- 07 October, 2022
- 0 Comment(s)
- 420 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
একদিকে রাশিয়া, অন্যদিকে ইরান, আফগানিস্তান – মেয়েদের লড়াই আজ ক্রমশই প্রকাশ্য রাজপথে নেমে আসতে শুরু করেছে। হয়তো বা সেই কারণেই, খানিকটা ব্যুলেটিন প্রচারের মতো করেই – চেষ্টা করে চলেছি খবরগুলোকে তুলে নিয়ে আসার। খবরগুলোকে জায়গাতে জায়গাতে ছড়িয়ে দেওয়ার। বিশেষত ইরান, আফগানিস্তানে গোঁড়া ইসলামিক শাসনাধীন একেকটি জায়গাতে, খোমেইনি অথবা তালিবানের ভয়ভীতিকে নিঃসঙ্কোচে উপেক্ষা করে কাতারে কাতারে মেয়েদের এই যে রাস্তায় নেমে আসা, তা নিঃসন্দেহে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। কোথাও গিয়ে যেন বা মনে হচ্ছে, এক নতুন সকালের সময় আসন্ন।
“এলি শফাকের বই কিনেছিলাম সেদিন। বই কিনে বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। তারপর মনে মনে উপলব্ধি করছিলাম, লাইব্রেরী জায়গাটা কত ভালো লাগে আমার। বই দেখতে, বই পড়তে ভালো লাগে। তালিবানের নাম, তালিবানের ইতিহাস আমাকে আতঙ্কিত করে। কিন্তু আমাকেও ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করতেই হবে” – মর্জিয়া (১৬)
ষোলো বছরের মর্জিয়ার ডাইরি থেকে এই কথাগুলো পাওয়া গেছে। লেখার তারিখ ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২। ঠিক আটদিন পর, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে কাবুলের দশ্ত-এ-বার্চি এলাকায় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হঠাৎ নেমে আসা বোমা বিস্ফোরণে আরও প্রায় ৬০জন হাজারা গোষ্ঠীভুক্ত মেয়ের সঙ্গে সেও নিহত হয়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ ভাবেই হাজারা জনগোষ্ঠীর মহিলাদের জন্য কাজ করত। হামলার সময় সেখানে শতাধিক হাজারা মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সংখ্যালঘু হাজারা গোষ্ঠী আফগানিস্তানের ইতিহাসে বারংবার এমন জাতিগত আক্রমণের শিকার হয়েছে। বিশেষত তালিবান আমলে বামিয়ান ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে যে নারকীয় গণহত্যার ইতিহাস আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তাই বলে দেয় মোট আফগান জনসংখ্যার প্রায় ১৫% অংশীদারীত্বের মালিক হওয়া সত্ত্বেও হাজারারা কি ভয়াবহ জাতিগত গণহত্যার ক্ষতচিহ্নকে বুকে নিয়ে বেঁচে আছে। অথচ এর বিপরীতেও হাজারা সম্প্রদায়, হাজারা মেয়েরা তাদের মতো করে প্রগতিকে জারি রাখতে চেয়েছে। যে কারণে সাম্প্রতিক অতীতে মসজিদ ভিন্ন আর যে সমস্ত জায়গাতে হাজারাদের উপর আঘাত নেমে এসেছে, সেগুলি মূলত হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান, ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিবাহবাসরের আনন্দ অনুষ্ঠানের মঞ্চ। হাজারাদের বিরুদ্ধে অঘোষিত এথনিক ক্লিন্সিং শুরু করেছে তালিবান ও ইসলামিক স্টেটের যৌথ সন্ত্রাসী মঞ্চের কুশীলবেরা সবাই। কিন্তু এরও বিপরীতে এমন প্রতিক্রিয়াও যে নেমে আসতে পারে, আন্দাজ করেনি কেউ।
ইরানে মহিলাদের আন্দোলন শুরু হওয়ার পরেপরেই আফগানিস্তানের এক নারীকে সোশ্যাল মিডিয়াতে নাচের মাধ্যমে প্রতিবাদে সরব হতে দেখা গিয়েছিল। পাশাপাশি বামিয়ান অঞ্চলে কোনও এক জলাশয়ের পাশে বসে এক হাজারা মহিলার সুরেলা কণ্ঠে, সবকিছুকে উপেক্ষা করে গান গাইবার ভিডিওচিত্রও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতে পেরেছিল। এর পরেপরেই ঘটে যায় কাবুলের আক্রমণ। ৬০জন তরতাজা, পড়াশুনো করতে চাওয়া হাজারা মেয়ের শহীদ হওয়ার ঘটনাতে বিস্ফোরণ ঘটে আফগান মেয়েদের অন্তর-মহলে। ইরানে মেয়েরা ইতিমধ্যেই পথ দেখিয়েছে। ইরানের স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে একনায়ক খোমেইনির ছবি অবধি নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খোমেইনি জমানার সমর্থক, প্রাক্তন কোনও সেনা আধিকারিক বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে বক্তৃতা করতে এলেও, মেয়েরা তাঁরই সামনে মাথার হিজাব খুলে ফেলে বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন। লাঠি-গুলির ভয় দেখিয়েও আর কোনও ভাবেই সেদেশের মেয়েদের দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। রাজপথ কেঁপে উঠছে ‘জান, জিন্দগি, আজাদি’র সরব চিৎকারে। একইরকম ভাবে এক বিপ্লব সূচিত হয়েছে আফগানিস্তানে। “নিরাপত্তা আমাদের অধিকার, শিক্ষা আমাদের অধিকার, গণহত্যা বন্ধ হোক!", এই শ্লোগানেই সেদেশের রাজপথকে মুখর করে তুলেছেন সেদেশের মেয়েরা। তালিবানদের বিরুদ্ধে এ যেন এক অবাক নারী-অভ্যুত্থানের গল্প! আফগান ট্যুইটারে দশলক্ষেরও বেশিবার শেয়ার হয়েছে #স্টপহাজারাজেনোসাইড’এর হ্যাশট্যাগ বার্তাটি। বিদ্রোহের আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে।
গত সোমবার, উত্তর বলখ প্রদেশের মাজার-ই-শরিফ শহরে অন্যতম বড় বিক্ষোভের ঘটনাটি ঘটেছে। মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের মূল নেতৃত্বে সংঘটিত হওয়া এই বিক্ষোভ আন্দোলনকে তালিবান বলপূর্বক দমনের চেষ্টা চালিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বহুসংখ্যক মহিলা ছাত্রীকে জোর করে ছাত্রী-আবাসের ভিতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই অবস্থাতেও আটকে থাকা মেয়েরা আওয়াজ তুলছেন, “নীরবতা আসলে বিশ্বাসঘাতকতা!” মাজার-ই-শরিফের রাজপথে মিছিলে শামিল হওয়া তরুণীরা আওয়াজ তুলছেন, “আমরা নিষ্পাপ, আমাদের মেরো না! আমরা শুধু পড়তে চেয়েছি!” হেরাট ও বামিয়ান প্রদেশ থেকেও হাজারা-গণহত্যা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভের খবর এসেছে। শূন্যে গুলি চালিয়েও তালিবান জঙ্গিরা সেই বিক্ষোভ-আন্দোলনকে প্রতিহত করতে পারেনি। তারা হুমকি দিয়েছে, বিক্ষোভ না থামালে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে মসজিদে পরিণত করা হবে। মেয়েরা বিক্ষোভ চালিয়ে গিয়েছে। মাথায় গুলি করার হুমকি সত্ত্বেও, মেয়েরা শ্লোগান দিতে পিছপা হয়নি। রূপকথার চেয়েও আশ্চর্য মনে হয় এসব। মনে রাখতে হবে, ২০২১এর আগস্টে ক্ষমতা দখলের পরেপরেই আফগানভূমে সমস্ত ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে তালিবান নেতৃত্ব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর পরেও মেয়েদের এই যে স্বতঃস্ফূর্ত রাস্তায় নেমে আসা, তাই দেখিয়ে দিচ্ছে আজ – নতুন প্রভাতের আগমন আসন্ন। দশ্ত-এ-বার্চি এলাকাতে এখনও ঝুলে রয়েছে ৩০শে সেপ্টেম্বরের হামলায় শহীদের মৃত্যু বরণ করা দুই হাজারা কিশোরীর ছবি। তলায় লেখা রয়েছে তাদের স্বপ্নের কথা। তারা দুজনেই এঞ্জিনিয়র হতে চেয়েছিল।
শেষ খবর পাওয়া অবধি জানা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে হাজারাদের উপর নেমে আসা এই গণহত্যার বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের তরফে জানানো হয়েছে, হাজারা অধ্যুষিত প্রদেশগুলিতে তালিবানের তরফে বিশেষ ভাবে পাশতুন গোষ্ঠীভুক্ত নেতাদের ক্ষমতার উচ্চপদে বসানো হয়েছে। যা কি না এই গণহত্যা ও জাতিবিদ্বেষের পরিমণ্ডল সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। এসব সত্ত্বেও, মেয়েদের বিক্ষোভ, মেয়েদের রাস্তায় নেমে আসা – এই সবকিছুই তালিবান নেতৃত্বের কাছে অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের কাছে যা ঝড় ও সূর্যোদয়ের পূর্বাভাস।
ইরান থেকে আফগানিস্তান, গোঁড়া ইসলামিক মৌলবাদী একনায়কতন্ত্র, এমনকি তালিবানদেরও বিরুদ্ধে অবধি যে প্রজন্ম আওয়াজ তুলেছে –তার লড়াই বহুদূর অবধি পৌঁছবে। নারী আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায় লেখা শুরু হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। কেবল নতুন নেতৃত্ব, বা নতুন প্রজন্ম নয় – এ এক নতুনতর সাহসের নারী আন্দোলন। মৃত্যুভয়কে যেদিনই মানুষ তুচ্ছ করতে পেরেছে, সেদিনই রচিত হয়েছে ইতিহাস। ইরান, আফগানিস্তানের মেয়েরা আজ সেই ভয় তুচ্ছ করারই বার্তা দিতে দিতে চলেছে। হিংসার বিপরীতে হিংসা নয়, অহিংস অথচ দুঃসাহসী প্রতিরোধ, যা কি না তাদেরকে কালাশনিকভের সামনেও বুক চিতিয়ে দিতে ভয় পাওয়াচ্ছে না, সেই প্রতিরোধই আজ নতুন ইতিহাস রচনার অপেক্ষায়। এই লড়াইকে যে সরবে আজ উদযাপন করতেই হতো! এই লড়াই আজ আমাদের সকলকে উদ্বুদ্ধ করে। ইরান-আফগানিস্তানে বসন্তের আগমনী আজ সময়ের অপেক্ষা কেবল।
0 Comments
Post Comment