- 03 March, 2021
- 0 Comment(s)
- 708 view(s)
- লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রমিক নারীদিবস? নাকি শুধুই নারীদিবস? আনন্দের, উৎসবের দিন নাকি সশ্রদ্ধ, গম্ভীর স্মরণের? পরস্পরকে Happy Women’s Day বলে অভিবাদন জানানোটা কি এই দিনের তাৎপর্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এক কথায়, দিনটা আনন্দের নাকি শোকের? গত কয়েক বছর ধরেই দেখছি নারীদিবসকে ঘিরে কেমন এক ধরনের পুজোসুলভ উত্তেজনা। প্রায় প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছোটবড় কোনও অনুষ্ঠান তো হয়, এছাড়া পুলিশ, রেল, বিমানসংস্থা, ব্যাঙ্ক, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন—সবাই এগিয়ে আসে নিজের মতো করে নারীদিবস পালন করতে। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তিগত, সরকারি, বেসরকারি— নাগরিক সমাজের সমস্ত স্তরে এই দিনটার উদযাপনের আয়োজন। হোয়াটসআপ, ফেসবুকে শুভেচ্ছাবার্তার প্লাবন। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনী শুভেচ্ছা আর কেনাকাটায় ছাড়ের ছড়াছড়ি। ৮ই মার্চের কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় এই উৎসব, এর জের থাকে আরও বেশ কিছু দিন। বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ তো আছেই, পার্বণের সংখ্যা ইতিমধ্যেই বেড়ে বহুগুণ। নারীদিবস আরেকটি এসে জুড়েছে। হয়তো কয়েক বছর পর দেখা যাবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইক বাজিয়ে পাড়ার ছেলেরা নারীদিবস পালন করছে। বছরের বাকি দিনগুলো তো তাদেরই, একটা দিন নারীদিবসের অজুহাতে মদ-মাংস নিয়ে হুজ্জত করলে ক্ষতি কি? শুধু বাকি দিনগুলো কেন, সেদিনটাও কি তাদের নয়? নারীদিবসে কি মদ্যপ স্বামী স্ত্রীকে ধরে পেটায় না? নাকি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে না? এমনিতেই জৈবিকভাবে ধর্ষণ না করলেও মেয়েদের দেমাককে শায়েস্তা করার জন্য মনে মনে প্রতিদিন ধর্ষণ করা পুরুষের অভাব নেই। তারা অনেকেই আমাদের চারপাশেই ভদ্র পোশাক পরে প্রগতিশীলের তকমা এঁটে ঘোরাফেরা করে। প্রকাশ্যে নারীমুক্তির বুলি কপচায়। নারীদিবসে লম্বা-চওড়া বক্তব্য রাখে। অথচ হয়তো ঘরের নারীটিকে অবিরাম নির্যাতন করে আর পথেঘাটে মেয়েদের দিকে লোলুপ নজরে তাকায়। যাই হোক এদের কারণে নারীদিবসের উৎসবে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়ে না। তবে কি নারীদিবস শুধুমাত্র আরেকটা হুজুগ, পণ্যসংস্কৃতির উসকে দেওয়া কৃত্রিম উত্তেজনায় ভরপুর আরেকটা দিন? এতটা সংশয়ী হবার কারণ আছে বলে মনে করি না। আসুন, এই সমারোহের সঙ্গে নারীদিবস উদযাপনকে আমরা একটা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। এই দিন আমরা অঙ্গীকার নিই যে প্রতিনিয়ত নারীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া হিংসাকে রুখব, নিজেদের শোষিত হতে দেব না, মুখ বুজে সহ্য করব না অন্যায়, আমাদের অন্তর্লীন শক্তির বিকাশ ঘটাব, অন্যদের মধ্যে যে শক্তি নিহিত আছে, তার বিকাশে সহায়ক হব। এই দিন আমরা কৃতী নারীদের কুর্নিশ জানাব, পাচার, ধর্ষণ, আসিড-নিক্ষেপ প্রভৃতি জঘন্য অপরাধের কারণে যাদের অস্তিত্ব বিপন্ন, যারা সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্যুত, নিরপরাধ যাদের সমাজ লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকতে বাধ্য করেছে, তাদের আলোয় আনব, জীবনের দিকে তাদের মুখ ফেরাব। ৮ই মার্চ অঙ্গীকারের দিন। একটি সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার শপথ নেব এই দিনে। পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে যোঝার রণকৌশল নির্ধারণ করব এই দিনে।
হ্যাঁ ৮ই মার্চ অবশ্যই খুশির দিন। কিসের খুশি? ১৯০৯-১০ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক নারীর সংগ্রামকে চিহ্নিত করেছিল এই দিন। কিন্তু তারপর একশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে এই দিনটা যে অর্থ বহন করত আজ তার পরিবর্তন হয়েছে। ‘নারীদিবস’ এই শব্দবন্ধের আদি দ্যোতনায় দিনটাকে আবদ্ধ রাখলে চলবে না। গত এক শতকে যে দিনটার মানে পাল্টেছে সেটা স্বীকার করে নেওয়াটাই প্রকৃত ইতিহাসচেতনার পরিচায়ক। তবে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের পিতৃতান্ত্রিক চরিত্র যে খুব একটা বদলেছে তা নয়। কিন্তু যখন আমরা পরস্পরকে ‘হ্যাপি উইমেন্স ডে’ বলি, আমাদের সম্ভাষণের মধ্যে দিয়েই ইতিবাচক শক্তি সৃজিত হয়, তা এক থেকে বহুর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। হয়ত বা পুরুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। পুরুষদের একটু নাড়িয়ে দেয়। সামান্য হলেও একটু ভাবতে শেখায়। তারা তো আমাদের শত্রু নয়! শত্রু হচ্ছে পিতৃতন্ত্র যা সর্বত্র পরিব্যপ্ত, যা আমাদের মনে উপনিবেশ গড়ে যুগ যুগ ধরে তার আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে। আমাদের সম্মিলিত ইতিবাচক শক্তি সজোরে ধাক্কা দেবে পিতৃতন্ত্রকে, আমাদের মনকে, মননকে পিতৃতান্ত্রিক দখল থেকে মুক্ত করবে। তাই নারী দিবস উপলক্ষে এই উন্মাদনায় আমি ভরসা রাখি, বিশ্বাস করি সাম্যের দিকে আমাদের আগামী দিনের যাত্রাকে সুগম করে তুলবে এই উদযাপন।
এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শ্লোগান হল ‘I choose to challenge’। অর্থাৎ আমি চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চ্যালেঞ্জ করব কাকে? পিতৃতন্ত্রকে। আমরা জানি, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুজনেই সমান অপরাধী। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অন্যায়, অপরাধ, দমন, পীড়ন, বঞ্চনা, নিষ্পেষণ, নির্যাতন, শোষণ, আমরা অনেকসময় মেনে নিই। যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়ে গেলেও প্রতিবাদ করি না। যদি পারিবারিক পরিসরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করি, অন্যায় মেনে নেওয়ার অনেক কারণ। প্রথমতঃ আমরা অন্যায়কে অন্যায় বলে চিনতে পারছি না, তাকে স্বাভাবিক, এমনকি কাম্য মনে করছি। জন্ম থেকে আমাদের যে সামাজিকীকরণ ঘটেছে তার ফলে আমরা অন্যায়কেই স্বাভাবিক হিসেবে দেখতে শিখেছি। আবার প্রতিবাদ করাটা নারীসুলভ নয়, প্রতিবাদ করলে লোকে মন্দ মেয়ে বলবে, এই ভাবনা থেকেও আমরা চুপ করে থাকি। দ্বিতীয়ত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আমরা ভয় পাই, কারণ প্রতিবাদ করলে আমাদের জন্য কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে। শাস্তিরও আবার রকমফের আছে। দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন, গৃহচ্যুতি, প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা, আরো কত কি! সবচেয়ে যে শাস্তিটাকে ভয় পাই সেটা হল মাথার ওপর ছাদ হারানোর ভয়। প্রতিবাদ করলে বাবার বাড়ি বা স্বামীর বাড়ির দরজার বাইরে আমাদের ঠেলে দেবে। আমরা তখন থাকব কোথায়? খাব কী? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের অন্ন নিজে জোগাড় করার, নিজের ছাদ অর্জন করার সামর্থ্য নেই আমাদের। আমাদের স্বনির্ভরতার জন্য প্রস্তুত হবার সুযোগ দেওয়া হয় না। আমরা সেই সুযোগ দাবিও করি না। ভেবেছি, আমাদের ভাবতে শেখানো হয়েছে যে পিতা, স্বামী, পুত্রসন্তানই আমাদের প্রতিপালন করবে। তৃতীয়ত, যে অন্যায় করছে সে আমার খুব প্রিয়জন, সে আমার বাবা, মা, দাদা, প্রেমিক, স্বামী বা সন্তান। তাকে ভালবাসি তাই তার অন্যায় মেনে নিই। প্রতিবাদ করে তাকে কষ্ট দিতে চাই না। তাকে হারাতে চাই না, তাই আমি চুপ করে থাকি। আড়ালে কাঁদি, যন্ত্রণায় বুক ভেঙ্গে যায় তাও মুখে কিছু বলি না। অনেক সময়, আমরা অশান্তির ভয়ে প্রতিবাদ করি না। যেমন চলছে তেমনই চলুক, এতেই শান্তি, ভয় পাই, অশান্তির পরিস্থিতিতে সন্তান মানসিকভাবে বিপন্ন হবে। তাই আমি চুপ করে থাকি। মেনে নিই অন্যায়। মেনে নেওয়ার কারণগুলোকে কিন্তু এক লহমায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা আজ হাত তুলে শ্লোগান আওড়াতেই পারি, I choose to challenge. কিন্তু চ্যালেঞ্জ করা এত সহজ নয়। চ্যালেঞ্জ করতে হলে, আমাদের মনের পরাধীনতাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে, তার আগে সচেতন হতে হবে যে আমরা পরাধীন। আমাদের আত্মনির্ভর হতে হবে। আমরা ভালবাসব, কিন্তু ভালবাসার মানুষের শোষণ বরদাস্ত করব না। অশান্তির ভয় পাব না আমরা। তবেই আমরা ময়দানে নামতে পারব। পিতৃতন্ত্রের দিকে ছুঁড়ে দিতে পারব মোক্ষম চ্যালেঞ্জ। তখনই নারীদিবস হয়ে উঠবে প্রকৃত খুশির দিন।
লেখক: অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক
প্রতীকী ছবি
0 Comments
Post Comment