- 23 July, 2023
- 0 Comment(s)
- 419 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
অক্ষরও নীরব যেখানে, এ লজ্জার কোনও ভাষা নেই। গুছিয়ে কিছু লেখার মতো মানসিকতা এখনও আসেনি। অথচ, কত সহজেই না রাজনৈতিক মানুষেরা বিবৃতি দিয়ে ফেলেছেন। কেবল কি রাজনৈতিক? সহজ, সরল (?, অন্তত এককালে তো ছিলেন) সাধারণ মানুষেরা, যারা কিনা মানসিক ভাবে বিশেষ কোনও একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থক, সামাজিক মাধ্যমে তাদেরও অবস্থান দেখলে শিউরে উঠতে হয়। অথবা, আমরাই বোধহয় পিছনে থেকে গিয়েছি। আমাদের অনেক আগে থাকতেই হৃদয়হীনতার পাঠ নেওয়া উচিত ছিল। ১৯৯২, অথবা গুজরাত ২০০২ থেকেই। নির্ভয়া কাণ্ডে অনেক মানুষ পথে নেমেছিলেন। সেই উদাহরণ টেনে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, মণিপুরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তেমন কোনও গণ-বিস্ফোরণ দেখা যাচ্ছে না কেন। উত্তরটা সরাসরি দেওয়া উচিত। এর কারণ হল, নির্ভয়ার ঘটনা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাথমিক ভাবে রাজনৈতিক প্রভাব-মুক্ত। যদিও, বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল সুকৌশলে পরবর্তীতে সেই ঘটনাটিকেও রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রয়োজনে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু, উন্নাও, কাঠুয়া, হাথরাস অথবা ২০০২এর গুজরাতেও, আমরা গণ-বিস্ফোরণ দেখিনি। কারণ শুরুর মুহূর্ত থেকেই, সেখানে ধর্ষিতা মেয়েদের উপর, মুসলিম, দলিত, অথবা আরও কোনও সামাজিক, তদুপরি রাজনৈতিক পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ, অথবা রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনায় মহিলাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার যুগ যুগ ধরে হয়ে এসেছে। আমরা সেই ঘটনাগুলিকে সাধারণের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছি। কারণ, রাজনীতি আমাদের ড্রয়িংরুমের মৌতাতের বস্তু। সেখানে অমার্জিত, অশোভন আলোচনা মৌতাতের তালভঙ্গ করে। সেই একই কারণে আমরা মণিপুরের ঘটনার ক্ষেত্রেও গণ-বিস্ফোরণ দেখিনি। সামাজিক মাধ্যমে আমাদের মতোই একেকজন যারা পীড়িত, ক্ষুব্ধ, ও বিধ্বস্ত (ওই ফুটেজটিকে যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের পক্ষে বিধ্বস্ত ও নির্বাক হয়ে যাওয়াটাই একমাত্র স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলে মনে করি), আমরা সেই মোতাবেক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি, কিন্তু সেই চূড়ান্ত কষ্টের অনুভূতিটুকু জনতার ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র এক অংশের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ থেকেছে। জনতা যদি সামাজিক, বা রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনায়, সত্যি করেই সংবেদনশীল হতো, তাহলে কখনই ২০০২এর গণহত্যার নায়ককে তারা উপর্যুপরি দুইবার করে ভারতের মসনদে বসাত না। বিলকিসকে আমরা ভুলে গিয়েছি। কাঠুয়া, উন্নাও অথবা হাথরাসকেও আমরা ভুলে গিয়েছি। মণিপুরকেও আমরা ভুলে যেতে পারব। মণিপুরের ধারা ৩৭১, অথবা তার কু-প্রয়োগকে ঘিরে দশকের পরে দশক ধরে যে অত্যাচার চলেছে, এদল-ওদল সমস্ত দলগুলিরই তরফে, আমরা সেই ইতিহাস সম্পর্কে উৎসাহিত হইনি। মনে রাখতেও চেষ্টা করিনি। আমরা নিজেদেরকে সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র বলে উল্লাস প্রকাশ করি, ভোট-উৎসব বলে সামাজিক মাধ্যমে নিজস্বী ভাগ করে নিতে আগ্রহ বোধ করি, এবং রাজনীতি সম্পর্কে যে কোনও আলোচনাকে উচ্চমার্গের নেশার বস্তুর মতোই মনে করে, রাত্তিরে খাওয়ার সময়ে অথবা পানীয়ের সাহচর্যে বুক ফুলিয়ে সেই বিষয়ে মন্তব্য করি। সেখানে অশালীন কোনও শব্দ বলা নিষিদ্ধ। অশ্লীল ছবি দেখানো নিষিদ্ধ। মণিপুরের মতো কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে আলোচনা উঠলেই, “ট্র্যাশ, আটার ট্র্যাশ, সত্যিই কোন অন্ধকারে নেমে গিয়েছে আমাদের দেশ - ভদ্দরলোকেরা কি এরপরেও রাজনীতি করবে!” এমনধারা কিছু আলগা প্রতিক্রিয়াকে আকাশে ছুঁড়ে দিয়েই, আমরা পানীয়ের গেলাসে চুমুক দিই।
ঠিক এই কারণেই, ওই জঘন্য ঘটনার পরেও, আমাদের (মাপ করবেন, আর মাননীয় লেখা যাচ্ছে না) ছাতিবহুল, পেশীবহুল প্রধানমন্ত্রী মহাশয়, ওই রাজ্যে কি হচ্ছে, সেই রাজ্যে কি হচ্ছে, মণিপুরের ঘটনা খুবই খারাপ, এমন নির্লজ্জ ধরণে প্রতিক্রিয়া উগরিয়েও জনতার আদালতে দিব্যি পার পেয়ে যেতে পারেন। উল্লেখ করে দিই, রাজস্থানের যে ঘটনাটিকে নিয়ে আমাদের নির্লজ্জ শাসক দল অনেক ঢক্কা-নিনাদের প্রচার চালিয়েছে, সেই ঘটনাটি আদ্যন্তরকমে একটি পারিবারিক বিবাদের ঘটনা। তদুপরি, ঘটনার ৩ থেকে ৪ দিনেরই ভিতর রাজস্থান পুলিশ ঘটনার মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করেছে। এর জন্য আগে থাকতে কোনওরকম ছবি বা ভিডিওকে ভাইরাল করে দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। আমাদের সরকার এবং সংবাদমাধ্যম এতখানি নির্লজ্জতায় নিমজ্জিত হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির পরেও যখন সামাজিক মাধ্যমগুলিতে আমাদের মতো কিছু সাধারণ মানুষের ‘গণ-রোষ’ বন্ধ হল না, সেই রাত্তিরেই সরকারি-মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যম মণিপুর পুলিশকে উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রচার করল, মণিপুরের ঘটনায় অভিযুক্তদের একজনকে অন্তত গ্রেফতার করা গিয়েছে। তারা এও উল্লেখ করতে ভুলল না যে, অভিযুক্ত একজন মুসলমান – তার নামও সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হল। কেন্দ্রীয় শাসকদলের নেতা ও সদস্যেরা রে রে করে আবারও গলাবাজি করতে ও সাম্প্রদায়িক উসকানি দিতে নেমে পড়লেন। কিছু সময় পর সেই সংবাদসংস্থার পক্ষ থেকে আগের খবরটি মুছে দেওয়া হল, এবং দুঃখপ্রকাশ করে বলা হল অন্য একটি খবরের সঙ্গে তাঁরা নাকি আগের খবরটিকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। এত জঘন্য একটি ঘটনাকেও সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের প্রচারে ব্যবহার করতে, হৃদয়সম্রাটের দলের সদস্য বা সমর্থকদের সেই বিষয়ে এতটুকুও দ্বিধা বোধ হল না। ৮০ দিন পরে প্রধানমন্ত্রী প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, ৭২ দিন পরে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে, এসবই তো এই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মানসিকতার পাশে নেহাতই তুচ্ছ মনে হয়। একই দিনে আরেক জঘন্য মানুষ ও সাংসদ বৃজভূষণ সিংহকে জামিন দেওয়া হল, কারণ কিনা দিল্লী পুলিশ কৌশলগত ভাবে বৃজভূষণের জামিনের আবেদনের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনওদিকেই মত দিতে রাজি হয়নি। একই দিনে আরেক ধর্ষক ধর্মীয় নেতা গুরমিত রাম রহিমকে জন্মদিন পালনের জন্য ৩০দিনের প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হল। এদেশে নারীর অধিকার বলে কিছু নেই। কোনওদিন ছিল না। এইমুহূর্তে এদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় যে ‘ভগবান’, ‘রামচন্দ্র’ বলে বোধহয় যাকে সম্বোধন করা হয়, তার নামেরও আগে ‘শ্রী’ বসাতে আমি অস্বীকার করি, মনে রাখতে হবে – যুদ্ধ জিতে এসে নিজের স্ত্রীকেও জনসমক্ষে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে তিনিই বাধ্য করেছিলেন। এদেশের পুরুষেরা তো তাকেই আদর্শ মেনেছে। মণিপুর তো সামান্য উদাহরণমাত্র।
পরবর্তী কিছু তথ্যকে সাজাতে, আমার হাত অবশ হয়ে আসছে। একথা সবচেয়ে কষ্টের, সবচেয়ে অস্বস্তির বলে মনে হয় – সেই মেয়েরা এখনও বেঁচে আছে। তাঁদেরকে সাংবাদিকেরা, রাজনীতিকেরা এরপরেও এই বিষয়টিকে নিয়ে প্রশ্নের পরে প্রশ্নে বিদ্ধ করবেন। শোনা যাচ্ছে, এই হিংসা শুরুর প্রথমদিকে, ‘প্রতিপক্ষ’ একজন মেইতেই মহিলাকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, এই বিষয়ক একটি ভুয়ো খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তারই প্রতিক্রিয়াতে শুরু হয় এই চূড়ান্ত জাতিহিংসার ঘটনা। আরও শোনা যাচ্ছে, ভিডিওতে যে দুইজন মহিলাকে দেখা গিয়েছে, মণিপুর পুলিশ নাকি তাদেরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসে, এবং পরবর্তীতে উন্মত্ত জনতার সামনে আক্ষরিক অর্থে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। এই তথ্যগুলিকে হয়তো ভবিষ্যৎ বিচার করবে। কিন্তু সেই দুইজন মহিলাকে, এরপরেও,
এই বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে
এই বিষয়ে জনসমক্ষে, সংবাদমাধ্যমের সম্মুখে, বারংবার, (বারংবার ও বারংবার) ঘটনাটির প্রত্যেকটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণকে উচ্চারণ করতে হবে।
ঘটনাটির প্রত্যেকটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণকে উচ্চারণ করতে হবে
জানি না। সুশীল সমাজ বিষয়টিকে কেমন ভাবে নেবেন। রাজনীতি সত্যিই ভদ্দরলোকেদের জন্য নয়। কারণ তাঁরাই এই নরককে জন্ম দিয়েছেন। তাঁরাই বাবরি ধ্বংসের পরবর্তীতে গুজরাত গণহত্যার নায়ককে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। শহুরে তাঁরাই, এতকিছুর পরেও, সাম্প্রতিকতম কর্ণাটক নির্বাচনে, বেঙ্গালুরু-সহ শহরকেন্দ্রিক এলাকাতে বিজেপির ভোট বাড়িয়েছেন। রামচন্দ্রের আদর্শ ভক্তদল! এদেশে নারীর কোনও দেশ নেই।
আক্রান্ত একজন মহিলার স্বামী ২৮ বছর ভারতীয় সেনাতে চাকরি করেছেন। সংবাদে প্রকাশ। এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরবর্তীতে তিনি সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, কার্গিল, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি এলাকাতে যুদ্ধ করে এসেও, তিনি, নিজের স্ত্রীকে ‘এই লাঞ্ছনা’ থেকে বাঁচাতে অপারগ হয়েছেন। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “১০০র উপরে এমন ঘটনা ঘটেছে! সেই কারণেই ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।”
আজ হিরন্ময় নীরবতা নেমে আসুক! নিনাদিত হোক “জয় শ্রী রাম!”এর উচ্চারণ!
আর যদি সার্বিক বহুত্বের দিক থেকে দেখতে হয়, সিয়ারামের দেশ নারীর দেশ হতে পারে কিনা জানিনা, কিন্তু রামচন্দ্রের দেশ নারীর জন্য নয়। ব্যক্তিগত উপলব্ধি আজ, কেবল এইটুকুই। অলমিতি, নমস্কার।
0 Comments
Post Comment