ঘর

  • 03 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 290 view(s)
  • লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
খাতার ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে হনহন করে নেমে এল শ্যামলী। কৌশিকের ব্যাখ্যা দেবার কাতর প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে, তার সাধের ‘ঘর’, তার সাজানো বাগানের দিকে একবারও না ফিরে তাকিয়ে শ্যামলী হাঁটতে শুরু করল কোনও এক অনির্দেশ্য ঠিকানার উদ্দেশ্যে।

সকাল সাতটা বাজে। অভি বোধহয় এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। বড় রাত জাগে ছেলেটা। অভির মা মর্নিং স্কুলে পড়ান। উনি এতক্ষণে নিশ্চয় বেরিয়ে গেছেন। রিনি কলিং বেল বাজাল। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। অভি, তুমি জাগো! তোমাকে যে আমার এখন বড় দরকার! অভির মোবাইল এখনো সুইচ অফ। রিনি আবার বেল বাজাল। এবার বোতামটা অনেকক্ষণ ধরে টিপে ধরে থাকল। আরো দু’ মিনিট পরে আবার। এবার ভেতরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। অভি দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়াল। চোখ ঘুমে এখনও আধ-বোঁজা।
‘তুই?’
‘অভি, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে’।
‘ভেতরে আয়’।
ভেতরে ঢুকেই রিনি ঝাঁপিয়ে পড়ল অভির বুকে। গতকাল রাত থেকে রিনির মন বড় অশান্ত। রিনির বাবা গতকাল রাত্রে সাফ-সাফ জানিয়ে দিয়েছে, অভির সঙ্গে তাকে মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। অভি অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে নয়। অভির ছয় বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। অভির মা প্রাইমারী স্কুলে পড়িয়ে ছেলেকে মানুষ করেছেন। তবে রিনির বাবার মতে, অভি যে পুরোদস্তুর মানুষ হয়েছে বলা যায় না। কোথায় ডাক্তারী-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলার চেষ্টা করবে তা নয়, সে পড়ল ইতিহাস। যদিও এম.এ পরীক্ষায় তার রেজাল্ট ভালই, এবং এক বারেই নেট পরীক্ষাতেও উতরে গেছে, তবু চাকরি এখনও দূর অস্ত। অভির বাবার দৃঢ় ধারণা, কলেজে পড়িয়ে আর মহাভারত-সমান গবেষণাপত্র লিখে কেউ সংসার প্রতিপালন করার যোগ্য হয়ে ওঠে না। তিনি নিজে ডাক্তার। এই শহরে তাঁর ভালোই পসার। রিনির দাদা আই.আই.টি পাশ ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে আমেরিকায় কর্মরত। রিনির বাবা মেয়েকে ইতিহাস পড়তে বাধা দেননি কারণ তিনি মনে করেন আর্টস পড়লেই বরং মেয়েদের বিয়ের বাজারে দর বাড়ে। রিনি কনভেন্টে পড়া, দেখতেও যথেষ্ট ভালো। তার জন্য ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার-এম.বি.এ পাত্র জোগাড় করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। বিদেশে কর্মরত পাত্রও অমিল হবে না। কিন্তু তাঁর মেয়ে যে নির্বুদ্ধির মতো সহপাঠীর সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করবে তা ধীরাজবাবু স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। গতকাল রাত্রে চেম্বার থেকে ফেরার পর রিনির মা আসেন তাঁর কাছে। স্বামীকে বোঝান, এবার মেয়ের বিয়ে দেবার সময় এসেছে। বয়স হচ্ছে দুজনেরই, তাছাড়া মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তিন বছরের বড় ছেলেরও বিয়ের জোগাড় এবার শুরু করা যায়, ইত্যাদি। কথায় কথায় মেয়ের পছন্দের কথাও জানান। রিনি তার মাকে মনের সমস্ত কথাই খুলে বলে। মা তার বন্ধুর মতই। অভির গল্প সে মায়ের কাছে খোলামেলাভাবেই করে। অভিকে বিয়ে করার ব্যাপারে তার মায়ের কোনো আপত্তি নেই। মেয়ে পড়াশোনায় ভালো, সেও কলেজ-বিশ্বাবিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। এব্যাপারে দুজন দুজনকে সাহায্য করছে। তাছাড়া রিনির মায়ের মন বলে, অভি তার মেয়েকে বুঝবে। রিনির বাবা যে খুব সহজে এ বিয়েতে মত দেবে না, সে আশঙ্কা তাঁর ছিল, কিন্তু একেবারেই যে তিনি বেঁকে বসবেন তা তিনি ভাবেননি। গতকাল রাতে তিনি মেয়েকে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন, অভির সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। রিনি বাবার এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কান্নাকাটি চেঁচামেচি করেনি। শুধু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিল, তারপরে গলায় উত্তেজনার ছাপমাত্র না রেখে জানিয়েছিল, বাবার একথা তার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। দৌড়ে বাবার ঘর থেকে চলে এসেছিল সে। সারা রাত নিজের ঘরের বিছানায় ছটফট করেছে সে, তারপর ভোরের আলো ফুটতেই ছুটে এসেছে অভির কাছে। জড়িয়ে ধরে পরপর কয়েকটা চুমু খাওয়ার পর অভি রিনিকে চা করে খাইয়েছে। নিজেও খেয়েছে।
‘তুই এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি যা। আজকেই আমরা ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে নোটিস দেব। আমাদের বিয়ে তোর বাবা আটকাতে পারবে না। কিচ্ছু ভাবিসনা তুই।‘
রিনি আর কিছুক্ষণ চুপ করে অভির গা-ঘেঁষে বসে থাকার পর নিজের ব্যাগটা তুলে নিল কাঁধে। নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিল।
বাড়ি পৌঁছে দেখল বাড়ির সদর দরজার কোলাপসিবল গেটে তালা মারা। এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়। সেই সাত সকালে সে বেরিয়ে এসেছে। তার আগেই দরজার তালা খোলা হয়ে গেছে। আবার কেন দরজায় তালা পড়ল? রিনি বেল বাজাল। একবার, দুইবার, তিনবার। রিনি দোতলার বারান্দায় চোখ তুলে তাকাল। তার মা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। মুখ-চোখ ফোলা। কয়েক মুহূর্ত পরে মাকে আর দেখা গেল না। বাবার রাশভারী গলা কানে ভেসে এল রিনিরঃ
‘ওকে বলে দাও, এ বাড়ির দরজা ওর জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।‘
পাথরের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রিনি যে পথে এসেছিল, সে পথেই ফিরে চলল। তার নিজের বাড়ির দরজা আজ তার জন্য বন্ধ। নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে চেয়েছে বলে। তার ঘর, দক্ষিণের বারান্দা, তার রাশি-রাশি বইখাতা, জামা-কাপড় কিছুই আজ তার আর নয়। সে কোথায় যাবে? অভির বাড়ি? কিন্তু অভির মা যদি তাকে না আশ্রয় দেয়? বাপে-খেদানো মেয়ে বলে ফিরিয়ে দেয়? তবে কোথায় যাবে সে? কোন ঘরে?

 

 

সীমন্তীর আজ মনটা বেশ হালকা লাগছে। কতদিন পর দেখা হল কুট্টিমাসির সঙ্গে, তার মাসতুতো বোন হিয়ার সঙ্গে। বিদেশ থেকে কয়েকদিন হল এসেছে ওরা। উঠেছে দিদার কাছে। সীমন্তীর নিজের ফ্ল্যাট ওখান থেকে খুব দূরে নয়। তবু বেরোতে পারেনি সীমন্তী। তার মেয়ের সবে মাত্র ছয় মাস হল। সীমন্তী স্কুল থেকে ফিরে আসামাত্র আয়ামাসির কোল থেকে ঝাঁপিয়ে চলে আসে তার কোলে। তখন থেকে মাতৃদুগ্ধই তার একমাত্র খাদ্য। যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়ছে ততক্ষণ মাকে ছাড়তেই চায় না। অবশ্য সন্ধের পরেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। এখন আর তার ঘুম ঘন ঘন ভাঙ্গে না। আরেকটু যখন সে ছোট ছিল তখন বারবার তার ঘুম ভেঙে যেত। আবার নতুন উদ্যমে তাকে ঘুম পাড়াতে হত। এব্যাপারে তার স্বামী সৌভিকের অবদান কম ছিল না। কোলে শুইয়ে পা নাচিয়ে গুনগুন করে গান গেয়ে সে ছোট্ট তুলতুলিকে ঘুম পাড়াত। এখন আর তুলতুলিকে নিয়ে এত চিন্তা নেই। নিশ্চিন্তে ওই সময়টা সে নিজের কাজগুলো গুছিয়ে নিতে পারে। সৌভিকের সঙ্গে সারাদিনের জমে থাকা কথাগুলো ভাগ করে নিতে পারে। অথবা হাত-পা ছড়িয়ে কিছুক্ষণ টিভির সামনে বসে থাকতে পারে।
আজ হিয়ার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে মনে ভরপুর খুশি নিয়ে বাড়ি ফিরছে সীমন্তী। একটু রাত হয়ে গেছে ঠিকই। তা হোক। তুলতুলি যদি মাঝখানে উঠেও থাকে নির্ঘাত সামলে নিয়েছে সৌভিক। সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠে থমকে দাঁড়াল সে নিজের ফ্ল্যাটের সামনে। ফ্ল্যাটের বাইরের কোলাপসিবল গেট বন্ধ। তালা মারা। দরজার ওপরকার আলোটাও নেভানো। এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়! রাত্রিবেলা সবাই ঘরে ফিরে আসার পরই তো তাদের কোলাপসিবল গেট বন্ধ হয়! এবং সে ব্যাপারে সীমন্তীকেই উদ্যোগ নিতে হয়। অন্যসময় কাঠের দরজার ছিটকিনি মাত্র বন্ধ থাকে। কি হল? মা নেই টের পেয়ে কি তুলতুলি ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল? তাকে ভোলাতে ছাদে নিয়ে গেছে সৌভিক? তরতর পায়ে ছাদে ঊঠল সীমন্তী। ছাদে কেউ নেই। তাহলে কোথায় গেল সৌভিক মেয়েকে নিয়ে? মেয়েটার কি হঠাৎ করে শরীর খারাপ হল? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছে? তাকে ফোন করে একবার জানাল না কেন সৌভিক? সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল সীমন্তী হাঁফাতে হাঁফাতে। সীজারের পর এখনো শরীরটা এখনো ঠিকভাবে সারেনি। সিঁড়ি উঠতে নামতে এখনো কষ্ট হয়। নীচে নেমে এসে সিকিউরিটির কাছে খোঁজ নিল।
‘দাদা তো বেরোয়নি, বৌদি!’
অজানা এক আশঙ্কায় শিউরে উঠল সীমন্তী। ছুটতে ছুটতে আবার ওপরে উঠে অস্থির হয়ে বেল বাজাতে লাগল সীমন্তী। গেটটা পাগলের মতো ঝাঁকাতে লাগল। উদভ্রান্তের মতো ডাকতে লাগল স্বামীকে। বেশ কিছুক্ষণ পর সৌভিক দরজা খুলল। মুখ তার ভারি থমথমে। কোলে তুলতুলি।
‘কি হয়েছে?’
‘মেয়েকে ফেলে রেখে ফুর্তি করে আসা হল?’
এই ভাষায় সৌভিককে কোনোদিন কথা বলতে শোনেনি সীমন্তী।
‘ফুর্তি কিসের? তুমি তো জানো আমার বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম।’
‘রাতটা তো ওখানেই কাটিয়ে আসতে পারতে!’
‘কি বলছ তুমি’
‘এ বাড়িতে থাকতে হলে এসব ফুর্তিবাজি বন্ধ করতে হবে’।
এ কোন মানুষ! এ কার স্বর! এ কার সঙ্গে ঘর বেঁধেছে সে?
বালির বাঁধের মতো ঝুরঝুর করে ধসে পড়ল সীমন্তীর স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা। এ ঘর ভেবেছিল তার একান্ত নিজের। সেই ঘরের দরজা আজ তার জন্য বন্ধ হয়ে গেছিল কারণ সে নিজের জন্য কিছুটা সময় চেয়েছিল। তবে কোথায় তার ঘর!

৩ 

মেট্রো স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে খেয়াল হল শ্যামলীর। তাড়াহুড়োর মধ্যে সে তো পরীক্ষার খাতাগুলোই আনতে ভুলে গেছে। গতকাল রাত দুটো পর্যন্ত জেগে খাতা দেখেছে সে। সকালে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। ছেলেকে রেডি করে স্কুলবাসে তুলে তারপর নিজের বেরোনর জন্য প্রস্তুত হওয়া। আজকে নম্বর জমা দেওয়ার শেষ দিন। খাতা না নিয়ে গেলে তার বিভাগীয় প্রধান চেঁচামেচি শুরু করে দেবে। শ্যামলীর আর ওসব ভালো লাগেনা। না! বাড়ি না ফিরে উপায় নেই। তার শোবার ঘরের বিছানার ওপর সে সকালেই খাতা ভর্তি ঝোলাটা গুছিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বেরোনোর সময় কি করে যে ভুলে গেল! কলেজ পৌঁছতে তার আজকে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে যাবে কিন্তু উপায় নেই। হেডের ঝাড় থেকে তো বাঁচবে।
রিকশা ধরে অগত্যা বাড়ির দিকে চলল শ্যামলী।। আজকে কৌশিকের অফ ডে। ওর জন্য ফ্লাস্ক ভর্তি কফি করে রেখেছে। টেবিলে দুপুরের খাবার সাজিয়ে রেখেছে। একটা দুটো পদ ফ্রিজ থেকে বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিতে হবে। রান্নার লোক থাকলেও শ্যামলী বরাবরই দুই-একটা পদ নিজে রান্না করতে ভালোবাসে। না করে উপায়ও নেই। ছেলে বা স্বামী কেউই রান্নার মাসির রান্না বিশেষ পছন্দ করে না। তাদের রসনার তৃপ্তির কথা ভেবে তাই প্রায় রোজই শ্যামলীকে এটা-ওটা রাঁধতে হয়। কৌশিক যখন তাকে দশভূজা বলে সম্বোধন করে তখন সে খুশি হয় ঠিকই কিন্তু শ্যামলী আজকাল মাঝেমাঝেই হাঁফিয়ে ওঠে। ক্লান্ত হয়ে যায়। ভুলে যায়। যেমন আজকে ভুলেছে।
রিকশায় বসে ভাবছিল শ্যামলী, তার যে বয়স হয়েছে একথাই কি তার শরীর-মন জানান দিচ্ছে? হল তো তার পঁয়তাল্লিশ গত মাসে। যাকে বলে মধ্যবয়স বা mid-life। এই বয়সে মানুষের কী যে না হয়! নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শরীর-মনের যতসব উপসর্গ। কৌশিকেরও সাতচল্লিশ হবে। কলেজে তার থেকে দুই বছরের সিনিয়র ছিল কৌশিক। বলাই বাহূল্য প্রেমজ বিবাহ। এতগুলো বছর তারা দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছে। আশা করা যায় বাকি জীবনটাও একরকম কাটিয়ে দেবে। তবে কৌশিকের ইদানীং শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সুগার, প্রেশার দুটোই ধরা পড়েছে। মন-মেজাজও একটু অন্যরকম। একটু যেন অন্যমনস্ক। শ্যামলী দশটা কথা বললে একটার উত্তর দেয়। অনেক রাত পর্যন্ত ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে। নাহলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে একনাগাড়ে কথা। বিছানাতেও আজকাল তাকে তেমনভাবে চায় না। একবার দুবার একটা অশুভ সন্দেহ শ্যামলীর মনে উঁকি দেয় ঠিকই কিন্তু শ্যামলী ফুঁ দিয়ে তা উড়িয়ে দিতে চায়। কৌশিককে সন্দেহ করল কী করে সে? কৌশিকের মতো স্বামীভাগ্য কজনের হয়? নিজের মনকেই দোষ দেয় সে। সে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে উঠছে। নিশ্চিতভাবে এটা একটা প্রাক-ঋতুবন্ধ বা মধ্যজীবনের উপসর্গ। না, এবার থেকে যোগব্যায়াম, meditation শুরু করতে হবে। শরীর-মনকে সুস্থ রাখতে হবে।
বাড়ির কাছাকাছি চলে এল শ্যামলী। সুন্দর সাজানো দোতলা বাড়ি। শহরের প্রান্তে বাইপাসের ধারে দুকাঠা জমির ওপর শ্যামলী আর কৌশিক তাদের স্বপ্নের বাড়ি গড়ে তুলেছে। ভালোবেসে নাম দিয়েছে ‘ঘর’। বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে গড়ে তুলেছে তারা তিলতিল করে তাদের ভালোবাসার সংসার। তাদের সুখনীড়। বাড়ির সামনে পরম যত্নে সাজিয়েছে এক চিলতে বাগান।
রিকশা থেকে নেমে শ্যামলী বেল বাজাল। কই বারান্দায় তো বেরিয়ে এল না কৌশিক! একবার, দুবার, তিনবার বেল বাজাল শ্যামলী। কোনো সাড়া নেই। গেটের গ্রিল ধরে ঝাঁকাল। কৌশিকের হল কী? ঘুমিয়ে পড়ল নাকি বাথরুমে? নাকি শরীর খারাপ হল? নাকি…..! শ্যামলীর বুকে যেন কেউ হাতুড়ি পিটোচ্ছে। এক এক মুহূর্ত যেন এক-একটা যুগ। তারপর কৌশিকের একরাশ বিরক্তিভরা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে।
‘কে?’
‘আমি!’
গায়ে পাঞ্জাবী গলাতে গলাতে আরো কিছুটা মুহূর্ত পেরিয়ে কৌশিক থমথমে মুখে এসে বাড়ির গেট খুলে দিল।
‘তুমি আবার ফিরে এলে যে?
কোনো উত্তর না দিয়ে শ্যামলী তরতর করে দোতলায় নিজের শোবার ঘরে উঠে এল। ঢুকেই নাকে লাগল চেনা ঘাম, বীর্য ও অচেনা এক পারফিউমের গন্ধ। সকালে শ্যামলী দক্ষিণাপণ থেকে কেনা যে কলমকারী বেডকভার পাটপাট করে বিছিয়ে গেছিল, তা এলোমেলো। ঘরে কাউকে না দেখে বাথরুমের দরজা পাগলের মতো ধাক্কা দিতে লাগল শ্যামলী। বলাই বাহুল্য সে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। শেষমেষ দরজা খুলে বেরিয়ে এল কৌশিকের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী পামেলা। আগে একবার-দুবার তাকে দেখেছে শ্যামলী। স্যরের কাছে এসেছে পড়া বুঝতে, বই নিতে। কিন্তু আজ স্পষ্টতঃ ই অন্য উদ্দেশ্যে।
খাতার ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে হনহন করে নেমে এল শ্যামলী। কৌশিকের ব্যাখ্যা দেবার কাতর প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে, তার সাধের ‘ঘর’, তার সাজানো বাগানের দিকে একবারও না ফিরে তাকিয়ে শ্যামলী হাঁটতে শুরু করল কোনও এক অনির্দেশ্য ঠিকানার উদ্দেশ্যে।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment