সান দিয়েগো’র এক মায়ের গল্প (!)

  • 30 August, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 551 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধে দেখেছি, মেয়েদেরকে মায়ের জাত বলে তাঁদেরকে ‘স্নেহ-পরবশ’ একটি ঠুনকো খোলসে মুড়ে রাখার, চমৎকার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা করা হয়। এই সূত্রে মনে পড়ল, মারিয়ার নোবেলপ্রাপ্তির খবরে সান দিয়েগোর একটি সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল, “সান দিয়েগো মাদার উইনস নোবেল প্রাইজ”। বিজ্ঞানীর চেয়েও মাতৃ পরিচয়টাই ছিল সেখানে মুখ্য। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক (পর্ব ২৬)

“ধরলে কথা থামায় কে, আজকে ঠেকায় আমায় কে!” মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ারের ক্ষেত্রে (জন্মঃ জুন, ১৯০৬) সুকুমার রায়ের এই উক্তিটা চলতে পারত। আক্ষরিক অর্থেই তিনি যখন কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের একেবারে মুখটুকুতে পৌঁছিয়ে যেতেন, অথবা জটিল কোনও গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলতেন – তখন সামনে যিনিই থাকুন না কেন, বন্যার মতো সেই সমস্যার সমাধান, আবিষ্কার, তত্ত্ব সবকিছুই সেই মানুষটিকে কার্যত ধরেবেঁধে চরম উৎসাহে বোঝাতে শুরু করতেন এই মারিয়া মেয়ার। সবচেয়ে ভালো করে এই বিষয়টিকে একবার উপলব্ধি করেছিলেন জগদ্বিখ্যাত আরেক বৈজ্ঞানিক এনরিকো ফার্মি স্বয়ং। সেই গল্পে পরে আসছি। আপাতত নোবেলের ইতিহাসে পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় নোবেলজয়ী নারী বৈজ্ঞানিক (প্রথমজন অবশ্যই মারী কুরি) মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ারের ছোটবেলার কথা দিয়ে শুরু করি। বিজ্ঞানের বিষয়ে তাঁর আগ্রহ শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। তাঁর পরিবারের একাধিক পূর্বপুরুষ বিজ্ঞান-বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। কাজেই বাড়ির পরিবেশটা কিছুটা হলেও যে বিজ্ঞান-ঘেঁষা ছিল তা বলাই যায়। এরই মধ্যে অনেক পরে এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে মারিয়া বলেছিলেন, “অবশ্যই আমি বাবার কাছে থাকতেই বেশী পছন্দ করতাম, কারণ তিনি আমার কাছে অধিক আকর্ষণীয় ছিলেন। যতই হোক, তিনি একজন বৈজ্ঞানিক!” বিজ্ঞানের প্রতি এই সহজাত আকর্ষণই একদিন মারিয়াকে নোবেলজয়ী পদার্থবিদ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। অর্ধেক আকাশের তত্ত্বকে ছাপিয়ে তিনি উৎকর্ষের আকাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

সতেরো বছর বয়সে মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ার, তাঁর আরও তিন-চারজন সহপাঠিনীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসেন। একই সঙ্গে, তাঁদের শ্রেণীর আরও প্রায় ত্রিশজন ছাত্রও সেবারের পরীক্ষাতে নাম লিখিয়েছিল। মারিয়া-সহ সবকজন ছাত্রীই পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হলেও, একজনও ছাত্র সেই পরীক্ষাতে পাশ করতে পারেনি। ১৯২৪ সালে মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ার জার্মানীর বিশ্বখ্যাত গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতবিদ্যার ছাত্রী হিসেবে নিজের নাম নথিভুক্ত করেন। কিন্তু ক্রমশ পদার্থবিদ্যার দিকেই তাঁর আকর্ষণ বাড়তে থাকে। ১৯৩০ সালে তিনি পরমাণুর কেন্দ্রে ফোটন-কণার গতিবিধির উপরে তাঁর ডক্টরাল থিসিস জমা করেন। যদিও সেই সময় তাঁর প্রস্তাবিত তত্ত্বের পরীক্ষামূলক কোনও পর্যবেক্ষণ সম্ভব ছিল না। তবু, তিন-তিনজন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ (যথাক্রমে, ম্যাক্স বর্ন, জেমস ফ্র্যাঙ্ক এবং রাইনহোল্ড ওয়াইনডস) মারিয়ার থিসিসটিকে সাদরে গ্রহণ করেন। একই বছরে মারিয়ার বিবাহ হয় মার্কিন নাগরিক জোসেফ এডওয়ার্ড মেয়ারের সঙ্গে। বিবাহান্তে দুজনে আমেরিকাতে পাড়ি জমান।

জোসেফ এডওয়ার্ড মেয়ার আমেরিকার বিখ্যাত জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোরতম মনোভাব থাকায় মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ার সেখানে অধ্যাপনার সুযোগ পাননি। যদিও নিন্দুকেরা একেকজন বলেন কিছুটা সেই সময়ে মেয়েদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিদ্বেষ থাকায় যাতে অধ্যাপক-গৃহিণীরা কোনও ভাবে বিশ্ববিদ্যার অঙ্গনে ঢুকে পড়তে না পারেন সেই কারণেই ‘স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে এই কঠোরতম মনোভাব’ দেখানোর প্রয়োজন হত। সেই বিতর্কে যাব না, কারণ মারিয়ার মতো কাউকে এমন একেকটি সাময়িক প্রতিবন্ধকতা কোনও সময়েই দমিয়ে রাখতে পারে না, রাখতে পারেওনি। তাঁকে জন হপকিন্সের ল্যাবরেটরিটুকু ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তাই, পারিপার্শ্বিক হাজারো প্রতিবন্ধকতাকে মেনে নিয়েও মারিয়ার গবেষণা থেমে থাকেনি। প্রথম প্রভাবটা পড়ল ১৯৩৩এ এসে।

জার্মানীতে, ১৯৩৩ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। ওই বছরই কুখ্যাত নাৎসি পার্টি প্রথমবারের জন্য জার্মানীর ক্ষমতা দখল করে। এই সময় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক মহল থেকেও অজস্র প্রতিভাবান মানুষ আত্মরক্ষার তাগিদে শরণার্থী হিসেবে মার্কিনভূমে এসে হাজির হন। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্ল হার্জফিল্ডের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মারিয়া মেয়ার এই সমস্ত শরণাগত বিদ্বজনেদের পুনর্বাসনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৯৩৭ সালে কিছুটা মারিয়ার খ্যাতির প্রতি বিদ্বেষ এবং সেই বিষয়ে মারিয়ার প্রতি স্বামী জোসেফের উৎসাহের জন্য তাঁদের কাজেকর্মে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা ভাবে বাধার সৃষ্টি করতে থাকে, এবং সবশেষে জোসেফ কর্মচ্যুত হন। যদিও কেউ কেউ বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান অধ্যাপকদের সংখ্যা কমানোর জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, আবার কেউ কেউ বলে থাকেন – ছাত্রদের একাংশ নাকি মারিয়ার বিরুদ্ধে পড়ানোর বিষয়ে কিছু কিছু অভিযোগ এনেছিল। মোট কথা কোনও কিছুই জোসেফ অথবা মারিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমনতরো কড়া পদক্ষেপকে সেভাবে মান্যতা দিতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে জোসেফ ও মারিয়া কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এখানেই মারিয়ার সঙ্গে হ্যারল্ড উরে এবং জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক এনরিকো ফার্মির পরিচয় হয়।

এনরিকো এবং মারিয়াতে মিলে পরমাণু কেন্দ্রবিন্দুতে যে নিউক্লিয়াস এবং তাকে ঘিরে যে কক্ষপথে অশান্ত ইলেকট্রনগুলি ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়ে চলেছে সেই বিষয়ে বেশ কিছু নতুন তথ্য আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারই মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ারকে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এর কিছুকাল পরে তাঁর কাছে ম্যানহাটান প্রজেক্টের সঙ্গে গবেষক হিসেবে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব আসে। এর আগে লিজা মেইৎনার সেই প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মারিয়া সেই প্রস্তাবকে ফেরাতে পারেননি। এই ম্যানহাটান প্রজেক্টে গবেষণার সূত্রেই সহযোগী বন্ধু এডওয়ার্ড টেলারের সঙ্গে যৌথ গবেষণার মাধ্যমে তাঁরা ‘টেলার্স ‘সুপার’ বম্ব’এর নকশা প্রস্তুত করেন। ভাবীকালের ‘থার্মোনিউক্লিয়ার’ সমস্ত যুদ্ধাস্ত্রের প্রয়োজনে এই ‘টেলার্স ‘সুপার’ বম্ব’এর নকশাই সব চাইতে বেশী করে বিজ্ঞানের কাজে লাগবে। ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম ‘টেলার্স ‘সুপার’ বম্ব’টিকে পরীক্ষামূলক ভাবে বিস্ফোরিত করা হয়। সেই বিস্ফোরণ থেকে উৎপাদিত শক্তির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০.৪ মেগাটনের কাছাকাছি।

আমরা হয়তো আবার নতুন করে সেদিন শুনতে পেয়েছিলেম, “নাও আই বিকাম ডেথ – দ্য ডেস্ট্রয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস” ... সে যা হোক,

ইতিমধ্যে এই সমস্ত গবেষণার পাশাপাশি এনরিকো ফার্মি এবং মারিয়াতে মিলে পরমাণুর ভরকেন্দ্র বা উক্লিয়াসের বিষয়ে আরও কিছু তাত্ত্বিক গবেষণার কাজ শুরু করেন। মারিয়া তাঁর গবেষণার মাধ্যমে দেখান, ঠিক কোন কারণবশত একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে বিশেষ সংখ্যার কয়েকটি মাত্র নিউক্লিয়ন কণাই কেবল সুস্থিত ভাবে অবস্থান করতে পারে। এই নিয়ে একদিন আলোচনা চলতে চলতে অধ্যাপক ফার্মির কাছে একটি জরুরি লং ডিসট্যান্স টেলিফোন কল আসে। টেলিফোনে কথা সেরে ফার্মির আবার ল্যাবরেটরিতে ফিরে আসতে মাঝে মিনিট দশেক মতো সময় লেগেছিল। ইতিমধ্যে সমস্যাটি সমাধানের বিষয়ে মারিয়া একটি দিশা দেখতে পেয়েছিলেন। ফার্মি ল্যাবরেটরিতে ঢোকামাত্রই কার্যত উত্তেজিত বাক্যস্রোতের বন্যাতে মারিয়া তাঁকে এতটাই ‘ধরাশায়ী’ করে ফেলেন, অধ্যাপক ফার্মি কোনও মতে তার প্রত্যুত্তরে বলেন – “আজকের মতো এইটুকুই থাক মারিয়া। কাল আমরা বরং শান্ত হয়ে আরেকবার বিষয়টাকে ভেবে দেখব ?”

একবার কোনও সমস্যা সমাধানের উপায়কে খুঁজে পেলে আর মারিয়াকে থামায় কে! পরমাণুর ভরকেন্দ্রের বিষয়ে এই গবেষণার জন্যই ১৯৬৩ সালে মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ার পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। মারী কুরির পর তিনিই দ্বিতীয় মহিলা যিনি কিনা এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির পর আরও প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশী সময় অতিবাহিত হয়। অবশেষে ২০১৮ সালে ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড তৃতীয় মহিলা বৈজ্ঞানিক হিসেবে পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। নোবেল দিয়ে প্রতিভার পরিমাপ চলে না। তবু একেকজন মহীয়সীর শেষ অবধি বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতিপ্রাপ্তির বিষয়টিও তো উল্লেখযোগ্য।

সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধে দেখেছি, মেয়েদেরকে মায়ের জাত বলে তাঁদেরকে ‘স্নেহ-পরবশ’ একটি ঠুনকো খোলসে মুড়ে রাখার, চমৎকার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা করা হয়। এই সূত্রে মনে পড়ল, মারিয়ার নোবেলপ্রাপ্তির খবরে সান দিয়েগোর একটি সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল, “সান দিয়েগো মাদার উইনস নোবেল প্রাইজ”। বিজ্ঞানীর চেয়েও মাতৃ পরিচয়টাই সেখানে মুখ্য। অন্তত, পুরষ্কারের বিষয় অথবা নিজের নামোল্লেখটুকুও কি সেদিন মারিয়ার প্রাপ্য ছিল না ? তবু মাথার উপরে অনেক কাচের দেওয়ালকে ক্রমশ ভাঙতে ভাঙতে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়েগো শহরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে পরমাণু ভরকেন্দ্রের একটি বিশেষ রাশির পরিমাপের একককে গ্যোপার্ট মেয়ার ইউনিট বা জি এম ইউনিট নাম দেওয়া হয়েছে। শুক্র গ্রহের একটি উল্কাগহ্বরকেও মারিয়ার নামে সম্প্রতি নামাঙ্কিত করা হয়েছে। পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে মারিয়ার অবদান মহাকাশের সেই উল্কাগহ্বরটির মতোই চিরস্থায়ী হয়ে থেকে যাবে, আর থেকে যাবে এমন প্রত্যেকজন মহীয়সীর অস্তিত্ব – যাঁরা কাচের দেওয়ালকে ভাঙবার সাহস দেখিয়েছিলেন।

সূত্রঃ

[১] জোসেফ ফেরি, ‘মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ার’, ফিলাডেলফিয়াঃ চেলসি হাউজ পাবলিশার্স, ২০০৩

[২] রবার্ট স্যাচস, ‘মারিয়া গ্যোপার্ট মেয়ার ১৯০৬-১৯৭২ - এ বায়োগ্রাফিক্যাল মেমোয়্যার’, বায়োগ্রাফিক্যাল মেমোয়্যার্স, ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়ান্সেস, ১৯৭৯

[৩] লন্ডা স্কিবিঙ্গার, ‘হ্যাজ ফেমিনিজম চেঞ্জড সায়ান্স ?’, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৯

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ছবি: সংগৃহীত  

0 Comments

Post Comment