বিবাহিত নারী (দশম পর্ব)

  • 10 July, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 555 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
আবেগের অতিরেক যেমন কুমারী মেয়েদের ভয়ের কারণ হয়, তেমনি অতিরিক্ত শ্রদ্ধাও তাঁদের লাঞ্ছনার কারণ হয়ে ওঠে। সেই সব পুরুষকেই মহিলারা চিরকালের জন্য ঘৃণা করেন যাঁরা মহিলাদের কষ্টের কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো কেবল নিজের আনন্দের কথাই ভাবেন। তবে, মহিলারা সেই সব পুরুষের প্রতি চিরায়ত বিদ্বেষ অনুভব করেন যাঁদেরকে দেখা যায় মহিলাদের ঘৃণা করতে।

*আগের পর্ব  এখানে পড়ুন।

বিয়ের দিন বাড়ি ফিরে আপনি যদি আপনার স্ত্রীকে রাতের বেলা কুয়োর মধ্যে ফেলে ভিজিয়ে দেন, তাহলে স্ত্রী হতবাক হয়ে যাবেন। তাঁর মধ্যে একটি অস্পষ্ট উদ্‌বেগও তৈরি হতে পারে ...

দাঁড়ান, দাঁড়ান, স্ত্রী বললেন, একেই কি বলে বিবাহ? এই কারণেই তো আমরা এর অনুশীলন এত গোপনে করি। এই ব্যাপারে আমি নিজেকে যুক্ত হতে দিলাম।

বিরক্ত হলেও স্ত্রী কিন্তু কিছু বললেন না। আর এই কারণেই বিবাহ-ব্যাপারে আপনি দীর্ঘ সময়ের জন্য এবং বারে বারে ডুব দিতে পারেন আশেপাশে কোনো কেলেঙ্কারি না ঘটিয়েও।

‘বিবাহের রাতগুলি’ শিরোনামে লেখা মিশোর এই কবিতাংশটি পরিস্থিতির একটি যথাযথ বিবরণ দেয়। আজকের দিনের যুবতী মেয়েরা অনেক বেশি সতর্ক, অনেক বেশি সচেতন। তাঁদের সম্মতিদানের প্রসঙ্গটি যদিও এখনও আকার লাভ করেনি। তাঁদের কৌমার্য-ত্যাগের মধ্যেই রক্ষিত রয়েছে ধর্ষণের বৈশিষ্ট্য। হ্যাভলক এলিস বলেছেন, “নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, বিবাহের বাইরের চেয়ে বৈবাহিক ধর্ষণই বেশি সংঘটিত হয়”। নোজবোয়ার তাঁর বই ‘Monatsschrift für Geburtshilfe’ (১৮৮৯)-এর নবম খণ্ডে সঙ্গমের সময় পুরুষাঙ্গ দ্বারা মহিলাদের ওপর দেড়শোরও বেশি আঘাতের ঘটনা জড়ো করেছিলেন। এই আঘাতের কারণগুলি ছিল নির্মমতা, মাতলামি, সঙ্গমের সময় ভুল অবস্থান, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অসামঞ্জস্য। হ্যাভলক এলিস জানিয়েছেন, ইংল্যান্ডে, একজন মহিলা ছ-জন মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিমতী বিবাহিত মহিলাকে তাঁদের বিবাহ-রাতের অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। প্রত্যেকের কাছেই সঙ্গম বিষয়টি ছিল এক বিরাট ধাক্কা। ছ-জনের মধ্যে দু-জন এই সব বিষয়ে অনবগত ছিলেন। বাকিরা মনে করতেন যে, তাঁরা এই ব্যাপারটি জানতেন। যদিও মানসিকভাবে তাঁরাও কম আহত হননি। অ্যাডলার নিজেও মহিলাদের কৌমার্যহরণ-ক্রিয়ার ফলে মনোগত অভিঘাতের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

সমস্ত অধিকার অর্জনের প্রথম মুহূর্তেই পুরুষ তাঁর বাকি জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। অনভিজ্ঞ এবং অতিমাত্রায় উত্তেজিত স্বামী এভাবেই বপন করতে পারে মেয়েলি অসংবেদনশীলতা। নিজের আনাড়িপনা এবং অব্যাহত বর্বরতা দিয়েই তিনি সেই মেয়েলি অসংবেদনশীলতাকে চিরায়ত অ-সংবেদনে রূপান্তরিত করতে পারেন।

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা এইরকম অ-খুশি উদ্যোগের অনেক উদাহরণ দেখেছি। স্টেকেল সাহেবের বর্ণনা করা এইরকম আরও একটি উদাহরণ এবার দেখা যাক :

শ্রীমতী এইচ. এন. ...খুব নম্র-ভদ্র-বিনয়ীভাবে যিনি বড়ো হয়ে উঠেছেন, তিনিও বিবাহ-রাতের ধারণামাত্রই কেঁপে ওঠেন। বিবাহ-রাতে তাঁর স্বামী তাঁকে শুতে না দিয়ে প্রায় সহিংসভাবে বিবস্ত্র করে দেন। নিজের পোশাক খুলে ফেলে স্বামী দাবি করেন, স্ত্রী তাঁর নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকুন আর তাঁর যৌনাঙ্গের প্রশংসা করুন। স্ত্রী তখন নিজের হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে রাখেন। বিস্ময়ের সঙ্গে স্বামী বলেন : “তুমি তাহলে বাপের বাড়িতেই থাকলে না কেন? ক্যাবলা জবরজং কোথাকার!” অতঃপর, স্বামী তাঁর স্ত্রীকে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলেন আর নির্মমভাবেই সঙ্গমে লিপ্ত হন। স্বাভাবিকভাবেই, এরপর থেকে চিরকালের জন্য তাঁর স্ত্রী নিরুৎসাহী হয়ে পড়েন।

প্রকৃতপক্ষে আমরা দেখেছি, নিজের যৌন নিয়তির অভীষ্টলাভের জন্য একজন কুমারী মেয়েকে কী কী বাধা অতিক্রম করতে হয়। আর এই কাজ সম্পন্ন করার প্রথম পদক্ষেপই দাবি করে ‘পরিশ্রম’, যা একইসঙ্গে শারীরবৃত্তীয় এবং মানসিক। বিবাহিত মহিলা এক রাতের মধ্যেই সেই শ্রম সম্পূর্ণরূপে দান করবেন, এমন চাহিদাও মূর্খামি এবং বর্বরতা। প্রথমবার সঙ্গমের মতো ভীষণ শক্তসাধ্য একটি কাজকে একটি কর্তব্যে রূপান্তর করাও অযৌক্তিক। এই অদ্ভুত পবিত্র কার্যের কাছে মহিলারা উৎসর্গীকৃত বলে মহিলারা আরও ভীত হয়ে পড়েন। কারণ সমাজ, ধর্ম, পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব তাঁকে শুদ্ধমাত্র প্রভুস্বরূপ একজন স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছে। আর এই সঙ্গম-কার্যে যুক্ত থাকাই যেন তাঁর বাকি ভবিষ্যতের কাজ। কারণ, ইতিমধ্যেই বিবাহ একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ধারণ করে ফেলেছে। আর সেই মুহূর্তেই একজন মহিলা নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত অনুভব করেন। যে-পুরুষের কাছে তাঁকে চিরকালের জন্য উৎসর্গ করে দেওয়া হয়, সেই পুরুষই তাঁর চোখে একজন সম্পূর্ণ মানবরূপে প্রতিভাত হন। আবার, সেই পুরুষও এক অজানা চরিত্র বা ব্যক্তিত্বের আবরণে স্ত্রীর কাছে নিজেকে প্রকাশ করেন। সেই অজানা ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব অসীম, যেহেতু তিনি তাঁর স্ত্রীর চিরজীবনের সঙ্গী হবেন। যদিও, একজন পুরুষও কিন্তু তাঁর ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই গুরুভারে পীড়িত হয়ে পড়েন। একে তো তাঁর নিজেরও অনেক সমস্যা, অনেক জটিলতা আছে। আর এই সমস্যা আর জটিলতাই তাঁকে ভীতু এবং আনাড়ি করে তোলে, অথবা বিপরীতে করে তোলে পাশবিক। এমন অনেক পুরুষও আছেন যারা বিয়ের রাতে নিজেদের শক্তিহীনতা প্রকাশ করে ফেলেন বিবাহের গাম্ভীর্যের জন্য। ‘Obsessions et la psychasthénie’ গ্রন্থে JANET লিখছেন :

কে না জানে যে, এই নতুন স্বামীরা, যাঁরা দাম্পত্যক্রিয়া সুসম্পন্ন করতে পারেন না, তাঁরা নিজেদের কপাল নিয়ে সম্পূর্ণরূপে লজ্জিত থাকেন। আর এই জন্য তাঁরা প্রবলভাবে লজ্জিত আর হতাশাগ্রস্তও হয়ে পড়েন। গত বছর আমরা একটা ট্র্যাজি-কমিক দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলাম। একজন ক্রুদ্ধ শ্বশুরমশায় তাঁর বিনয়ী, হতাশ জামাইকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। শ্বশুরমশায় আসলে চাইছেন মেডিক্যাল তথ্যপ্রমাণ--যার দ্বারা বিবাহ-বিচ্ছেদের অনুমতি পাওয়া যাবে। বেচারা বর ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, আগে তিনি যথেষ্টই বীর্যবান ছিলেন, যদিও বিবাহের পর এক ধরনের বিব্রতবোধ আর লজ্জানুভূতি সব কিছুকেই অসম্ভব করে তুলেছিল।

আবেগের অতিরেক যেমন কুমারী মেয়েদের ভয়ের কারণ হয়, তেমনি অতিরিক্ত শ্রদ্ধাও তাঁদের লাঞ্ছনার কারণ হয়ে ওঠে। সেই সব পুরুষকেই মহিলারা চিরকালের জন্য ঘৃণা করেন যাঁরা মহিলাদের কষ্টের কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো কেবল নিজের আনন্দের কথাই ভাবেন। তবে, মহিলারা সেই সব পুরুষের প্রতি চিরায়ত বিদ্বেষ অনুভব করেন যাঁদেরকে দেখা যায় মহিলাদের ঘৃণা করতে। প্রায়শই দেখা যায়, সেই সব পুরুষের প্রতি মহিলারা চটে থাকেন, বিবাহের প্রথম রাতেই যাঁরা কৌমার্যহরণ করেন না বা সঙ্গম-কার্যে অক্ষম থাকেন। হেলেন ডয়েশ জানিয়েছেন, এমন অনেক ভীত, লজ্জিত এবং অদক্ষ স্বামীও আছেন, যাঁরা ডাক্তারকে অনুরোধ করেন শারীরিকভাবে স্ত্রীর গঠনের মধ্যে কিছু অসম্পূর্ণতা আছে এই অজুহাতে অস্ত্রোপচার করে স্ত্রীর সতীচ্ছদ নষ্ট করে দিতে। স্বামীর এই উদ্দেশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু যুক্তিগ্রাহ্য নয়। হেলেন জানিয়েছেন, স্ত্রীরাও এর ফলে স্বামীদের প্রতিও চিরকালের জন্য ঘৃণা, অবজ্ঞা এবং বিদ্বেষ পোষণ করে চলেন, যেহেতু স্বামীরা আর পাঁচজনের মতো তাঁদের সতীচ্ছেদ ভেদ করতে পারছেন না। ফ্রয়েডের অন্যতম একটি পর্যবেক্ষণ হল, স্বামীর অক্ষমতাও স্ত্রীর মধ্যে আঘাত বা যন্ত্রণার জন্ম দিতে পারে :

একজন অসুস্থ ভদ্রমহিলার অভ্যাস ছিল এক ঘর থেকে অন্য ঘরে দৌড়ে যাওয়া। দুটি ঘরের মাঝে একটি টেবিল ছিল। টেবিলের ওপর নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে সেই ভদ্রমহিলা কাপড় পেতে বাড়ির পরিচারিকাকে ডাকতেন। পরিচারিকাকে তখন টেবিলের কাছে আসতেই হত। আর পরমুহূর্তেই পরিচারিকাকে তিনি ফেরত পাঠিয়ে দিতেন ... ভদ্রমহিলা যখন তাঁর নিজের এই প্রবল আসক্তির কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন, তখন তাঁর মনে পড়ছিল সেই কাপড়ের ওপর একটা বিচ্ছিরি দাগ ছিল আর প্রত্যেকবারই সেই কাপড়টিকে তিনি এমনভাবে টেবিলের ওপর পেতে দিতেন যাতে পরিচারিকার চোখে সেই দাগ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ... আর এই সবটাই ছিল বিবাহ-রাতের ঘটনার জন্য। সেই রাতে ভদ্রমহিলার স্বামী তাঁর পৌরুষ প্রদর্শন করতে পারেননি। হাজার বার বাসর ঘর থেকে নিজের ঘরে দৌড়োদৌড়ি করে নতুন উদ্যমে শুরু করার চেষ্টাও করছিলেন। যে-পরিচারিকা তাঁদের বিছানাপত্র পেতে দেয়, তার কাছ থেকে লজ্জা এড়ানোর জন্য, ভদ্রলোক তাই বিছানার চাদরের ওপর লাল কালি ঢেলে দেন, পরিচারিকা যাতে সেটিকে রক্তের দাগ বলে মনে করে।

 

ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক।

 

0 Comments

Post Comment