জরিশিল্পীদের করুণ চিত্র

  • 17 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 902 view(s)
  • লিখেছেন : ‌আফরোজা খাতুন
লকডাউনে জরিশিল্পীদের কাজ বন্ধ। ত্রাণের দিকে চেয়ে থেকেই ওঁদের এখন দিন গুজরান। অনেকের স্বামীরাও জরির কাজেই গিয়েছিলেন ভিন রাজ্যে। সেখানেও কাজ বন্ধ। বাড়ি ফেরার পথও বন্ধ। পাঁচলার শিল্পীরা অপেক্ষায় আছেন, যদি কেউ তাঁদের স্বামীদের বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করে দেন, সবাই মিলে তাহলে কাটাতে পারবেন একটা দুঃসময়ের খুশির ইদ।

‘‌দিদি ইদের দিন বাচ্চাগুলোর মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।’‌— বললেন জুজারসাহ (পাঁচলা, হাওড়া) গ্রামের জরিশিল্পী মহিলারা। সখি বেগম, হালিমা মল্লিক, আসমিরা মল্লিক, নাসিমা বেগম, সাবিরা শেখ, রূপসা গোলদার, মারিয়াম মল্লিকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছিলেন ইফতারের পর। তাঁদের গোষ্ঠী সম্পাদক আবিকা খাতুনকে ঘিরে। বাচ্চারা মায়েদের কোলঘেঁষে ঝিমিয়ে রয়েছে। চেঁচামেচি, দুরন্তপনা কোথায় যেন উধাও। ক্ষুধার্ত শরীরের ক্লান্তি নিয়ে তারা মাকে আঁকড়ে আছে। সংসারে অর্থ জোগানদার মায়েরাও আজ বড় অসহায়। তাঁরা জানেন না, খালি পেট বা আধপেট খেয়ে থাকা বাচ্চাদের খাবার কেনার টাকা আবার কবে থেকে রোজগার করতে পারবেন।

দু মাস ধরে কাজ বন্ধ। রাষ্ট্র লকডাউন ঘোষণা করার পর তাঁদের আর রোজগার নেই। পরিবারের পুরুষরা জরির কাজে কেউ বিশাখাপত্তনম, কেউ হায়দরাবাদ গিয়ে আটকে পড়েছেন। এখন তাঁদেরও কাজ বন্ধ। নিজেদের খাবারের টাকা শেষ। বাড়ি ফেরাও অনিশ্চিত। ইদের আগে যেভাবেই হোক বাড়ির পুরুষরা ফিরে আসুক। চাইছেন মহিলারা। কিন্তু ফেরানোর  ক্ষমতা যে তাঁদের নেই। এখন পর্যন্ত বাড়ি ফেরানোর কোনও সরকারি ব্যবস্থা তাঁদের জন্য হয়নি। নিজেরা বাস ভাড়া করে এলে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। তার উপর আছে প্রশাসনের অনুমতি আদায় করার ঝামেলা। মারিয়াম মল্লিক বললেন, তিন মাস হল সিজার করে বাচ্চা হয়েছে। হাতে কাজ নেই। খাওয়ার কষ্টে আছি খুব। বাচ্চার দুধও কিনতে পারছি না। কোথা থেকে টাকা জোগাড় করে পাঠাবো? আসমিরা মল্লিকের স্বামী শাহরুল মল্লিকও হায়দরাবাদে আটকে আছেন। আসমিরা বললেন, কাজ থাকলে দিনরাত খেটে, টাকা জোগাড় করে স্বামীকে ফিরিয়ে আনতাম। কিন্তু এখন পাঁচ হাজার টাকা পাঠাবো কী করে? ছেলেপিলের পেটের খাবারটুকুই তো জোগাড় করতে পারছি না। রেশনের পাঁচ কেজি চাল আর আটা। ওতে চারজনের পেট কদিন চলে? আর শুধু নুন ভাত কি খাওয়া যায়? আলু কেনার টাকাও তো হাতে নেই। 

ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে এঁদের অনেকের সংকোচ ছিল। কিন্তু আর যে পেট বাধ মানছে না। চোখের সামনে অভুক্ত বাচ্চারা। ইফতারের সময় দশ টাকার তরমুজ কেনার ক্ষমতা নেই অনেকের। সামনে ইদ। সন্তানদের কী দিয়ে খুশি রাখবে? সেদিনও কি বাচ্চাগুলোর নেতিয়ে পড়া চেহারা দেখবে তাঁরা? এই প্রশ্ন মায়েদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। 

হাওড়া, জুজারসাহ গ্রামের মহিলা জরি শিল্পী সংগঠনের দলনেত্রী আবিকা খাতুন বললেন, এমনিতেই জিএসটি চাপানোর পর জরির কাজে মজুরি কমে গেছে। আর এদিকে শুধু জরির কাজ করেই এইসব পরিবারগুলোর সংসার চলে। জিএসটি চাপানোর আগে দিনে ঘন্টা দশেক কাজ করে তিনশো/সাড়ে তিনশো টাকা রোজগার করেছি। আর এখন সেটা হচ্ছিল দুশো/আড়াইশো মত। লকডাউন ঘোষণার পর এই দু মাসে এক টাকাও রোজগার নেই আমাদের।
 
সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় আবিকা খাতুনের। তারপর থেকেই তিনি জরির কাজে যুক্ত। তা হয়ে গেল প্রায় তেরো বছর। স্বামী এখন গেছেন বিশাখাপত্তনমে জরির কাজ করতে। কখনো নিজে, কখনো স্বামী বাড়িতে থাকলে তাঁকে পাঠিয়ে ওস্তাগরের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে আসেন। তাঁর দলের ৭০ জন মহিলাকে তিনি ভাগ করে দেন কাজ। 

জরিশিল্পীদের কাজ ওস্তাগর নিয়ে গিয়ে মহাজনকে দিয়ে আসেন। মহাজনের কাছ থেকে দেশবিদেশের বাজারে সেগুলো যায়। কিন্তু জরি শিল্পে এখানে মজুরি কমে যাওয়ার পর, গ্রামের বহু পুরুষ বাইরে গিয়েছেন জরির কাজ করতে। তাতে যদি পরিবারে আরেকটু সচ্ছলতা আসে। লকডাউনে এখন তাঁদেরও কাজ বন্ধ। বাড়ি ফেরার পথও বন্ধ। ত্রাণশিবিরের দেওয়া খিচুড়ি কোনদিন পান। কোনদিন কিছুই জোটে না। বাড়ির মহিলারা অপেক্ষায় আছেন, যদি কেউ ইদের আগে তাঁদের বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করে দেন। সবাই মিলে তাহলে কাটাতে পারবেন একটা দুঃসময়ের খুশির ইদ।

কাজ করছেন জরিশিল্পীরা। (‌ইনসেটে)‌ আবিকা খাতুন
লেখক অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী

0 Comments

Post Comment