- 22 February, 2021
- 0 Comment(s)
- 888 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮২৭ সালে মধ্য লন্ডনের অভিজাত বেলগ্রাভিয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন শারীরবিদ্যার জগদ্বিখ্যাত অধ্যাপক হেনরি গ্রে। ১৮৫৩ সালে তিনি সেন্ট জর্জেস হসপিটাল মেডিক্যাল স্কুলে শারীরবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৫৫ সাল থেকে তিনি বন্ধু হেনরি ভ্যানডাইক কার্টারের সঙ্গে যৌথভাবে শবব্যবচ্ছেদ এবং মানুষের দেহের বিন্যাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। দীর্ঘ সেই গবেষণার ফসল হিসেবেই ১৮৫৮ সালে লন্ডনে, প্রকাশক জন উইলিয়াম পার্কারের হাত ধরে প্রকাশিত হয় ‘গ্রে’জ এ্যানাটমি’। এ্যানাটমি বা শারীরবিদ্যার জগতে আলোড়ন ফেলে দেয় এই বইটি। ১৮৫৯ সালে বইটির প্রথম আমেরিকান সংস্করণটিও প্রকাশিত হয়। বিশ্বজুড়ে ডাক্তারি ছাত্রদের কাছে এই বইটি অপরিহার্য এবং অবশ্যপাঠ্য। কিন্তু এই ‘গ্রে’জ এ্যানাটমি’র অনেক আগে থেকেই শারীরবিদ্যা বা এ্যানাটমি নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে গুরুগম্ভীর চর্চা হয়েছে। এমনকি একজন মানুষের দেহবিন্যাসকে বা দেহতন্ত্রকে যে সঠিক ভাবে চিত্রিত করে অথবা মডেলের সাহায্যে শিক্ষার প্রয়োজনে ফুটিয়ে তোলা উচিত, বর্ণনা করা উচিত— সেই নিয়েও যথেষ্ট পরিমাণে কাজ হতে পেরেছে। আর সেখানেও, পুরুষ গবেষকদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন নারী প্রতিভূরা, যথাক্রমে মেরি মার্গেরিট বিহেরঁ এবং আনা মোরান্দি মাঞ্জোলিনি। পাশাপাশি দেখা যাক এই দুই মহীয়সীর অবদান।
মেরি মার্গেরিট বিহেরঁ এবং আনা মোরান্দি মাঞ্জোলিনি, প্রথম জনের জন্ম ফ্রান্সে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় জন জন্মসূত্রে ইতালীয়, তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ কি না এই দুই মহীয়সীরই জন্ম হয়েছিল গ্রে’জ এ্যানাটমি প্রকাশেরও প্রায় একশো চল্লিশ বছর আগেকার সময়ে। ফ্রান্সের মেরি মার্গেরিটের কথাই আগে বলি। তাঁর পিতা ছিলেন পেশায় ফার্মাসিস্ট। বিশিষ্ট চিত্রকর ম্যাডেলিন ব্যাসপোর্টের কাছে তিনি চিত্রাঙ্কন শিক্ষা করেন। ক্রমশ শারীরবিদ্যার প্রতি আগ্রহ জন্মালে মেরি মার্গেরিট শবদেহ ব্যবচ্ছেদে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই সময়ে সরাসরি কাটাছেঁড়া বা পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য শবদেহ পাওয়াটা একজন মহিলার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। সৈন্যবাহিনীর দুচারজন অফিসার বা সেনাকর্মীদের কল্যাণে একআধসময়ে দুটি একটি বেওয়ারিশ দেহ পাওয়া গেলে পরে, মেরি মার্গেরিট সেগুলির উপরেই পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই এই সমস্ত দেহগুলি প্রায় পচন ধরা অবস্থায় পাওয়া যেতো বলে মেরি মার্গেরিটের ততটাও কার্যসিদ্ধি হতো না। এই সময় ম্যাডেলিন ব্যাসপোর্ট তাঁকে বুদ্ধি দেন মোমের মাধ্যমে মানবদেহের বা দেহতন্ত্রের মডেল তৈরি করতে। যেমন ভাবা তাঁর তেমনই কাজ। ক্রমশ মোমের মাধ্যমে শারীরবিদ্যার মডেল তৈরিতে রীতিমতো পারদর্শী হয়ে ওঠেন মাদাম মার্গেরিট। তাঁর কাজের খ্যাতি দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশিষ্ট চিকিৎসকেরা মার্গেরিটের তৈরি মডেলকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেন। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে মেরি মার্গেরিট তাঁর দেশের রয়্যাল সোসাইটি অব সায়ান্সের সামনে নিজের কাজকে তুলে ধরেন। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে আবার এই একই সংস্থার বিশিষ্ট সভ্যদের সামনে মেরি মার্গেরিট তাঁর নিজের তৈরি মোমের একটি গর্ভবতী মহিলার মডেল বর্ণনা করেন। এই মডেলটির বিভিন্ন অংশকে রীতিমতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো যেতো এবং, এমনকি ভ্রূণের অবস্থান বা তার গঠনগত বিষয় সম্পর্কেও এই মডেলটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয়বারের জন্য আবার, ফ্রান্সের রয়্যাল সোসাইটি অব সায়ান্সে সুইডেনের রাজপুত্র গুস্তাভের সফর চলাকালীন নিজের কাজকে উপস্থাপিত করেন মেরি মার্গেরিট। কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সের মাটিতে অন্তত শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে মহিলাদের তেমন একটা অধিকার ছিল না। কাজেই ব্যক্তিগত পরিসরে মডেল বানিয়ে, সেগুলি বিক্রি করে, অল্পস্বল্প গৃহশিক্ষার কাজ করেই মেরি মার্গেরিটকে জীবনধারণ করতে হত। পরবর্তীতে, ফ্রান্সে বসে কোনোভাবেই শারীরশিক্ষার বিষয়ে একজন মহিলার পক্ষে শিক্ষাদান করা সম্ভব নয় বলে মেরি মার্গেরিট বিহেরঁ ইংল্যান্ডে চলে আসেন। এখানে বিখ্যাত সার্জন জন হান্টার তাঁর কাছ থেকে শারীরবিদ্যার পাঠ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এমনকি হান্টারের লিখিত বইতে বেশ কিছু চিত্রাঙ্কন দেখেও সন্দেহ হয় যে সেগুলি আসলে বিহেরঁ’রই শিল্পকর্ম। নিজের তৈরী মডেল বিক্রি করেও সংসার চালাতেন মার্গারিট। তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে ছিলেন ডেনমার্কের রাজা এবং রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথারিন প্রমুখ। শারীরবিদ্যার জগতে মোমের তৈরি এ্যানাটমিক্যাল মডেলিংয়ের বিষয়ে নতুন একটি দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন মেরি মার্গেরিট বিহেরঁ, আর সেই একই সময়ে ইতালিতেও বিপ্লব চালাচ্ছেন আরেকজন।
২১শে জানুয়ারি, ১৭১৪ সাল। আনা মোরান্দি মাঞ্জোলিনি জন্মগ্রহণ করেন ইতালির বোলোনা শহরে। রক্ষণশীল একটি পরিবারে জন্মেও ক্রমশ নিজের দক্ষতায় এবং স্বামীর সহযোগিতায় শারীরবিদ্যার জগতে নিজের ছাপ রেখে যাবেন এই মহীয়সী। ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে আনা মোরান্দির সঙ্গে বিবাহ হয় জিওভান্নি মাঞ্জোলিনির। এই জিওভান্নি মাঞ্জোলিনি ছিলেন বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার অধ্যাপক। স্বামী-স্ত্রীতে মিলে নিজেদের বাড়িতে রীতিমতো একটি স্টুডিও তৈরি করে ফেলেন, যেটি ক্রমশ একটি গবেষণাগার-তুল্য জায়গা হয়ে ওঠে তাঁদের দুজনের কাছে। দীর্ঘসময় ধরে এই স্টুডিওতে শবব্যবচ্ছেদ চলতো আর মোমের কারিকুরিতে ক্রমশ বিজ্ঞানী(নাকি শিল্পী)-দের হাত ধরেই একে একে মূর্ত হয়ে উঠত মানবদেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন। বিহেরঁ’র মতোই আনা মোরান্দিরও নাম ক্রমশ দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই সময় তিনি রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথারিন-সহ একাধিক রাজদরবারে গিয়ে নিজের কাজকে উপস্থাপিত করেন। স্বামীকে ছাড়াই নিজে হাতে সাহসের সঙ্গে তিনি প্রকাশ্যে শবব্যবচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় অংশ নেন এবং মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠনকে সেই ব্যবচ্ছেদের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন। শোনা যায়, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে প্রায় ১০০০টিরও বেশী শবব্যবচ্ছেদের প্রক্রিয়াকে আনা মোরান্দি একা হাতে পরিচালনা করেছিলেন। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে আনা মোরান্দি মাঞ্জোলিনির স্বামী জিওভান্নি মাঞ্জোলিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগই শেষ অবধি তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজদরবারে ঘুরে ঘুরে শারীরবিদ্যার বিষয়ে হাতেকলমে বর্ণনা দেওয়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ফলে শারীরবিদ্যার তাত্ত্বিক বিষয়টিতেও আনা যথেষ্টই পোক্ত হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি স্বামীর অসুস্থতার সময়ে একাধিকবার বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীর জায়গায় তিনিই বক্তৃতা দিয়েছেন, শিক্ষকতা করেছেন। কাজেই স্বামী জিওভান্নির মৃত্যুর পর, ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে আনা মোরান্দি মাঞ্জোলিনি স্বয়ং বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ সময়ের শারীরবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। মোরান্দির তৈরি মডেলগুলি এখনও বোলোনার বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেখানকার রাজপ্রাসাদে সংরক্ষিত আছে। দেহ বা দেহতন্ত্রের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ও তাঁর মডেলগুলির মধ্যে দিয়ে উঠে আসতো। এমনকি শিরা, ধমনী, রক্তনালি ও রক্তজালিকার মতো অতিসূক্ষ একেকটি উপাদানও তাঁর মডেলে পরিলক্ষিত হতো। মনে রাখতে হবে ‘গ্রে’জ এ্যানাটমি’র বই বেরুতে তখনও এক শতাব্দীরও বেশি সময় বাকি রয়েছে। মডেল বানাতে বানাতেই, চোখের কিছু বিশেষ পেশীসমুহের মতো দেহের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টেরও আবিষ্কার করেন এই আনা মোরান্দি মাঞ্জোলিনি। শারীরবিদ্যার ইতিহাসে তাই তাঁর নামও হেনরি গ্রে অথবা মার্গেরিট বিহেরঁয়ের মতোই স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হয়ে থাকবে।
এই ধারাবাহিক রচনাতে যতই লিখছি ততই যেন জানতে পারছি যে, নারীর ইতিহাসে যেমন দুঃখ আছে, লাঞ্ছনা আছে, অবহেলা আছে— তেমনই আছে উদযাপন, উপলব্ধি, প্রাপ্তি এবং জয়যাত্রার ইতিহাস। শতবছরের, সহস্রবছরের এই সমস্ত মহীয়সীরাই শিক্ষার পথে, সমৃদ্ধির পথে, বিজ্ঞানের পথে কেবল নারীজাতিকে নয়, সমগ্র মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আজ কেবল একেকটি করে পাতা উলটিয়ে যাই। একেকটি করে প্রাপ্তির ইতিহাস চোখে পড়ে। একেকটিবারে থমকে দাঁড়াই, কিছুক্ষণ। আমাদের তাই প্রতি সপ্তাহের, প্রত্যেকটি দিনেই নারীদিবস।
সূত্রঃ
[১] রেবেকা মেসবার্গার ও অন্যান্য, ‘দ্য কনটেস্ট ফর নলেজঃ ডিবেটস ওভার উইমেন’স লার্নিং ইন এইটিনথ সেঞ্চুরি ইতালি’, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো, ২০০৭
[২] লুইস এস. গ্রিন্সটাইন, ‘উইমেন ইন বায়োলজিক্যাল সায়ান্সেসঃ এ বিবলিওগ্রাফিক সোর্সবুক’, গ্রিনউড প্রেস, ১৯৯৭
[৩] মেরিলিন ওগিলভি ও অন্যান্য, ‘দ্য বায়োগ্রাফিক্যাল ডিকশনারি অব উইমেন ইন সায়ান্স, দ্বিতীয় খন্ড’, রুটলেজ, নিউ ইয়র্ক, ২০০০
[৪] জুন কে. বার্টন, ‘নেপোলিয়ন এ্যান্ড দ্য উইম্যান কোয়েশ্চেনঃ ডিসকোর্সেস অব দ্য আদার সেক্স ইন ফ্রেঞ্চ এডুকেশন, মেডিসিন এ্যান্ড মেডিকেল ল ১৭৯৯-১৮১৫’, টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৭
[৫] ক্যাথারিন হেইন্স, ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন ইন সায়ান্সঃ এ বায়োগ্রাফিক্যাল ডিকশনারি টু ১৯৫০’ ২০০১
[৬] লরা লিন উইন্ডসর, ‘উইমেন ইন সায়ান্সঃ এ্যান এনসাইক্লোপিডিয়া’, ২০০২
ছবি : আনা মোরান্দি মাঞ্জোলিনি এবং (ডানদিকে) তাঁর তৈরি মডেল
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment