- 01 November, 2021
- 0 Comment(s)
- 525 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এই গল্প যত না বিজ্ঞানের, যত না গণিতের, তার চেয়ে অনেক বেশি করে একজন আফ্রো-আমেরিকানের। এই গল্প এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর জীবনের গল্প। জীবনের কোনও বিড়ম্বনাই যাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। মার্কিন মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে যাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা রয়েছে। ২০১৫ সালে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ক্যাথারিন জনসনকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডমে ভূষিত করেন। ২০১৯এ তিনি সেদেশের সংসদীয় ব্যবস্থার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেলে সম্মানিত হন। ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০— অতিমারী শুরুর মাত্র কয়েক দিন আগেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন ক্যাথারিন জনসন, ১০১ বছর বয়সে। ক্যাথারিনের জন্ম ২৬শে আগষ্ট, ১৯১৮, পশ্চিম ভার্জিনিয়ার হোয়াইট সালফার স্প্রিংস এলাকাতে।
সেই সময় ভার্জিনিয়ার ওই অঞ্চলে ক্লাস এইটের ঊর্ধ্বে কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা করার কোনও সুযোগ ছিল না। ক্যাথারিনের পরিবার তাই তাদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া স্টেট কলেজ ক্যাম্পাসের একটি আবাসিক স্কুলে ক্যাথারিনের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে। ১৪ বছর বয়সে স্কুলের পাঠ্যক্রম শেষ করে তিনি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া স্টেট কলেজেই গণিতশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। এই কলেজটি সম্পূর্ণ ভাবেই কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। কলেজে গণিতবিষয়ক যত কোর্স বা লেকচারই আয়োজন করা হতো না কেন, অঙ্ক-পাগল ক্যাথারিন সেই সবকটি কোর্স বা লেকচারেই হাজির থাকতেন, এবং সসম্মানে উত্তীর্ণও হতেন। এই সময় বিশিষ্ট গণিতবিদ এবং কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে যিনি গণিতশাস্ত্রে পিএইচডি করেছিলেন, সেই ডব্লিউ ডব্লিউ শিফেলিন ক্লেটর স্বয়ং ক্যাথারিনের অধ্যাপক ছিলেন। ক্যাথারিনের গণিতের প্রতি আগ্রহ দেখে ক্লেটর নিজে তাঁর জন্য নতুন নতুন গণিত পাঠ্যক্রম বা কোর্স চালু করতেন। ১৯৩৭ সালে ক্যাথারিন, ১৮ বছর বয়সে গণিতশাস্ত্রের একটি প্রাথমিক ডিগ্রিতে সম্মানিত হন। ১৯৩৮ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার ব্যাপারে আরও কিছু কিছু সুবিধার কথা ঘোষণা করলে প্রথম তিন আফ্রো-আমেরিকান ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একমাত্র মহিলা হিসেবে ক্যাথারিনই প্রথম সেই সুবিধা গ্রহণ করে স্নাতকস্তরের পড়াশোনা শেষ করেন।
এর পরবর্তীতে ক্যাথারিন গবেষক হিসেবে নিজের কেরিয়ার তৈরি করতে চাইলেও সে সময়ে মেয়েদের সেই বিষয়ে তেমন একটা কিছু করার সুযোগ ছিল না। বেশ কিছুদিন স্কুলশিক্ষক হিসেবে জীবন অতিবাহিত করার পর একদিন এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তিনি জানতে পারেন ল্যাংলীতে ন্যাশনাল এ্যাডভাইসরি কমিটি ফর এ্যারোনটিকসের গবেষণাগারে নাকি কমপিউটেশন অথবা জটিল সমস্ত গণনার কাজে সাহায্য করার জন্য মেয়েদের নিযুক্ত করা হচ্ছে। ১৯৫৩ সালের জুন মাসে, ক্যাথারিন জনসন ল্যাংলীর গবেষণাগারে মানব কম্পিউটার হিসেবে যোগদান করেন। হ্যাঁ, খানিকটা রসিকতা করেই তখন সেই পেশায় থাকা মানুষদেরকে এই নামেই ডাকা হতো। কারণ ডিজিটাল কম্পিউটারের যুগ তখনও আসেনি, আর সেই ডিজিটাল কম্পিউটারেরই সমতুল কম্পিউটেশনের কাজগুলিই এই সমস্ত কর্মীদেরকে হাতেকলমে সম্পন্ন করতে হত। বেশ কিছু বছর পর, এই ন্যাশনাল এ্যাডভাইসরি কমিটি ফর এ্যারোনটিকস গবেষণাগারেরই নাম পালটে গিয়ে নতুন নাম হয় ন্যাশনাল এ্যারোনটিকস এ্যান্ড স্পেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন। যাকে আমরা সকলেই ‘নাসা’ বলে চিনি, আর মহীয়সী ক্যাথারিন জনসন ছিলেন জগদ্বিখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানেরই অন্যতম প্রথম একজন আফ্রো-আমেরিকান মহিলা বৈজ্ঞানিক। যদিও ভুললে চলবে না, মহিলা মানব কম্পিউটারদের যে গ্রুপে ক্যাথারিনকে সেই সময় প্রথম নিয়োগ করা হয়েছিল তারও অধিকর্তা ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গী, তাঁর নাম ছিল ডরথি ভন। ক্রমশ আফ্রো-আমেরিকান মানব-কম্পিউটারদের সংখ্যা ন্যাশনাল এ্যাডভাইসরি কমিটি ফর এ্যারোনটিকস গবেষণাগারে ক্রমশই বাড়তে শুরু করায়, তাঁদের দলটিকে তখন অনেকেই আড়ালে (এমনকি প্রকাশ্যেও) ‘কালার্ড কম্পিউটার্স’ বলে চিহ্নিত করতেন। তখনও অবধি এই গবেষণাগারের অভ্যন্তরেও শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের একসাথে এক রেস্তোরাঁয় বা ক্যান্টিনে বসে খাওয়ার চল ছিল না। কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদা ক্যান্টিন এবং আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল। ১৯৫৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারি ভাবে ন্যাশনাল এ্যারোনটিকস এ্যান্ড স্পেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা ‘নাসা’য় রূপান্তরিত হলে পরে, বর্ণবিদ্বেষ-জনিত সমস্যাগুলির কিছুটা হলেও উপশম হয়। ক্যাথারিন অবশ্য অনেক পরে বলেছিলেন যে, এই সমস্তকিছুকে কোনোদিনই তিনি গায়ে মাখেননি। কেবল নিজের কাজটুকুকে নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকতেন।
১৯৫৮ থেকে ১৯৮৬ অবধি নাসার গবেষণাগারে সসম্মানে রাজত্ব করেছিলেন ক্যাথারিন জনসন। সেখানে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলির মধ্যে কয়েকটির কথা না বলেই পারছি না। ১৯৬১ সালের মে মাসে নাসার পক্ষ থেকে প্রথম মার্কিন নাগরিক হিসেবে এ্যালান শেফার্ডকে মহাকাশে পাঠানো হয়। এই যাত্রার সমস্ত খুঁটিনাটি অঙ্কের হিসেব ক্যাথারিন জনসনের দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছিল। এছাড়াও, সেই বছরই মার্কারি মিশন সিরিজের অঙ্গ হিসেবে নাসার প্রথম দিককার হিউমান স্পেসফ্লাইটগুলির যাবতীয় লঞ্চ উইন্ডো’সমূহেরই (রকেট উৎক্ষেপণের কালনির্ণয়) জটিল সমস্ত হিসেবনিকেশও ক্যাথারিনের গণনার দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছিল। তাঁর গণনার প্রতি অন্যান্য মহাকাশচারী এবং বিজ্ঞানীদের যে কতখানি আস্থা ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬২তে, জন গ্লেনের মহাকাশ সফরের সময়। উল্লেখ্য যে এই জন গ্লেনই প্রথম মার্কিন নাগরিক হিসেবে মহাকাশে গিয়ে পৃথিবীর চারপাশে সফলভাবে একবার প্রদক্ষিণ করে এসেছিলেন। সেই সময় নাসার গবেষণাগারে ডিজিটাল কম্পিউটার এসে পড়েছে। জন গ্লেনের সফরসূচি এবং তাঁর কক্ষপথে আবর্তনের বিষয়ে জটিল সমস্ত হিসেবনিকেশ সেই কম্পিউটারের মাধ্যমেই গণনা করা হয়েছিল। কিন্তু সফরের প্রাক্কালে জন গ্লেন স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেই সমস্ত হিসেবনিকেশকে যদি ক্যাথারিন জনসন দ্বিতীয়বারের জন্য পরীক্ষা করে নির্ভুল বলে রায় না দেন, তিনি কোনোভাবেই নতুন সেই সমস্ত ডিজিটাল কম্পিউটারের হিসেবের উপরে ভরসা করে রকেটে চাপবেন না। এমনটাই ছিল ক্যাথারিনের প্রতিপত্তি। এই সময়, ক্যাথারিনের সিনিয়র ডরথি ভন আবার ডিজিটাল কম্পিউটারের খুঁটিনাটিকে বোঝবার জন্য কম্পিউটারের বিভিন্ন আদি ভাষাকে বা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজকে শিখতে শুরু করেন। ক্যাথারিন, ডরথির উদ্যোগে মানব-কম্পিউটারেরা এবার ডিজিটাল কম্পিউটারের আধিপত্যকেও আয়ত্ত করতে উদ্যোগী হন। ১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিনদের চন্দ্রাভিযানের সময়ও ক্যাথারিন সেই অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত গণনার দায়িত্বে ছিলেন। মার্কিন মহাকাশ গবেষণার ইতিহাস তাই কোনোদিনই তাঁকে বাদ দিয়ে রচিত হতে পারে না। ক্যাথারিন অথবা ডরথি, মহাকাশের বিশাল বিস্তৃত নক্ষত্রখচিত প্রান্তরের জমিতে একেকটি চুমকির মতো অথবা একেকটি মুক্তোর মতোই সবিস্ময়ে ফুটে থাকেন।
মহাকাশ, নক্ষত্র, গবেষণা — এই শব্দগুলিকে পাশাপাশি উচ্চারণ করতে ভালো লাগে। ক্যাথারিনদের মতো একেকজনকে নিয়ে লিখতে ভালো লাগে। সেই কোন মহাকালের ওপার থেকে যাত্রা শুরু করে আজ নারীর বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস এতদূর অবধি বিস্তৃত হয়েছে। সেই যাত্রার ক্ষুদ্র লিপিকর হিসেবে যখন এগিয়ে চলি, এমন একেকজন মানুষদের জীবনের বিষয়ে জানতে পারি – তখন মনে হয় এ যেন সকলের প্রাপ্তি। অর্ধেক আকাশ, অথবা মেয়েদের ক্ষমতা নিয়ে সকল বিতর্কই যে কেবল অর্থহীন তাই নয়, তা কেবলই সময় নষ্টের অজুহাত। আমরা মেয়েরা বা ছেলেরা নই, মানুষ হয়ে মনুষ্যত্বকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। সাদা-কালো, জাতি-ধর্ম, সমাজ-লিঙ্গ ইত্যাদিকে ভুলে গিয়ে এক আলোকিত জ্ঞানের পৃথিবীর দিকেই আমরা এগিয়ে চলতে এসেছি। যে যাত্রার কোনও সূচনা হয় না, কোনও সমাপ্তিও হয় না। কেবল এইটুকুই।
সূত্রঃ
[১] মার্গট লি শেটার্লি, ‘দ্য উওম্যান দ্য মার্কারি এ্যাসট্রোনটস কুডন’ট ডু উইদাউট’, নটিলাস, ডিসেম্বর, ২০১৬
[২]মার্গট লি শেটার্লি, ‘ফ্রম হিডেন টু মডার্ন ফিগার্সঃ ক্যাথারিন জনসন বায়োগ্রাফি’, নাসা, ডিসেম্বর, ২০১৬
[৩] উইনি ওয়ারেন, ‘ব্ল্যাক উইমেন সায়ান্টিস্টস ইন দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৯
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক
ছবি: সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment