সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা একটি সাংবিধানিক অধিকার

  • 19 February, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 775 view(s)
  • লিখেছেন : ​​​​​​​শর্মিলা ঘোষ
ভারতে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা আছে বলেই প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে ও মেয়েরা ধর্মের বেড়াজাল ছিঁড়ে অন্য ধর্মের মানুষকে বিয়ে করেছেন, যা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সহ্য হল না ধর্ম ব্যবসায়ীদের। “লাভ জিহাদ” নাম দিয়ে ইন্টারফেথ ম্যারেজগুলো ভাঙো আর তাদের চরম হেনস্থা করো।

লাভ জিহাদ আখ্যা দিয়ে সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্রের অযাচিত হস্তক্ষেপ ফ্যাসিস্ট বিরোধী ও সংবিধানের ওপর আস্থা রাখা যেকোনও মানুষই ভালো চোখে দেখছে না। ভারতে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা আছে বলেই প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে ও মেয়েরা ধর্মের বেড়াজাল ছিঁড়ে অন্য ধর্মের মানুষকে বিয়ে করেছেন।

সম্প্রতি ফেসবুকে দেখা গেছে জয়িতা হালদার নামে একটি মেয়ে ফুরকান মণ্ডলকে বিয়ে করায় সারা ফেসবুক জুড়ে খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটি প্রাপ্ত বয়স্ক, তাই স্বেচ্ছায় যাকে খুশি এবং যে পদ্ধতিতে খুশি বিয়ে করতে পারে। অথচ লাভ জিহাদের নাম করে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করা হচ্ছে। ফেসবুকে এই নিয়ে group-ও খোলা হয়েছে যার নাম Hindu communist national revolution। সেখান থেকে কুৎসিত ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে মেয়েটিকে। জানা নেই group-টি এখনও চলছে নাকি বন্ধ করা হয়েছে। 

লাভ জিহাদ একটি ভুল তথ্য এবং সংঘের একটি বিকৃত প্রচার। এই নিয়ে ২০১৭ সালেই মিডিয়ার সামনে মুখ খুলেছিলেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র ও সমাজকর্মী লেখিকা তহমিনা খাতুন এবং নস্যাৎ করেছিলেন লাভ জিহাদ তত্ত্বকে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পেশার মানুষজন এই নিয়ে কলম ধরেছেন, প্রতিবাদ করেছেন।

শুধুমাত্র প্রলোভনে বা ফাঁদে পা দিয়েই হিন্দু প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষিত মেয়েরা মুসলমান ছেলে বিয়ে করছে! শিক্ষিত হিন্দু মেয়েরা কি এতই বোকা! 

বিপরীত তথ্য কি বলছে। ভিন্ন ধর্মে বিবাহের এই সংস্কৃতি বহুদিন আগে থেকেই ছিল এবং বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এই জাতীয় বিয়ে যত বাড়ে ততই সম্প্রীতির দরজা খুলে যাবে। 

অমলেন্দু দে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক, লেখক যিনি বিয়ে করেছিলেন শের-এ-বাংলা ফজলুল হকের দৌহিত্রী নাসিমা বানুকে যিনি পেশায় শিক্ষিকা। সম্ভবত এটিই প্রথম Interreligion marriage (special marriage act 1954 অনুসারে)। সাংবাদিক সুকুমার মিত্রকে বিয়ে করেন লেখিকা ও সমাজকর্মী তহমীনা খাতুন এবং ভয়ঙ্কর তাদের অভিজ্ঞতা। তারা সারাজীবন ধরে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। চিকিৎসক শতানিক মাজিকে বিয়ে করেন শিক্ষিকা, লেখিকা, সমাজকর্মী জিনাত রেহানা ইসলাম। সাংবাদিক অমিতাভ গুপ্তকে বিয়ে করেন মাসুমা পারভীন। সংঘ পরিবার এই বিয়েগুলিকে কি চোখে দেখছে! তারপর অনেক জল বয়ে গেছে ঢাল অনুসারে, আর সেই স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করে ভালো আছেন অনেকেই।

শিক্ষিকা শর্মিলা ঘোষ শিক্ষক রফিউদ্দিন আহমেদকে বিয়ে করায় এইভাবেই খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে এবং তৎকালীন সরকারের  মোড়লদের প্রত্যক্ষ মদতে তাদের জীবন  দুর্বিষহ করে তোলা হয় (কাকদ্বীপ), দীর্ঘদিন ধরে একটা শক্তিশালী সিস্টেমের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই চলে।

ইলামবাজারের জিন্না আহমেদ পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিয়ে করার পর তাকে পাকিস্তানের চর বলে দেগে দেওয়া হয় এবং নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। একইভাবে দক্ষিণ দিনাজপুরের মুজজ্ফর -সুজাতার জীবনেও নেমে এসেছিল কঠিন বিপর্যয়। 

রিজওয়ানূর রহমানের প্রিয়াঙ্কা টোডিকে বিয়ে আর পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সকলের জানা। কেন বার বার দুটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ কাকে বিয়ে করবে, কী রীতি মেনে বিয়ে করবে, কোথায় থাকবে, কী খাবে এই নিয়ে ফতোয়ার সম্মুখীন হতে হবে?

দিনের পর দিন এই নিয়ে খবর হয় কিন্তু সমাজ এতটুকু এগোয় না। কয়েকটা ঘটনা ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুমুল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয় এই জাতীয় দম্পতিদের এবং প্রাণের ভয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই কু-সামাজিক ধর্মীয় ফতোয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। 

অতি সম্প্রতি  চিত্রশিল্পী তৌসিফ হক বেড়াতে গিয়ে তার  স্ত্রীকে (যিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী) নিয়ে হোটেলে ঘর নিতে গেলে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হন এবং সংবাদ মাধ্যম তোলপাড় হয়। মনে রাখুন রিজওয়ানকে আজ অবধি আমরা ন্যায় বিচার দিতে পারিনি।

সারাদিনে নানারকম ব্যস্ততায় আমরা জানতেই পারছি না প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মানুষের অধিকার হরণ হয়ে চলেছে। মানুষের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া ছিল ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রধান এজেন্ডা, "লাভ জিহাদ" নাম দিয়ে ইন্টারফেথ ম্যারেজগুলো ভাঙা  আর ছেলে-মেয়ে দুটিকে চরম হেনস্থার শিকার করা।

উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদের পিঙ্কি ও রশিদের ঘটনা হাড় হিম করে দেওয়ার মতো। তাদের দুজনকে দীর্ঘদিন ধরে দুজায়গায় আটক রাখা হয় এবং পিঙ্কির গর্ভস্থ সন্তানকে নষ্ট করে দেওয়া হয়।

কোনো মেয়ে ধর্মান্তরিত  হলেও  রাষ্ট্রের অধিকার জন্মায় না তার বিয়ে ভাঙার ও তার গর্ভপাত করানোর!! ম্যারেজ অ্যাক্টের যেকোনও একটিতে বিবাহ করার অধিকার মেয়েদের রয়েছে। সংবিধান স্বীকৃত এই অধিকারগুলো রাষ্ট্র এক এক করে কাড়ছে আর আমরা এই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে নিজেদের সমর্পণ করছি।

এক বছর আগে “লীলা” নামের এক ওয়েব চলচ্চিত্র দেখিয়েছিল “আর্যাবর্ত” নামক এমন এক ডিস্টোপিয়া (dystopia), যেখানে আন্তঃধর্ম বিবাহে মেয়েটির বিধর্মী সঙ্গীটিকে খুন করে দেওয়া ও সন্তানকে সরকারি তৎপরতায় গুম করাটাই প্রধান দস্তুর।

এই অন্ধকারের হাত ধরেই আমরা এগোচ্ছি। খুব ধীরে ধীরে আমাদের ভিতর সাম্প্রদায়িকতা বাসা বাঁধছে। আস্তে আস্তে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র আমাদের গিলে নিচ্ছে আর আমরা জেনে বুঝেই সেই ফাঁদে পা দিচ্ছি। আসলে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করলে বাবা মা ও পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজ সব সময় এই বিয়েকে মেনে নিতে পারে না। ফলে খুব সহজেই ‘লাভ জিহাদের’ তত্ত্ব এদের মনে বাসা বাঁধে এবং অনার কিলিং-এর মতো সাংঘাতিক অপরাধ ঘটে যায়। আর পরিবারের এই আবেগকেই পুঁজি করে একদল দুষ্কৃতী সাম্প্রদায়িকতাকে পুষ্ট করে তোলে। ভারতের সংবিধান, ভারতের আইন আমাদের কিছু অধিকার দিয়েছে আর সেটা রক্ষার জন্য রাষ্ট্র শক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই হবে। ফ্যাসিস্ট এমন একটি ভয়ঙ্কর শব্দ, যেটি প্রতিদিনের সুখ শান্তি কেড়ে একটি অন্তঃসারশূন্য সমাজ সংস্কৃতির জন্ম দেয়।

পিঙ্কি ও রশিদের মতো আরো কতজন কোথায় কীভাবে বন্দি রয়েছে তার খবর কে রাখে! যদি কোনও ভাবে কোনও ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায় তবেই তা সামনে আসে।

লাভ জিহাদ আইন নাম দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে আইন ভঙ্গকারী একদল সমাজবিরোধী। এখন পক্ষ নেবার সময়। ফ্যাসিস্টের পক্ষ নেবেন নাকি গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের!

লেখক : শিক্ষক, কবি, প্রাবন্ধিক

ছবি: প্রতীকী

0 Comments

Post Comment