- 03 September, 2022
- 0 Comment(s)
- 343 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
পর্ব-১
মার! মার! মেরে হার গোড় ভেঙ্গে দে!
চটাস, চটাস শব্দ, কিছু মানুষের কুৎসিত গালিগালাজ আর সেই সঙ্গে একটা মানুষের কাতর গোঙানি মিশে মুহুর্তের মধ্যে জায়গাটায় নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়। রহিমার পক্ষে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হয় না। একটু আগে পর্যন্ত সে যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছে। এর ওর কাছে হাত জোড় করেছে। পায়ে পড়েছে। কাতর মিনতি জানিয়েছে মানুষটাকে ছেড়ে দেবার জন্য। কেউ তার কথার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা জয়নালের কাছে যেতে চাইলে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে তাকে। রহিমার মনে হয়, জয়নাল যেন তার কেউ নয়। সে এখন ওই লোকগুলোর সম্পত্তি। ওরা চাইলে তার ছালচামড়া তুলে দিতে পারে। গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে দিতে পারে। জয়নালকে নিয়ে কি করা হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো স্থির সিধান্তে পৌঁছাতে পারেনি তারা। আলাপ আলোচনা চলছে। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে মানুষগুলোর মধ্যে বিরাট উত্তেজনা কাজ করছে। তাদের চোখ বড়ো বড়ো ও লাল হয়ে উঠেছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। রহিমার উপস্থিতিকে তারা গ্রাহ্যের মধ্যে আনছে না। সিধান্ত যাই হোক সেটা যে জয়নালের পক্ষে বিপজ্জনক হবে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে তাদের আস্ফালন শুনে।
রহিমার মাথা ঘুরতে শুরু করে। টলতে টলতে কোনোরকমে বাড়ি ফিরে এসে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে সে। সেই দুপুরের পর থেকে কাঁদার অবকাশও সে পায়নি। কান্নার দমকে দমকে বুকের ভিতর চাপ বাঁধা কষ্টটা গলে গলে ঝরে পড়তে থাকে। নিরবিচ্ছিন্ন কান্নার স্রোতে ভেসে যেতে পারলে ভালো হত। কিন্তু সেটা হতে পারছে না। প্রবল এক উৎকণ্ঠায় কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে সে। সঙ্গে সঙ্গে তার কান্না থেমে যায়, দু চোখ খট খটে হয়ে ওঠে, “ওরা মানুষটাকে কি খুব মারধর করছে?”
তাকে সান্ত্বনা দেবার কেউ নাই। পাড়ার মানুষজনদের বেশিরভাগ ঘটনাস্থলে ভিড় করে আছে। কিছুজন এখানে ওখানে জটলা বেঁধে বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে। জয়নালের পেটে পেটে এত শয়তানি ছিল, এটা ভেবে যার পর নাই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে তারা।
রহিমার ভিতর থেকে অন্য এক রহিমা এসে তাকে সান্ত্বনা দেয়—ভাবিস না, জয়নালের কিচ্ছু হবে না। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। রহিমা হাত জোড় করে ওপরঅলার উদ্দেশ্যে “তাই যেন হয় খোদা! ওই খ্যাপাধুপো মানুষটার ক্ষেতি যেন না হয়, তুমি দেকো!”
