বিবাহিত নারী (চতুর্দশ পর্ব)

  • 29 September, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 482 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
পুরুষের পেশাই হল কাজ করা। তাঁকে উৎপাদন করতে হবে, লড়াই করতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে, অগ্রগতি লাভ করতে হবে, মহাবিশ্বের সামগ্রিকতা এবং ভবিষ্যতের অনন্ততার দিকে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী বিবাহ নারীকে আহ্বান জানায় না স্বামীর সঙ্গে এই উত্তরণের পথে। অবিচলতার মধ্যে নারীকে তা বন্দি করে রাখে।

সত্য হল, শারীরিক প্রেমকে একটি চরমতম সমাপ্তি বা একটি নিছক মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। কোনো অস্তিত্বকেই ন্যায্যতা দিতে পারে না শারীরিক প্রেম। আবার বাইরের কোনো সমর্থনও গ্রহণ করতে পারে না। এর অর্থ হল : শারীরিক প্রেম মানুষের গোটা জীবন জুড়ে অবশ্যই একটি ধারাবাহিক এবং স্বশাসিত ভূমিকা পালন করে যাবে। অর্থাৎ, শারীরিক প্রেমকে সর্বাগ্রে অবশ্যই স্বাধীন বা মুক্ত হতে হবে।

অবশ্য এটাও ঠিক যে, বুর্জোয়া আশাবাদ তরুণ বধূকে যা প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ভালোবাসা নয়। তরুণ বধূর চোখে যে-আদর্শের ঝলক তুলে ধরা হয়, তা হল সুখ। অর্থাৎ অবিচলতা এবং পুনরাবৃত্তির মাঝে শান্ত, সুস্থিত ভারসাম্য। সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার একটি নির্দিষ্ট যুগে এই আদর্শ ছিল সব বুর্জোয়াদের,বিশেষত জমির মালিকদের। ভবিষ্যৎ এবংবিশ্বকে জয় করা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল অতীতের শান্তিপূর্ণ সংরক্ষণ, স্থিতাবস্থা। উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং আবেগ ছাড়া সোনালি মধ্যম অবস্থা, যে-দিনগুলি কোথাও পৌঁছে দেয় না এবং যা অনির্দিষ্টকালের জন্য নিজেদের পুনরাবৃত্ত করে, একটি জীবন যা ধীরে ধীরে কারণের সন্ধান না করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়, এই ব্যাপারটিকেই সমর্থন করে ‘সুখের সনেট’-এর লেখক। এপিকুরাস এবং জেনোর এই দুর্বলভাবে অনুপ্রাণিত ছদ্ম-প্রজ্ঞা এখন তার কৃতিত্ব হারিয়েছে। বিশ্বের সংরক্ষণ এবং পুরোনো বিশ্বেরই পুনরাবৃত্তি কাম্য এবং সম্ভব বলে মনে হয় না। পুরুষের পেশাই হল কাজ করা। তাঁকে উৎপাদন করতে হবে, লড়াই করতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে, অগ্রগতি লাভ করতে হবে, মহাবিশ্বের সামগ্রিকতা এবং ভবিষ্যতের অনন্ততার দিকে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী বিবাহ নারীকে আহ্বান জানায় না স্বামীর সঙ্গে এই উত্তরণের পথে। অবিচলতার মধ্যে নারীকে তা বন্দি করে রাখে। অতএব একটি সুষম জীবন গড়ে তোলা ছাড়া আর কিছুই নারী প্রস্তাব করতে পারেন না, যেখানে বর্তমান কেবল অতীতকে দীর্ঘায়িত করে পরের দিনের অজানা ভয় থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য, অর্থাৎ যথাযথভাবে বলতে হলে, সুখ গড়ে তোলার জন্য। ভালোবাসার অনুপস্থিতিতে, তিনি তার স্বামীর জন্য বিবাহিত প্রেম নামক একটি কোমল এবং সম্মানজনক অনুভূতি উপলব্ধি করবেন; বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে তিনি সংসার পরিচালনার জন্য দায়ী থাকবেন। মানবপ্রজাতিকে চিরস্থায়ী করবেন তিনি। যদিও, কোনো অস্তিত্বই পুরুষের উত্তরণের পথকে পরিত্যাগ করে না, এমনকি যখন সে তা অস্বীকার করার জন্য জোর দেন, তখনও।পুরোনো বুর্জোয়ারা বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিষ্ঠিত নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করে, বুর্জোয়া সমৃদ্ধির মাধ্যমেই তার সদ্‌গুণাবলী প্রকাশ করে, বুর্জোয়া সমাজ ভগবান, নিজের দেশ, একটি শাসন ব্যবস্থা, একটি সভ্যতার সেবা করেছিল : খুশি থাকাই হল পুরুষ হিসাবে নিজের কাজ সম্পূর্ণ করা। মহিলাদের জন্যও অবশ্যই উচিত যে, বাড়ির সুসমঞ্জস জীবনকে অতিক্রম করে তাঁরা এগিয়ে যাবেন শেষের দিকে : পুরুষই নারীস্বাতন্ত্র্য এবং মহাবিশ্বের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করবেন, তিনিই মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে তার সম্ভাব্য সত্যতা গ্রহণ করবেন। স্ত্রীর কাছ শক্তি গ্রহণ করে উদ্যমী হয়ে, কাজ করে, সংগ্রাম করে একজন পুরুষই তাঁর স্ত্রীকে ন্যায্যতা দেন : স্ত্রীর একমাত্র কাজ হল পুরুষের হাতে নিজের অস্তিত্বকে সমর্পণ করা। বিনিময়ে পুরুষই নারীকে দেবেন তাঁর জীবনের অর্থ। স্ত্রীর পক্ষ থেকে এটা হল একটি বিনয়ী আত্মত্যাগ। তবে, স্ত্রীকেও এর জন্য পুরস্কৃত করা হয় কারণ পুরুষের শক্তি দ্বারাই তাঁকে চালিত করা হয়, রক্ষা করা হয়। পুরুষের এই শক্তি দ্বারা তিনি তাঁর প্রকৃত অবহেলা থেকে রক্ষা পাবেন। স্ত্রীও তখন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবেন। বিবাহেই জীবনযাপনের শক্তি এবং জীবনের অর্থ খুঁজে পায় নারীরা। আমাদের দেখতে হবে কীভাবে এই আদর্শ বাস্তবে রূপান্তরিত হয়।

বাড়ি, কুটির অথবা দুর্গেই বাস্তবায়িত হয়েছে সুখের আদর্শ। স্থায়িত্ব অথবা বিচ্ছেদকে মূর্ত করে তোলে এই আদর্শ। বাড়ির এই চার দেওয়ালের মধ্যে একটি পরিবার তার নিজের প্রকোষ্ঠ গড়ে তোলে। আর এই পরিবার নিজের পরিচয়কে নিশ্চিত করে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্য দিয়ে। আসবাবপত্র এবং পূর্বপুরুষের প্রতিকৃতির আকারে সংরক্ষিত অতীত ঝুঁকি ছাড়াই ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেয়; বাগানেতে ভোজ্য শাকসবজির মধ্যেই নথিবদ্ধ হয়ে থাকে প্রকৃতির চক্রাকারে আবর্তনের নিশ্চিন্ততা। প্রত্যেক বছর একই ফুল দিয়ে সজ্জিত একই বসন্ত ঋতু প্রতিশ্রুতি দেয় আবারও সেই একইরকম বসন্তের ফিরে আসার, শরৎকালও প্রতিশ্রুতি দেয় প্রত্যেক শরতের মতো একইরকম ফল-সম্ভার নিয়ে প্রত্যাবর্তনের : সময় এবং স্থান কোনোটাই অসীমের কাছে পালায় না, সুবিবেচনার সঙ্গে বৃত্তের মধ্যেই তারা ঘুরে বেড়ায়। যে-সব সভ্যতায় মহিলারা হলেন জমির মালিক, সেই সব জায়গায় গৃহের কবিত্ব এবং সদ্‌গুণকীর্তন-মূলক সাহিত্যের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যায়। অঁরি বরদো-র উপন্যাস ‘বাড়ি’-তে সকল বুর্জোয়া মূল্যবোধের সারাংশ লিপিবদ্ধ রয়েছে : অতীতের প্রতি আনুগত্য, ধৈর্য, অর্থনীতি, দূরদর্শিতা, পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, দেশের মাটি ইত্যাদি। প্রায়ই দেখা যেত, ‘বাড়ি’-র প্রধান হলেন মহিলারা, যেহেতু পারিবারিক গোষ্ঠীর সুখ নিশ্চিত করা তাঁদেরই কাজ। ‘ডোমিনা’ অলিন্দে বসার দিনগুলির মতো তাঁদের ভূমিকা ছিল ‘বাড়ির উপপত্নী’। আজকের দিনে‘বাড়ি’ হারিয়ে ফেলেছে তার পুরুষতান্ত্রিক বৈভব। সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষের জন্য এটি কেবল একটি আবাসস্থল। মৃত প্রজন্মের স্মৃতি সেখানে আর দৌড়ে বেড়ায় না এবং আগত শতাব্দীকেও তা বন্দি করে না। তাঁর মনের ‘ভেতরে’ প্রকৃত ‘বাড়ি’-র মর্ম এবং মূল্য প্রদানের। ‘ক্যানারি রোড’ গ্রন্থে স্টেইনবেক একজন ভবঘুরের বর্ণনা করেছেন যিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে যেখানে থাকেন, সেখানকার বাড়িতে পরিত্যক্ত পুরোনো সিলিন্ডারকে কার্পেট আর পর্দা দিয়ে সাজিয়ে রাখার জন্য জোর করেছিলেন : বৃথাই স্বামী আপত্তি জানিয়েছিলেন যে জানলার অনুপস্থিতি পর্দাগুলোকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলবে।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

 

0 Comments

Post Comment