- 12 November, 2021
- 0 Comment(s)
- 643 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
দাদুর বিয়ে।
অনন্তের আজ কলেজে যাওয়া হচ্ছে না। চোখে-মুখে ভয়ানক বিরক্তি আর হতাশা নিয়ে ভাবছে-সাজানো গোছানো দিনটা এভাবে আউলা করে ছেড়াভেড়া করে দিল শালার বুড়ো! অথচ এই দিনটায় কলেজে যেতেই হতো। প্রথম বর্ষের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস হবে। ফ্রেশ কিছু মেয়ে একসঙ্গে দেখে নেবার দুর্লভ সুযোগ। পরে তো ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাবে।
দাদু, তোর বিয়ে করার এত খায়েশ আজকের দিনেই কেনো? দু’একদিন আগেপিছু হলে কি লগ্ন নষ্ট হয়ে যেত? দাদিটা মরল আর বছর ঘুরতে দিল না শালার বুড়ো! বিয়ের হুব জাগছে।
আজহার উদ্দিনের বড়-ছোট দুই ছেলেই স্কুল টিচার। মেজোটা জমিজিরাত দেখভালে আছে। ছেলেদের মধ্যে বড় ছেলে শরফুদ্দিনই বাপের ব্যথায় ব্যথিত। বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগে গেল। বাকি দুই ছেলে তিন মেয়ে মিলে ঐক্যজোট। ওরা বিয়ের ঘোর বিরোধী। ছোট ছেলে ঘাড়তেড়া ও একট্টা স্বভাবের, ত্যাজি ষাঁড়ের মতো একরোখা। মেজোটার অবস্থান হ্যাঁ-নার নোম্যান্সল্যান্ডে। মেয়ে তিনজন পালাক্রমে সপ্তাহে একদিন করে এসে বাবার সামনে বসে কেঁদে যায়। আজহার উদ্দিন ওপেনহার্ট মেজাজে আছে। অপজিশনের স্ট্রাইককে বানচাল করে সঠিক পথেই এগুচ্ছে বড় ছেলে। এই অসময়ের বিয়ের যৌক্তিকতা প্রমাণ ও সমর্থন আদায়ে শরফুদ্দিনের দক্ষ ডিপ্লোমেসির তারিফ করে মনে মনে ছেলের জন্য বাড়তি কিছু ভেবে রাখে। মেয়েরা বাপের হাতেপায়ে ধরে নিবৃত করার চেষ্টা করলে চতুর হাসি দিয়ে আজহার উদ্দিন বলে, কাঁদিস নারে মা, তোর মার লাগি বুকটা ফাইট্টা যায়! এক পা কবরে গেছে। এই কাম কী অহন ভাল্লাগে? শ্বাসের টান বাড়ে, চামড়া কুঁচকানো গালের মাংসগুলো আতঙ্কে কাঁপে, উপচেপড়া চোখের অশ্রু কাঁপা কাঁপা হাতে মুছতে মুছতে আজহার উদ্দিন বলে, মনুরা কইতো-শরফুদ্দিন, পুতে আমার পাগল কিছিমের। হের মনে যেনো আপনে আঘাত দিয়েইন না। আল্লার আরশ কাঁপবো। আমি মইরাও গোরে শান্তি পামু না। নগদ তৈরি করা একটা ডাহা মিথ্যা কথার দাওয়াই দিয়ে মেয়েদের মুখবন্ধ করে দিল আজহার উদ্দিন। এ সাফল্যের আনন্দে গলা ছেড়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মুখের গাম্ভীর্যকে এই মুহূর্তে ধরে রাখাই প্রধান কর্তব্য। মাথার সাদা চুলে কাশবনের ঢেউ খেলে যায়। বয়সে চামড়া কুঁচকানো, চোখের নিচে চর্বির থলি, গালের মংস থলথল করলেও আজহার উদ্দিনের ছিপছিপে একহারা শরীরকে সুঠাম সক্ষম পুরুষের শরীর বলেই চালানো যায়। শ্বাসের টান ছাড়া শরীরে বড়ো কোন রোগবালাই নেই। তবে ভেতরে বহমান মাতাল সমীরণ, চনমনে ভাবটা বাইরে ঢেকে রাখতে হয়। বউ মরেছে। ছেলে, ছেলের বউরা, নাতিরা কী ভাবে শেষে!
শরফুদ্দিনের একট্টা একগুয়ে জেদ তো আছেই। অন্যদিকে তার শাণিত যুক্তিটাও ফেলে দিতে পারছে না বা অস্বীকার করতে পারছে না বিরোধী জোট। আর দুইদিন বাদে বিছানাগত হলে কে দেখবে বাবাকে? সংসারে কার এত সময়? এত দায়ই বা কার আছে? আমি নিজে তো পারব না, সোজাকথা বলে শরফুদ্দিন। কে পারবে? জনে জনে জিজ্ঞেস করে।
কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েরা জোট ভেঙে শরফুদ্দিনের দলে যোগ দিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য আজহার উদ্দিনকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না।
কিন্তু কোন যুক্তিই টিকছে না ছোট ছেলের জেদের কাছে। ছাগলের দড়ি টেনে ধরার মতো বিয়ের রশি টেনে ধরে আছে। অবশেষে বিয়ের দিন সকালে ভয়ানক বিস্ফোরিত রূপ নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়াল ছোট ছেলে। আজহার উদ্দিন তখন খেতে মই দেবার মতো করে দাড়িতে চিরুনি চালাচ্ছিল।
নো, ইম্পুসিবল! এই বিয়া কিছুতেই সম্ভব না। বুইড়াকালে ইতরামি, অ্যা! কচি ছেঁড়ি সাদি করে, অ্যা! শয়তানি ঢুকছে মনে! শয়তানি ছুটাবো। রাতেই ঘরে আগুন দেব। নতুন বউ লইয়া...
ছেলের তোপের মুখে আজহার উদ্দিন অ্যা অ্যা করে। শব্দ আর বেরোয় না মুখ থেকে। মেয়েদের যে যুক্তি দিয়েছে, ছেলের কাছে টিকবে না। বি এ পাস ছেলে। স্কুলমাস্টার। এসব ফাউল কথা না বলে নতুন যুক্তি হাতড়ায়। আজহার উদ্দিনের শিরা-উপশিরায় রক্তের টানটান উত্তেজনা। ব্যথায় টাটাচ্ছে ক্রোধী চোখজোড়া। দাঁত খিচাচ্ছে বেদম। কিন্তু এখন চলছে ফান্দে পড়া বগার মতো ননস্টপ ছটফটানি। উদ্ধারের কী উপায়? আজহার উদ্দিন আর কতক্ষণ বোবাপ্রাণির মতো অ্যা অ্যা করবে! ছেলেও খুঁটির মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। নড়ার নাম নেই। এতদিনের ক্ষোভ এত বড়ো অগ্নুৎপাত ঘটাবে, আজহার উদ্দিনের ধারণারও বাইরে ছিল।
কী? সাদি তুমি করবা-ই? অ্যা! বুনো মহিষের মতো গর্জন করে ওঠে ছোট ছেলে।
বাঘের মুখের শিকারির মতো তিরতির করে কাঁপছে আজহার উদ্দিন। এ সময় কোথা থেকে যেন উল্কার মতো ছুটে এলো শরফুদ্দিন। ক্রদ্ধ ছেলের হাত থেকে আপাত মুক্তি পেয়ে লম্বা একটি শ্বাস ফেলে আজহার উদ্দিন; কপালের ঘাম মুছে আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে, আল্লাহ বাঁচাইছো! পোলাডা আর কিছুক্ষণ জেরা করলে বিয়ের বারোটা বাজতো।
বিয়ের পাত্রী সিংড়ার কলমগ্রামের মেয়ে। দোচালা একটি টিনের ঘর সামান্য একটু উঁচু জায়গায়। চতুর্দিকে থইথই পানিবেষ্টিত এই বাড়ির অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে আছে পানিই। জিভ বের করে দিলেই গিলে ফেলতে পারবে এই রকম নাগালে। ধূ ধূ বালুচরের উপরে যেন দোচালা টিনের ঘর। শরফুদ্দিন কথা বলে জেনেছে, দশ বছর ধরে এভাবেই আছে। একমাত্র সক্ষম পিতা, তাঁর বিবাহযোগ্য তিনকন্যাকে নিয়ে বসবাস। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতোই যেন নির্জনতম কোন জনবসতি আবিষ্কার করেছে আজহার উদ্দিন। বাবার ক্যারিশিমা দেখে শরফুদ্দিনের ভীষণ গর্ব হয়। বিশেষ করে, যে মেয়েকে ‘মা’-এর পদমর্যাদা দিয়ে বাড়িতে নিতে যাচ্ছে, সে প্রায় শেকড়হীন। ভাসমান। যে সামান্য ভয় ছিল তাও দূর হয়।
পাত্রী সামনে এসে বসতেই শরফুদ্দিনের সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে নড়ে ওঠে একবার। সাথে নড়ে ওঠে জলে ভাসমান দোচালা টিনের ঘরটিও। টলমলিয়ে ওঠে চলনবিলের পানি। শরফুদ্দিনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পানির উপরে ভাসমান বড় একটি পদ্মপাতায় এক জোড়া বাড়ন্ত তরুণ ও তরুণী খলবল করে হাসছে আর এ ওর শরীরের উপরে ঢলে পড়ছে। ছেলেটির হাসি খুব চেনা। মেয়েটির খোঁপায় পদ্মফুল, চোখজোড়া ফড়িঙের মতো চঞ্চল চোখ। পানির ঢেউয়ে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে মেয়েটা!
মেয়ের বাপকে হাত ইশারায় ডেকে কিছুটা আড়ালে গেল শরফুদ্দিন; আব্বার সাথে আপনার পরিচয় কী করে?
মোজাম ঘটকের মাধ্যমে।
বাড়ি কোথায় মোজাম ঘটকের?
ঐ গ্রামে। প্রায় মাইল দূরের এক জনবসতিকে দেখিয়ে দিল।
প্রশ্নে প্রশ্নে সব তথ্য জানল শরফুদ্দিন। বাবার উপরে চড়া ক্ষোভ গলে পানি হয়ে গেল। বরং বাবার মহত্ত্বই দেখতে পায়। চোখ ভরে গেল জলে। বড় মহৎ হৃদয়ের মানুষ না হলে এ বয়সে এ কাজ অসম্ভব। এমন বাবার সন্তান ভেবে শরফুদ্দিন গর্ব হয়। তিন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার এক কন্যাকে বিয়ে করে অসহায় পিতার অসহায় দুই কন্যার বিয়ের দায়িত্ব কাঁধে নিচ্ছে আজহার উদ্দিন। এক কন্যার বলির বিনিময়ে বাকি দুই কন্যাকে সুপাত্রে দেবার স্বপ্ন দেখছে পিতা।
বর-বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল। কবরস্থানের মতো নিষ্প্রাণ নির্জন বাড়ির কোনও প্রাণীই এগিয়ে এলো না বর-বউকে বরণ করতে। কেউ মেয়েটাকে একবারের জন্য দেখতে আসল না, ধান দুর্বা দিল না। শরফুদ্দিনও পর্দার আড়ালে গা ঢাকা দিল। আজহার উদ্দিন এই অবহেলা মেনে নেবে কী করে? সংসারটা যে আঙুলে শেপ দিয়ে দিয়ে নিজেই এত বড়ো করেছে। তার বাড়ি তার কাছে এখন কবরখানার মতো লাগে। তারই রক্তফল এখন তার সুখের প্রতিপক্ষ। রাত গভীর হবার সাথে সাথে আজহার উদ্দিনের ভেতরে তীব্র প্রতিহিংসা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। রোষে ফেটে পড়ে। চিৎকার করে লোক জড়ো করতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে, এই বাড়ি এই সহায় সম্পত্তির মালিক এখনও আমি। আমি আজহার উদ্দিন। নিজের বাড়িতে এনে প্রয়োজনে নটি নাচাবে, তাতে কার বুকে সাহস আছে যে সামনে দাঁড়ায়? বাঁধা দেয়? নীরবে সব সহ্য করছে বলে আর নীরব থাকবে না। এখন একজন অন্তত সংসারে তার পক্ষে থাকবে।
বিষয়টা মাথায় নেয়নি শরফুদ্দিনের বড় ছেলে অনন্ত। সে কারো পক্ষও নেয়নি। না বাবা-দাদুর, না চাচার। ফলে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল সন্ধ্যারাতে। ক্রুদ্ধ ষাঁড়ের মতো দাদুর গোঙানির শব্দে কানে ঢুকলে দুপুর রাতের তন্বিষ্ট ঘুম ভেঙে গেল । চরম বিরক্ত নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে বাধ্য হল অনন্ত।
বাড়ির জ্যান্ত মানুষগুলো যেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মুখ আঁছড়ে পড়ে আছে বধ্যভূমিতে। অথচ সবাই জেগে আছে। আজহার উদ্দিন জানে, অনন্ত জানে, যারা জেগে আছে তারাই সবচেয়ে বেশি জানে। অনন্ত ভাবে, ছোট চাচার নাম ধরে যেভাবে লাগামহীন গালিগালাজ আর খুনের হুমকি ছাড়ছে, সত্যিই যদি এই রাতেই দাদুর মাথা বিগড়ে যায় আর সকালে ওঠে নতুন বউয়ের নামে বাড়ি-ঘর-সম্পত্তি সব লিখে দেয়, আল্লা মালুম খুনখারাপি না ঘটে! এ নাটকের শেষ নাই! অনন্ত আর দাদুর ঘরের মধ্যে কেবল একটি নারিকেল গাছের দূরত্ব। দাদুর ভেতরের সব উত্তাপ এসে প্রথমেই হিট করে অনন্তের মগজে।
সাতপাঁচ ভেবে দরজা খুলে বেরোয় অনন্ত। খালি পায়ে হেঁটে দাদুর দরজার সামনে এসে কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে রইল।
দাদু, দরজা খুলো। চাপাকণ্ঠে ডাকে অনন্ত।
লুঙিতে গিঁট দিতে দিতে দরজা খোলে আজহার উদ্দিন। গাঁজাখোরের মতো লাল টকটকে চোখ, তিরতির করে কাঁপছে শরীরের চামড়া।
দাদুর চোখের দিকে তাকিয়ে অনন্তের মনে ভয় ঢুকে গেল। পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মুখে হা করে হাই ছাড়তে ছাড়তে বলে, দাদু, দাদি কী মনে করবো বলো তো? বাসর রাতে তুমি এসব খুনখারাবির কথা বলছো?
আজহার উদ্দিন কী মনে করে বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল হঠাৎ।
অনন্ত চাতুর্যের চোখে তাকায় দাদুর দিকে। নাকি বাসর রাতেই বিড়াল মারছো?
উঠতি বয়সের নাতির ছক্কামারা রসিকতার জবাবে আজহার উদ্দিন দারুণ বেসামাল। ভেতরে একপ্রকার ভয়ের দমকা হাওয়া ঝড়ের মতো বইছে। নেশার ঝোঁকে ভুল কিছু ঘটে গেল? গরিবের মেয়ে, কিন্তু শরীর তো গরিব ধনী চিনে না। খেলুড়ে হিসেবে আজহার উদ্দিনের পূর্বের রেকর্ড ভেতরে শক্তি জুগিয়েছে এ কাজে। মনুরার চোখের-নাকের জলে বালিশ ভিজে জবজবে হয়ে পড়ত। দিনে রোদে শুকাতে দিত সেই বালিশ। বিয়ের আগে নিজেকে নানা এঙ্গেলেই পরীক্ষা করে প্রস্তুত করে নিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য, একরত্তি মেয়ে পানতা খাওয়ার মতো সহজেই আজহার উদ্দিনকে গ্রাস করে নিল এক লুকমাতে। কাঁদবে তো দূরের কথা, তৃপ্তির ঢেকুরও তুলল না। বড় বড় চোখ করে করুণার চোখে তাকিয়ে ঠোঁট কাঁপিয়ে হাসছিল। বরং ঘুমের হাই তুলে এমন ভাব দেখায় যে, নাই যখন আর কী করা, আধ-পেটেই ঘুমাতে যাই! আজহার উদ্দিনের ভেতরে ভয়ের বরফ জমে কলিজা পাথর হয়ে আসছিল। পরাজিতের ক্ষোভ মিটাতেই এই ফোঁস ফাঁস নাটক। কিন্তু এতে যে নাতির ঘুম ভেঙে যাবে এবং এমন হেঁয়ালি করে ধারালো ছুরি দিয়ে পাথরে পোঁচ দেবার মতো কলিজায় পোঁচ দেবে, তা তার পরাজিত মাথায় খেলেনি।
এরমধ্যে বোমা ফোটানোর মতো অনন্ত বলে ওঠে, নাকি দাদি ঘুমাইয়া পড়ছে? কোনো সাড়াশব্দ নেই যে!
যা! আজহার উদ্দিনের এখন দাঁড়ানোই দায়। দাদি ঘুমাইছে বলতে যে কী অর্থ করছে তা বোঝার বাকি নেই। নাতির এই বোমাবাজি থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়? আজহার উদ্দিন পথ হাতড়ায়।
দাদা-নাতি কেউ আর কথা বলে না। মিনিট পাঁচেক দমফাটা নীরবতা চলে। দুপুর রাতে দাদু-নাতির সবাক-নির্বাক অভিনয়ের একমাত্র দর্শক সামান্য আড়ালে আলো-আঁধারির রহস্যময়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখছিল। নীরবতার পর্দা ফাটিয়ে হি হি হাসির ঝড় তোলে দর্শক, সঙ্গে ভেতরে দম আটকা গরম বাতাস ছাড়ে। হাসির ঝড় আর গরম বাতাসে আজহার উদ্দিনের ভেতরের নাড়িভুড়ি নড়ে ওঠে, করোটি খুলে চরকি নাচে, মগজ ছিটকে যেন উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে ভাব।
কী হাসি! ধারালো ছুরির মতো হাসি। এরকম হাসি আজহার উদ্দিন কোনেদিনই শুনেনি। মনুরা কোনোদিনই এমন হাসি হাসেনি। এই হাসির প্রতিউত্তর কী দেবে আজহার উদ্দিন? তার বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা সবই এই হাসির কাছে নস্যি।
অবশিষ্ট রাতটি অনন্তের জন্য কিছুটা অসহ্যই হয়ে ওঠে। ভোরের প্রতীক্ষায় চরম অস্থির। ভীষণ বিরক্তিতে মন ভরে ওঠে, কেন যে দাদিরে কেউ একবার দেখতেও এলো না? এই বাড়ির মানুষগুলোর মনে শুধু হিংসার পাহাড়। হাসিকে উপাত্ত ধরে নির্জন অন্ধকারেই তৈলরঙে আঁকা প্রচ্ছদপটের ছবির মতো দাদির একটি ছবিও এঁকে ফেলে মনের ক্যানভাসে। এখন প্রতীক্ষার পালা আঁকা ছবিটার সাথে দাদির ছবিটার মিল-অমিল যাচাই।
সকালের তুমুল হট্টগোলে অনন্তের ঘুম ভাঙে। চোখ মোচড়াতে মোচড়াতে দরজা খুলেই চমকে ওঠে, দাদুর সলজ্জ শরীর কাঁপছে! অনন্তকে দেখেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, ছিনালগুলি তোর দাদিরে লইয়া কী নাটক করে তুই দেখ্গা তো দাদু।
ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অনন্ত যা দেখল তাতে দাদুর উদ্বিগ্ন হবার মতো বিষয়ই বটে। সাত-আটজন পাড়ার বেওয়ারিশ বিধবা নতুন বউ নিয়ে ভলিবল খেলার মতো এর ওর কাছে ঢিল মারছে। ওটুকু কচি লতার মতো চিকন মেয়ে ওদের কাছে নস্যি। গায়ে-গতরে একেকটা বিধবা আফ্রিকার জঙ্গলের বুনো হাতির মতো। ওদের হাসাহাসি ঢলাঢালি, দাদুর দিকে তাকিয়ে চোখ টেপাটিপি, ব্যঙ্গ, হাসি-তামাশা দেখে অনন্ত নিশ্চিত হয়, এক ধরনের প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ছে বিধবাবাহিনী। ওদের এ হেন আচরণের একটা অর্থ খুঁজে পায় অনন্ত। ওদের একজন দাদুর দ্বিতীয় স্ত্রী হবার কথা ছিল। এদের মধ্যে ফার্মের গাভির মতো থলেথলে পেটওয়ালি রূপবানের মার ঘরে দাদুর যাওয়া-আসাকে নিয়ে পাঁচকান হয়েছেও। দাদুর বুদ্ধি, শক্তি আর দাপটের কারণে বিষয়টি বাজার পায়নি।
অনন্ত গলা ছেড়ে বাড়ির সবাইকে শুনিয়ে বলে, ঠিক করছে। ওরাই ঠিক কাম করছে দাদু। তোমার ছেলেরা-ছেলের বউরা বরণ করে নিবো না তো নতুন বউ বরণ ছাড়া থাকবো? সবাই খালি দাদুর সম্পত্তির হিসাব করে-দাদু কী মানুষ না!
অনন্তের এই আচরণের হেতু খুঁজে পায় না আজহার উদ্দিন।
বাড়ির নতুন সদস্য একা না, এই ম্যাসেজ পৌঁছে দিতেই অনন্ত কণ্ঠ উঁচিয়ে কথাগুলো বলল। উঠোনের মধ্যখানে ছুটে এসে চেঁচাতে লাগল এবার-থামো তোমরা! নতুন মানুষ পাইয়া খেলা জুটাইছো, অ্যা! তোমরারে ডাকছে কেডায়?
ও বাবা! কী দরদি গো? এই বলেই রূপবানের মা আজহার উদ্দিনের দিকে চোখে বিষতীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে তেড়ে এসে অনন্তকে চ্যাংদলা করে তুলে নিল। অনন্তর শরীর জুড়ে বিদ্যুৎপরিবাহীর মতো অচেনা এক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল। প্রায় নির্বল হয়ে গেল। ফুটবলের মতো গোল হয়ে শক্ত হয়ে জমে থাকা দাদির পাশে বসিয়ে দিল অনন্তকে।
রূপবানের মা চেঁচাতে লাগল-পানি ঢাল্। পানি ঢাল্। বরের মাথায় পানি ঢাল লো তোরা।
চার-পাঁচ বালতি পানিতে ভাসিয়ে দিল দুজনকেই।
রূপবানের মা ফের চেঁচায়, পয়সা কই? পয়সা আন লো তোরা, বর-বউরে পয়সা খেলাই!
ছেলের এই চরম বিপদে মা আর ঘরে বসে থাকে কী করে? শাড়ির আঁচল গুটিয়ে খিস্তিখেউড় করতে করতে ছুটে আসে, ধাড়িমাগিগুলির আর কাম নাই? এখানে আইছে তেজ দেখাইতে। ভাতারগুলির মাথা চিবাইয়া খাইয়া পরকালে পাঠাইছে, অহনে আইছে আমার পোলাডার মাথা খাইতে। শরম-হায়া বলতে নাই কিছু। ছি!
রূপবানের মা পানখাওয়া খয়েরি দাঁত বের করে ফোকলা হাসি হাসে-কেরে গো! আমার শাশুড়ি এত চেত্ছে কেরে?
দাদির কোলঘেঁষে বসে থাকা অনন্তর উঠার কোন লক্ষণ না দেখতে পেয়ে মা ধমকায়, ধাড়িপোলার কাম দেখো। উঠল নাকি। ধমকে কাজ হয় না। হাত ধরে টেনে তুলতে গেলে হেঁচকা টানে হাত ছাড়ায়, দাদি কি এখানে একলা থাকবো? আগে দাদিরে ঘরে নেও।
আর দাঁড়ালে বিতিকিচ্ছির কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। দলবল নিয়ে ফেরের সময় শকুনের মরা শুঁকার মতো করে আজহার উদ্দিনের শরীর শুঁকে গেল রূপবানের মা।
বাড়ির থমথমে পরিবেশ দু’দিনেই কেটে গেল। মেয়েটির বিশেষ উপদ্রুব করার কোন লক্ষণ নেই। আজহার উদ্দিনের কী পরিমাণ জমিজমা তার তিলবিন্দু হদিস জানে না। এসব বিষয়-আশয়ের প্রতি মেয়েটি চরম উদসীন। পরীক্ষা করার জন্য বাড়ির প্রত্যেকেই একবার অন্তত জিজ্ঞেস করেছে, স্বামীর জমিজামার খবর কিছু জানে কিনা? এ জিজ্ঞাসর প্রত্যুত্তরে অসম্ভব বিরক্তি আর অনীহা ফুটে ওঠে মেয়েটির চোখেমুখে, যা সকলেই জন্যই স্বস্তির। বড় স্বস্তি মেয়েটির জন্য।
অনন্তর মা দারুণ খুশি। একান্নবর্তী সংসারের বড় বউ; বিশাল দায়িত্ব কাঁধে তার। বুড় শ্বশুরের হুকুম-সেবা, কলেজপড়ুয়া ছেলের আব্দার-আত্তি উপদ্রবই মনে হতো। এখন দু’জনেরই দায়িত্ব নিয়েছে নয়া শাশুড়ি। খাওয়া, কলেজে পাঠানো, ওদের কাপড় ধোয়া সবই তার দফতর।
কিছুদিনের মধ্যেই অনন্তের উড়ুনচণ্ডি স্বভাবের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল। সুবোধ ছেলের মতো সন্ধ্যায় ফেরে বাড়ি। দেরি হলেই নয়াদাদির শাস্তির ব্যবস্থা। এই কড়া শাসনে আজহার উদ্দিন ভীষণ খুশি। ভীষণ খুশি অনন্তের মা। কৃতজ্ঞতায় ভেঙে পড়ে সে। মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে শরফুদ্দিনও।
অনন্তর নাম সংক্ষেপ করে অনু বলে ডাকে নয়াদাদি। কারণে-অকারণে হুকুম মারে, নিজের ঘরে শুয়েই খবরদারি করে, কিরে অনু পড়ার শব্দ কই? এই শাসনের কণ্ঠ অনন্তর মা’র কাছ অবধি পৌঁছায়। এরমধ্যে ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে এলে রাত-বিরাতে অনন্তর ঘরে নয়াদাদির যাতায়াত যেমন বেড়ে যায় তেমনি বেড়ে যায় অনন্তের আব্দার।
আচমকা বেফাঁস আব্দার করে বসে অনন্ত-রাতে তুমি এতো হাসো কেন দাদি? আমার ঘুমের ডিস্টার্ব হয় না?
নয়াদাদি জিভ কেটে লজ্জায় মরে। তুই, তুই করে কিছু সময়ক্ষেপণ করে একপ্রকার পালাতে উদ্যত হয়। অনন্ত আঁচল টেনে ধরে। নয়াদাদির চোখের লাল চিকন রেখাগুলো ভয়ানক ছটফট করে ওঠে। অনন্তের কণ্ঠের ওঠানামাও অস্বাভাবিক-রাতে তুমি এতো হাসো কেন?
আঁচল, শাড়িসহ দাদির নিয়ন্ত্রণহীন চিকন একহারা শরীর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে অনন্তের উপরেই। অনন্তের মুখ টিপে ধরে দাদি-আস্তে! পাগল আস্তে!!
অনন্তের অভিযোগের কণ্ঠ আরও দৃঢ় হয়-তুমি রাতে এতো হেসো না।
দাদি হাসতে হাসতে বলে, বানর খেলা দেখে হাসি। আচমকা কালবৈশাখী ঝড় এসে আশ্রয় নিল দাদির শ্যামলা মুখে। মুখের রগগুলো যেন মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। আঘাতখাওয়া সাপের মতো ছোবল দিতে দুই নাকে বাতাস ঢুকিয়ে ফুলিয়ে ভয়ানক শব্দ করে ফোঁসফাঁস করে।
অনন্ত ভয় পেল। ঢেকুর গিলে কাঁপাকণ্ঠে ডাকে-দাদি! দাদি!!
আজহার উদ্দিনের ডাক পড়ে।
পড়িমরি করে চলে যেতে যেতে দাদি বলে, কাঁনতে পারি না রে অনু, তাই হাইসা শোধ নেই!
দাদির এই শেষোক্ত বাক্য ঘোরপ্যাঁচে ছুঁড়ে ফেলল অনন্তকে। মানুষ কি সখ করে কাঁদে? তাও আবার গভীর রাতে। কান্নার শোধ কি হাসি দিয়ে মিটে? বন্ধুরা পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। বিষয়টা নিয়ে শেয়ার করার কেউ নেই কাছেপিঠে।
ভয়ানক এক নেশায় নিস্তব্ধ পাথরের মতো পড়ার টেবিলে বসে থাকে অনন্ত। কান পেতে রাখে বাতাসে। কখনো বাতি জ্বালিয়ে, কখনও নিভিয়ে উঠ্-বস্ করে। একটা সুতোর মতো ফারাক দাদি আর ওর মধ্যে। সেই ফারাকেই থুত্থুরে বুড়ো বেহুদা নড়েচড়ে। কাশে। শ্বাসটানে ভয়ানকভাবে। যুবতীর তীব্র দাপটের কাছে আজহার উদ্দিন অগোছালো হয়ে খুকখুক শব্দের মাতম তোলে। সেই মাতম অনন্তের ইন্দ্রিয়ের সমস্ত তারগুলো ছিঁড়ে একাকার করে ফেলে। ভীষণ ছটফটায়। সমস্ত স্নায়ুগুলো টানটান উত্তেজনা নিয়ে বিনিদ্র প্রহর কাটায়। পূর্ণিমার চাঁদের আলো বাইরে। পাহাড় ফাটানো জলপ্রপাতের মতো হাসি ঘাইমৃগীর ডাক হয়ে অনন্তের কানে পৌঁছায় দখিনা বাতাসে।
অক্ষম আজাহার উদ্দিন বেহুঁশ হয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে বেদম হাঁপায়। কলিজা কেটে বাতাস বেরোয়। সুযোগ থাকার পরও কিশোরী বউয়ের কচি লাউয়ের ডগার মতো লকলকে শরীরের দৌলত লুটে নিতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করে আজহার উদ্দিন। হিংস্র আক্রোশের তীর ছুঁড়ে মৃত স্ত্রী মনুরার দিকে; দিনে দিনে আজহার উদ্দিনের সব শক্তিই হরণ করে তবে মরেছে রাক্ষুসী!
জীবনের অভাবিত দুর্বিপাকে পড়ে আজহার উদ্দিন যৌবনের দিনগুলো ফিরে পেতে আর্তনাদ করে। সকল অর্জন, সম্পদ-সন্তান সবকিছুর বিনিময়ে গত যৌবন ফিরে পেতে প্রার্থনায় বসে প্রতিরাতে-হায় আল্লাহ! হায় মাবুদ! তুমি তো দয়ালু। আমি কিচ্ছু আর চাই না। তুমি আমারে দিনমজুর বানাইয়া দেও। পথের কাঙাল বানাইয়া দেও। আমার শরীরে সেই শক্তি ফিরাইয়া দেও মাবুদ।
জীবনের সব অর্জনের বিনিময়ে আজহার উদ্দিন ফিরে পেতে চায় মাত্র একটি রাত বা রাতের একটি প্রহর বা এমন একটি মুহূর্ত যে মুহূর্তে এই তরুণীর কাছে সে পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। তার পৌরুষের আস্ফালনের কাছে মাথা থেকে বিষ তুলে নেওয়া সাপের মতো মাথা নোয়ায়ে পরাজয় মেনে নেবে উন্মত্ত নদীর মতো বেগবতী তরুণী। বিশেষ মুহূর্তে হাত-পা ধরে কাঁদবে। মৃত স্ত্রীর মতো চোখের-নাকের জল এক করে বালিশ ভেজাবে।
বিশ্বস্ত বাহকের দাদুর এই করুণ প্রার্থনাবাক্য অনন্তের কাছে বহন করে আনে রাতের বাতাস। দাদুর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কানে পৌঁছা মাত্রই অনন্ত অস্থির হয়ে ওঠে; রাধার কানে কৃষ্ণের বাঁশির সুর পৌঁছলে যেমন অস্থির হয়ে উঠতো। অনন্তের ভেতরে তখন বয়ে চলে আনন্দধারার ছটফটানি। অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে তিরতির করে কাঁপে। মগজে রক্তের আগুন জট হয়ে জমে আসলে বিছানায় হামলে পড়ে শীতল বৃষ্টিপাত ঘটায়। শরীর থেকে গরম অস্বস্তিকর ভাপ বেরিয়ে গেলে হাত-পা টান করে বিছানায় লাশের মতো ঘুমায় অনন্ত।
[২]
বিয়ের বছর ঘুরে না আসতেই আজহার উদ্দিনের শরীরের আর হেলদুল টের পায় না। মেশিনপত্র বিগড়ে বীমা করা বাতিল বাস-ট্রাকের মতো লক্কর-ঝক্কর করে কোনপ্রকারে বছর পার করতে পারে। কিন্তু মাঘের শীত আসতেই শরীর আর কাজেকামে সায় দেয় না। যেনতেন প্রকারেও আর পারে না। মাস দু’য়েক ধরাধরি করে ঘর-বাইর করে চালালেও এখন পুরো বিকল। বিছানাতেও এপাশ-ও পাশ হতে পারে না একা। আজহার উদ্দিনের দুটো ব্যথাতুর চোখ জেগে থাকে। ঈর্ষার দৃষ্টিতে তরুণী বউয়ের দিকে তাকিয়ে অতৃপ্তির শ্বাস ফেলে। বউয়ের চোখে আগ্নেয়গিরির আগুন জ্বলেই থাকে। ভয়ার্ত আজহার উদ্দিনের অবশিষ্ট আয়ু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে নিজের বউয়ের চোখের আগুনেই।
টানা নয় মাসের ভাড়া হিসেবে শরীরের মাংস সব খেয়ে ফেলেছে বিছানা-ই। এখন মানবাকৃতি নিয়ে কঙ্কালগুলো যার যার স্থানে স্থবির থাকলেও জয়েন্টে জয়েন্টে পুরনো নাটবল্টুর মতো আলগা হয়ে আসছে। একটু-আধটু তরল খাবার মুখে দিলে পেটে ঢুকে যৎসামান্য।
ছেলে, ছেলের বউরা ভীষণ আনন্দে আছে। মরা টানার দায় থেকে মুক্ত সবাই। বাড়ির দুটো কৃতজ্ঞ প্রাণিই শুধু আধ-মরার পাহারায় এতটাই নিবেদিত যে, অন্যরা বরং ঘরে ঢুকলে বিরক্তির ভাব ফুটে চেহারায়। দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়টাই দাদুর ঘরে কাটায় অনন্ত। দাদুর সেবা করে। বাড়িতে যে সময়টুকু থাকে দাদুর ঘরেই থাকে। যে পরিবারের স্থপতির এখন-সখন মরবে অবস্থা, সেই পরিবারের সদস্যদের তো চোখে-মুখে বিষাদের বলিরেখা থাকার কথা। বাস্তবে ওরা দারুণ ফূর্তির মেজাজে থাকে। কারণ আজহার উদ্দিনকে টানাহেঁচড়া করছে যে দুইজন ওদের মধ্যে কোনো খেদ-বিরক্তি নেই, বরং সুখদ চাঞ্চল্য ও চনমনে ভাবই বেশি। দাদুর আদরের যোগ্য প্রতিদান দিচ্ছে নাতি, অনন্তের মা কৃতিত্ব নিতে এ কথা দিনে দু’চার বার বলবেই। ছেলে, ছেলের বউরা রুটিনমাফিক দিনে একবার করে আজহার উদ্দিনের ঘরে ঢোকে। ফিরে আসে মৃদু বিরক্তি নিয়েই। বাড়ির এতগুলো মানুষের প্রত্যাশাকে গলা টিপে স্বার্থপরের মতো নিশ্বাস টানা হেঁচড়ায় ব্যস্ত আজহার উদ্দিনের উপর যে মাত্রায় বিরক্তি ও অবজ্ঞা প্রদর্শনের কথা ছিল, তা সেই মাত্রায় নেই। বরং সংসারের আর দশ মরণাপন্ন প্রবীণের চাইতে বাবা বেশি সেবা-যত্ন পেয়ে যাচ্ছে বলে ছেলেরা গর্ব করে। মাস দুয়েক আগে সফর আলি ব্যাপারি মরার দু’দিন পরে ছেলেরা টের পেল। আজহার উদ্দিনের ফাটা কপাল। মরার মুহূর্তেও অন্তত দু’জনকে কাছে পাবে।
জীবনের প্রহরে প্রহরে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে-জাগিয়ে তুলেছে যে সংসার, আজহার উদ্দিন এতটা স্বার্থপর নয় যে, যুগযুগ ধরে মরার মতো পড়ে থেকে তার ক্ষতি করবে। তাই, কোন সাড়াশব্দ না করেই চলে গেল। রাতের কোন প্রহরে আজহারউদ্দিন শেষ নিশ্বাস টেনে ভেতর থেকে বের করে দিয়েছে, ঘুমের ঘোরে টের পায়নি পাশের মনুষটি।
দাফন-কবরের অনুষ্ঠানাদি চলে দুপুর পর্যন্ত। বাবার মৃত্যুতে ক্লান্তি ও বিষাদের ধকল কাটিয়ে উঠতে বিকেল পর্যন্ত সময় নিল তিনভাই। কিন্তু তিনজনের মাথাতে-ই ঘূর্ণিবলের মতো ঘুরছে ভাগবাটোয়ারার মানচিত্র। শরফুদ্দিন ভাবছে, অনন্তকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে, দাদা গোপনে কিছু দিয়ে গেল কিনা? জান দিয়ে সেবা করল যে নাতি, তাকে কিছু না দিয়ে চলে যাবে এতো অকৃতজ্ঞ আজহার উদ্দিন ছিল না।
হঠাৎ ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে উঠোনের ঠিক মধ্যখানে দাঁড়াল সদ্য বিধবা। এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। অনন্তের ঘরমুখী বসে ওয়াক্ ওয়াক্ শব্দের ঝড় তুলেছে।
বমির শব্দ শুনে প্রথম ঘরে থেকে বের হয় শরফুদ্দিন। তারপর বের হয় আজহার উদ্দিনের দুই ছেলে, মেয়েরা, ছেলের বউরা। এক এক করে সবাই গোল হয়ে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গেল বমিরত সদ্য বিধবাকে ঘিরে। ওদের প্রত্যেকের চোখে-মুখে বিস্ময়। প্রত্যেকের কপালে একাধিক ভাঁজ পড়েছে, ফুটে উঠেছে ভয়-আতঙ্কের বলিরেখা।
ইচ্ছে করেই সামান্য বিলম্বে ঘর থেকে বের হয় অনন্ত। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে বৃত্তের দিকে। বাবা শরফুদ্দিনকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে জায়গা ফাঁকা করে বুক ফুলিয়ে সগৌরবে বৃত্তের ভেতরে প্রবেশ করে অনন্ত।
লেখক : অধ্যাপক (নোয়াখালি বিশ্ববিদ্যালয়), কথাসাহিত্যিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment