বিবাহিত নারী (দ্বাদশ পর্ব)

  • 11 August, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 526 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
রীতি-প্রথার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা যে-কোনো বৈবাহিক সম্পর্কেরই অনেকটা সুযোগ আছে প্রেম জন্মিয়ে তোলা—এই অজুহাত হল একটি ভণ্ডামি। এমনটা দাবি করাও অ্যাবসার্ড যে, সারা জীবন ধরে ব্যবহারিক, সামাজিক ও নৈতিক স্বার্থ দ্বারা সংযুক্ত স্বামী-স্ত্রী একে-অপরকে গোটা জীবন ধরে যৌন আনন্দ পরিতোষ করবেন।

‘Thérèse Desqueyroux’ গ্রন্থে মোরিয়াক সাধারণভাবে বিবাহ, বিশেষভাবে যুগল কর্তব্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন যুক্তিসংগতভাবে বিবাহিত যুবতী নারীর প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেছেন। এবার আরও একটু আঁকাড়া সাক্ষ্য দেখুন। স্বীকারোক্তিটি স্টেকেলের সংগৃহীত। এর মধ্য থেকে আমি কেবল সেই অনুচ্ছেদটিই উদ্ধৃত করবো যেখানে বিবাহিত জীবনের কথা আছে। অনুচ্ছেদটিতে রয়েছে ২৮ বছর বয়সি একজন মহিলার কথা, বেশ পরিশীলিত এবং সংস্কৃতিসম্পন্ন পরিবেশে যিনি বড়ো হয়ে উঠেছেন।

একজন সুখী বাগ্‌দত্তা ছিলাম আমি। মনে হত একটা আশ্রয়ের মধ্যে আছি। হঠাৎ করে আমি এমন একজন হয়ে উঠেছিলাম, যে মনোযোগ আকর্ষণ করে নিত। খুব প্রশ্রয় দেওয়া হত আমাকে। আমার প্রেমিক আমাকে খুব সম্মান করতেন। এই সব কিছুই ছিল আমার কাছে নতুন ... প্রেমিকের চুম্বন (এটা ছাড়া অন্য কোনোরূপ যত্ন প্রেমিক আমাকে করেনি) আমাকে এতটাই উদ্দীপিত করেছিল যে, বিয়ের দিনের জন্য আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না ... বিয়ের দিন সকালে প্রবল উত্তেজনায় মুহূর্তের মধ্যে আমার জামা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছিল। এরকম ধারণা হয়েছিল, যাকে প্রবলভাবে চেয়েছি, সেই অপরিচিত পুরুষকেই অবশেষে জানতে চলেছি। আমার মধ্যে একটা শিশুসুলভ ধারণা ছিল যে, পুরুষকে অবশ্যই স্ত্রীযোনির মধ্যে প্রস্বাব করতে হবে ... আমাদের ঘরে, ইতিমধ্যেই একটা হতাশাজনক ঘটনা ঘটে যায় যখন স্বামী আমাকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি চলে যাবেন কি না। আমিই তাঁকে চলে যেতে বলেছিলাম, কারণ তাঁর সামনে আমি সত্যিই লজ্জা পেয়েছিলাম। পোশাক ত্যাগের দৃশ্য আমার কল্পনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আমি যখন বিছানায়, তখন অত্যন্ত বিব্রত হয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন। পরে আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, আমার আচার-আচরণই তাঁকে ভীত করে তুলেছিল। উজ্জ্বল ও প্রত্যাশিত যৌবনের মূর্ত প্রতীক ছিলাম আমি। সবেমাত্র পোশাক খোলা শুরু করেছি, উনি আলো বন্ধ করে দেন। চুম্বনমাত্রেই উনি আমাকে দখল করে নেন। ভয় পেয়ে ওঁনাকে বলি আমাকে ছেড়ে দিতে। চাইছিলাম ওঁনার থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকতে। কোনো পূর্ব-আদর ছাড়াই ওঁনার এই প্রচেষ্টায় আমি ভীত হয়ে পড়েছিলাম। ওঁনাকে আমার নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল আর পরে প্রায়শই ওঁনাকে আমি এইজন্য তিরস্কারও করতাম। এই তিরস্কার অবশ্য নিষ্ঠুরতার জন্য নয়, তা আসলে ওঁনার অদক্ষতা, ইতস্ততবোধ আর সংবেদনশীলতার অভাবের জন্য। রাতের বেলা ওঁনার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। এইবার আমি বেশ অখুশি হতে শুরু করি। নিজের বোকামির জন্য নিজেই লজ্জা পেতাম। মনে হত, আমিই ভুল করেছি, আমিই বাজে ভাবে বড়ো হয়েছি ... অবশেষে, ওঁনার চুম্বনে আমি খুশি হয়ে উঠি। দশদিন পরে, তিনি আমার কৌমার্য হরণ করেন। কেবল কয়েক মুহূর্ত স্থায়ী হয়েছিল আমাদের সঙ্গম। একটু মৃদু ব্যথা ছাড়া আমি আর কিছুই অনুভব করিনি। বড়োই নৈরাশ্যজনক ঘটনা! এরপর সঙ্গমের সময় কিছুটা আনন্দানুভব করি, যদিও এই ব্যাপারে সাফল্য ছিল বেশ যন্ত্রণাদায়ক। নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোনোর জন্য আমার স্বামী তখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রাগে, আমার অবিবাহিত দেওরের অ্যাপার্টমেন্টে, আমি কল্পনা করতাম আমার দেওরের শিহরণ যখন তিনি জানলেন যে আমি তাঁর খাটেই শুয়েছি। ওখানেই প্রথমবার আমার অর্গ্যাজম হয়, যা আমাকে প্রবল খুশি করেছিল। প্রথমদিকের সপ্তাহগুলোর প্রত্যেক দিন আমার স্বামী আমার সঙ্গে মিলিত হতেন। তখনও আমার অর্গ্যাজম হত, কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতাম না। কারণ খুব কম সময়ের জন্যই এটা ঘটতো। শৃঙ্গারের উত্তেজনায় আমি তখন প্রায় কাঁদার অবস্থায় চলে যেতাম ... দু-বার সন্তান জন্ম দেওয়ার পর ... সঙ্গম ধীরে ধীরে কম তৃপ্তিদায়ক হয়ে পড়ে। সঙ্গমের পরিণতিস্বরূপ এখন খুব বিরল আমার অর্গ্যাজম হয়। আমার স্বামীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সব সময়ই আমার আগে হত। উদ্‌বেগের সঙ্গে, প্রত্যেকবারই বিষয়টি আমি খেয়াল রাখতাম (এটি আর কতক্ষণ চলবে?)। আমাকে মাঝপথে ছেড়ে দিয়েই যদি তিনি তৃপ্ত হয়ে যেতেন, তাহলে ওঁনাকে আমি ঘৃণা করতাম। সঙ্গমের সময় আমি কখনো-কখনো আমার কাজিন বা যে ডাক্তার আমার জন্ম দিয়েছেন, তাঁদের কল্পনা করতাম। নিজের আঙুল দিয়ে আমার স্বামী আমাকে শৃঙ্গারিত রাখতেন ... এটা নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত থাকলেও এই পদ্ধতি আমার কাছে একইসঙ্গে লজ্জাজনক এবং অস্বাভাবিক মনে হত। কোনো চরমানন্দই আমার হত না ... আমাদের বিবাহের কোনো মুহূর্তেই তিনি আমার শরীরের কোনো একটি নির্দিষ্ট অংশে যত্ন নেননি। একদিন আমাকে বলেছিলেন, আমার সঙ্গে কোনো কিছু করার সাহস তাঁর ছিল না ... তিনি আমাকে কখনও নগ্ন দেখেননি, কারণ আমরা আমাদের পোশাক পরে থাকতাম। ফলত, রাতের বেলা কেবল সঙ্গম ছাড়া আর কিছুই তিনি করেননি।

