাকি তাঁকে বাইরে থাকতে হচ্ছে। এই দূরত্বটা ক্রমাগত বাড়ার পর রেহেনা বুঝতে পারেন তাঁর ব্যাংক একাউন্ট ফাঁকা। ফ্ল্যাট বুক করা হয়নি। স্বামী নিজের নামে অন্য শহরে বাড়ি তৈরি করছেন। কেন এই গোপনীয়তা? এর উত্তর স্বামী দেবেন না, জানিয়েছেন। বাড়াবাড়ি করলে তালাক দেবেন। থানায় গিয়ে টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি। এ টি এম কার্ড ব্লক করতে পেরেছেন শুধু। রেহেনা বললেন, ‘এখন বুঝি, টাকা নিজের আয়ত্বে না থাকলে পরাধীনতা মানতে হয়, বিপদের ভয়ও থাকে।’
কলকাতার গৃহপরিচারিকা ললিতাদি প্রত্যেক মাসে মাইনে নেওয়ার পর কিছুটা টাকা কোমরে লুকিয়ে ফেলেন। স্বামীকে মাসের মাইনে তুলে দিতে হয় তাই এই আড়াল। বললেন, ‘আগে পাঁচ বাড়ি কাজ করতাম। স্বামীকে বলেছিলাম চার বাড়ি। এক বাড়ির টাকা আমার কাছে থাকত। ধরা পড়ে গিয়ে স্বামীর হাতে মার খেতে হয়েছে। এখন তাই মাইনে কমিয়ে বলি। সব বাড়ি থেকে একটু করে সরিয়ে রাখি। ছেলে-পিলের মুখের দিকে তাকিয়ে দিন-রাত খাটব। আর সেই টাকা নিয়ে মদ-তাড়ি না গিললে ওর চলে না।’ ললিতাদি নিজের জীবনটা এইভাবে কাটিয়ে দিলেও মেয়ের জীবন এমন করে কাটুক চান না। তাঁর বড় মেয়ে পারমিতাও পরিচারিকার কাজ করেন। পারমিতার স্বামী টাকা নিয়ে মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেতেন। ললিতাদি মেয়েকে বলেছেন নিজের রোজগারের টাকা স্বামীর হাতে তুলে না দিতে। যে ভুল তিনি করে গেলেন, তা যেন মেয়ে আর না করে। পারমিতা কঠোর হাতে নিজের টাকা আগলে রাখেন। তাতে স্বামীর সঙ্গে অনেকবার গণ্ডগোল হয়েছে। ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত। তাঁর দুটো বাচ্চা। তবু বিবাহ বিচ্ছেদ করেছেন। নিজের খাটুনির টাকায় বাচ্চা মানুষ করবেন বলে।
মেয়েরা স্বাধীনতা চাই। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বনির্ভর ছাড়া স্বাধীন হওয়া যায় না। অর্থনৈতিক স্বনির্ভর মানে শুধু অর্থ উপার্জন করা নয়। অর্থ নিয়ন্ত্রণ করাও। অনেক রোজগেরে মেয়ের মুখে শুনেছি, আমার বাবার বাড়িতে টাকা দেওয়ার স্বাধীনতা আছে। স্বামী আপত্তি করেন না। তার মানে স্বামীর মতের ওপর বাবা-মাকে টাকা দেওয়া না দেওয়া নির্ভর করে? মেয়ের উপার্জনের টাকায় বাবা-মায়ের অধিকার নেই? স্বামীকে অভিভাবক মনে করা মেয়েদের মুখেই এ কথা বেরোয়। উপার্জন করতে শিখলেই শুধু হয় না। অধিকার সচেতন হতেও শিখতে হয়। নইলে পুরুষের অনুমতি জোটাকেই স্বাধীনতা বলে ভ্রম হবে।
মূল ছবি ঃ চপ ভাজছেন রাখিবিবি
লেখক অধ্যাপক ও সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment