- 04 March, 2022
- 0 Comment(s)
- 708 view(s)
- লিখেছেন : তানভি সুলতানা
সাত নয়, তুমি থাকবে পাঁচের মতো। না না পাঁচ নয়, তোমার থাকা উচিত তিন হয়ে। না না, তিন কেন? ছয়ও তো হতে পারে, ছয়ই বা হবে কেন? আট কী দোষ করলো?
উপরের বক্তব্যকে খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায় তা হল কেউ একজন কাউকে বলছে তোমাকে অমুক হতে হবে। অন্য একজন বলছেন না অমুকই কেন তমুক হওয়া উচিত। অন্য আরেকজন এসে চাপিয়ে দেয় তমুকই কেন? অন্যকিছু হতে পারতো না?
আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এইসব বক্তা প্রচুর। আর শ্রোতা? তাদের শুধু শুনলেই হয় না, মানতেও হয় ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক। তাকে হতে হয় তিন। পাঁচ। ছয়। আট। যখন যেভাবে বক্তারা চান।
এখানে বক্তা আর শ্রোতাকে অতিসরলীকরণ করলে যা দাঁড়ায়, যথাক্রমে পুরুষ এবং নারী। আর প্রসঙ্গ পোশাক।
পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে লিখতে বসে যদি এক পলক চোখ বুজে আমার ছেলেবেলাতেই ফিরে যাই, তাহলেই দেখা যাবে এই বক্তাদের বাড়বাড়ন্ত। তাদের চাপিয়ে দেওয়া। চোখ রাঙানি। আমার ছেলেবেলার একাংশ কেটেছে মুসলিম আবাসিক মিশনে। যেখানে স্কুল ইউনিফর্মে চুড়িদারের সাথে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা বিশাল ওড়না, যা দিয়ে ঢেকে রাখতে হচ্ছে পুরো শরীর। তখনই শুনেছিলাম হিজাব বা পর্দা করা এসবের কথা। নিজেকে পর্দা করার পেছনেই বা লজিক কী? কেনই বা করবো নিজেকে আড়াল? কাদের থেকে করবো? এইসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। মাথা থেকে মুখ ফুটে উচ্চারণ অবধি আমার কৈশোর কেটে গেল নিজেকে ঢেকেঢুকেই। এভাবে একের পর এক প্রজন্ম। একের পর যুগ। পর্দা বা হিজাব চলে এসেছে বক্তাদের চোখ রাঙানি বা চয়েস নিয়ে। হিজাব কতটা চোখ রাঙানি আর কতটা চয়েস সেই ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। হিজাব যে মধ্যযুগীয় একটি প্রথা তা নিয়েও কোনও দ্বিমত নেই। মেয়েদের ঠিক কতটা পণ্য ভাবলে ধর্মে, সমাজে বারবার তাঁদের পর্দা করা বা শরীর ঢাকার নির্দেশ দেওয়া হয় সে নিয়ে আলাদা করে আলোচনার অবকাশ রাখে না।
কিন্তু তার মানে কি এই দাঁড়ায়, কর্ণাটকের ঘটনা সমর্থনযোগ্য? এক্কেবারেই না। একটা মেয়ে কী পোশাক পরে কলেজে আসতে চাইছেন, শুধুমাত্র সেইজন্য যদি তাঁকে ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে অনেকগুলো পুরুষ তাঁর দিকে রে রে, ধর মার করে তেড়ে যান সেটাও মধ্যযুগীয় বর্বরতার বাইরে পড়ে না। আমার দেশে হিজাব বিতর্ক নতুন নয়। এর আগেও বহু জায়গায় পক্ষ বা বিপক্ষ নিয়ে নানান বিতর্ক এসেছে। যেমন কিছুদিন আগেই কাশ্মীরে দ্বাদশ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে হিজাব না পরার অভিযোগে নোংরাভাবে আক্রমণ করা হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁকে আক্রমণের হুমকি অবধিও দেওয়া হয়। কর্ণাটকের মান্ডিয়ার রোটারি স্কুলে ছাত্রীদের হিজাব খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে বলা হয়। এই নিয়ে অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের বিবাদও বাঁধে। কিন্তু মুসকানের ঘটনা এই সমস্ত হিংস্রতাকে ছাপিয়ে যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে আমাদের মতো প্রত্যেক মেয়েদের কাছে তা নিতান্তই ভয়ংকর এবং প্রশ্ন তোলে আমাদের আইডিন্টিটি নিয়ে। শুধুমাত্র বোরখা পরে কলেজে ঢোকার জন্য ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানে একদল পুরুষের যে হিংস্র চিৎকার তা আমাকে শিহরিত করেছে। আরও বেশি শিহরিত করেছে মেয়েটার পালটা মুঠো এবং পালটা আল্লাহু আকবর। জয় শ্রী রাম বনাম আল্লাহু আকবর যতই ধর্মীয় লড়াই বলে দাগিয়ে দিতে চান লোকজন আমার ততই মনে হয় ভুল। ভীষণ বড়ো একটা ভুল। সেদিনের ওই জয় শ্রী রাম বনাম আল্লাহু আকবর যতটা না ধর্মের তার চেয়ে অনেক বেশি নারী বনাম পুরুষের। ফ্যাসিবাদ বনাম শোষিত হতে হতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কোনও অসহায়তার। আর সেই সমস্ত অসহায়তার আস্ফালন হিসেবে মুসকানের কেবলমাত্র একটা ‘আল্লাহু আকবর’।
শুধুমাত্র পোশাকের দোহাই দিয়ে যদি বিজেপি বা কোনও সরকার মনে করে মুসলিম মহিলাদের শিক্ষার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে তাহলে সেই দলের মানসিকতা শুধুমাত্র ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই না। এবার কোনও সরকার যদি ক্ষমতা দিয়ে নির্ধারণ করে দিতে চায় পোশাক তাহলে মৌলবাদ আর সরকারে তফাৎ থাকে না খুব একটা। ‘তোমাকে হিজাব পরতেই হবে’ যতটা ধর্মের, ‘হিজাব পরে এলে তোমাকে শিক্ষাঙ্গনে ঢুকতে দেওয়া হবে না’ ততটাই ক্ষমতার। এবার এই ধর্ম বনাম ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা মেয়েরা চিরকালই ভুক্তভোগী। অসহায়। আর আমার স্ট্যান্ড পয়েন্ট বরাবরই ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে বা তাদের পক্ষে যারা হিজাব খুলে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চান খোলা চুল, যারা নিজেরা বেছে নিতে চান হিজাব নাকি জিন্স, যারা নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী পরতে চান নিজেদের পোশাক। এক্ষেত্রে কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও প্রতিষ্ঠান বা কোনও ধর্মীয় মৌলবাদ নির্দেশ বা ফতোয়া দিয়ে ঠিক করে দিতে পারে না কে কী পরবে। কে কী পড়বে। আমাদের লড়াই করতে হবে যেকোনও চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধেই। হিজাব যেমন পরতেই হবে এমনও না, আবার অন্যদিকে হিজাব পরলে তাকে মব করে জয় শ্রী রাম স্লোগান দিয়ে হিজাব খুলে নিতে হবে এমনটাও না। এই দুই আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই আমাদের, মেয়েদের তৃতীয় পক্ষের লড়াই বা জেহাদ। কোনওরকমভাবেই কোনও ধর্ম, কোনও দল, কোনও প্রতিষ্ঠান,কোনও জাতি নিজ নিজ মব লেলিয়ে, উড়ো মন্তব্য ছুঁড়ে, দু’টো চোখরাঙানি দিয়ে ঠিক করে দেবে না আমার শিক্ষার মৌলিক অধিকারের সীমারেখা ঠিক কতটুকু। আমার পোশাকের স্বাধীনতা কতটুকু। সাত,পাঁচ, আট বা ছয় নয়, আমরা হতে চাই আমাদের মতোই।
সৌজন্য সহমন
0 Comments
Post Comment