প্রকৃত অর্থে, এই কামার্ত মহিলাই পরবর্তী সময়ে একজন প্রেমিকের বাহুতে যথার্থ খুশি ছিলেন।

এই এনগেজমেন্টগুলির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হল বাগ্‌দানের জন্য যুবতী মেয়েদের ধাপে ধাপে তৈরি করা। কিন্তু প্রায়শই সামাজিক রীতিনীতি বাগ্‌দত্ত-বাগ্‌দত্তার ওপর চরম সতীত্ব আরোপ করে। বাগ্‌দান পর্বের মধ্যে যেসব ক্ষেত্রে একজন কুমারী তাঁর ভবিষ্যতের স্বামীকে ‘চেনেন’, তাঁর অবস্থাও বিবাহিত যুবতীদের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়। কুমারী মহিলারাও সেক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করেন, কারণ তাঁর কাছে এই এনগেজমেন্ট ইতিমধ্যেই বিবাহের মতোই নির্দিষ্ট বলে মনে হয়, এবং প্রথম সংগমের মধ্যে থাকে অগ্নিপরীক্ষার বৈশিষ্ট্য ধরে রাখে। যখনই সেই কুমারী একবার নিজেকে ছেড়ে দেন—এমনকি তিনি যদি গর্ভবতী নাও হন, যা তাঁকে পুরোপুরি শৃঙ্খলিত করে রাখবে--তা সত্ত্বেও এটা বেশ বিরল যে তিনি আবার নিজের অধিকার প্রকাশের সাহস পাবেন।   

