- 23 December, 2020
- 0 Comment(s)
- 739 view(s)
- লিখেছেন : মালেকা বেগম
বনে যদি ফুটলো কুসুম
নেই কেন সেই পাখি ।
কোন্ সুদূরের আকাশ হতে
আনব তারে ডাকি।।
হাওয়ায় হাওয়ায় মাতন জাগে,
পাতায় পাতায় নাচন জাগে গো--
এমন মধুর গানের বেলায়
সেই শুধু রয় বাকি।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড়ো প্রিয় সাথী ছিলেন তোমার। গুনগুনিয়ে গানের সুরে, ছন্দে ছন্দে কবিতায়, ইতিহাস-বুননে, কথায়-সুরের বুননে, পরিবারের একান্ত স্বামীকে বন্ধুর রাখী-বন্ধনে, সন্তান-বংশধরকে আপন বন্ধুত্বের ডোরে জড়িয়ে নিয়ে তুমি উত্তরাদিদি ‘সেনগুপ্ত’ থেকে ‘চক্রবর্তী’-তে পরিচিত হলে ‘বিবাহ-ডোরে’ আবদ্ধ হয়ে। [ এই যাত্রাপথ বিষয়ে তোমার সাথে আগেই আমি কথা বলেছিলাম]। যেদিন তুমি তোমার সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘পথচারী ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত’ [প্রকাশনা ‘সম্পর্ক’, ১ বৈশাখ ১৪২৫, কলকাতা] কলকাতা থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলে, ডাকে-ক্যুরিয়ারে সেদিন বইটির প্রাপ্তি খবর মোবাইলে জানালাম উচ্ছ্বসিত হয়ে। জীবন সংগ্রামের সমতুল্য এই গবেষণা কাজ তোমাকে আনন্দও দিয়েছিল অনেক। গবেষণা যখন নিকটতম আত্মীয়-ব্যক্তিত্বকে নিয়ে (‘মায়ের বাবা’--তুমি তার দৌহিত্র) হচ্ছিল, সেসময় আমার সঙ্গে অনেকবার কথা বলেছ। কেন-না তুমি ইতিহাসচর্চায় নিমগ্ন ‘মানবী বিদ্যাচর্চার নিষ্ঠাবান গবেষক, ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক’ পরিচিতিতে ভাস্বর অনন্য ব্যক্তিত্ব বলেই ব্যক্তি পরিচয়কে স্থান দিয়ে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে ‘ঘরোয়া’ বানাতে চাওনি। ‘কলকাতা-ঢাকা-বিক্রমপুর’ যাত্রাপথটি সশরীরের এবং বিপুল পরিশ্রমে; দীর্ঘ সময় ধরে হলেও ছিল আনন্দময়। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে শুরু করে ‘Office of the Registration and Publication’ পশ্চিমবঙ্গ শাখার তথ্যাদি সংগ্রহের প্রতিটি কাজে; যা তোমার ভাষায় ‘নতুন নতুন আবিষ্কার ও প্রাপ্তির ক্ষেত্র’ বলে অভিহিত--যাঁরা সাহায্য করেছেন অকুণ্ঠভাবে তাঁদের সম্মান জানিয়েছ। ইতিহাসবিদ তুমি একেবারে নির্লিপ্ত থেকেছ যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের সঙ্গে তোমার পরম আত্মীয় সম্পর্ককে প্রচারের-উল্লেখের বাইরে রেখে। বইটির পাতায় পাতায় ইতিহাসবিদ-গবেষক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের ইতিহাস সাধনার গবেষণায় নিয়ত পরিশ্রমী ইতিহাস-বিদ গবেষক উত্তরা চক্রবর্তীকে পাঠক নিঃসন্দেহে স্বীকৃতি দেবেন।
সর্বশেষ গবেষণা-প্রকাশিত বইটি তোমাকে শান্তি দিয়েছিল। তোমার অশেষ জিজ্ঞাসা ছিল ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস’ বিষয়ে। আমার জিজ্ঞাসা ছিল ‘বেথুন কলেজ’ ও লেডি ব্রেবোন কলেজ বিষয়ে ইতিহাসের তথ্যাদি, বই, ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার (১৯৭১, ১৬ ডিসেম্বর) ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন প্রস্তুতির সময় তোমার জন্মদিন ’২৩ ডিসেম্বর’-এর উদ্দেশে তোমার ঘনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ, গবেষক, অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে জানাচ্ছি ‘অভিনন্দন’।
আমি বিশ্বাস করি মানুষের ‘মৃত্যু’ কখনও ‘জীবনের জয়ধ্বনি’-কে কেড়ে নিতে পারে না, নিঃস্তব্ধ করে দিতে পারে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বছরটিতে ১৯৭১-এর অগস্ট-সেপ্টেম্বরের পরে কলকাতা, দিল্লি, জলপাইগুড়িসহ ভারতের নারী-আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সহায়তায় প্রচার আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। ইলা মিত্র, অরুণা কাসভ আলী, কল্পনা দত্ত, রেণু চক্রবর্তী, বাণী দাসগুপ্ত প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত নারী নেত্রীবৃন্দের সাথে পরিচিত হয়ে ও কাজ করতে পেরে জীবন যখন ধন্য হয়ে উঠেছিল রাজনীতি-সংহতি-মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায়, সে সময় তোমার সাথে যোগাযোগ হয়নি।
তোমার সাথে যোগাযোগ হল আমার ছাত্রজীবনের পরম শ্রদ্ধেয় রোকেয়া হল-এর প্রভোস্ট অধ্যাপক আখতার ইমাম আপার সূত্রে। তিনি তোমার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কলকাতার ইতিহাস প্রসিদ্ধ ‘বেথুন কলেজ’-এর ১২৫তম প্রতিষ্ঠা বর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত। The Footsteps of Chandramukhi বইটিতে লেখা দিয়ে সেই কলেজের ছাত্রী (১৯৩৫ সালের) আখতার ইমাম ঢাকা থেকে যুক্ত হয়েছিলেন তোমার যোগসূত্রে। তুমি ছিলে বইটির অন্যতম সম্পাদক। ২০০৪ সালে প্রকাশিত বইটির কাজ শুরুর সময় থেকে অর্থাৎ ২০০০ সালের সময় কাল থেকে (ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী) উত্তরাদি তোমার সাথে পরিচয় বন্ধনে যুক্ত হলাম। আমার অন্যতম সুহৃদ স্নেহাস্পদ অধ্যাপক আফরোজা খাতুন ইতিহাসবিদ না হয়েও ইতিহাস তৈরি করছেন ভারতের মুসলিম নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে। তাঁর মাধ্যমে তোমার সাথে পরিচয় হল কলকাতায়।
সেই সব স্মৃতি ইতিহাস ও ইতিহাস চর্চার অংশ হয়েছে। ক্রমশ তুমি ও আমি ‘এপার বাংলা – ওপার বাংলার’ যোগসূত্র হল। তুমি যত লেখা লিখেছ, ইতিহাস গবেষণার মূল্যবান দলিল হয়ে আছে থাকবে। কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে আমি নারী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে (১৯৬৯) নারী আন্দোলনের ইতিহাস চর্চায় নিমগ্ন হয়ে ইতিহাসবিদ উত্তরা চক্রবর্তীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। শ্রদ্ধেয় যশোধরা বাগচী ও আরও বহুজনের সাথে যখন পরিচিত হচ্ছিলাম, তখন ‘ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহল’ রচয়িতা চিত্রা দেব-এর আকর্ষণে যুক্ত হলাম--তোমাকে সাথী করে। এরকম স্মৃতিকথার ফুলঝুরি উপচে পড়ছে আজ।
ব্যক্তিপরিচয়ের মাধ্যমে তোমার লেখা, গবেষণা, ইতিহাসের শিক্ষকতা, পড়ায় নিবিষ্ট ছাত্রীতুল্য ব্যস্ততা, বন্ধুত্ব, নিমগ্নতা, আবার একই সাথে সাংসারিক দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠ, স্বামী-সংসার বন্ধুত্বের আবরণে ঘিরে রাখা সবই আমাকে মুগ্ধ করেছে, শিখিয়েছে। কলকাতায় তোমাদের বাসায় থেকেছি। দীর্ঘ সময় ধরে বারবার সেমিনার-সভা-গবেষণা ইত্যাদি সূত্রে তোমাদের বাড়িতে আপ্যায়িত হয়েছি, ধন্য হয়েছি।
তোমার লেখা ও সেমিনারে দেওয়া লেকচার এবং গবেষণা সমৃদ্ধ প্রবন্ধ যে সব বইয়ে প্রকাশিধে সে সব বই তুমি আমাকে উপহার দিয়েছ। আমিও দিয়েছি আমার প্রকাশিত গবেষণার বইগুলি। দুজনের বিষয় কিছুটা ভিন্ন--তোমার গবেষণা বইগুলো সমৃদ্ধ ইতিহাসের আকর হিসাবে--আর আমার গবেষণায় আন্দোলন, ঘটনাপ্রবাহ, ব্যক্তিত্বদের অবদান বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। দুজনেই অধ্যাপনায় যুক্ত হয়ে নারী শিক্ষা, নারী আন্দোলন, জেন্ডার চর্চার ইতিহাস অনুসন্ধান, সরাসরি যুক্ততা ও ইতিহাস চর্চার গভীরে যাওয়ার পথে খুঁজেছি।
তোমার সর্বশেষ যুক্ততা মুসলিম নারীর অধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত ভারতের নারীদের অধিকার বিষয়ে গুরুত্ব পেয়েছে। এই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের অন্যতম প্রধান অধ্যাপক আফরোজা খাতুন আবার তোমার অন্যতম সুহৃদ বন্ধু। আজ তারই অনুরোধে তোমার জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকার জন্য লিখছি, কৃতার্থ হচ্ছি।
তোমার সূত্রে পরিচিত হয়েছি ডায়মন্ড হারবার ইউনিভারসিটির অধ্যাপক অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, লেডি ব্রেবোন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল অধ্যাপক শিউলি সরকার, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাসবী চক্রবর্তী প্রমুখ বহু গুণীজনের সাথে। তোমার ও সুভাষদাদার মাধ্যমে সম্মানিত হয়েছি ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-তে। সবই স্মৃতি হয়ে আছে।
তোমার এবং সুভাষ চক্রবর্তী দাদার সাথে সম্পর্কে এতটাই ঘনিষ্ঠ, বন্ধুত্বপূর্ণ ও আপনজনের মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে যে সেসব লিখলে একটা ইতিহাসের বট হয়ে যাবে। মনের পরতে পরতে সেসব লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তোমার জন্মদিন আজ সার্থক হবে নতুন নতুন ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে। সেই আশায় উদ্দীপ্ত হচ্ছি। তোমার-আমার প্রিয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরণাপন্ন হয়ে বলছি :
ফিরবে না তা জানি, তা জানি --
আহা, তবু তোমার পথ চেয়ে জ্বলুক প্রদীপখানি ।।
লেখক : অধ্যাপক (Central Womens University. Chair Person, Sociology and Gender Studies. Dhaka, Bangladesh। ) প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment