খেলা ভাঙার খেলা 

  • 27 May, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 620 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
বিভিন্ন পুরুষের স্বভাব-‌প্রকৃতি অনুসন্ধান করা আর তাদের সাথে মেলামেশা করাটা কোনো কোনো মেয়ের নেশা। একটা করে সম্বন্ধে জড়ায়, পছন্দ হয় না, নিজেই ছেড়ে দিয়ে চলে আসে মাঝপথ থেকে। ভয়ঙ্কর বিপদেও পড়তে হয় কখনও তাদের। এমনই এক মেয়ে মোহিনীর গল্প।

এই সম্পর্কটার আয়ুষ্কাল একটু বেশিই ছিল। পাক্কা এক বছর চার মাস। না, এটা প্রথম নয়, এর আগে আরও অনেকগুলিই এমনভাবেই প্রচুর উত্তেজনা নিয়ে শুরু হয়েছিল এবং হেলায় শেষ হয়ে গেছে। তবে সেগুলির আয়ু এত বেশি দিন ছিল না। কোনটা চার মাস, কোনটা বা ছ মাস, দশ মাস, এক বছর... হ‍্যাঁ এর আগেরবারেরটা অনেক দিন টিকে ছিল বটে, টানা এক বছর! তবে এবারেরটা আরও চার মাস বেশি। না, এত বেশি সময় ধরে একটা রিলেশনে থেকে যাওয়াটা মোহিনীর মোটেই পছন্দ নয়। সেই তেরো বছর বয়স থেকে প্রেম করতে শিখেছে আর এখন ছাব্বিশের কোঠা ছাড়িয়ে পড়েছে সাতাশের ঘরে। আসলে বিভিন্ন পুরুষের স্বভাব-‌প্রকৃতি অনুসন্ধান করা আর তাদের সাথে মেলামেশা করাটা মোহিনীর একটা নেশা। ঠিক অনেকটা বিভিন্ন পদের খাবার একবার করে চেখে দেখার মতোই। মোহিনী একটা করে সম্বন্ধে জড়ায়, পছন্দ হয় না, নিজেই ছেড়ে দিয়ে চলে আসে মাঝপথ থেকে। যদি অপছন্দের কোনো কারণ নাও থাকে তবুও তুচ্ছ একটা ছোটোখাটো সাধারণ ইস‍্যুকে বড় করে সামনে তুলে ধরে সম্পর্কের ইতি ঘটাতে চায়। তবে এবারের ছেলেটা ছিল একটু ট্রিপিকাল। 

সায়নের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়েই মোহিনীর মুশকিলটা হয়েছে। মোহিনী সায়নের সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে দিলেও সায়ন ওকে জ্বালাতন করা এখনো ছাড়েনি। উপদ্রবটা এখন ফোন থেকে এসে পৌঁছেছে বাড়ির দরজা পর্যন্ত। 

সায়ন যে খুব খারাপ ঘরের ছেলে ছিল তা নয়, বাবা-মা অমায়িক ভালো মানুষ। সম্ভ্রান্ত পরিবারেরই ছেলে বলা যায়। সায়নের বাবা সরকারি অফিসে চাকরি করতেন, এখন রিটায়ার্ড। তবে মাসে মাসে বেশ মোটা টাকার পেনশন পান। সায়ন নাম করা একটা বড় ওষুধের কোম্পানিতে কাজ করছে। মোহিনীর থেকে বছর পাঁচেকের বড়। ফেসবুকেই দু জনের আলাপ। মোহিনীই প্রথমে সায়নকে ফাঁসায় নিজের রূপের জালে। তখন ভেবেছিল সায়ন খুবই বোকা-সোকা একটা সাদামাটা ছেলে, কয়েকদিন ওর সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আবার নতুন প্রেমিক পাতাবে অন্য কাউকে। কিন্তু সায়ন রিলেশনটাকে খুব সিরিয়াসলি নেয়। প্রথম দু মাস খুব ভালোভাবেই চলছিল কিন্তু তারপর থেকেই সায়ন বারবার মোহিনীকে ফোন করে এখানে-ওখানে দেখা করতে বলতো। একরাত জোর করে একটা হোটেলে এক সাথে থাকার জন্য বাধ্যও করেছিল। এত তাড়াতাড়ি সায়নকে এত কাছাকাছি চলে আসতে দেখে মোহিনী রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়। রিলেশনটা খুব দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করতে থাকে মোহিনী। মোহিনী এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও সায়ন থেমে থাকেনি। মোহিনীর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে নিজেই যাতায়াত শুরু করে দেয়। মোহিনীকেও জোর করে ওদের বাড়িতে নিয়ে যেত কোনোকোনো দিন। সায়ন নিজের বাবা-মায়ের সাথে মোহিনীর পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের জন্য সায়নের এই তাড়াহুড়োর কারণ মোহিনী বুঝতে পারে। সায়ন হয়তো ভাবছে মোহিনী ওকে ছেড়ে যেকোনো দিন চলে যেতে পারে। সায়ন ওর পাস্ট লাইফের ব্যাপারে মোহিনীকে কিছুই জানায়নি। তাই মোহিনীর অস্বস্তিটাও ছিল বেশি। তবে সবথেকে বিরক্তির কারণ হল, এই ছেলেগুলো কিছুতেই বুঝতে চায় না মেয়েরা যার সাথে প্রেম করছে তার সাথেই যে বিয়েটা করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মোহিনী মনে করে মূলত বিয়ে করার পরে প্রেম করাটাই শ্রেয়, প্রেম করে বিয়ে করতে গেলে পুরনো হয়ে যায় কিনা তাই ঝঞ্ঝাট আরও বাড়ে। মোহিনী একবার করে বিয়ে করে আর একবার করে ডিভোর্স দেবে সেটা কিছুতেই করতে পারবে না। আরে বাবা, আমাদের সমাজ বলে তো একটা জিনিস আছে নাকি? আর বারবার ডিভোর্সি হওয়াটাও তো ভালো দেখায় না মেয়েদের। শেষকালে চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করবে। মোহিনীর এক বন্ধু পায়েলের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছিল। স্বামী জোর করে ডিভোর্স পেপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেও পুরুষের চরিত্রে কলঙ্কের ছিটেফোঁটাও লাগে না। যত দোষ মেয়েদের বেলায়। স্বামীকে ধরে রাখতে না পারলে সমস্ত কলঙ্কের অধিকারী সে— এমনই কিছু ফালতু ধারণাকে মনে পুষে রেখে দিয়েছে আজও এক শ্রেণির লোক, উফফ্ ডিসগাস্টিং! কারোর ঘরের বউ হওয়া মানেই তাকে সতীলক্ষী হতেই হবে। না হলেই তুমি সমাজের চোখে একেবারে ভিলেন! সে সতীলক্ষী হতে গেলে যদি নিজের আত্মাকে খুন করে হাত রক্তাক্তও করতে হয় তাও ভালো। সে তো বড় পূণ্যের কাজ। না না, মোহিনী এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায় না। কম করে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স না হলে কোনো মেয়ের বিয়ে করাই উচিৎ নয়। আগে মেয়েরা সেটেল হবে, সবকিছু বুঝতে শিখবে তারপর সবশেষে বিয়ে। মোহিনী পায়েলকেও এমনটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। আসলে ছেলেবেলাকার বন্ধু তো তেমন একটা কথার আমল দেয়নি, এখন তার ফল ভুগছে। বাড়ি থেকে কোর্ট, কোর্ট থেকে বাড়ি করতে করতেই মেয়েটার জীবন একেবারে নরক হয়ে গেল। টাকাকে টাকা তো যাচ্ছেই উকিলের ঘরে জলের মতো, জমানো টাকায় আর চলছে না। এই তো সেদিনই ফোন করেছিল কোনো একটা কাজ জুটিয়ে দেওয়ার জন্য। এখন ভোট শেষ, হন্যে হয়ে খুঁজলেও কাজ পাওয়াটা রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার তার ওপর থাবা বসিয়েছে করোনা-লকডাউন, কাজ পাবে কোত্থেকে? বারবার পায়েলকে না বলতে মোহিনীর খুবই খারাপ লাগে। যাক্ সে কথা। আচ্ছা, মোহিনী এখন বিয়েটাই বা কেন করতে যাবে? ও একজন প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার। অফিসের পোস্ট যে খুব বেশি নীচু তা নয়। তাছাড়া বস্-এর পছন্দের পাত্রী হওয়ার সৌভাগ্যও জুটেছে। কেন শুধু শুধু বিয়েথা করে লোকের ঘরে হাতাখুন্তি নাড়তে যাবে? এর থেকে প্রেম করে বেড়ানো, লিভ টুগেদার করা অনেক ভালো। নিজের মর্জির একটা মান থাকে সেখানে। সেটা সায়নের মতো ছেলেরা কোনোদিনই বুঝবে না। সব কিছুতেই একটা সেন্টিমেন্টকে টেনে আনে এরা। মোহিনীর জীবনটা অবশ্য সবসময়ই এমন সুখের ছিল না। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা কেমন যেন নিজেকে খুব বেশি অসহায় বলে মনে করতেন। বাবা ছিলেন লাইফ ইনস‍‍্যুরেন্স পলিসির এক ছোটোখাটো এজেন্ট। জমানো সম্পত্তির পরিমাণটাও খুব বেশি ছিল না। আর্থিক সঙ্কট কাকে বলে মোহিনী তার সংজ্ঞাটা খুব ভালোভাবেই জানতে পেরেছিল সেদিন। কিছুকাল মাকে এর দুয়ারে তার দুয়ারে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছে টাকার জন্য। বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। মোহিনীর কপাল ভালো, মেধার জোরে পড়া শেষ হতে না হতেই চাকরিটা জুটে গেছে। তারপর থেকে কেবলমাত্র নিজের বুদ্ধির জোরে প্রোমোশনের পর প্রোমোশন আর এখন এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। মায়ের লড়াইটাকে মোহিনী কিছুতেই ভুলতে পারেনা। আজও মনে পড়লে চোখে জল আসে। মোহিনীর মা অনুরাধা সেইসময় চেয়েছিলেন মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে। মোহিনী জানতো তখন মায়ের মাথার ঠিক নেই। কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হবে না। আর একটা বছর, মোটে একটা বছর বাকি এম টেক কমপ্লিট হতে। মোহিনী বুঝতে পেরেছিল মায়ের কথা শুনতে গেলে ওর ভবিষ্যৎ পুরো শেষ। বাবার শেষ ইচ্ছাটাকে ওকে পূরণ করতেই হবে। বাবাকে খুব ভালোবাসতো যে। তাই মায়ের সাথে কখনো খারাপ ভাবে ঝগড়া করে, কখনো বাড়ি থেকে পালিয়ে বয়ফ্রেন্ডের বাড়িতে, কোনোদিন বা পায়েলের বাড়িতে থেকে কোনো রকমে পড়াশোনাটা চালিয়েছে। মায়ের সাথে দুর্ব‍্যবহার করতেও সেদিন একটুও বুক কাঁপাইনি মোহিনী। আজ সব শান্তি। এখন সেই মা ছাড়া মোহিনির আপনার বলতে আর কেউ নেই। পায়েল এখনো ওপর ওপর বন্ধুত্বটা রেখেছে ঠিকই, সেটাও কাজের ধান্ধায়। কাজ ফুরোলেই পাজি। মোহিনী জানে ওর এই কামুকতার জন্য বাকি বন্ধুরা মিশতে চায় না। অনুরাধা মেয়ের সব কীর্তির ব্যাপারে না জানলেও সায়নকে ঠিক চিনতেন। সায়ন নিজের থেকেই পরিচয় পর্বটা আগেভাগে সেরে নিয়েছিল। তাই সায়নের ব্যাপারটা মোহিনী আর আড়াল করতে পারেনি। অনেক শোকতাপে ভুগে অনুরাধা এখন কেমন যেন একটা হয়ে গেছে। ছোটোখাটো ঝামেলাগুলিতে মাথা ঘামানো একদমই পছন্দ করে না। তাই মোহিনী আর সায়নের এই ঝামেলার মধ্যে আর নাক গলাতে চায়নি।

ওদের সম্পর্কের এই শেষটা সায়ন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। কোনো খারাপ ব্যবহারও মোহিনীর সাথে করেনি। তাহলে, এভাবে অপমান করে সবকিছু ছেড়েছুড়ে দেওয়ার কারণ কি? মা-বাবা তো বিয়ের জন্য রাজিই ছিলেন, ওদিক থেকে কাকিমারও কোনো আপত্তি ছিল না। তবে, নতুন কোনো বয়ফ্রেন্ড? হ‍্যাঁ সেটা একটা কারণ হতে পারে। মোহিনী দেখতে তো খুবই সুন্দর তাছাড়া সায়ন এখন অনেকটাই পুরোনো হয়ে গেছে বোধহয়। কিন্তু ভালোবাসা কি কখনো পুরোনো হয়? কোনো কারণে মাথার ঠিক ছিল না। তাই বোধহয় অমন উল্টোপাল্টা একটা কথা বলে ছেড়ে দিয়েছে। বেচারা, অসহায় মেয়ে তো, মেজাজ খিটখিটে হওয়াটাই স্বাভাবিক। না, তা বলে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া চলে না। মোহিনী যোগাযোগ না রাখলেও সায়নকে জোর করে ওর সাথে কথা বলতেই হবে। মেয়েদের মন বোঝা সত‍্যিই বড় দূরহ ব্যাপার। ওসব প্রেমিকাদের অভিমান নিয়ে এত মাথা ঘামালে চলে?

ব্যাস্, আবার শুরু হল ওই একই জ্বালাতন! সকাল হতে না হতেই ফোন, অফিসে ফোন, রাস্তায় ফোন, খাওয়ার সময় ফোন, ঘুমোতেও দেবে না শান্তিতে মাঝরাতে ফোন... উফ্, আর না পেরে মোহিনী নাম্বারটা ব্লক করে দিয়েছে। না, তাতেও শান্তি নেই, অন্য কোত্থেকে নাম্বার জুটিয়ে ফোন। তারপর বাড়িতে আগমন। হ‍্যাঁ, মোহিনী এই ভয়টাই পাচ্ছিল। দরজার আইহোলে সায়নকে দেখতে পেয়ে মোহিনী দরজাই খোলেনি। বাইরে থেকেই অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। অনুরাধা মেয়ের কান্ড দেখে যথেষ্ট অবাক হয়। ব্যাপারটা কি? মনে হচ্ছে ওদের ঝামেলাটা এবার একটু গুরুতর হয়েছে। অনুরাধা প্রথমেই এইসব বিষয়ে মাথা ঘামায়নি। জানে বাচ্চাদের ব্যাপার, ওরা মিটিয়ে নিলেই ভালো। কিন্তু কয়েকদিন ধরে দেখছে, মোহিনীকে কেউ ফোনে অনবরত উপদ্রব করে যাচ্ছে। আজ নিশ্চিত হল সেটা সায়ন ছাড়া আর কেউ নয়। মোহিনীর যদি পছন্দ না হয় তাহলে সায়ন বারবার ধরে উৎপাত করবে কেন? মোহিনী আবার কোনো বিপদে পড়ে যাবে না তো? এভাবে নির্বিকার হয়ে বসে থাকা কী আর উচিৎ? এবার জানতেই হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা। একমাত্র রোজগেরে মেয়ে, তার কিছু হয়ে গেলে অনুরাধা আর বাঁচবে কি নিয়ে?

ঠাকুরঘরে সন্ধ‍্যে দিয়ে অনুরাধা মোহিনীর ঘরে ঢুকে দেখে মোহিনী ল্যাপটপে কাজে মশগুল। মোহিনী আজ আর অফিসে যায়নি, মন নাকি ভালো ছিল না। অনুরাধা বিছানার ওপর আস্তে করে বসে জিজ্ঞাসা করলো, ‘‌মিনু, অনেক দিন ধরে দেখছি সায়নের সাথে তোর ঝামেলা চলছে, কি হয়েছে?’‌ 
মোহিনী ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে মুখ না তুলেই বললো, ‘‌ওহ্, তুমিও জেনে গেছো ব্যাপারটা। দেখো না, সায়ন এত বিরক্ত করছে না। ব্রেকআপ করে দিয়েছি তার পরেও। ধুর্, আমি ও সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না, দু দিন মাছির মতো একটু ঘ‍্যানঘ‍্যান করে যাবে তারপর নিজে থেকেই কেটে পড়বে।’
—‘‌সে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াক। ওকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। আমার সমস্ত চিন্তা শুধু তোকে ঘিরে। আগে খবরের কাগজে খুব বেরোতো দেখতাম, প্রেমিকা ছেড়ে দিয়েছে বলে আবেগের বশে কিছু একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসে থাকে। এখন করোনা আর ভোটের খবরের তলায় সেই ছুটকো খবরগুলো চাপা পড়ে যায়। আমার ভয় হয় সায়ন আবার তোর কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না তো?’‌ 

সামান্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মোহিনী বললো, ‘‌ও একটা বদ্ধ পাগল,  আমার ক্ষতি করার মতো ক্ষমতা ও সাহস কোনোটাই ওর নেই।’‌ 

অনুরাধা এবার একটু ধমকের সুরেই বললো, ‘‌উড়িয়ে দিস না কথাগুলোকে, রাস্তাঘাটে বেরোস, খুব চিন্তা হয় আমার। এমনিতেই এখন বাইরে কোভিড সিচুয়েশন ভালো নেই। বসকে বল না যদি ঘরে বসে কটাদিন কাজ করতে পারিস।’‌ 
— ‘‌আরে দাঁড়াও দাঁড়াও কোম্পানির অবস্থা এমনিতেই খারাপ আবার লকডাউন হবে গুজব শুনছি। ওই কথাটা পাড়া এখন খুব মুশকিল। কিছু হবে না আমার, বলছি তো। শুধু শুধু চিন্তা করে মাথা খারাপ কোরোনা তো, যাও তোমার কাজ কর গে।’‌ 

অনুরাধা আর কিছু না বলে বেরিয়ে চলে আসে ঘর থেকে। মোহিনী বিষয়টিকে পাত্তা দিতে চাইছে না। কিন্তু অনুরাধা ছেলেটিকে যতটুকু চিনতে পেরেছে তাতে মনে হচ্ছে এ ঝামেলা এত তাড়াতাড়ি মেটার নয়। দূর থেকে একটা গণ্ডগোলের গন্ধও আঁচ করতে পারছে অনুরাধা। অনুরাধা নিজের মনকে শক্ত করতে আরম্ভ করলো। মোহিনী ওর কাছে প্রাণের চেয়েও বেশি দামী। আর কতদিন এভাবে সংসার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবে? যে গেছে সে তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। অনুরাধাকে একাই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মোহিনীকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই।

পরের দিন মোহিনী বেরিয়ে যায় অফিসে। যাক্, আজ সারাদিন আর কোনো উপদ্রব হয়নি। তবে, সবকিছু খুবই শান্ত মনে হচ্ছে। আগের দিন ওইভাবে অপমানিত হয়ে ফেরার পর সায়ন বুঝি অনেক দুঃখ পেয়েছে। সে পাক, আর উপদ্রব না করলেই হল। তবে মোহিনী রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় সামনের ফাঁকা রাস্তাটায় ট‍্যাক্সি ধরার জন্য না দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল তিন মাথার মোড়টার দিকে। ওখানে তাও একটু জমজমাটি আছে। আগের দিনের মায়ের কথাগুলো অল্প অল্প করে খচখচ করে বিধঁছে মনের মধ্যে। ফুটপাথের ওপর একটা পানের দোকান, ওখানেই দাঁড়াতে যাবে, হঠাৎ করে কি বিশাল একটা আওয়াজের ঝড় উঠলো। ওই যে দূর থেকে একটা লাল স্পোর্টস বাইক সাঁইসাঁই করে এদিকেই এগিয়ে আসছে। মোহিনী সরে গিয়ে ফুটপাথের ওপর উঠে গেল। আরে, কে ওটা? সায়ন না? বাইক চালকের পিছনের সিটে বসে আছে। বাইকের স্পিডটা একটু স্লো করে মোহিনীর দিকে এগিয়ে আসতেই সায়ন পকেট থেকে একটা বোতল বের করে জলের মতো কিছু একটা ছুঁড়ে মারলো মোহিনীর দিকে। মোহিনী ভ‍্যাবাচ‍্যাকা খেয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু শেষ রক্ষা আর হল না। অব্যর্থ নিশানা। অ‍্যাসিডটা পুরো এসে লাগলো মোহিনীর ডান চোখ ঘেঁষে। বাইকটা ততক্ষণে পগার পার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মোহিনীর মুখের ডান দিকের সমস্ত চামড়া পুড়তে শুরু করে দিল। অসহ‍্য একটা দহনজ্বালা ছড়িয়ে পড়তে থাকলো মোহিনীর সর্বাঙ্গ জুড়ে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, ফুটপাথে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো। নিজেরই চামড়া পোড়ার বিকট একটা গন্ধ নাকে আসছে মোহিনীর। চিৎকার শুনে কিছু লোক বোধহয় ওকে ঘিরে ধরেছে। চোখ মেলে দেখার আর ক্ষমতা নেই। ওকে ঘিরে থাকা লোকগুলির গলার আওয়াজ কিছুটা কিছুটা কানে আসছে। কেউ বোধহয় বললো, ‘‌মাস্ক খুলে ফেলুন তাড়াতাড়ি।’‌ মোহিনী মাস্ক খুলে ফেললো। কেউ বোধহয় মুখের ওপর জল ঢালছে। মোহিনী ছটফট করছে যন্ত্রণায়। আর পারছে না। ... আর জ্ঞান নেই।

আড়াই মাস কেটে গেছে। হসপিটালের পর্ব শেষ করে মোহিনী ফিরেছে বাড়িতে। ভাগ্য ভালো যে ডান চোখের দৃষ্টি শক্তিটা হারিয়ে ফেলেনি। মোহিনী বাড়িতে ফিরে এসে দেখে, মা মুখ দেখতে দেবে না বলে সুপরিকল্পিত ভাবে ঘর থেকে সব আয়না, ল্যাপটপ সরিয়ে রেখেছে। এমনকি মোবাইলটাকেও ওর কাছে দেয়নি। মোহিনীর আর মুখ দেখার আগ‍্রহও নেই। ও জানে অ‍্যাসিড আক্রান্তের মুখের কেমন শ্রী হয়। তবুও মোহিনী মা কে একবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘‌আমাকে দেখতে এখন কেমন লাগছে মা?’‌ 
অনুরাধা খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিল, ‘‌ভালোই।’‌
—‘‌মিথ্যে কথা।’‌
—‘‌ছয়-সাতবার সার্জারি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, ভালো না হয়ে যাবে কোথায়?’‌
—‘‌তবুও আগের মতো আর সুন্দর নেই বলো?’‌
—‘‌না, তবে এখন নতুন যে রূপটা পেয়েছিস সেটা আগের থেকে আরও মিষ্টি।’‌
একটা মমতা মাখা হাসিমুখ নিয়ে অনুরাধা আলতো করে চুম্বন করলো মেয়ের কপাল। মোহিনী আর পারলো না, মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদ ফেললো হাপুস নয়নে। অনুরাধার চোখের কোণে একটু একটু জল জমতে আরম্ভ করলো। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। মেয়ের সামনে চোখের জল একদমই ফেলা যাবে না। ডাক্তারেরা বলে দিয়েছিলেন মোহিনীর মনটাকে সবসময় ভালো রাখার জন্য। অনুরাধা বললো, ‘‌মায়ের কাছে সন্তান কখনো কুৎসিত হয় না, আর রূপ যৌবন চিরকাল থাকে না মিনু। যা থাকে না তাকে নিয়ে চিন্তা করে কোনো লাভ নেই, ভালো থাকাটাই আসল কথা।’‌ এভাবে স্বান্তনা দিয়ে মোহিনীকে আর কতদিন সামলাতে পারবে, অনুরাধা তা জানেনা। তবে সবকিছুকে আবার স্বাভাবিক করার জন্য সমস্ত চেষ্টা চালাবে।

অনুরাধা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে মোহিনী একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে। মোহিনীকে আর একা রাখা চলে না। ঘরের ভেতর একা বসে বসে যত কুচিন্তা মাথায় ঘোরাবে। সকালে বাজার আর রান্নাবান্নার সময়টুকু ছাড়া সারাক্ষণই মেয়েকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে অনুরাধা। ঘরে একটা নতুন কাজের লোকও রেখে দিয়েছে সে। ভোটের রেজাল্ট বেরোতে না বেরোতেই আবার লকডাউন হয়ে গেল। ঘরে বসেই কাজ করার একটা সুযোগ পেল মোহিনী। মোহিনী হসপিটালে থাকাকালীনই অনুরাধা অফিসে সব কিছু জানিয়ে দেয়। বস্ নিজে একবার ফোন করেও মোহিনীর খোঁজখবর নিয়েছে।

দুপুর বেলা মোহিনীর ঘরের সব দরজা জানলা বন্ধ করে পর্দা দিয়ে দিয়েছে অনুরাধা। ঘরের ভেতর এসি চলছে। অনুরাধা মোহিনীর সাথে শুয়ে আছে একই খাটে। সারাদিন খাটাখাটনির পর এখন একটু ঘুমিয়ে পড়েছে। মোহিনীর কিছুতেই ঘুম আসছে না। একটু উসখুস করে উঠে বসে পড়েছে বিছানার ওপর। গোটা ঘর ছেয়ে গেছে অন্ধকারে। মোহিনী ভাবছে, মা এত কিছু সামলাবে কীভাবে? মোহিনী হসপিটালে থাকাকালীন অনুরাধা নিজে গিয়ে পুলিশ ডেকে এনেছিল। মোহিনী তখন বেশি কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে ছিল না। শুধুমাত্র সেইরাতে ওর সাথে যা যা ঘটেছিল সেগুলোই কোনোরকমে পুলিশকে জানিয়েছিল। মা সায়নের বিরূদ্ধে মামলা লড়তে চাইছে, কিন্তু এত টাকা আসবে কোত্থেকে? এইসব ঝামেলায় না যাওয়াই ভালো। এছাড়া সংসার খরচ আছে, ইলেকট্রিক, কেবিলের বিল। মা কি এগুলো সব পে করে দিয়েছে? না হলে তো লাইন কেটে দেওয়ার কথা। এতদিন মোহিনী বাড়িতে ছিল না। কিন্তু, কোনোকিছুই তো লণ্ডভণ্ড হয়নি। মা একা সব দিকটা সামলে নিতে পেরেছে। মোহিনী এবার সত‍্যিই অবাক হয় মা কেমন যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। সেই ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছে মোহিনী, মা ছিল আলুথালু আর খুবই ঘরকুনো প্রকৃতির। বাইরের একটা লোকের সামনে আসতে পর্যন্ত লজ্জা পেত। বাবা বেঁচে থাকাকালীন বাবাই বাইরের সমস্ত কাজ সামলেছেন আর বাবা চলে যাওয়ার পর মোহিনীকেই সবকিছু সামলাতে হত। মা এখন সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে দশভুজা মূর্তি ধরে ছুটে এসেছেন মেয়েকে বাঁচাতে। এত সাহস, এত শক্তি সঞ্চিত ছিল মায়ের ভিতরে! তা মোহিনী এতদিন বুঝতেই পারেনি। কত সাধারণ কত তুচ্ছই না ভাবতো সে নিজের মাকে। এখন সত‍্যি মায়ের জন্য খুবই গর্ব অনুভব করছে মোহিনী। কিন্তু এখন ওর ভবিষ্যতের কী হবে? কেউ তো আর ওকে বিয়ে করতে চাইবে না। মায়ের কথা শুনে আগে বিয়েটা করে নিলেই ভালো হত হয়ত। নিজের এই বিশ্রী মুখটাকে নিজেই সহ‍্য করতে পারছে না মোহিনী। কী হবে এই পোড়া মুখ নিয়ে। এর থেকে মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো। না, মনে হচ্ছে মোহিনী আর কোনোদিনই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। সবাই ওকে দেখে হাসবে, ঘৃণা করবে, মিথ্যা সিমপ্যাথি দেখানোর চেষ্টা করবে যেটা ওর কখনোই পছন্দ নয়। সব দোষ ওর একার, ছেলেগুলোর সাথে এই রকম মিথ্যা প্রেমের খেলা না খেললেই ভালো হত। এখন নিজের পাপের ফল ভোগ করছে। মোহিনী কাঁদছে কিন্তু নিঃশব্দে হাতের তালুর মধ্যে মুখ গুজে, মা যাতে কোনোভাবেই টের না পায়, না হলে সে খুব দুঃখ পাবে। মায়ের এত কষ্ট করে বাড়ানো মনোবলটা ভেঙে দিতে চায় না মোহিনী। কান্নার একটু বিরাম হতেই মোহিনীর আবার মনে হল, সব দোষ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিলে তো হবে না। অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে না হলে নিজের সাথে একটা বড় অন্যায় করা হবে। উল্টোপাল্টা চিন্তা না করে মোহিনীর উচিৎ এখন মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসা, মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। লড়াইটা ওদের দু জনকে একসাথে লড়তে হবে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই কিন্তু মায়ের ডাকাডাকিতে যখন ঘুম ভাঙলো তখন সন্ধ‍্যা সাড়ে ছ টা বাজে। মা এসি বন্ধ করে জানলা দরজা সব খুলে দিয়েছে। একটা হালকা বাতাস ঢুকছে দক্ষিণের জানলা দিয়ে। গ্রীষ্মের তপ্ত আকাশের শ্যামবর্ণা আলো স্থিরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে ঘরের মেঝেয়। অনুরাধা ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে মোহিনীকে বললো, ‘‌থানা থেকে ফোন করেছিল একটু আগে। ওরা তোকে ডেকেছে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চল আমার সাথে।’‌ 
থানায় যাওয়ার পর অফিসারের থেকে মোহিনী জানতে পারে ওরা সায়নকে গ্রেফতার করতে পেরেছে। অফিসার মোহিনীকে আরও বলেন, ‘‌খুব ভালো করেছেন এই রকম বিপজ্জনক ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখেননি। ওর মা-বাবা বলে যাদের পরিচয় করিয়েছিল আপনার সাথে তারা সব মিথ্যে। এমনকি নিজের যে পরিচয়টা আপনাকে দিয়েছিল সেটাও সম্পূর্ণ মিথ্যে। পুরোটাই সাজানো। লোকটার এর আগে আরও দুটো বিয়ে আছে। ঠিক এইরকম ভাবেই যেরকম আপনাকে বন্ধু পাতিয়েছিল, ফেসবুকে মেয়েদের সাথে আলাপ জমিয়ে এই কীর্তি করে বেড়াচ্ছে। এর আগেও ওর নামে অন্য একটা থানায় এক মহিলা কমপ্লেন লিখিয়েছিলেন। ভালো করেছেন ওকে বিয়ে করে ফেলেননি।’‌

থানা থেকে ফেরার সময় অনুরাধা একটা রিকশ ডেকে নিল। মোহিনীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বললো, ‘‌যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই। তুই শয়তানটাকে যোগ্য শাস্তি দিতে পারবি এই অনেক।’‌
 মোহিনীকে চুপ থাকতে দেখে অনুরাধা আবার বললো, ‘‌কাল রবীন্দ্রজয়ন্তী মনে আছে তো?‘‌ 
মোহিনীর ঠোঁটের কোণে এবার একটা হালকা হাসির রেখা দেখা দিল, বলল, ‘‌তোমার মনে আছে রবীন্দ্রজয়ন্তীর কথা?’‌
—‘‌তা মনে থাকবে না, ছোটবেলায় স্কুল কলেজে কত নাচ, গান, আবৃত্তি করতিস।’‌
—‘‌হ‍্যাঁ আর এবছর সবাই ঘরবন্দি।’‌
—‘‌তাতে কী হয়েছে, ঘরেতেই রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করবো তুই আর আমি। সুন্দর করে একটা গান একটা নাচ আর একটা আবৃত্তি করবি আমি সব ভিডিও করে রেখে দেব তুই পরে সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দিবি।’‌
—‘‌কাল তো মাদারস্ ডে তাই না? দেখো আমি মনে রেখেছি কিন্তু মা। কিন্তু এবারের গিফটটা যে কেনা হল না।’‌
—‘‌না মিনু, এবছর আর ওই গোলাপ ফুল আর চকলেট দিলে হবে না, ভালো গিফট দিতে হবে।‘‌
—‘‌কী চাও বল।’‌
—‘‌তুই আমাকে কথা দিবি যে এইসব কিছু ভুলে গিয়ে আবার স্বাভাবিক ভাবে কাজে মন দিবি। আমি তোকে সারা জীবন বস্-‌এর তাবেদারি করে যেতে দেখতে চাই না। তোকে অনেক উঁচুতে উঠতে হবে মিনু। একটা কোম্পানির ম্যানেজার হতে দেখতে চাই আমি তোকে। নিজের কেরিয়ারের বিষয়ে এবার তুই আরও সচেতন হবি, কথা দে।’‌
—‘‌ঠিক আছে, দেব।’‌

লেখক : কলেজ ছাত্রী

0 Comments

Post Comment