নারীমুক্তির অগ্রদূত বিদ্যাসাগর : শিক্ষায় ও সমাজে

  • 27 September, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1274 view(s)
  • লিখেছেন : দেবযানী বসুসেন
বিধবাবিবাহের আইন, বালিকা বিদ্যালয়, বহুবিবাহ রোধ আর বাল্যবিবাহ বন্ধ করার চেষ্টা-- সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো নারীজাতির ব্যক্তিত্ব গঠনের ধাপ তৈরি করেছেন বিদ্যাসাগর।

সাত ডিসেম্বর ১৮৫৬ আর সাত ডিসেম্বর ১৮৭২। ষোলো বছরের ব্যবধানে এই দুটি দিনকে বাঙালির একটু বেশি গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন সত্যিই আছে কি? ভেবে দেখা যাক। প্রথম দিনটিতে কলকাতায় বিধবা বিবাহ হচ্ছে। পাত্র সংস্কৃত কলেজের কৃতি ছাত্র, অধ্যাপক, বিদ্যাসাগরের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পিতা প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশ। পাত্রী বর্ধমান জেলার পলাশডাঙা গ্রামের ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বারো বছরের বিধবা কন্যা কালীমতী। ষোলো বছর বাদে  ওই দিনই আত্মপ্রকাশ করছে জাতীয় নাট্যালয়, ন্যাশানাল থিয়েটার, যা বাঙালির আত্মপরিচয়ের বাহন  হয়ে উঠল। প্রথম অভিনয় দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীলদর্পণ’। নাটকটিতে রয়েছে প্রতিবাদের সংকল্প। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই ভালো ছাত্র ও শিক্ষক রূপে প্রতিষ্ঠিত। সুদক্ষ প্রশাসকও বটে। ব্রিটিশ শাসকদের কাছে তাঁর কর্মচেতনা এবং আরব্ধ জ্ঞানের সদ্ব্যবহার নন্দিত হয়েছে। তিনি  ছিলেন তাঁর উপাধি ‘বিদ্যাসাগর’-এর জীবন্ত ধারক হয়ে।

কিন্ত সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা অন্যরকম। heart of a  Bengali mother and the energy of an English man (মধুসূদন দত্তের ভাষায় ) নিয়ে যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, তিনি নিজের প্রতিভাকে বহমান করবেন বিভিন্ন ধারায়। শোনা যায় একবার তিনি নিজ গ্রামে গিয়ে বাল্য বয়সের সহপাঠিনী  ক্ষান্তমণিকে বৈধব্যদশায় দেখে খুবই কাতর হয়ে পড়েন এবং বিধবা বিবাহ যে হিন্দু শাস্ত্র সম্মত তা প্রমাণ করেন। এ বড্ড কঠিন যাত্রা। তীব্র কর্তব্যবোধের তাড়নায় তিনি এ কাজে ব্রতী হলেন। এ জন্য জীবননাশের আশঙ্কা ছিল। তাঁর দুরন্ত ইচ্ছা অভীষ্ট কর্ম সম্পাদন করেছে। ইতিমধ্যেই  বাংলাভাষাকে অশ্লীলতামুক্ত করতে চেয়ে ব্যঙ্গোক্তি শুনেছেন :

                         শহরে এক নতুন হুজুক উঠেছে রে ভাই

                         অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই

                         এর বিদ্যাসাগর জন্মদাতা

                         বঙ্গদর্শন এর নেতা ।

                                               বসন্তক ১৮৭৪

‘বঙ্গদর্শন’-এর সম্পাদক বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬ ) কে ব্যঙ্গ করে 'বিষবৃক্ষ 'এর প্রধান চরিত্র সূর্যমুখীর হাত দিয়ে লেখাচ্ছেন 'কলকাতার কোন পণ্ডিত নাকি বিধবা বিবাহ এর নিদান দিয়েছেন। এই যদি পণ্ডিত বলেন তাহলে মূর্খ কে।" যে ‘নীলদর্পণ’-এ শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সেখানেও অশিক্ষিত বৃদ্ধা দাসী আদুরীর মুখে সংলাপ : “এমা থু বিধবার নাকি বে হয়। মুই আজাদের দলে”। আজাদ অর্থাৎ রাজা রাধাকান্ত দেব অত্যন্ত বিরোধিতা করেছিলেন  বিধবাবিবাহের। বিদ্যাসাগরের সপক্ষে যত সাক্ষর পড়েছিল তার চারগুণ বেশি সাক্ষর জোগাড় করেছিলেন তাঁর ধর্মসভা থেকে। কিন্ত লর্ড ডালহৌসি বিদ্যাসাগরের যুক্তির সারবত্তা গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৫৬-তে বিধবা বিবাহ আইন হল। তার আগে প্রকাশিত হল দুটি পুস্তিকা। বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব, (১, ২ )। প্রতিবাদ অনেক হল।  কিন্ত  এই অপার জ্ঞানের অধিকারী কর্মোদ্যোগীকে পরাজিত করা সহজ নয়। এই পদক্ষেপ নিয়ে দেখলেন কুলীন ব্রাহ্মণদের একাধিক বিবাহ রীতি, যা তাঁর বিশেষ মানসিক বিষাদের কারণ হল।  এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ থেকে কিছুটা অংশ শোনা যাক : “ঈশ্বরচন্দ্র যখন কলেজের ছাত্র ছিলেন তখন তাঁহাদের বেদান্ত-অধ্যাপক শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির সহিত তাঁহার বিশেষ প্রীতিবন্ধন ছিল। বাচস্পতিমহাশয় বৃদ্ধবয়সে পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া তাঁহার প্রিয়তম ছাত্রের মত জিজ্ঞাসা করিলে ঈশ্বরচন্দ্র প্রবল আপত্তি প্রকাশ করিলেন। গুরু বারংবার কাকুতিমিনতি করা সত্ত্বেও তিনি মতপরিবর্তন করিলেন না। তখন বাচস্পতিমহাশয় ঈশ্বরচন্দ্রের নিষেধে কর্ণপাত না করিয়া এক সুন্দরী বালিকাকে বিবাহপূর্বক তাহাকে আশু বৈধব্যের তটদেশে আনয়ন করিলেন। শ্রীযুক্ত চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাঁহার বিদ্যাসাগর গ্রন্থে এই ব্যাপারে যে পরিণাম বর্ণন করিয়াছেন তাহা এই স্থলে উদ্‌ধৃত করি।--

‘বাচস্পতিমহাশয় ঈশ্বরচন্দ্রের হাত ধরিয়া বলিলেন, ‘তোমার মাকে দেখিয়া যাও।’ এই বলিয়া দাসীকে নববধূর অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিতে বলিলেন, তখন বাচস্পতি মহাশয়ের নববিবাহিতা পত্নীকে দেখিয়া ঈশ্বরচন্দ্র অশ্রুসংবরণ করিতে পারিলেন না। সেই জননীস্থানীয়া বালিকাকে দর্শন  করিয়া ও সেই বালিকার পরিণাম চিন্তা করিয়া তিনি বালকের ন্যায় রোদন করিতে লাগিলেন। তখন বাচস্পতি মহাশয় ‘অকল্যাণ করিস্‌ না রে’ বলিয়া তাঁহাকে লইয়া বাহির বাটীতে আসিলেন এবং নানাপ্রকার শাস্ত্রীয় উপদেশের দ্বারা ঈশ্বরচন্দ্রের মনের উত্তেজনা ও হৃদয়ের আবেগ রোধ করিতে ও তাঁহাকে প্রবোধ দিতে প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। পরিশেষে ঈশ্বরচন্দ্রকে কিঞ্চিৎ জল খাইতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু পাষাণতুল্য কঠিন প্রতিজ্ঞাপরায়ণ ঈশ্বরচন্দ্র জলযোগ করিতে সম্পূর্ণরূপে অসম্মত হইয়া বলিলেন, ‘এ ভিটায়, আর কখনও জলস্পর্শ করিব না’। ”

এই কাতরতার ছবি মনে পড়ায় আর এক বাঙালি কৃতবিদ্যর বিষণ্নতা, যিনি বিদ্যাসাগরের বিশেষ স্নেহভাজনও বটে।

মধুসূদন দত্তের নামের আগে ‘মাইকেল’ বসার পর পিতা তাঁকে ত্যজ্য পুত্র করেন। মধুসূদন মাতা জাহ্নবী দেবীর মৃত্যুর পর সন্তান লাভের জন্য আরও দুটি বিয়ে করেন। সেই ইচ্ছাপূরণ হয়নি। কিন্তু ছোটো মা বয়সে এত ছোটো ছিল যে পিতার মৃত্যুর পর বাড়িতে গিয়ে এই বালিকা বিধবাটিকে দেখে মধুসূদন দত্ত কেঁদে ফেলেন। নিজের এই যন্ত্রণার কথা বন্ধুকে চিঠিতে জানান।

আবার একটু ফিরে দেখি বিধবাবিবাহের পটভূমিকে। ১৮৫৬ থেকে তাঁর কলকাতায় বসবাসকালে তিনি বিধবাবিবাহের আয়োজন করেন। আর ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’ একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রের বিয়ে দেন বিধবা বালিকার সঙ্গে। এ নিয়ে পরিবারের আপত্তি গ্রাহ্য করেননি। তাঁর সঙ্গে যে ব্যক্তিরা এই মহৎ কর্মে অর্থ ও শ্রমদান করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, অক্ষয় দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, তারানাথ বাচস্পতি। শেষের দুজন প্রাচীনপন্থী সংস্কৃত পণ্ডিত ও শিক্ষক। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে কোনো কারণবশত বিদ্যাসাগরের মনোমালিন্য হয়, কিন্ত বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে অকুণ্ঠ সহযোগিতা ছিল। তারানাথ বাচস্পতি মনে করতেন ‘পরাশর সংহিতা’-তে যখন বিধবাবিবাহের বিধি পর্যন্ত দেওয়া আছে, তখন সেই বিধি পালনের জন্য প্রাচীন সমাজের বাধাদানকে অগ্রাহ্য করতেই হবে। বিদ্যাসাগরের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের বিধবাবিবাহকালে বিদ্যাসাগরের আত্মীয়রা বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলেও তারানাথ সপরিবারে এসে নবদম্পতিকে বরণ করেন।

হ্যাঁ, পরাশর সংহিতা। প্রাচীন বিষ্ণুপুরাণ  রচয়িতা এই ঋষির সংহিতাতে বিদ্যাসাগর খুঁজে পেলেন বিধবাবিবাহের শাস্ত্র বচন। মনু-সংহিতা নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর স্ত্রীকে বিবাহ নিদান দিয়েছেন। কিন্তু বিধবাবিবাহের বিরোধী মত জানিয়েছেন। এই পুরাণগুলিতে প্রক্ষিপ্ত অংশ এত বেশি যে মহাত্মা গান্ধিকেও গ্রন্থটির অনুরাগী হয়েও স্বীকার করতে হয়েছিল যে যুগের প্রয়োজনে ইচ্ছামতো এর ভাষ্য পরিবর্তন করা হয়েছে ক্ষমতাবানদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য।

বিধবাবিবাহের প্রক্রিয়া চলাকালীন বিদ্যাসাগর বিশেষ ভাবে লক্ষ করলেন অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি একটি স্ত্রীর বর্তমানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিয়েতে উৎসাহিত হচ্ছেন। যেন বিধবাবিবাহের পবিত্র সরণিতে নিজের লালসা মেটানোর উপায় খুঁজে পেলেন তাঁরা। এমনিতেই পুরুষের বহু বিবাহ সমাজের 'বন্ধনহীন গ্রন্থি'। কুলীন বামুন খাতার লিস্ট রেখে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেন, কী করবেন--বল্লাল সেন বলে গেছেন না--কন্যার পিতার একঘরে হওয়া ঠেকানোর উপায় তো এটিই। দীনবন্ধু মিত্রর 'সধবার একাদশী' নাটক রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ পুরুষের বহুবিবাহের করুণ চিত্র এঁকেছে। এবার শোনা যাক ১৮৭১ সালে 'বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার'-এ ঈশ্বরচন্দ্র কী বলছেন : “কোনো কারণে কুলীন মহিলার গর্ভ সঞ্চার হইলে  তাহার পরিপাকার্থে, কন্যাপক্ষীয়দিগকে ত্রিবিধ উপায় অবলম্বন করিতে হইবে। প্রথম, সবিশেষ চেষ্টা করিয়া জামাতার আনয়ন। তিনি আসিয়া দুই একদিন শ্বশুরালয়ে অবস্থান করিয়া প্রস্তান করেন। দ্বিতীয়, জামাতার আনয়নে কৃতকার্য হইতে না পারিলে ব্যাভিচার সহচরী ভ্রুণ হত্যা দেবীর আরাধনা ... তৃতীয় উপায় অতি সহজ, অতি নির্দোষ ও সাতিশয় কৌতুকজনক। ... কন্যার জননী অথবা বাড়ির অপর কোনো গৃহিণী ... পাড়ায় বেড়াইতে যান এবং দেখ মা দেখ বাছা এইরূপ সম্ভাষণ করিয়া কথা প্রসঙ্গে বলিতে আরম্ভ করেন, অনেকদিন পরে কাল জামাই আসিয়াছিলেন....”।

কেন এমন পাড়াপ্রচার? নইলে কন্যার গর্ভধারণ সামাজিক প্রতিষ্ঠা পায় না। অবশ্য স্বামীর গৃহে থেকেও স্বামীর সঙ্গ-বঞ্চিত সতীর সংখ্যাও কম ছিল না। পুরুষের উদাসীনতার সুযোগের সদ্ব্যবহার এঁরা করতেন। 'নববাবুবিলাস’ (ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) সামাজিক নকশায় শেষে বাবুর অবাক হবার পালা। কোনও সম্পর্ক স্ত্রীর সঙ্গে না থেকেও তিনি কীভাবে পাঁচ কন্যার পিতা হলেন ! বহুবিবাহের বিরোধিতার সূত্রে লক্ষ্ করলেন বাল্য বিবাহের কুফল। বহুবিবাহের তিক্ত পরিণাম নিয়ে বিতর্ক করছেন স্বনামে, ছদ্মনামে। 'কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য' ছদ্মনাম ব্যবহার করে দুটি ও' কস্যচিৎ ঊপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য' ছদ্মনামে নবদ্বীপের পণ্ডিত, হিন্দুধর্মরক্ষিণী সভার পণ্ডিতদের সঙ্গে বিতর্ক চলছে। ছদ্মনামে রচিত এই সব পুস্তিকায় হাস্যরসের উপাদান অনেক।

তখন তিনি জয়ী তিন ভুবনে। বাল্যবিবাহ নিয়ে লড়াই চলছে। এর মধ্যেই ১৮৪৯-এ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ভারতের প্রথম হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়। নামও হল ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’। ভারতবন্ধু ইংরেজ জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটনের (১৮০১-১৮৫১) সঙ্গে আর যে রিফরমাররা নারীশিক্ষার জন্য এই বিদ্যালয়ের স্থাপনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁরা হলেন রামগোপাল ঘোষ, রাজা দক্ষিণারঞ্জণ মুখোপাধ্যায়, পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার।

আর আছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এইবার তিনি মনু-সংহিতার শ্লোকে খুঁজে পেলেন কাঙ্ক্ষিত বচন  ‘কন্যাপেবং পালনীয়া শিক্ষণীরাতিযত্নত’। এই বচন মেয়েদের গাড়ির দুইদিকে লেখা থাকত।   একটি মাত্র  বালিকা বিদ্যালয়ের মধ্যেই থেমে যাননি তিনি। ১৮৫৭-এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রতিষ্ঠা , বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য ও ফেলো বিদ্যাসাগর। এত কাজের মধ্যেও আসল দায়িত্বের হিসেব ভোলেননি। এই বছরে হুগলিতে ৭টি ,বর্ধমান জেলায় ১টি বালিকা বিদ্যালয় খোলা হচ্ছে। ১৮৫৮-তে হুগলিতে ১৩, বর্ধমানে ১০, মেদিনীপুরে ৩, নদিয়ার ১টি। এইভাবে ১৮৫৮-র মে মাসের মধ্যেই দক্ষিণবঙ্গে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীসংখ্যা ১৩০০। খরচ ৮৪৫টাকা। এর সঙ্গেই বাংলার বিভিন্ন জেলায় ‘স্ত্রী শিক্ষা বিধায়ণী সম্মেলনী’ প্রতিষ্ঠা করছেন।

এর মধ্যে তাঁর কাজের ক্ষেত্র বহুধা বিস্তৃত হয়েছে। সংস্কৃত কলেজের চাকরি একবার ছেড়েছেন (১৮৪৬) আবার সম্মানের সঙ্গে অধ্যক্ষ হয়েছেন। সব শ্রেণির হিন্দুছাত্রর প্রবেশাধিকার দিয়েছেন। বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যে মানুষটির সংস্কারমুখী কর্মকাণ্ডকে ব্যঙ্গ করে ছড়া গাঁথা হয়েছিল  আজ তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শান্তিপুরের তাঁতীরা ধূতির পাড় বুনছেন। গ্রামের মানুষ কালীঘাট দর্শন করে ফেরার পথে তাঁকে দেখে যাচ্ছেন।

বাংলা গদ্যে বিরতি চিহ্নের যথার্থ ব্যবহার তাঁর গদ্যরচনাতেই পাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে বলেছেন ‘বাংলা গদ্যের যথার্থ ভাষা শিল্পী’। রামকৃষ্ণ দেব নিজে এসে তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িতে দেখা করে যান। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতের অমিল হয়েছে, নিজের দৃঢ়তা বজায় রেখেছেন। শহর থেকে দূরে ছোটোনাগপুরের কার্মাটারে শেষ জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন। সেখানেও সেবাকর্মটি ভোলেননি। এখানেই পড়ে গিয়ে আঘাত পান। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২৯ জুলাই ১৮৯১।

এই লেখার শুরুতেই বাংলা জাতীয় নাট্যশালার প্রসঙ্গ এনেছিলাম। ১৮৫৯-এর ২০ এপ্রিল বিধবাবিবাহ নামক নাটকের অভিনয় হয় মেট্রোপলিটন থিয়েটারে। ২৩ এপ্রিল বিদ্যাসাগর এটির  অভিনয় দেখলেন। বাঙালির আত্মপরিচয়ের দিকচিহ্নগুলি যখন নিজ পথ খুঁজছে, তখন সেখানেও মেয়েদের স্থান নিম্নকোটিতে। দুটি থিয়েটার দর্শক এই মেয়েদের কিছুটা সম্মানিত করেছিলেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ আর কর্মপ্রাণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রঙ্গালয়ের অভিনেত্রী হয়ে এরা স্বাধীন জীবিকার পথ চাইছে, বাধা আছে, আছে কলঙ্ক, তবু কথা কইবার অধিকারটুকু আদায় করতে পেরেছেন।

 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নশ্বর দেহ বিলীন হল ২৯|০৭|১৮৯১। তারপর থেকে অপরাজেয় এই কর্মবীরকে নিয়ে প্রশংসা বা নিন্দা কোনোটাই কম হয়নি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট স্কুল থেকে নরেন্দ্রনাথ দত্তকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, জামাই-এর কানভাঙানিতে। শোনা যায়, ভবিষ্যতের বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ তখনই পড়ানোর গুণে ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, যেটা জামাই বাবাজীবনের অপছন্দ হয়েছিল। স্কুল বুক সোসাইটির ক্ষমতাবান সদস্য হিসেবে তিনি নাকি তাঁর রচিত গ্রন্থগুলিই পড়ানোর সুপারিশ করতেন। এমন আরও কিছু অপবাদ তাঁর জীবিতাবস্থাতেই ঘোরাঘুরি করেছে। মানুষ যখন তাঁর কীর্তির চেয়ে মহান হন তখন তো এমন কিছু কালিঝুলি মাখানোর হাত এগিয়ে  আসেই। ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু বিশ শতক, একবিংশ শতকও কি তাকে ভয় পায়? এই মানুষটির তুলনায় আমরা চিন্তা ও কর্মজগতে কিছুই করে উঠতে পারিনি। পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে তাঁর মূর্তি ভাঙার উচ্ছলতা (বেলেল্লাপনা) আসে কেন !!! ওই তীব্র প্রস্তরচক্ষু কি আমাদের অবনতি লক্ষ করছেন? দুশো বছর কেন, মানবমন যতদিন সৃষ্টিশীল, বিদ্যাসাগরের নবজাগরণের মেধাটি বাঙালি জাতির সম্বল।

মেয়েদের শিক্ষার উদ্যোগ মেমসাহেব দ্বারা শুরু হয়েছিল আগেই। ১৮২২ ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে কয়েকটি মেয়েকে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়। কিছুটা অক্ষরজ্ঞান ছাড়া এ চেষ্টা এগোয়নি। কিন্তু সংগঠিতভাবে বেথুন স্কুলের প্রতিষ্ঠা নারীশিক্ষার নতুন দিগন্ত খুলে দিল। বিধবাবিবাহের আইন, বালিকা বিদ্যালয়, বহুবিবাহ রোধ আর বাল্যবিবাহ বন্ধ করার চেষ্টা-- এযে সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো নারীজাতির ব্যক্তিত্ব গঠনের ধাপ তৈরি করেছেন--যাদেরকে ব্যক্তি বলে মনে করাই হত না--তারা হত ব্যক্তিগত সম্পদ--বাল্যকালে পিতার, যৌবনে স্বামীর বৃদ্ধ বয়সে ছেলের। আশাপূর্ণা দেবীর সত্যবতীর চিন্তায় (প্রথম প্রতিশ্রুতি) "মেয়েদেরকে আর কে কবে মানুষ মনে করেছে"  এই মানুষ করার মহাস্থপতির আজ মৃত্যদিন।

ছবি : সংগৃহীত

লেখক : অধ্যাপক

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ  ২৯জুলাই,২০২০

0 Comments

Post Comment