আজ পাঁচ বছরের ওপর জয়নালকে দেখছে রহিমা। প্রথম প্রথম জয়নালকে দেখলে তার ভয় করত, দূরে দূরে থাকতে চাইত সে। কিছুদিনের মধ্যেই রহিমা বুঝতে পারে, তার স্বামী আর পাঁচজনের মত নয়। একেবারে আলাদা। পাড়ার লোকজন তাকে “জয়নাল ক্ষ্যাপা” বললেও সে ক্ষ্যাপা নয়। সে নিজে যেমন সোজা-সরল, তার সব হিসেবও তেমনি সোজা-সাপ্টা। একটুও গরমিল সে ধরতে পারে না। গরমিল হলেই বাধে গন্ডগোল। এর প্রতিবাদ স্বরূপ সে লাফাঝাঁপা, চিৎকার চেঁচামেচি করে। আর সেটাকেই সবাই তার ক্ষ্যপামী বলে ধরে নেয়। জয়নাল বোবা নয়। গোটা কতক শব্দ জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে পারে। তাই দিয়েই মনের সমস্ত ভাব সে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। যারা অনেক দিন ধরে তাকে চেনে, তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। অন্যরা পারে না। জয়নালের মা ছেলের সব কথা বুঝতে পারে। এখন রহিমাও পারে।
রহিমার সাথে তার বিয়ের আগে জয়নালের সম্পর্কে সব খবরই ছিল রহিমার বাপের কাছে। ছেলেটা একটু উদোমাদা গোছের। তবে শরীর-স্বাস্থ্য ভাল। খাটতেখুটতেও পারে। মা ছাড়া আগেপিছে কেউ নাই। পাত্র হিসেবে জয়নালকে অপছন্দ হয়নি রহিমার বাপের। জয়নালের মানসিক ত্রুটিকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি চার মেয়ের বাপ রহমতুল্লা।
জয়নালের মা মানুষটা ভাল। রহিমাকে সে ভালবাসে। সাধ্যমত আদরযত্ন করে। রহিমার মলিন মুখ দেখে তাকে কাছে বসিয়ে সে বলে, “তুই পানিতে পড়েছিস এ ভাবনা মনে ঠাঁই দিসনাকো? ছেলেটো আমার আবোড়, কুনো বুদ্ধিসুদ্দি নাই এ কতা ঠিক। তবে ত্যার মনে কুনো ময়লা নাই। একেবারে ফেরেস্তার মতুন। তুকে কুনো দিনকার লেগে কষ্ট দিবে না। আর ক দিন যাক তু নিজিই বুজবি।” রহিমা চুপ করে শোনে।
জয়নাল ভ্যান রিক্সায় মাল বওয়ার কাজ করে। চারপাঁচটা গুদামের মালিক কুদ্দুস জয়নালকে পছন্দ করে। কাজে ফাঁকি নাই, কামাই নাই, মজুরি বাড়ানোর বায়নাক্কা নাই। জয়নালকে নিয়ে একটুআধটু অসুবিধে যে হয় না তা নয়। সেগুলো নিয়ে কুদ্দুস মাথা ঘামায় না। কুদ্দুসের কাছে আরো অনেকে কাজ করে। তারা জয়নালকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে মজা পায়। জয়নাল লাফায়, ঝাঁপায়, চিৎকার চেঁচামেচি করে। শেষে কুদ্দুশ এসে বুঝিয়েবাঝিয়ে তাকে শান্ত করে।
জয়নাল হিসাব বোঝে না। প্রতিদিন কাজের শেষে নগদ মজুরি মিটিয়ে দিতে হয় তাকে। দু টাকা কম দিলে যেমন সে নেয় না তেমনই বখশিশ হিসাবে দশ টাকা বেশি দিতে গেলেও বুঝতে না পেরে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বেশ কিছুদিন হয়ে গেল রহিমা এ বাড়িতে এসেছে। আজ পর্যন্ত জয়নাল রহিমার প্রতি কোনো খারাপ আচরণ করেনি। বরং রহিমাকে একটু সমীহ করেই চলে সে। মায়ের সাথেই তার যত মান অভিমান। প্রায় প্রতিদিনই রাতে খেতে বসে মায়ের ওপর চোটপাট করে। মাঝেমাঝে ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তার মা তার পাতে এটাসেটা তুলে দিতে চায়। এটা তার একেবারে অপছন্দ। সে খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ে। “অঁ-অঁ” শব্দ করে লাফাঝাঁপা করে। তারপর তার মা এসে অনেক সাধ্যসাধনা করে তাকে খাওয়ায়।
জয়নালের একটাই নেশা। রোজ কাজে বেরোবার আগে একতাড়া বিড়ি তার চাই। নিজে সে কিছু কিনতে পারে না। মায়ের বয়স হয়েছে। বিড়ি কিনতে ভুলে যায়। জয়নাল বিড়ি না পেয়ে চেঁচামেচি করে। মুড়ি ভর্তি টিফিন কৌটো ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মুড়ি ছড়িয়ে পড়ে উঠোনে। তার মা রাগ করে—“এ্যামুন ছেলে প্যাটে ধরেচি আল্লা! আমার মরণ হয় না ক্যানে?”
জয়নালের মা এখন মাঝেমাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। রহিমা বুঝতে পারে সারাজীবন ধরে এই অবোধ সন্তানটিকে সামলাতে সামলাতে তার মা ক্লান্ত, বিধ্বস্থ। তার এখন বিশ্রামের দরকার। রহিমা এসে সংসারের হাল ধরে।
জয়নালকে সে এখন বোঝে। বুঝি একটু বেশিই বোঝে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছাপিয়ে আরো কিছু সম্পর্কে জয়নালের সাথে জড়িয়ে যায় রহিমা। সেই সম্পর্ক মমতার, নির্ভরতার, সমব্যাথীর। খাওয়ার ব্যাপারে জয়নালের পছন্দ অপছন্দটি বুদ্ধিমতী রহিমা বুঝতে পেরেছে। এক থালা ভাত আর এক বাটি তরকারি তার চাহিদা। এর কম বা বেশি হলেই সে রেগে যায়। যা রান্না হয় তার থেকে খানিকটা করে নিয়ে একটা বাটি ভর্তি করে জয়নালের ভাতের থালার পাশে নামিয়ে দেয় রহিমা। জয়নাল খুশী খুশী খেয়ে নেয়।
তার নেশার ব্যাপারটিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবে রহিমা। বোকাসোকা মানুষ। কারো সাথে গল্পগুজোবও করতে পারে না। সবাই যখন গল্প করে তখনও সে কাজ করে। বিড়ি না পেলে হয়তো একদণ্ড জিরোবেও না। কাজে বেরোনোর আগে একতাড়া বিড়ি জয়নালকে দিতে ভুল হয় না তার। বৌয়ের দিকে তাকিয়ে একমুখ হেসে ওঠে জয়নাল, শিশুর হাসি। সে হাসির ছটা এসে লাগে রহিমার গালে।
পর্ব-২
বিয়ের চারবছর পরে একটি মেয়ে হয় রহিমার। জয়নালের মা না্তনিকে দেখে যেতে পারেনি। তার আগেই একদিন পুকুর ঘাটে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায় সে। আর জ্ঞান ফেরেনি তার। মায়ের মৃতুর পর উলটোপালটা আচরণ করতে থাকে জয়নাল। ঠিক করে খাওয়াদাওয়াও করে না। অকারণে রাগ করে। মায়ের বয়সি কাউকে দেখলেই তার ক্ষ্যাপামী আরো বেড়ে যায়। তখন তাকে সামলানো যায় না।
সেই সময়টা খুব কষ্টে কেটেছে রহিমার। মায়ের সমান শাশুড়ির মৃত্যু অন্যদিকে জয়নালের বাড়াবাড়ি রকমের ক্ষ্যাপামী। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না সে। জয়নাল কাজে যেতে চায় না। রহিমার জোরাজুরিতে যদি বা কোনদিন যায়, কাজ না করে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে।
কুদ্দুসের ম্যানেজার জলিল। কুদ্দুসের কারবারকে জড়িয়ে তার একটি নিজস্ব কারবার আছে। সে ভ্যান রিক্সা ভাড়া দেয়। কুদ্দুসের কাছে যারা কাজ করে তারা সবাই জলিলের কাছে ভ্যান ভাড়া নেয়। একমাত্র জয়নালের নিজস্ব ভ্যান আছে। জয়নালের ভ্যানটির ওপর তার অনেক দিনের লোভ। জয়নাল কিছুই বোঝে না। ওর মাও গত হয়েছে। এখন ওর বৌটাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে কমসমে যদি ভ্যানটা কেনা যায়, তা হলে দুদিক থেকে লাভ হয় জলিলের। ভ্যানটা বেশ মজবুত। অনেক দিন কোনো খরচাপাতি করতে হবে না। আবার ভাড়ার টাকাটাও পকেটে আসবে। জলিল জয়নালের বাড়ি এসে এ কথায় সে কথায় ভ্যান বিক্রীর কথাটা পাড়ে। জলিলের ফন্দি ধরতে পেরে যায় রহিমা।
আমার শাশুড়ি অনেক কষ্ট করে ভ্যানটি তার ছেলেকে কিনে দিয়েছিল। ও ভ্যান আমি বেচতে পারব না। রহিমার সাফ জবাব।
বেচা না বেচা তোমাদের ব্যাপার। তোমাদের কষ্টের কথা ভেবেই বলা। তাছাড়া পড়ে থেকে থেকে ভ্যানের কলকব্জা সব জং ধরে যাবে। তখন আমাকে বললেও আমি কিনব না। বিরস মুখে বিদায় নেয় জলিল।
রহিমার জীবনের এমন ঘোর দু্র্দিনে তার মেয়ের জন্ম হয়। মেয়ে জন্মানোর পর জয়নাল ধীরেধীরে সুস্থ হতে শুরু করে। কিছু শব্দ জয়নাল সহজে বলতে পারে। তার মধ্যে একটি হল “নিম”।
ন্যাকড়া জড়ানো শিশুটিকে প্রথম দেখে জয়নাল বলে ওঠে ‘নিম্’। তারপর থেকে মেয়েকে দেখলেই সে বলে— ‘নিম্’। আর মেয়েও ‘নিম’ ডাক শুনলে হাত পা নেড়ে তার খুশী জানিয়ে দেয়। মানুষটা কোনদিন কাউকে নাম ধরে ডাকতে পারেনি। সে ক্ষমতাই তার নাই। নিজের মেয়ের নাম ধরে ডেকে সে সাধ পুরণ হচ্ছে, হোক। বাপের মুখের ডাক শুনে মেয়েরও জীবন ধন্য হচ্ছে, হোক। জয়নালের অন্তর্জগতের যাবতীয় খুশীর, আনন্দের, উছ্বাসের একমাত্র শব্দবাহিত বহিঃপ্রকাশ হল ‘নিম’। এরথেকে মধুর শব্দ আর কি হতে পারে? রহিমা মেয়ের নাম রাখল নিম।
নিম এখন গুটগুট করে হাঁটে, আধোআধো কথা বলে। জয়নাল মেয়ে অন্ত প্রাণ। মেয়েও হয়েছে বাপ লাগোটা। যত হাসি-খেলা সব কিছুই তার বাপের সাথে। রহিমা যেন তার কেউ নয়। কাজ থেকে ফিরেই মেয়েকে নিয়ে পড়ে জয়নাল। এতদিন পর এমন একজনকে সে পেয়েছ, যে তার মনের সব কথা বুঝতে পারে। নিমও যেন অপেক্ষায় থাকে বাপের ফিরে আসার। তারপর তাদের খেলা শুরু হয়। রহিমা এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত।
কিন্তু এমন নিশ্চিন্ত জীবন রহিমার বেশিদিন সইল না। তার জীবনের আলোর উৎসটি অন্ধকারে চিরতরে হারিয়ে গেল। দিন কয়েকের বমি পায়খানায় নিম তাদের ছেড়ে চলে গেল।
কিছুদিন যেতে রহিমা মেয়ের শোক খানিকটা সামলে উঠলেও জয়নাল নিমকে হারানোর ধাক্কা সামলাতে পারল না। সে সারাক্ষণ নিমকে খুঁজে বেড়ায়। নিম আর নাই সে কথা তাকে বোঝানো যায় না। রহিমা বুকে পাথর চেপে জয়নালকে সান্তনা দেয়। রাতের আকাশে একটি জ্বলজ্বলে তারা দেখিয়ে বলে, “ওই দেখ, আমাদের নিম! ও আবার আমাদের কাছে আসবে। তুমি দেখো!”
জয়নাল দিন কতক একটু ভালো থাকে। আবার উলটোপালটা আচরণ করতে থাকে। সংসারে অভাব জাঁকিয়ে বসেছে। এরমধ্যে জলিল বার দুই এসেছে। রহিমার কঠিন মুখ দেখে নিরাশ হয়ে ঘুরে গেছে। রহিমা জানে সে আবার আসবে। ভ্যানটার লোভ সে ছাড়তে পারছে না। আর কতদিন অভাবের সাথে লড়াই করে ভ্যানটাকে রক্ষা করতে পারবে রহিমা নিজেও জানে না।
সকাল পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ, জয়নাল তখনো ওঠেনি। কুদ্দুসকে তাদের বাড়ি ঢুকতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে ওঠে রহিমা।
জয়নালের খবর নিতে এলাম। এখন কেমন আছ সে?
ওই আছে! একদিন ভাল তো, পরের দিন আবার যাকে তাই। এটি বুঝি আপনার মেয়ে? কুদ্দুসের কোল থেকে তার মেয়েটিকে কোলে নিতে হাত বাড়ায় রহিমা।
আর বোলোনা, এখানে আসবো বলে বেরিয়েছি, ওমনি সাথ ধরেছে? এবার ওকে নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরি বলতো? আমার কি আর একটা কাজ?
আপনি ঘুরে আসুন না? আমি রাখছি ওকে?
ঠিক আছে। দেখ, রাখতে পার কি না? খুবই চঞ্চল মেয়ে? মেয়ের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে হাসে কুদ্দুস। তারপর পকেট থেকে কিছু টাকা রহিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে এটা রাখ। জয়নাল কাজে গেলে ধীরে ধীরে শোধ কোরো।
কুদ্দুসের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বিগলিত রহিমা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। ওকি আবার কাজে যেতে পারবে?
কেন পারবে না? চাচি মারা যেতেও ওর এমন দশা হয়েছিল, দেখোনি? মেয়ের শোকও ঠিক সামলে উঠবে। জয়নাল মেয়েটাকে বড় ভালোবাসত কি না?
সবই আমাদের কপাল!
আমি তাহলে পটলের বাড়ি থেকে চট করে ঘুরে আসি। টুকু থাকুক। কিরে থাকবি চাচির কাছে? মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে কুদ্দুস। রহিমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় টুকু। এই বাড়িটি তার বেশ পছন্দ হয়েছে। কুদ্দুস চলে গেলে, সে দিব্যি ঘুরে ঘুরে খেলা করে বেড়ায়।
নিম ঠিক এইভাবে খেলা করত। আজ পাঁচমাস নিম তাদের ছেড়ে চলে গেছে। মেয়ের জন্য বুকটা মোচোড় দিয়ে ওঠে রহিমার। নিমের কথা ভাবতে ভাবতে একটুক্ষণের জন্য বুঝি অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে রহিমা। হঠাৎ টুকুর আর্ত চিৎকার শুনে চমকে উঠে তাকিয়ে যা দেখে, তাতে তার বুক কেঁপে ওঠে। জয়নাল টুকুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছে। আর টুকু নিজেকে মুক্ত করার জন্য প্রাণপনে চিৎকার করছে, হাত পা ছুঁড়ছে। ভয়ে তার মুখ ছাই বর্ণ হয়ে উঠেছে। রহিমা জয়নালের কাছ থেকে টুকুকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করতে গেলে সে টুকুকে আরো চেপে ধরে। টুকুর ছোট্ট শরীরটাকে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে দিতে চায় সে। তারপর ওই অবস্থায় সে টুকুর মাথায় গালে ঘাড়ে চুমু খেতে শুরু করে। রহিমা বুঝতে পারে এই অবস্থায় কিছুক্ষণ থাকলে টুকুর বিপদ হয়ে যেতে পারে।
“কি করছো? ছাড়ো ওকে? ছাড়ো বলছি?” তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে রহিমা। টুকুর কান্না, সেই সঙ্গে রহিমার চিৎকার শুনে অনেকেই এসে হাজির হয়।
কুদ্দুসও এরমধ্যে এসে পড়েছে। মেয়ের অবস্থা দেখে তার অবস্থা যা হবার তাই হয়। সে জয়নালের চুলের মুঠি ধরে উপর্যুপরি দেয়ালে তার মাথা ঠুকে দিতে থাকে। জয়নালের নাক মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত বের হতে শুরু করে। এক সময় জয়নাল নেতিয়ে পড়লে, তার কোল থেকে মেয়েকে ছিনিয়ে নেয় কুদ্দুস।
টুকু তখন প্রায় সঙ্গাহীন। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিলে কিছু সময় পরে সে কিছুটা সুস্থ হয়। তার সারা গায়ে জয়নালের তীব্র আদরের চিহ্নগুলো চিত্রবিচিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে। সেই নীল বেগুনী দাগগুলো দেখে মরমে মরে যায় রহিমা। সব তার দোষ। সে যদি টুকুকে নিজের কাছে রাখার কথা না বলত, তাহলে এমন অঘটন ঘটার সম্ভাবনাই ছিল না। পরম মমতায় টুকুর গায়ে হাত দিতে গেলে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে কুদ্দুস, “ছোঁবে না ওকে? তোমার কাছে বিশ্বাস করে রেখে গিয়েছিলাম। আমার সেই ভুলের মাসুল দিতে হল কচি মেয়েটাকে? প্রাণে বেঁচেছে তাই খুব! এখন এসেছ সোহাগ দেখাতে? সরে যাও!”
ওই মাগিটাও খুব হারামি। আপনি না এসে পড়লে কি হতো বুঝতে পারছেন? ভিড়ের মাঝখান থেকে বলে ওঠে জলিল।
জলিলের কথা কুদ্দসের কানে গেল কিনা বোঝা যায় না। সে মেয়েকে কাঁধে ফেলে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ করে। বাড়িতে গিয়ে কি জবাব দেবে সেই চিন্তা তাকে আছন্ন করে রেখেছে।
“ওটার কি বন্দোবস্ত করব বলে যান? আবার কার না কার মেয়ে ধরে টানাটানি করবে?” নেতিয়ে পড়ে থাকা জয়নালকে দেখিয়ে বলে জলিল।
তোরা যা পারিস কর। আমাকে ছাড়ান দে। কুদ্দুস বেরিয়ে যায়।
এরপর পুরো দায়িত্বটা জলিল নিজের কাঁধে তুলে নেয়। জয়নালের দ্বারা আরো অনেকের মেয়ে বৌয়ের ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। তাই তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া দরকার। জলিলের কথায় সবাই তাদের মেয়ে বৌয়ের সুরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সাব্যস্ত হয়, গাঁয়ের সকলের সামনে জয়নালের বিচার হবে। কুদ্দুসের মেয়েকে শারীরিক নিগ্রহ করার বিচার।
রহিমা প্রমাদ গোনে। টুকু সুস্থ হলে, সে ভেবেছিল বুঝি বিপদ কাটল। কিন্তু বিপদ এভাবে আসবে ধা্রণা করতে পারেনি রহিমা। সে হাত জোড় করে মিনতি করে, “ক্ষ্যাপা-ধুপো মানুষ। টুকুকে দেখে নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে গেছে। তাই ওমন করে ফেলেছে। ও যে খারাপ মানুষ নয়, তা তোমরা সবাই জানো। ওর যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে। ওকে মাপ করে দাও তোমরা”।
রহিমার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার মত সময় এই মুহূর্তে কারো নেই। জলিলের কথামত জয়নালের হাত পা বেঁধে, উঠোনের এক পাশে রাখা ভ্যানটায় চাপিয়ে হৈ হৈ করে চলে যায় তারা। জয়নাল কাতর চোখে রহিমার দিকে তাকায়। রহিমা কেঁদে পড়ে, “এটা তুমি কি করলে? তুমি কেন বুঝলে না ও আমাদের নিম নয়! আমি এখন কি করে তোমাকে বাঁচাই?”
এখন রাত কত হবে কে জানে? রহিমার চোখে ঘুম নাই। মানুষটা কি করছে কে জানে? সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। খুব মারও খেয়েছে নিশ্চয়? হঠাৎ ধুপধাপ আওয়াজে ধড়মড়িয়ে ওঠে রহিমা—এতো তারই পায়ের আওয়াজ? তবে কি ওকে ছেড়ে দিয়েছে, পাগল-ছাগল মানুষ ভেবে? হ্যাঁ সেই মানুষটাই তো?
“তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে? আহা! কি মার মেরেছে? জানে একটু মায়া হল না?” জয়নালকে দেখে ধড়ে প্রাণ ফিরে আসে রহিমার। সে জয়নালের গায়ে মাথায় হাত বুলোতে শুরু করে। রহিমাকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে উঁ উঁ করে কাঁদতে থাকে জয়নাল। “বেশ, বেশ, আর কেউ তোমাকে মারবে না? এবার শোও তো? শোও?” জয়নালের কান্না থামানোর চেষ্টা করে রহিমা।
দূরে কিছু মানুষের হট্টগোল কানে আসে রহিমার— “পালিয়েছে রে! পালিয়েছে”! রহিমার বুঝতে বাকি থাকে না, জয়নাল কোনরকমে ওদের হাত ফস্কে পালিয়ে এসেছে। এখন উপায়? জয়নালকে একবার যখন হাতে পেয়েছে, তখন ওই শয়তানগুলোর হাতে আর কিছুতেই ছেড়ে দেবে না সে। ফেরেস্তার মত মানুষটাকে একজন খারাপ মানুষ বলে দেগে দিতে চাইছে ওরা। সেটা কিছুতেই হতে দেবে না রহিমা। জয়নালকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। জয়নালকে টানতে টানতে ঘর ছেড়ে মাঠের দিকে ছুটতে থাকে। সামনেই গোরস্থান। একটা ভাঙ্গা কবরের কাছে গিয়ে জয়নালকে ঠেলে দেয় রহিমা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জয়নাল হুড়মুড়িয়ে গর্তের মধ্যে পড়ে যায়।
খানিক পরে লাঠিসোটা নিয়ে কিছু লোক জয়নালের খোঁজে তার বাড়িতে আসে। রহিমাকে একরকম ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢোকে। জয়নালকে ঘরে না পেয়ে যেমন দূদ্দাড় করে এসেছিল তেমনই দূদ্দাড় করে বেরিয়ে যায় তারা। ভয়ে বুক হিম হয়ে যায় রহিমার। জয়নালকে খুঁজে পেয়ে যাবে না তো? “মা গো! তোমার আবোড় ছেলেটাকে তোমার কাছে রেখে এসেছি। তুমি দেখো, কেউ যেন ওর খোঁজ না পায়!” কান্নায় গলা বুজে আসে রহিমার।
পরের দিন একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কামরায় সবাই দেখে, একজন মহিলা এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আর তাকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে যে লোকটি বসে আছে, তার গোটা শরীরে টাটকা আঘাতের চিহ্ন। সেখানে রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে। তার দু কষ বেয়ে লালা ঝরছে, সেই লালার রংও লালচে।
ও কি পাগল? একজন বৃদ্ধা শুধোয় রহিমাকে।
বোধ-বুদ্ধিহীন মানুষ!
তোমার সোয়ামী?
হ্যাঁ।
ওর গায়ে মাথায় অত আঘাতের দাগ কিসের?
গাছ থেকে পড়ে গেছিলো মা!
আহা গো! তা কোথায় নামবে বাছা?
ওই যে, তিনটে ইস্টিশান পরেই নামব।
ও! তাই বল? কুসমুড়ি যাবে? হ্যাঁ, তাই যাও। ওখানকার পীরবাবা খুব জাগ্রত। পীরের থান থেকে খালি হাতে কেউ ফেরে না।
কুসমুড়ি গাঁ, সেখানকার পীরের থানের কথা জীবনেও শোনেনি রহিমা। বৃদ্ধার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে কিছু একটা বলতে হবে বলেই বলেছে সে। এখন এই কথাটির মধ্য দিয়ে তার গন্তব্যহীন যাত্রায় একটা গন্তব্য খুঁজে পায় রহিমা। তিনটি ইস্টিশান পার হবার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে বসে থাকে সে।
0 Comments
Post Comment