- 26 May, 2022
- 0 Comment(s)
- 823 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
মেয়েরা যে পুরুষকে বিয়ে করে সেই পুরুষটিকে ওই মেয়ের স্বামী বলে। স্বামীর সংসার, স্বামীর ভিটে, স্বামীর সোহাগ, স্বামীর অর্থ, স্বামীর খ্যাতির ওপর নির্ভর করে স্ত্রীর মর্যাদা-অমর্যাদা। স্বামীর আভিধানিক অর্থ প্রভু, মনিব, মালিক, অধিপতি। গৃহস্বামী হলো গৃহের মালিক। ভূস্বামী হচ্ছে ভূ অর্থাৎ ভূমি বা জমির মালিক। বিবাহিত পুরুষরাও স্বামী অর্থাৎ স্ত্রীর মালিক। মালিক বা মনিবের নির্দেশ মতোই দাসীদের চলতে হয়। প্রভুর (স্বামীর) কথামতো চললে ভালো। নইলে অত্যাচারের ভয়, আশ্রয় হারানোর আশঙ্কা থেকে যায়। যে মেয়ের উপার্জন নেই, সে ওই মনিবের বাড়ির চাকরিটা বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে। তবে উপার্জন করলেও সব মেয়ে যে প্রভুর নিয়ন্ত্রণে থাকতে অসম্মানবোধ করে তাও নয়। কারণ জন্মের পর থেকেই সামাজিক পরিবেশ মেয়ের কানের কাছে বলে যায়, তুমি উদ্বাস্তু। যেখানে জন্মেছো সেটা তোমার বাস্তুভিটে নয়। এক ভিটেতে মেয়ে তুমি বেড়ে উঠলেও, শেকড় কিন্তু কাটা পড়বেই। তোমাকে থাকতে হবে স্বামীর ভিটেতে। ওটাই তোমার নিজের জায়গা। ধর্মমতে বিয়ে করে পুরুষ তার মাকে গিয়ে দাসী উপহার দেয়। আর দাসীরা শিখে যায় প্রভুর পায়ের নীচে বেহেস্ত। অতএব বেহেস্ত বা স্বর্গে যাওয়ার এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না। সমাজে সুনিপুণভাবে তৈরি হয়েছে এমন কত স্ত্রী-শোষণের চতুর বয়ান। শিশুকাল থেকে সেই বয়ানে কন্যাদের দীক্ষা দেওয়া হয়। তাই কোনটা অপমান আর কোনটা সম্মান, কোনটা শাস্তি আর কোনটা প্রাপ্তি এটা যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারে না অধিকাংশ মেয়ে।
আদর্শ মেয়ে তৈরি করার ছড়াছড়ি চলে সমাজে। আদর্শ নারী, আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ জননী। এই আদর্শ কী? জন্মভিটেতেই আদর্শের অনুশীলন শুরু হয়। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সকলের মন জুগিয়ে চলবে, স্বামীর হুকুম নিপুণভাবে তামিল করবে তবে না সে আদর্শ স্ত্রী! মেয়েরা বিয়ের আগে যখন তার স্বভাব-প্রকৃতি অনুযায়ী চলে, কোন ব্যাপারে জিদ বা দস্যিপনা করে তখন পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়রা ঠাট্টারছলেই বলে, ‘এমন মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে খেদিয়ে দেবে।’ ওই এক শ্বশুরবাড়ি যেটা নাকি মেয়েদের নিজের স্থান, ওই স্থানে ঠাঁই পাওয়ার মতো করে স্বভাব গড়তে হবে এটা তাদের মনে গেঁথে যায়। মেয়েরা তাই স্বাভাবিক নিয়মে নিজের জন্য গড়ে উঠতে পারে না। প্রভুর খুশিতে চলার মতো করে সে গড়ে ওঠে। এই শিক্ষা কিন্তু অনেক মা-ঠাকুমারাই দেন। তাহলে আমরা পিতৃতন্ত্রকে দায়ী করি কেন এই প্রশ্ন আঙুল উঁচিয়ে উঠে আসবে। এটাই তো পিতৃতান্ত্রিক কৌশল। মেয়েদের শোষণ-প্রতারণার জন্য তৈরি করেছে সতীসাধ্বী, সেবাময়ী, মমতাময়ী, দেবী, গৃহলক্ষ্মী নানা বিশেষণ। গৃহপরিসরে বন্দি মেয়ে এমন অনেক মোহময় ভাষায় আচ্ছন্ন হয়েছে। মনঃকষ্টে বুকে ব্যথা,পরিশ্রমে শরীরে ব্যথা। তবু দায় নারীত্ব, মাতৃত্বের আদর্শ বজায় রাখা। কারণ পিতৃতন্ত্রের তৈরি ভাষার রাজনীতিতে তারা আবদ্ধ। সেই বদ্ধজীবনের ছকে আবর্তিত মা-ঠাকুমারা এই নিয়মকে অবধারিত ধরে নিয়ে তাদের মেয়েদেরও সেই আদর্শে গড়ে তোলে। স্বামী-গৃহের পরীক্ষা কেন্দ্রে চাবি দেওয়া পুতুল হয়ে যে মেয়ে সকলকে তুষ্ট করলো, তাকেই না পাশের বাড়ির কাকিমা, উপরতলার পিসিমা, নীচেরতলার মাসিমা, ও পাড়ার মামিমা তাদের বাড়ির মেয়ে-বউকে শুনিয়ে বলতে পারবে, ‘আহা, একেই বলে সতীলক্ষ্মী।’ আর ওই শব্দগুলোতে প্রলোভিত হয়ে পড়া মেয়েরা তখন চাবি-পুতুল হওয়ার প্রতিযোগিতায় জেতার জন্যে প্রাণপণ লড়াই চালাই। তবু কেন মনে জমে ব্যথা?
সুখি সুখি আবরণে-আভরণে মেয়েরা নিজেদের ঢেকে রাখে। অথচ প্রভু-যত্নের গল্প বলতে গিয়ে তার নিজেকে অযত্ন করার, উপেক্ষিত হওয়ার দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। স্বামীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ স্ত্রীটিরও মুখ ফুটে বেরিয়ে পড়ে তার মনের ইচ্ছে। চারবেলা মুখের সামনে খাবার সাজিয়ে দেয় স্বামীকে। হুকুম মাত্রই চা বানায়। কিন্তু তারও যে মনে হয় এভাবেই তাকেও স্বামী যদি খাবার সাজিয়ে দিত। ভালো লাগত এই যত্নের ছোঁয়া। কারো স্বামী অবশ্য ৩৬৫ দিনে পাঁচদিন হয়ত শখ করে খাবার পরিবেশন করে। তার পরেও যদি বউ পরিবেশনে ক্লান্ত হয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে তখন স্বামীদেবতার কঠিন-কঠোর বাক্য ছোটে বউ-এর উদ্দেশ্যে। কারণ ক্লান্ত স্ত্রীর স্বামীও তো পাঁচদিন পরিবেশন করেছে। এই বাস্তবতা চোখ থাকলেই বোঝা যায়। কান পাতলেই শোনা যায়। বাংলাদেশের এক অভিনেত্রী হতাশ হয়ে বললেন, ‘কেন ছেলেরা মনে করে তাদের যত্ন করে খাবার পরিবেশন করা মেয়েদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এই অধিকার শুধু শারীরিক অববয়ের জন্য তারা দাবি করে? একসঙ্গে খেতে বসলেও স্বামীর আবার কিছু অর্ডার থাকলে খাবার ছেড়ে সেই স্ত্রীই কেন উঠবে সেটা আনতে?’ স্ত্রীর কর্মক্ষেত্র বাইরে হোক বা গৃহে হোক, তারা মহিলা শুধু এই কারণেই নির্দিষ্ট কিছু কাজের বোঝা তাদের জন্যই ধার্য করা থাকে। সমাজের চোখে এই কাজগুলো নিম্নমানের। তাই ওটা মেয়েরাই করবে। পুরুষদের অসম্মান হবে গৃহের দৈনন্দিন কাজের রুটিনে দায়িত্ব ভাগ করে দিলে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিছু পুরুষতো ঘরের একঘেয়েমি কাজের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় ভাগ করে নেয়। মুশকিল হলো তাকে নিয়ে আবার অনেকে ব্যঙ্গও করে।
এই প্রজন্ম সচেতনভাবে বিষয়গুলো চর্চায় আনছে। চর্চার পরিধি বাড়লে লিঙ্গীয় বৈষম্যও কমবে। তখন পুরুষ আর স্বামী (মালিক) হয়ে স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে না নিশ্চয়। কিন্তু তার জন্যে যে দরকার শিক্ষা আর সচেতনতা। গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যম্যের ইতিবাচক ভূমিকা পালন। শিশু যদি সিনেমা, নাটক, সিরিয়াল, কার্টুন, বিজ্ঞাপনে লিঙ্গীয় বিভাজন দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে স্বামী (মালিক) হওয়া থেকে তাকে রক্ষা করবে কে? তখন মেয়েরা হয়তো ব্যাপকহারে ঘোষণা করবে (এখনও কিছু মেয়ে করছে), বিবাহ নামক নারী শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানকে আমরা বয়কট করছি।
0 Comments
Post Comment