প্রথম অভিজ্ঞতার অসুবিধাগুলি সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারা যায়, যদি প্রেম বা ইচ্ছা উভয় অংশীদারের কাছ থেকেই পূর্ণ সম্মতি পায়। শারীরিক প্রেম তার শক্তি এবং মর্যাদা গ্রহণ করে সেই আনন্দ থেকে যা প্রেমিক-প্রেমিকারা একে-অপরকে দিয়ে থাকে এবং প্রতিদানে লাভ করে তাঁদের স্বাধীনতার পারস্পরিক চেতনায়। ফলত, তাঁদের কোনো প্রচেষ্টাই অবমাননাকর নয়।  বরং তাঁদের এই প্রচেষ্টাই তো উদারভাবে কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বিবাহের নীতি হল অশ্লীল। কারণ এই বিবাহ রূপান্তরিত হয় অধিকার ও কর্তব্যবোধে যার ভিত্তি হওয়া উচিত স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা। দুটি শরীরকে সাধারণভাবে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে এই বিবাহ শরীরকে একটি যন্ত্র বানিয়ে তোলে। ফলত, বিবাহ হল অবমাননাকর। স্বামীরা প্রায়শই ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যান এই ধারণা থেকে যে তাঁরা একটি কর্তব্য সম্পাদন করছেন। আর স্ত্রীরাও লজ্জিত হন এমন একজনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে যিনি তাঁর ওপর অধিকার ফলান। অবশ্য এটাও ঘটতে পারে যে, বিবাহিত জীবনের শুরুতে সম্পর্কগুলি স্বতন্ত্র থেকে যায়। ধীরে ধীরে যৌনশিক্ষা সম্পন্ন হয়। বিবাহের প্রথম রাত থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আনন্দময় শারীরিক আকর্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। পাপের ধারণাকে দমন করে স্ত্রীর পরিত্যাগকে বিবাহ সহজতর করে। ঘন ঘন এবং নিয়মিত সহবাস শারীরিক ঘনিষ্ঠতার যা যৌন পরিপক্বতার অনুকূল। বিবাহের প্রথম বছরগুলিতেই সুখী দম্পতি দেখতে পাওয়া যায়। এটাও আলাদা করে উল্লেখ করার মতো যে, বিবাহিত মহিলারা তাঁদের স্বামীদের প্রতি এমন এক ধরনের কৃতজ্ঞতা লালন করে চলেন যা পরবর্তীকালে স্বামীদের সকল অপরাধকে মার্জনা করে দিতে সাহায্য করে। “যে নারীরা অসুখী পরিবার থেকে নিজেদের বের করে আনতে পারেন না, তাঁরাই সবসময় তাঁদের স্বামীদের দ্বারা সন্তুষ্ট থাকেন”, জানিয়েছেন স্টেকেল। তবুও যুবতী মেয়েরা একটি ভয়ানক ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যান সারা জীবন নির্দিষ্ট একজন লোকের শয্যাসঙ্গী হয়ে, যেই লোককে তাঁরা যৌনভাবে জানেন না। তবুও তাঁদের ইরোটিক নিয়তি মূলত নির্ভর করে সঙ্গীর ব্যক্তিত্বের ওপর : এই কূটাভাসকেই লেও ব্লুম যুক্তিসহকারে তিরস্কার করেছেন তাঁর ‘বিবাহ’  নামক গ্রন্থে।

সামাজিক রীতি-প্রথার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা যে-কোনো বৈবাহিক সম্পর্কেরই অনেকটা সুযোগ আছে প্রেম জন্মিয়ে তোলা—এই অজুহাত হল একটি ভণ্ডামি। এমনটা দাবি করাও অ্যাবসার্ড যে, সারা জীবন ধরে ব্যবহারিক, সামাজিক ও নৈতিক স্বার্থ দ্বারা সংযুক্ত স্বামী-স্ত্রী একে-অপরকে গোটা জীবন ধরে যৌন আনন্দ পরিতোষ করবেন। যাই হোক, সুবিধাজনক বিবাহের পক্ষপাতীদের কাছে এটা অনুকূল সময় দেখানোর জন্য যে, স্বামীদের আনন্দ নিশ্চিত করার খুব একটা সুযোগ লাভ ম্যারেজে নেই। প্রথমত আদর্শ প্রেম, যা প্রায়শই একজন যুবতী মেয়ে জেনে থাকে, তা কিন্তু তাকে যৌনপ্রেমের দিকে সবসময় ঠেলে দেয় না। তাঁর প্লেটোনিক আকর্ষণ, তাঁর স্বপ্ন, তাঁর আবেগ যার মধ্যে তিনি তাঁর ছেলেবেলার বা কিশোর বয়সের অবসেশনকে মিশিয়ে দিয়েছেন, সেগুলি কিন্তু তাঁকে দৈনন্দিন পরীক্ষা থেকে বিরত করে, এমন নয়। এ ছাড়া, সেই অবসেশনগুলি দীর্ঘস্থায়ীও হয় না। তাঁর এবং তাঁর বাগ্‌দত্তর মধ্যে যদিও-বা আন্তরিক এবং প্রবল কামোত্তেজনা থেকেও থাকে, তা সত্ত্বেও তা কিন্তু তেমন কোনো শক্তপোক্ত ভিত নয় যার ওপর আজীবনের কারবার গড়ে তোলা যায়। 

লেখক  : অধ্যাপক ও সমাজকর্মী 

ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment