- 07 November, 2021
- 0 Comment(s)
- 767 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
এসে গেছে বিয়ের মরসুম, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে; যেদিকে যায় সেদিকে দেখি সমারোহে চলছে বিয়ের আয়োজন! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গিয়ে দেখি, কী শাড়ি কিনবেন, কী গহনা পরবেন, কী করে ঝা চকচকে সাজে সেজে উঠবেন এইসব পসরা সাজিয়ে পিছু ধাওয়া করছেন প্রভাবকরা। এদের দু-চোখ ভরে দেখে, আহারে, আহারে কোথায় পাবো তাহারে গাইতে গাইতে চোখ আটকে যায় অদ্ভুত এক খবরে, বিয়ের আমন্ত্রণ পত্র নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড! কন্যাকে ‘দানসামগ্রী’র সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই অপমানজনক রীতির বিপক্ষে গিয়ে, এক কন্যার বিয়ের কার্ডে ইংরাজিতে লেখা হয়েছে-'Kanya is not an object to given as daan' এবং বাংলায় লেখা হয়েছে-'কন্যা দান নয়, রক্ত দান।' অতঃপর যুদ্ধ শুরু হয়েছে। হিন্দুত্বের অপমান হয়েছে তাই কনের বাবার কাছে হুমকি ফোন আসছে। বলাই বাহুল্য বিয়ে নিয়ে হাজার ঝামেলা শুরু হয়েছে।
কন্যাদান বিয়ের একটি আচার। বাবা নিজের কন্যাকে জামাইকে দান করেন। কন্যাদান রীতি নিয়ে অনেক গল্প রয়েছে। কন্যাদানের অর্থ 'কুমারী দান'। নিজেদের যাবতীয় পাপস্খলনের জন্য বাবা-মা কুমারী দান করেন। অনেকেই মনে করেন- আসলে মেয়ের দায়ভার ঝেড়ে ফেলতেই আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এই কন্যাদানের রীতির প্রচলন করেছেন। এইসময় মান্ধাতার আমলের রীতি বন্ধ করার জন্য অনেক যুক্তিবাদীরা সরব হয়েছেন। নারীবাদীরা কন্যাদান নিয়ে আরও একটি মোক্ষম প্রশ্ন তুলেছেন, বাবার অবর্তমানে অন্য কোনও পুরুষ আত্মীয় কন্যাদান করবেন, অথচ মা করতে পারবেন না এ কেমন কথা!
ফেব্রুয়ারি মাসে আরেকটি বিয়ের ঘটনা নিয়েও খুব শোরগোল হয়েছিল। অম্লান রায় মেয়ের বিয়েতে কন্যাদান, কনকাঞ্জলির মতো রীতির বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। নন্দিনী ভৌমিকের তত্ত্বাবধানে, তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘মেয়ে কি আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি যে তাঁকে দান করা যায়?’’ এরপর কন্যাদান রীতিকে অস্বীকার করার পিছনে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও নিজের যুক্তি সাজিয়েছেন তিনি। মনু-বেদ থেকে উদাহরণ টেনে তিনি বলছেন, ‘‘বেদে বিভিন্ন রকমের বিয়ের উল্লেখ রয়েছে। এরমধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহ ছাড়া প্রজাপতি বা গান্ধর্ব্য বিবাহের মতো অন্য পদ্ধতিতে কন্যাদানের কথা উল্লেখ নেই। আমার মেয়ে নিজে পাত্র পছন্দ করে বিয়ে করেছে। তাই বেদের কথা ধরলেও এটি ব্রাহ্ম বিবাহ নয়।’’ (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা,৬/২/২০২১)
প্রসঙ্গত, নন্দিনী ভৌমিকের ‘শুভমস্তু’- বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় মন্ত্রচারণ ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে বিয়ে দিয়ে থাকেন। এই বিয়েতে কন্যাদান থাকে না। নন্দিনীরা বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে চান। এই প্রসঙ্গে নন্দিনী বলেছেন, ‘‘যে সকল রীতি বর বা কনেকে হেয় করে, সে রকম কোনও রীতিই আমাদের বিয়েতে থাকে না। (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা,৬/২/২০২১)
সেপ্টেম্বর মাসে, পোশাক কোম্পানি মান্যবরের লেহেঙ্গার বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে 'কন্যাদান'-এর জল অনেকদূর গড়িয়েছে। হিন্দু সংস্কৃতি ও রীতিনীতির গোঁড়া চিন্তাভাবনার পরিবর্তন আনতে, ব্যতিক্রমী বিজ্ঞাপন বানিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে এই সংস্থা। বিজ্ঞাপনে প্রধান মুখ ছিলেন আলিয়া ভাট। তাঁকেও সামাজিক মাধ্যমে হেনস্থা করা হয়। হিন্দু ধর্মকে আঘাত করার অভিযোগ তোলা হয়েছে আলিয়া এবং মান্যবরের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মকে অবমাননা করা হচ্ছে বলে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিও দেওয়া হয়েছে কন্যাদানের পক্ষে। টুইটারে অনেকেই তাঁদের ধর্মকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে জানিয়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন। সেই বিজ্ঞাপনের আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- মিড শটে দর্শকের সঙ্গে কথা বলছেন আলিয়া, আবার বিজ্ঞাপনের চরিত্রগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছেন ব্যকগাউন্ডের ফোকাস অফ ফোকাসের মধ্যে দিয়ে। বিজ্ঞাপনের শুরু হয়েছে এই সংলাপ দিয়ে- “ছোটবেলা থেকে দাদি বলেন, যখন তুই নিজের ঘরে চলে যাবি, তখন তোর কথা খুব মনে পড়বে!” এরপরে আলিয়া সরাসরি দর্শকদের প্রশ্ন করেন- “এই ঘর আমার নয়?” প্রাচীনকাল থেকে এই প্রশ্ন চলে আসছে, আসলে নারীদের বাড়ি কোথায়? এই প্রসঙ্গে নকুল কুমার বিশ্বাসের বিখ্যাত গানের কথা মনে পড়ে যায়-
“বাবার বাড়ি এই গেরাম শ্বশুর বাড়ি ওই
তবে তোমার বাড়ি কইগো নারী
তোমার বাড়ি কই?”
এরপরে বিজ্ঞাপনে আবির্ভাব হয় বাবা চরিত্রের। মেয়ের পাশে এসে খোশমেজাজে সেলফি তুলছেন। মেয়েকে স্বাধীন ভাবে তিনি বড় হতে দিয়েছেন। কোন বিধি নিষেধ মেয়ের উপর চাপিয়ে দেননি। এরপরে আবার দর্শকদের উদ্দেশ্যে মেয়ে বলেন- “বাবাকে সকলে বলতেন মেয়ে পরের ধন, এত আশকারা দিয়ো না, কিন্তু উনি কারো কথা শোনেন নি! ক্যামেরা এরপর মায়ের উপর ফোকাস করা হয়। তারপরে সংলাপে বলা হয়- “ আমাকে মা পাখি বলে ডাকেন। তিনি বলেন, এখন তোর দানাপানি অন্য কোথাও! কিন্তু পাখির জন্য তো পুরো আকাশ রয়েছে তাই না! তাহলে আমি কী দানের জিনিস? কেন এই কন্যাদান? ” এরপরে বিজ্ঞাপনে ‘কন্যাদানে’র পরিবর্তে ‘কন্যামান’ নামের নতুন একটি রীতি শুরু করার কথা বলা হয়েছে। আলোচ্য বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে ‘কন্যাদান’ প্রথা ছাড়াও যে বিষয়গুলি উঠে এসেছে সেগুলি হল- ক) মেয়েদের নিজের কোন বাসস্থান নেই
খ) মেয়েরা পরের সম্পদ
গ) মেয়েদের স্বাধীনতা না দেওয়া
ঘ) মেয়েদের ভাতকাপড়ের ভাবনা অন্যের
প্রশ্ন উঠেছিল, হঠাৎ মান্যবর এরকম বিজ্ঞাপন কেন করলেন? মান্যবর সংস্থা জানিয়েছে- “এরফলে পুরনো সংস্কৃতিকে দূরে সরিয়ে রেখে নতুন কিছু ভাবনা এনে সমাজ বদলানো যাবে। সংস্থার বিজ্ঞাপন অনুযায়ী, নতুন এই তৈরি হওয়া কন্যামান প্রথা বিয়েকে একটি নতুন চিন্তা ভাবনার দিকে নিয়ে যাবে আর দানের বদলে কন্যার সম্মান করার বিচারধারা ফুটে উঠবে।” (তথ্যসূত্র-indiarag.in, ২০/০৯/২০২১) স্বাভাবিক ভাবে আমাদের পিতারা এই বিজ্ঞাপন মেনে নিতে পারেননি। ফলে এই বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
আমাদের আলোচনা শুরু হয়েছিল সাম্প্রতিক এক ঘটনাকে ঘিরে। আবার ফিরে আসি সেই প্রসঙ্গে। আজকাল সমাজের এত বেশি মাথাব্যথা! নেট মাধ্যমে এতো জ্যেঠুদের আধিপত্য, ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। যাইহোক, আনন্দবাজার অনলাইন সমাজের মানুষদের চিন্তা দেখে খোঁজখবর নিয়েছেন। সমাজতাত্ত্বিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সমাজতাত্ত্বিক প্রশান্ত রায় জানিয়েছেন- “ হিন্দু ধর্ম তো আগেও ছিল। কিন্তু তা ঘিরে এ ধরনের কাণ্ড তেমন শোনা যেত না। এখন ধর্ম এবং রাজনীতি যেন কিছুটা গুলিয়ে যাচ্ছে। মানুষের না পাওয়া বেড়ে গিয়েছে। তাই অন্যের জীবন নিয়ে এমন সব মন্তব্যও বাড়ছে। অন্যের চলাফেরায় ত্রুটি খুঁজেই নিজের অপ্রাপ্তির জ্বালা মেটাতে চান অনেকে।’’
আবার, সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘বিয়ে একটি সামাজিক আয়োজন। এতে ধর্মের বিশেষ জায়গা নেই। তাই কেউ নিজের মতো করে বিয়ে করা মানেই যে তা কোনও ধর্মকে অবমাননা করা নয়, সে কথা বুঝতে হবে।" (তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার অনলাইন, ৪/১১/২০২১)
উপরিক্ত দুটো মন্তব্য দেখে আমরা কী বুঝলাম? প্রথমত, ধর্ম ও রাজনীতির পাচন আমরা অহর্নিশি গিলছি, সোনার হরিণের পিছনে দিবারাত্রি আমরা ছুটে বেড়াচ্ছি, সোনার হরিণ না পেয়ে অন্যদের যে কোন কাজ দেখে মনে জ্বালা ধরে, আর সেই জ্বালা ধরান ফোসকায় প্রলেপের কাজ করে গালিগালাজ মূলক মন্তব্য।
দ্বিতীয়ত, নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়া মানে ধর্মকে মান্যতা না দিয়ে, অপরাধ করছে এমনটি নয়।
এবার আসা যাক আসল প্রশ্নে, ঝুলি থেকে বের করি সেই সযত্নে লালিত প্রশ্নটিকে? এতক্ষণ যাঁদের হয়ে অরণ্যে রোদন করলাম, হ্যাঁ, তাঁদের কাছে জানতে চাইছি , আপনারা এবার অপমানের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন তো? প্রতিবাদ করবেন? নাকি চুলোয় যাক ছাতার মাথার প্রতিবাদ, আমরা বরং এইবেলা দেখি তো সব্যসাচী, মনিশ মালহোত্রার ফাস্ট কপি কালেকশন আসলো কি না, অনুস্কা, দীপিকার মতো সাজুগুজু করে রিসেপশন জমানো যায় কি না, ক্যাটরিনা কাইফের মতো বিয়ের ভেন্যু পাওয়া যায় কি না, ফ্লোরাল হেয়ার ডু ইন কি না ভাবতে ভাবতে, নিজের গালে নিজে থাপ্পড় মেরে, ‘দিন সাগনা দা’ গানের তালে তালে ছাদনাতলার দিকে হাঁটা লাগাবেন!
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
ছবি : গৃহীত
0 Comments
Post Comment