- 18 August, 2020
- 0 Comment(s)
- 972 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
“নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বশী - গোষ্ঠে যবে নামে সন্ধ্যা শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি, তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বালো সন্ধ্যাদীপখানি ...” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, (২৩ অগ্রহায়ণ, ১৩০২ বঙ্গাব্দ, গীতরূপে প্রকাশঃ অগ্রহায়ণ, ১৩৪৭, ‘শাপমোচন’)
শুনতে বেশ লাগে আমাদের। আবৃত্তি করতে অথবা গাইতেও। নারীসৌন্দর্যের বর্ণনায় — তার মাহাত্ম্যে, তার উন্মেষে আপ্লুত হওয়াটা ভারতবাসীর স্বভাব। নারীবাদ নিয়েও অনেক কথা বলা হয়। অনেক আলোচনা। কিন্তু বাস্তবের সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই সংকটে পড়বার জোগাড়। আমাদের দেশে ইদানীং একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। হয়তো বা সে একদিক থেকে দেখতে গেলে অনেকদিনের পুরনো অভ্যাস। তবুও, স্মরণকালের মধ্যে তার প্রকোপ বেড়েছে। সংখ্যা এবং প্রশ্ন — এই দুটি বিষয় সরকার এবং সরকারে থাকা জনপ্রতিনিধিদের কাছে অতীব পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘সোনার কেল্লা’র লালমোহনবাবুর মতোই, “কোনও প্রশ্ন নয় — নো কোয়েশ্চেনস” বলতে বলতে মাথা নামিয়ে নেওয়াটাই বোধহয় সবচেয়ে নিরাপদ এখন।
সম্প্রতি, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা ইউনাইটেড নেশনসের তরফে প্রকাশিত একটি সমীক্ষার ফলাফল সামনে আসতে — আমাদের এই ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’য়ের দেশে নারী-নিরাপত্তার বিষয়টিকে নিয়ে আবার বোধহয় বেশ কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন তোলবার সময় হয়েছে। নারীর পূর্ণবিকাশ তার যে প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে ওঠবার সৌভাগ্যে — সেই সময় অবধিও কি মেয়েরা সকলে পৌঁছতে পারে? এই রিপোর্ট বলছে, পারে না। তার কারণ, গত পঞ্চাশ বছরে জন্মের সময়ে, লিঙ্গ-বৈষম্যের কারণে ভ্রূণাবস্থায় অথবা জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যেই পৃথিবী থেকে চিরতরে ‘হারিয়ে যাওয়া’ কন্যাসন্তানদের মোট সংখ্যাটি প্রায় সোয়া চৌদ্দ কোটি ছুঁতে চলেছে। এরমধ্যে প্রায় ৪ কোটি ৫৮ লক্ষ কন্যাসন্তানের দায়ভার আমাদের দেশের, প্রায় ৭.২৩কোটি কন্যাসন্তানের হিসেব প্রতিবেশী চীনের। কেবল এই দুটি দেশ মিলিয়েই প্রায় বারো কোটি কন্যাসন্তানের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া নিশ্চিত হয়েছে। আমরা বলি ‘মায়ের দেশ’ — সত্যিই কি তাই? জানা যাচ্ছে যে, ভারত এবং চীন মিলিয়ে প্রি-নাটাল সেক্স সিলেকশন এবং জেন্ডার বায়াসের কারণে জন্মের আগেই প্রতি বছর অন্ততপক্ষে ১২ লক্ষ কন্যাসন্তানের মৃত্যু হয়, অথবা তারা ‘হারিয়ে যায়’। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর এই সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৫ লক্ষের কাছাকাছি — অর্থাৎ মোট মৃত্যুর প্রায় ৯০% থেকে ৯৫%-এর জন্যই দায়ী থাকে ভারত ও চীন। ভারতে প্রতি ১০০০ জন কন্যাসন্তানের জন্মের বিপরীতে, ১৩.৫ জনেরই জন্মের সময় অথবা তার অল্পসময়ের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে। এই সংখ্যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। পাঁচ বছর বা তার কম বয়সের প্রতি ৯’টি কন্যাসন্তানের মৃত্যুতে, তাদের মধ্যে অন্তত একটির কারণ হয়ে দাঁড়ায় পোষ্ট-নাটাল সেক্স সিলেকশন — বা জন্মের পরে কন্যাসন্তানের প্রতি তার লিঙ্গের কারণে দেখানো অসতর্কতা এবং অবহেলা। জানা যাচ্ছে যে, ২০১৩ থেকে ২০১৭-র মধ্যে প্রতি বছর, কেবল ভারতবর্ষে জন্মের সময়, প্রি-নাটাল সেক্স সিলেকশন এবং জেন্ডার বায়াসের কারণে গড়ে ৪.৬ লক্ষ কন্যাসন্তানের মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যাটি কিন্তু আশাপ্রদ — কেন জানেন ? ১৯৭০ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে এই সংখ্যাটি একা ভারতবর্ষের জন্যই ছিল প্রায় ২০ লক্ষের কাছাকাছি প্রতি বছর!
নারী-পুরুষের সংখ্যার অনুপাতে ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’-এর ভারতে কিন্তু ভয়ানক ভাবে একটি পশ্চাদপসরণের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। কারণ, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতবর্ষে নারী-পুরুষের সংখ্যার অনুপাত ছিল প্রতি ১০০০ জন পুরুষ পিছু ৯৪০ জন নারী। ২০১৬-১৮-র সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি ১০০০ জন পুরুষে নারীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৯৯-তে। প্রতি ১০০০ জন পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা ৯০০-রও তলায় রয়েছে এমন রাজ্যগুলি হল হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, দিল্লী, গুজরাট, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং বিহার। উল্লেখ্য, সমীক্ষার সময়ে ৯টি রাজ্যের মধ্যে ৭টিতেই কিন্তু কেন্দ্রের বন্ধুভাবাপন্ন সরকার ছিল এবং ৫টিতে এখনও রয়েছে — তাঁরাও কি ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’-এর শ্লোগান ভুলে গিয়েছিলেন? নারীর বিকাশে, তাঁদের শিক্ষার খতিয়ান যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তাও রাষ্ট্রপুঞ্জের এই সমীক্ষার ফলাফলে উঠে আসতে পেরেছে। দেখা যাচ্ছে যে, একেবার অশিক্ষিতা নারীদের ৫১% এবং ন্যূনতম প্রাথমিক শিক্ষাটুকু প্রাপ্ত হয়েছে এমন নারীদের ৪৭% আঠেরো বছরের কম বয়সেই ভারতবর্ষে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হন। সেখানে, মাধ্যমিক স্তর অবধি শিক্ষিত নারীদের ২৯% এবং তার চেয়েও বেশী শিক্ষিত নারীদের মাত্র ৪% আঠেরো বছরের কম বয়সে বিবাহে বাধ্য হন। সংখ্যাতত্ত্ব আরও বলছে যে, ২০১৫-১৬তে ভারতবর্ষে মোট বিয়ের পিঁড়িতে বসা মেয়েদের অন্তত ২৫%-এর বয়স ছিল আঠেরোর কম। আর বর্তমানে বিবাহিতা মেয়েদের মধ্যে, যাঁদের বয়স কুড়ি থেকে চব্বিশের ভিতরে — তাঁদের অন্তত ২৬.৮%-ই আঠেরো বছরের কম বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। জাতীয় স্বাস্থ্য এবং পরিবারকল্যাণ সংক্রান্ত সরকারি সমীক্ষাতেই এই ফলাফল উঠে এসেছে। সমীক্ষায় আরও দেখা যাচ্ছে যে আঠেরো বছরের কম বয়সে যে সমস্ত মেয়েরা এমন বিবাহে ‘সম্মত হতে’ কার্যত বাধ্য হন, তাঁদের মধ্যে ৩২%-ই পরবর্তীতে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন। অন্যদিকে বিয়ের বয়স আঠেরো পেরোলেও, বিবাহিতা নারীদের অন্তত ১৭% তাঁদের স্বামীদের হাতে নিয়মিত গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন। শতাংশে সামান্য কিছু তফাত ঘটলেও, আজ ২০২০-তে দাঁড়িয়ে পরবর্তী সংখ্যাটিকেও বোধ করি তেমনটা আশাপ্রদ লাগছে না। নয়া জমানার নয়া ভারত যতই নয়া সড়কের পথে হাঁটুক না কেন, সত্যি সত্যি নাগরিকদের মনে নয়া শোচ আসতে এখনও অনেক দেরী আছে বোধহয়।
গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো এখন আবার প্যানডেমিকের সময়। মেয়েদের অবস্থা এমন একেকটি সংকটের সময়ে আরও বেশী করে খারাপ হয়। ব্যক্তিগত উপলব্ধি নয় — এও সেই সংখ্যার হিসেব। ২০০৪ সালের সুনামির পর, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়াতে — সুনামির কারণে বিপত্নীক পুরুষদের সঙ্গে জোর করে অল্পবয়স্কা মেয়েদের বিবাহে বাধ্য করা হয়েছিলো। ইবোলা মহামারীর পর, আক্রান্ত দেশগুলিতে স্কুল-ড্রপআউটের সংখ্যা মেয়েদের মধ্যে তিনগুণ অবধি বেড়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেবে প্রতি বছর পৃথিবীতে বাল্যবিবাহে বাধ্য মেয়েদের সংখ্যা প্রায় ১.২ কোটির কাছাকাছি। রাষ্ট্রপুঞ্জের আশঙ্কা কোরোনা-পরবর্তীতে আগামী দশ বছরে, মোট ১২ কোটির বদলে প্রায় ২৫কোটি কন্যাসন্তান বাল্যবিবাহে বাধ্য হতে পারে। আগামী তিনমাসে অন্ততপক্ষে সাড়ে আট কোটি শিশু প্যানডেমিকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে শোষণ, হিংসা, নিপীড়নের শিকার হবে। এই মূহুর্তে প্রায় ১৫০ কোটি শিশুর শিক্ষা, স্কুল এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে ব্যহত হচ্ছে। এর মধ্যে, ভারতবর্ষে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে মিড ডে মিলও বন্ধ হয়ে রয়েছে। যার ফলে কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমে মানসিক পুষ্টি তো ‘দূর কি বাত’, ন্যূনতম শারীরিক পুষ্টিরও অভাব দেখা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এ্যানিমিক বা রক্তাল্পতায় ভোগা মেয়েদের সংখ্যা পৃথিবীর মধ্যে ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশী। সেখানে এই মিড ডে মিলের বন্ধ হয়ে যাওয়াটা একটা বড় প্রভাব ফেলবে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
আর অন্যান্য সুযোগ সুবিধে? কেরালায় স্মার্টফোন না থাকার কারণে অনলাইন ক্লাস না করতে পারা ছাত্রীটির আত্মহত্যার খবর প্রায় সকলেই জানেন। এই সমস্ত সুযোগ সুবিধের ক্ষেত্রেও যদি তুল্যমূল্য বিচার করা হয় তাহলে দেখা যাবে, লিঙ্গ-বৈষম্য সেখানেও। সরকারি সমীক্ষাতেই দেখা যাচ্ছে, পরিবারে দুটি সন্তান থাকলে — ছেলেটির জন্য থাকছে পয়সা খরচ করে হলেও — বেসরকারি স্কুলের সুযোগ-সুবিধে; আর কন্যাসন্তানটিকে কোনোমতে সরকারি স্কুলে ফেলে দিতে পারলেই হল। এই মানসিকতার প্রভাব সর্বত্র। দেখা যাচ্ছে যে, ৪ থেকে ৫বছরের মধ্যে কন্যাসন্তানদের ৫৬.৮% সরকারি স্কুলের আশ্রয়ে রয়েছে, যেখানে একই বয়সের ছেলেদের জন্য সংখ্যাটি ৫০.৪%। অতটাও ফারাক নয় বলছেন, তাহলে পরের তথ্যে যাই। ৬ থেকে ৮ বছরের মধ্যে কন্যাসন্তানদের ৬১.১% সরকারি স্কুলের আশ্রয়ে রয়েছে, যেখানে একই বয়সের ছেলেদের জন্য সংখ্যাটি ৫২.১%। ভারতীয় নারীরা গড়ে প্রতিদিন বয়স নির্বিশেষে প্রায় ২৯৭ মিনিট (ঘন্টার হিসেবে প্রায় ৫ ঘন্টা) বাড়ির কাজে ব্যয় করেন। করতে বাধ্য হন। বিপরীতে একজন ভারতীয় পুরুষ বাড়ির কাজে প্রতিদিন ব্যয় করেন মাত্র ৩১ মিনিট, যা পৃথিবীতে সর্বনিম্ন। এতখানি বৈষম্য কেন? ভারতে নেট-ব্যবহারকারী জনতার ৭০%-ই পুরুষ, মাত্র ৩০% নারীর কাছে এই সুবিধা রয়েছে। ডিজিটাল ডিভাইডের হিসেব তো আরও মারাত্মক — গ্রামীণ ভারতবর্ষে মাত্র ১৫% বাড়িতে ইন্টারনেটের সুবিধে রয়েছে, যেখানে শহরাঞ্চলে সংখ্যাটি ৪২%। এই গ্রামীণ ভারতে ইন্টারনেটের সুবিধে রয়েছে এমন মানুষদের মধ্যে মাত্র ১৩% সেটিকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে জানেন, এই সংখ্যারও মাত্র ৮.৫% নারী। বাড়িতে স্মার্টফোন থাকলেও, তার উপরে মূল অধিকার আগে পুরুষের। পরে নারীর। গ্রামীণ বা মফস্বলের ভারতবর্ষে এর প্রভাব ইতিমধ্যেই মারাত্মক আকার নিতে শুরু করেছে। বৈষম্য যে চিরকালীন, সর্বত্রগামী এবং ভয়ঙ্কর।
সবশেষে — শোচের কথা বলছেন? আইপিসির দিকে ফিরে তাকানো যাক। ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, ধারা ৩৭৫ — ব্যতিক্রম ২ (বা এক্সেপশন টু)-তে বলা হচ্ছে যে, যদি ধর্ষণে অপরাধী পুরুষ অপরাধের সময় তার বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে কোনরকম যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে থাকেন, এবং স্ত্রীর বয়স যদি ‘পনেরো বছর বা তার বেশী হয়’, তাহলে পরে — ৩৭৫ নং ধারার সংজ্ঞা অনুযায়ী ধর্ষণের সমস্ত শর্তগুলি স্বীকৃত হলেও, অপরাধটিকে ধর্ষণ বলে গণ্য করা যাবে না। পনেরো বছরের সমস্ত মেয়েরা আজ এই ধারাটিকে সম্মান করতে শিখুক। অলমিতি — নমস্কার।
ছবি: প্রতীকী
লেখক: প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষক , প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment