মুসলিম উত্তরাধিকার বিষয়-আশয় : এক মেয়ের আত্মকথা

  • 13 February, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1399 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
শরিয়ত অনুযায়ী মৃত বাবার সম্পত্তির ১৬ আনার মধ্যে বিধবা স্ত্রীর অংশ থাকবে ২ আনা ও পিতৃহীন কন্যার অংশ হবে ৮ আনা। বাকি ৬ আনার ভাগ বণ্টিত হবে নিকট আত্মীয়দের মধ্যে। উত্তরাধিকারী কন্যা হওয়াতেই বেরিয়ে যাবে ৬ আনা?‌ 

উত্তরাধিকার। শব্দটির সঙ্গে মেয়েদের, বিশেষত মুসলিম মেয়েদের খুব একটা পরিচিতি নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে তা সন্তানের মধ্যে বিকশিত বাবা-মায়ের জিনঘটিত মানবিক / অমানবিক আবেগ, দোষ-গুণ কিংবা চেহারার মিল ইত্যাদির পরিচায়ক। কিন্তু বৈষয়িক উত্তরাধিকার— সোজা কথায় বাবার সম্পত্তির সমবণ্টনের আইনকানুনের সাথে মুসলিম মেয়েদের যোগাযোগ থাকে না বললেই চলে। “ভাগ্যে যা আছে তাই হবে”, কিংবা “ওসব মুরুব্বিরা ঠিক করে দেবেন”—  এই অবধিই মেয়েদের উত্তরাধিকারের ‘আইডিয়াটি’ সীমাবদ্ধ। অন্তত কিছুদিন আগে অবধি তো তাইই ছিল। মানে আমার এই চৌত্রিশ পার করা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জীবনে এটাই দস্তুর ছিল। তা বেশিরভাগ শিক্ষিত চাকরিজীবী বাবারা নিজের জীবদ্দশায় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির পাকাপোক্ত কাগজ এবং প্রয়োজনীয় উইল করে রেখে দেন পরিবারের সদস্যদের নামে। ফলে খুব বড় পরিবার কিংবা আত্মীয়দের বিশাল লতাপাতার তালিকা না থাকলে, শরিকি বিবাদে উচ্চশিক্ষিত শহুরে চাকুরে পরিবারের সদস্যদের এসব ঝামেলা পোহাতে হয় না। অন্তত আমার মুসলিম সহকর্মী বা বান্ধবীদের ক্ষেত্রে বৈষয়িক বাঁটোয়ারা নির্ঝঞ্ঝাটে সম্পন্ন হয়েছিল। আমার কেস শুনে তারা চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করেছিল— “সেকি,এসব কেন?‌ তোদের নামে কাকু কোনও উইল করে যাননি?”

যদিও ‘উইল করা’ ব্যাপারটা নিয়ে ভারত, বাংলাদেশের মুসলিমদের আবার নানা মুনির নানা মত। উইল করে যাওয়াটা কেউ বলে  “ইসলাম সম্মত”, কেউ বলে “না”। সে যা হোক, ওসব তর্কসিদ্ধ আইনের মারপ্যাঁচে যাচ্ছি না । 

যেটা নিয়ে লিখছি, সেটা নিতান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে যে লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হয়েছিলাম সেটা নিয়ে। এতে তার্কিক ব্যাপার নেই। নিতান্ত নিজের অভিজ্ঞতার কিস্যা।

এ প্রসঙ্গে আগেই বিধিমত সতর্কীকরণ দিয়ে নিই— শরিয়তি আইনে বাবার সম্পত্তির ভাগ নিয়ে আমাদের যেভাবে বোঝানো হয়েছিল, সেভাবেই আমার বাবার সম্পত্তির বাঁটোয়ারা হবে বলে মেনে নিতে হয়েছিল। তা সম্পূর্ণ ঠিক ছিল নাকি ভুল ছিল, আমার তাতে বিন্দুমাত্র কিছু যায় না আসলেও উত্তরাধিকারী কন্যা সন্তান হওয়ার ‘‌অপমান’‌ আজও আমাকে বিদ্ধ করে।

ছোটবেলা থেকেই জেনেছি আমি বড় বংশের মেয়ে। বড় বংশ মানে আকারে নাকি সম্মানে, তা এখনও পরিষ্কার হয়নি যদিও। আমার বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী এবং মা ছিলেন বেসরকারি কর্মচারী। ফলে একমাত্র সন্তান হিসেবে একটা আল্‌হাদী চকচকে জীবন পাওনা ছিল আমার। কিন্তু মনীষীর বচন অনুযায়ী বিত্ত দিয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কেনা গেলেও, শান্তি তো কেনা যায় না। ফলে দূরে দূরে চাকরি করা স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের ইগোর ‘পাঁকে-চক্রে’ একটি অনাকাঙ্ক্ষিত কন্যাসন্তান হিসেবে আমি জন্ম ইস্তক বলিপ্রদত্ত ছিলাম। আমার নাদুসনুদুস চেহারা, বালখিল্য সরল আচরণ কিংবা বোকা-বোকা হাসি সবকিছুর পেছনেই আমার মায়ের ‘বিপুল বেতনের চাকুরীরতা’ হওয়ার দোষ কিংবা ‘স্বামী-সংসারে আর পাঁচজন গাঁয়ের বধূর মত’ জানপ্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়া-কেই দায়ী করা হত।

আমার মায়ের শ্বশুরবাড়িটি ছিল মালদা জেলার একটা অজ গাঁয়ে, বৈরগাচ্ছি যার নাম। সেটিই আমার বাবার বাসস্থল, কর্মস্থল এবং তস্য জ্ঞাতিদের ভিটে জমি মাটি। মামাবাড়িটি কালিন্দী-র উল্টো দিকে অর্থাৎ মায়ের বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সীমানার অদৃশ্য কাঁটাতারে পাহারা দিত একটি নদী। এদিকে আমার জন্ম মায়ের কর্মস্থল আসানসোলে। বাবা-‌মায়ের মানসিক দূরত্বের যে কারণই থাক না কেন, ‘শান্তি’ শব্দটি আমার পরিবারে অনুপস্থিত ছিল ২০১০ সালে বাবার মৃত্যু পর্যন্ত এবং পরবর্তী আরও তিন বছর অবধি।

সারাজীবন আমার বাবার মেয়েদের প্রতি এক অদ্ভুত কট্টর জীবনদর্শন ছিল।
তাঁর মতে— মেয়েমানুষের উচ্চস্বরে হাসি-কাশি হতে নেই, ঢিলা জামা ছাড়া পরতে নেই, পুঁথিগত বিদ্যেশিক্ষার শেষে একটা বয়সের পর তাদের বাধ্যতামূলক ধর্মকর্মে মতি থাকতে হয়, মেয়েদের বেশি চাহিদা (খিদে, তেষ্টা, বিনোদন কিংবা সাজগোজ) থাকতে নেই, কারণ তারা ‘পরের সম্পত্তি’ এবং ‘বাপের কবরের মাটির হক নেই’ ... ইত্যাদি।

এদিকে আজন্ম শহরে বেড়ে ওঠা আমি ছিলাম এসবের একেবারেই উল্টো। স্বাধীনচেতা, উদারমনষ্ক, আউটডোর স্পোর্টসে চ্যাম্পিয়ন মা এবং নার্সেস হোস্টেলের সেকুলার পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠে আমার জীবনবোধ তৈরি হয়েছিল মুক্তমনা আধুনিকতার ছোঁয়ায়। সিনেমা-‌খেলা দেখে উচ্চস্বরে হা-হা অট্টহাসি, আধুনিক পোষাক, বয়েজ কাট চুল এবং ধর্মকর্মে অনাগ্রহ— এই ছিলাম আমি। ছুটিছাটায় দেশের বাড়ি গেলে ঠিক এইসব কারণেই বাবা সহ কেউই আমায় পছন্দ করত না বলা বাহুল্য। 

ফলে মালদার ওই গ্রামের প্রতি, ‘দেশের বাড়ি’ নামক যমালয়ের প্রতি আমার প্রচ্ছন্ন বিতৃষ্ণা, ঘৃণা ও রাগ জন্মেছিল মেয়েবেলা থেকেই। নিছক অতিথির মত স্কুলের ছুটি পড়লে ‘দেশের বাড়ি / বাপের বাড়ি’ বেড়াতে যাওয়া হত এবং পৌঁছানো মাত্র ফেরার দিন গোনাও শুরু হত মনে মনে। জীবনানন্দের পল্লীগ্রামের মত যে আমারটি নয় সেসব হাই স্কুলে উঠেই দিব্য বুঝেছিলাম।
আসলে বাবা-মায়ের ‘একমাত্র সন্তান’ (থুড়ি কন্যাসন্তান) হওয়াটাই ছিল আমার অপরাধ। ফলে আমার প্রতিও জ্যাঠার বাড়ির লোকজনের ভাব-ভালোবাসা কোনোদিন প্রকাশিত হয়নি। বরং সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে চাপা লালসা ও চাকরিওয়ালা বাপ-মায়ের ‘এত টাকা কে খাবে’ গোছের প্রশ্নের যথার্থ জবাব আমার মত নিরীহ বোকাসোকা মেয়ের কাছে না থাকায় জ্ঞাতিভাই এবং ভাইপোদের হিংসে ও উপহাসের পাত্রী হয়েই গোটা কিশোরীবেলাটা কাটাতে হয়েছিল। এ ব্যাপারে জানাই, আমার বাবা ও জ্যাঠার বয়সের ফারাক প্রায় উনিশ বছরের। ফলে জ্যাঠার দুই ছেলে (আমার দুই দাদা ছিল আমার মায়ের কাছাকাছি বয়সী) এবং তাদের ছেলেপিলেরা (আমার ভাইপো) ছিল আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়।   

যাইহোক, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের কিস্যা বাড়িয়ে লাভ নেই। এতটা বলার কারণ, আমার পরিবারের একটা রাফ ছবি মোটামুটিভাবে তুলে ধরা, যাতে ‘বাব্বা! একমাত্র মেয়ে... বাপের লাডলি বেটি তো!’ বলে আল্‌হাদে গলে যাওয়া পাঠকের কাছে মুদ্রার উল্টো দিকের চিত্রটিও সমান ভাবে দৃশ্যমান হয়। 

এবার মূল বিষয়ে ফেরা যাক। আজ থেকে দশ বছর আগে আমার বাবা ‘মাল্টিপল মাইলোমা’ রোগে মারা যান কলকাতার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন। সে সময় আমি চন্দননগরে চাকরিরতা, সদ্য প্রভিশনাল পিরিওড কেটেছে এবং মা আসানসোলের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার দোরগোড়ায়। একজন ক্যান্সার পেশেন্টের দেখভাল, হাসপাতালের যাবতীয় ফর্মালিটি ইত্যাদিতে, সারাটা জীবন আমার বাবা, তাঁর যেসব ভাইপো ভাইজিদের নিজের আত্মার অংশ, কলিজার টুকরো, দাফন-কাফনের জায়েজ কর্তা বলে চিহ্নিত করে এসেছিলেন তারা আমাদের মা-মেয়েকে কোনোরকম সাহায্য করতে পারবে না স্পষ্ট জানিয়েছিল। বাবাও তাল মিলিয়ে বলেছিলেন “ওরা এতদিন করেছে, এবার তোমরা শহুরে লোকেরা কর।” 

মৃত্যুর আগে দীর্ঘ চারমাসের কিছু বেশী সময় আমার বাবা সজ্ঞানে ছিলেন। অথচ রোগটা যেহেতু ক্যান্সার, ফলে পরিণতি আমরা সবাই জানতাম। তবু কঠিন স্নায়ুর অধিকারী হওয়ায় তিনি ফোনে দীর্ঘদিন খোসগল্প করেছেন, কিন্তু তবু তিনি বন্ধু বা শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে উইল করে রাখেননি।
“ মা-বেটিকে যা দেওয়ার তা শরিয়ত দেবে।”
“কবরের মাটির হক যাদের, তাঁদেরই সম্পত্তির ভাগীদার হওয়া সাজে। মেয়েছেলেদের নয়।”— ইত্যাদি অকাট্য যুক্তিতে অটল থেকেছেন কোমায় যাওয়ার আগের দিন অবধি। বহুবার আমি নিজেও বলেছি “আমার কিছু লাগবে না। তোমার যাকে ইচ্ছে তাকে সবকিছু লিখে দাও। তবে তোমার কাছে এটুকুই অনুরোধ জমিজায়গার কাগজপত্র নিয়ে ঝামেলায় আমায় যেন না জড়ানো হয়। সে ব্যবস্থা তুমি করে রেখ।”— সেই আর্জিটুকুও বাবা রাখেননি। বস্তুতই মালদার ওই গণ্ডগ্রাম থেকে বরাবর আমি পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছি। যে বাবার কাছে কন্যাসন্তান হিসেবে শুধু বঞ্চনাই পেয়েছি, তার জমি জায়গার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার কোনোকালেই ছিল না। আমি শুধু একটা একাকী স্বাধীন চাকরিরতা জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম মাকে নিয়ে।

কিন্তু বিধি বাম। মৃত্যুর পর চারদিনের (‌চাহরম)‌ কাজের আগের দিন থেকে আমায় সেই চরম অপ্রিয় ঝামেলায় পড়তে হল। ঘটনার সুত্রপাত বাবার মোটরবাইক বিক্রি নিয়ে। সেটি এক বিবাহবার্ষিকীতে আমার মা উপহার দিয়েছিলেন বাবাকে। সারাজীবন বাবার সঙ্গী ছিল সেটি। কিন্তু অসুখে পড়া মাত্রই সেটি আমার নিকট আত্মীয়র হস্তগত হয়। এবার কোনও পিছুটান না থাকায়, গ্রামের একজন সেটি কেনার প্রস্তাব রাখলে মা স্বভাবতই রাজী হয়। সেখানেই আঁচ পেলাম ক্ষোভের। ‘‌শরিয়তের ভাগ’‌ কি মোটরবাইকেও থাকে?‌

চারদিনের কাজ ‘চাহরম’ মিটে গেলে আমরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে (চন্দননগর ও আসানসোল) ফিরে যেতেই ওদিকে শুরু হল দাঁতনখে শান দেওয়ার পালা। ইতিমধ্যে আমাদের জানানো হয়েছে শরিয়ত অনুযায়ী মৃত বাবার সম্পত্তির ১৬ আনার মধ্যে বিধবা স্ত্রীর অংশ থাকবে ২ আনা ও পিতৃহীন একমাত্র কন্যার অংশ হবে ৮ আনা। বাকি ৬ আনার ভাগ বণ্টিত হবে জ্ঞাতি ভাইগণ ও তস্য পুত্রদের মধ্যে। আমরা সেই অনুযায়ী সবাইকে তুষ্ট করেই কাজ করব বলে অঙ্গীকার বদ্ধ হয়েছি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই খবর আসতে লাগল আমবাগান, বাঁশবাগান, বসতবাড়ি সহ নানা কিছুর বলপূর্বক দখলদারি করছে কিছু উটকো লোকজন।

কারা করছে ?
আমার ছোট পিসির ছেলেরা। কেন ও কোন অধিকারে করছে? তারা স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে লিখিয়ে আনিয়েছে শরিয়তের আরেক নিয়ম— ‘কোনো মৃতের সহদোর ভাই / দাদা যদি প্রয়াত হয়ে থাকে, তবে তাঁর পিতৃহীন (এতিম) ছেলেরা সদ্যমৃত কাকার সম্পত্তির কোনও অংশই পাবে না। ফলে উক্ত মৃতের ৬ আনা অংশের ভাগীদার হবে জীবিত ভাই/বোনের পরিবার।’  এই যুক্তিতে আমার একমাত্র জীবিত পিসির পরিবার এই ৬ আনা ভাগের সম্পত্তি দখলে উঠেপড়ে লাগল। তারা কোনোদিন আমাদের বাড়ি আসেনি, বাবার খোঁজখবর নেয়নি এবং কোনও যোগাযোগও রাখেনি দীর্ঘদিন। গ্রামের খাপ পঞ্চায়েত যখন সম্পত্তির ভাগীদার নিয়ে সালিশি বসিয়েছিল তখনও তারা গরহাজির থেকেছে, শুধুমাত্র এক টুকরো কাগজের উপর আস্থা রেখে। কারণ ওই মাদ্রাসার কাগজটিই তাদের ‘হকের সম্পত্তি’ পাইয়ে দেবে। এমতাবস্থায়, মায়ের কাছে প্রচুর ফোন আসতে লাগল জ্যাঠতুতো ভাইদের পরিবার থেকে। প্রথমে অনুনয় এবং তারপর হুমকি। যেহেতু তারা কাকার ঘনিষ্ঠজন হয়েই কালাতিপাত করেছে, ফলে আমরা যেন তাদের নামে বসতবাড়ি ইত্যাদি লিখে দিই। নইলে পিসির ছেলেরা তাদের ভাগের সবটা খেয়ে নিলে কিছুই পড়ে থাকবে না। আমার ছোটমামা তখন জানালেন, আইনানুযায়ী বসতবাড়িটির উপরও ২ আনা + ৮ আনা + ৬ আনার ভাগ থাকে। ফলে আমাদের একার সিদ্ধান্তে কারোর নামে সেটি লিখে দেওয়া যায় না। এই যুক্তি খুব কষ্টে হলেও সকলে মেনে নিল, কিন্তু জ্ঞাতিভায়েরা হজম করল না। এ প্রসঙ্গে জানাই, আমার বাবার দুটি বাড়ি ছিল। একটি বৈরগাচ্ছি গ্রামে, অন্যটি পীরগঞ্জ গ্রামে।

বাবার মৃত্যুর চল্লিশ দিনের কাজের আগেই আরও একবার খবর এল জ্ঞাতিজনেরা আমাদের জমির সামনের দিকের অংশগুলি নিজেদের নামে করিয়ে নিচ্ছে। আসলে বাবার জমির দলিলে আলাদা প্লটের উল্লেখ ছিল না, ভাই-ভাইপোদের সাথে মিলিজুলি করেই জমির এপারওপার ভাগাভাগি চাষ করা হত। এবার ওরা সেই জমিগুলির সামনের বড় রাস্তার দিকের ভাল ও উর্বরা অংশগুলি নিজেদের নামে পাকাপাকি রেকর্ড করিয়ে নিচ্ছে। যাতে পরিত্যক্ত আমাদের অংশগুলি বিক্রি করতে খরিদ্দার পেতে অসুবিধা হয়। পেছনের ডোবা, নিচু অংশের দাম স্বভাবতই কম হবে— ফলে লোকসান যা হওয়ার আমাদের হবে।

এরকম চরম বিশৃঙ্খলায় মানসিক ও শারীরিক চাপে আমাদের শরীর আর দিচ্ছিল না। মায়ের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছিল। আমাদের অংশের জমি ও বাগানগুলি বিক্রি করা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু সেসব বিষয়ের হদিস আমাদের সম্পূর্ণ অজানা। কোথায় সেসব আছে? কীভাবে বিক্রি করতে পারব? কেমন সেসবের দাম ইত্যাদি কিছুই জানি না।

ক্রমাগত হুমকি ও শাসানির চোটে এবং এসব উটকো অবাঞ্ছিত ঝামেলায় খামোকা জড়িয়ে পড়ায় দিশেহারা অবস্থায় আমার রাগ, বিরক্তি এবং সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমি মরিয়া হয়ে সব ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম মাকে। কিন্তু মা এত সহজে ছেড়ে দিতে চাইল না। যখন ওরা ইঁট ছুঁড়েছে তার বদলে পালটা পাটকেল না হোক, নিজের হকের জিনিস ছাড়ব কেন? ফলে বিষয়ের বিষ থেকে জীবন ও সম্মান বাঁচিয়ে পরিত্রাণ পাওয়ার ইচ্ছে ফিকে হতে লাগল। স্পষ্ট বুঝলাম সহজে এসব শরিকি বিবাদ এবং নিজেদের মানহানী মেটার নয়।

মায়ের প্রতিও আমার বিরক্তি জন্মালো। একদিকে যখন আমি সব ছেড়ে মালদা থেকে অনেক দূরে একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চাইছি, অন্যদিকে মা তখন চাইছে জল যখন ঘোলা হয়েইছে তখন এর বিহিত করে একটা সুষ্ঠু সমাধান হোক। অথচ এরকম চতুর্মুখী ঝামেলার সমাধান আমাদের কারোর জানা নেই। এক অদ্ভুত অশনী সঙ্কেত মিশেছিল সেদিনের বাতাসে।
 
সবারই মতামতে ঠিক হল বাবার ‘চল্লিশা’র কাজে এসব নিয়ে ফাইনাল বৈঠক হবে। সব পক্ষকে ডাকা হল। সেখানে মা সর্বসমক্ষে একটা প্রস্তাব রাখল— ‘আমাদের মা-মেয়ের (২আনা + ৮আনা )= ১০ আনা অংশ আমরা যাকে ইচ্ছে বিক্রি করব তার উপর অন্যদের খবরদারি চলতে পারে না। কিন্তু বাকি ৬ আনা অংশের দাবীদার কে হবে তা দেখার দায় আমাদের নয়। সুতরাং ওই বাড়তি অংশের ব্যাপারে যেন আমাদের টানাটানি না করা হয়।’ তারপরেও মানবিকতার খাতিরে এটুকুই আর্জি রাখা হল যে, ‘যে জ্ঞাতিভাই ও তাদের ছেলেরা তাদের কাকার শেষ দিনগুলোয় পাশে থেকেছিল, রোগশয্যায় নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছিল এবং কবরে মাটি দিয়েছিল তারা কিছু না কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়েই কর্তব্য পালন করেছে। এখন তাঁদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করাটা যতই শরিয়ত সম্মত হোক না কেন, অমানবিক হবে। তাই যারা (ছোট পিসি ও তার ছেলেরা) মাদ্রাসার কাগজের উপর ভিত্তি করে ৬ আনার অংশের সবটুকু চাইছে, তারা যেন এ ব্যাপারে কিছুটা উদার হয়ে বসতবাড়ির অংশিদারি ছেড়ে দেয় (কারণ আমার জ্যাঠার ছোট ছেলের তখনও মাটির বাড়ি এবং বাবা চাইত তার মৃত্যুর পরে সেই ছেলে পরিবারসহ ওই বাড়িটি পাক) যাতে ওই বাড়ির উপর আমাদের ১০ আনা অংশটুকুও ছেড়ে বাড়িটি ওদের দিতে পারি।’ এতে পিসির পরিবারও যেমন বাকি অংশ পাবে, তেমনি জ্যাঠার ছেলের পরিবারও কিছু পাবে। ফলে দুই বিবদমান পক্ষেরই এরকম মধ্যপন্থায় লাভ বেশী, ক্ষতি কম।

বলাবাহুল্য মায়ের এই প্রস্তাবে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেও, গ্রামের সালিশি সভার কোনও সভ্যই কোনোরকম উচ্চবাচ্য করল না। এমনকি যাদের হয়ে মা কথা বলল, সেই খুড়তুতো দাদারাও গুম হয়ে রইল। বোঝা গেল যুক্তির কাছে নিরব হলেও, মনে মনে কেউই সূচাগ্র ভূমি ছাড়তে রাজী না! সবটাই নেব— সবার ইচ্ছে। সভা নিস্ফলা রইল। রাতে আবার ঘরোয়া মিটিঙে সেই আমাদের কাছেই দুই খুড়তুতো দাদা পালা করে এসে আর্জি জানাল আমরা যেন কোর্ট পেপারে কিছু লিখে দিই, নইলে যে স্বার্থের জন্য এতদিন ধরে তারা কাকার কাছাকাছি প্রিয়পাত্র হয়ে থেকেছে সেই প্রচেষ্টাটুকু মাঠে মারা যাবে এবং ৬ আনা সম্পত্তির সবটুকু লাভের দই নেপোয় মেরে নেবে। আমরা স্বভাবতই তাতে রাজী হলাম না। আমরা অনড় অবস্থানে জানালাম— বৈরগাচ্ছির বসতবাড়িটি মুফতে ছেড়ে দেব, যদি ওই বাড়ির উপর পিসির পরিবার ওদের ৬ আনা অংশটুকু ছেড়ে দেয়। নইলে এভাবে কোর্ট পেপারে খামোকা সই করতে পারব না।

বিনাকারণে এসব উটকো ভাগবাঁটোয়ারার ঝামেলায় হয়রানিতে আমার মাথায় তখন রক্ত চড়ে গেছে, আমি চাইছি সব কাগজপত্র ছিঁড়ে আগুন ধরাতে। কিন্তু মায়ের কথার উপর আমার কোনও কথাই ধোপে টিকছে না।

এর কিছুদিন পর ‘‌জানতে’ পারলাম‌ আত্মীয়রা আমাদের অজ্ঞাতেই নানাভাবে জাল কাগজ তৈরি করে আমাদের ভাগটুকুও নিজেদের নামে করিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। কেউ কেউ আমাদের প্রাণ সংশয় নিয়ে সাবধান করতে থাকল। আমরা সত্যিই ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। আমার মাথায় তখন কেবল একটাই চিন্তা— যে করেই হোক মালদা থেকে সবরকম যোগাযোগ কেটে ফেলতে হবে। লাভক্ষতির চেয়েও বড় ব্যাপার আমার কাছে ছিল শান্তি, শুধুমাত্র শান্তি। ফলে বাবার দুটি বাড়ি এবং শরিয়তি বাঁটোয়ারায় পাওয়া জমি জায়গা বিক্রি করে দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম।

খরিদ্দারও জুটল। কিছুদিন পর জমি বিক্রির জন্য রেজিস্ট্রি অফিসের বারান্দায় অপেক্ষা করছি। ক্রেতা তখনও আসেনি। কিছু সময় পরে ক্রেতা এসে জানালো, “বিক্রি হবে না।” সে এমন ডিস্পুটেড প্রপার্টি কিনবে না। কেন? নানা অস্পষ্ট কথাবার্তায় মোদ্দা কথা বোঝা গেল যে, আমার জ্ঞাতিভাইয়েরা নাকি একটি রটনা ছড়িয়েছে গোটা গ্রামে যে, আমি একটি হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করে পালিয়ে গেছি। ফলে ভিন্ন ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য আমার মুসলিম বাপের সম্পত্তির প্রাপ্য অংশের সবটুকুই বেআইনি বলে গণ্য হবে। শুনে তো আমি হেসে বাঁচি না। এমন ঢপের প্রমাণ কী ? তারা বলে সেই বিয়ের নাকি ভিডিও ফুটেজও রয়েছে তাদের জিম্মায়! জমি বিক্রির কোনও চেষ্টা করলে তারা কোর্টে সেসব প্রমাণ দিয়ে দেখাবে আমরা অবৈধ কাজ করছি। মরিয়া হয়ে মা পালটা যুক্তি দিল— প্রথমত এই ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যে। আর যদি এমন কিছু ঘটতও তাও বিয়ের আগে অবধি তো সে একজন মুসলমান বাবারই সন্তান। বিয়ের পরে তার ধর্ম যাই হোক না কেন, তা বলে তার মুসলিম বাবার নাম তো বদলে যায় না। সে যে ওই বাবারই মেয়ে তাও বদলে যাবে না কোনোদিনই।

ক্রেতা তবু নারাজ। আমি এবার নাছোড় জেদে বললাম,— “জমি বিক্রি করব এবং আজকে এই মূহুর্তেই করব। আপনি না কিনলে অন্য খরিদ্দার দেখব। আমার বিরুদ্ধে যার কোর্টে যাওয়ার সে যে কোনো অভিযোগ নিয়ে, প্রমাণ নিয়ে যেতে পারে। বাকিটা আমি বুঝে নেব। কিন্তু জমি বিক্রি আজই হবে। এসব কুৎসা ও রটনার চেয়ে আমার সময়ের মূল্য অনেক বেশি দামি।” আমাদের জেদের কাছে এবার ক্রেতা বিপাকে পড়ল। বারবার বুঝিয়ে বলার পরে অগত্যা তাকেই আমাদের ভাগের জমি কিনতে হল। আমাদেরও প্রথম পর্বের রেজিস্ট্রি সাঙ্গ হল। এভাবেই পরবর্তী প্রায় তিন বছর ধরে একে একে আমাদের অংশের জমি বিক্রি হয়েছিল বিশাল নাটক ও অমানুষিক টেনশানের মধ্য দিয়ে।

একথা আমি আজীবন স্বীকার করব যে, আমরা মা-মেয়ে বাবার সম্পত্তির শরিয়তি ১০ আনা ভাগের যে উচ্ছিষ্টাংশের ন্যূনতম দাম যেটুকু পেয়েছি— ওটুকু না পেলেও আমাদের দিব্য চলত। নিজের শিক্ষা জ্ঞানবুদ্ধি সবকিছুর উপর ভরসা চলে যায় এতে। 

বাবা মারা যাওয়ার পর আমি সবার অলক্ষ্যে একটা ছোট্ট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম এই ভেবে যে, এবার আমার মত করে জীবন গড়ব। মাকে নিয়ে দেশভ্রমণ করব মন দিয়ে। মায়ের বিয়ের ছাব্বিশটি আতঙ্কের বছর ফিরিয়ে না দিতে পারলেও, অন্তত ভয়ে ভয়ে বাঁচা জীবনে যা কিছু এতদিন আমরা সাজিয়ে উঠতে পারিনি, মায়ের অবসর জীবনে আমি নিজে হাতে সেসব সাজিয়ে দেব। আমাদের আর কোনও নির্ঘুম আতঙ্কের রাত পার করতে হবে না।

কিন্তু কী ভাবলাম আর কী পেলাম! এখনও ভাবি, কী এমন হত ওদের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিলে? ওদের কী হত তা ওদের ব্যাপার, তবে চার বছর ধরে এই সীমাহীন আতঙ্ক, টেনশন, মানসিক চাপ এবং ছোটাছুটির ধকল থেকে আমরা মা-মেয়ে তো অব্যাহতি পেতাম। বৈষয়িকভাবে আমি চিরকালই উদাসীন প্রকৃতির মানুষ। অঙ্ক বুঝি না, মানুষজন চিনি না, মিশুকেও নই। তবে এটুকু হাড়েহাড়ে জানি— যেখানে সম্মান, ভালোবাসা নেই, সেখানে যেচে অপমানিত হতে আমার যাওয়া চলে না। একটা নিরুপদ্রব জীবন কাটাতে হলে এটুকু সত্য কি যথেষ্ট নয়?
কিন্তু আমার ভাবনাকে কেই বা মূল্য দিয়েছে! মাকে এখনও বুঝিয়ে পারি না যে, একটা সাদামাটা পাতি শান্তিপূর্ণ জীবনই তো চেয়েছি— উত্তরাধিকারের শিকল আর শরিয়তি হাঁড়িকাঠে সেটুকু কুরবানি না দিয়েও তো থাকা যেত। বাবার মৃত্যুর আগে অবধি পারিবারিক হিংসার শিকার হয়েছি আর বাবার মৃত্যুর পরের চারবছর দীর্ঘ ফালতু অসম অযৌক্তিক লড়াইয়ে সেই হিংসারই শিকার হলাম।

এর বেশি কিছু বদল কি উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে নামা মেয়েদের জীবনে ঘটে? কে জানে কিছুক্ষেত্রে হয়ত ঘটে, সেগুলো খবর হয়; আর আমাদের মত পাতি জীবনগুলো ঘটনার ঘনঘটায় চাপা পড়ে পড়ে একদিন ফসিল হয়ে যায়।

পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৭ জুলাই ২০২০

ছবি  : প্রতীকী

লেখক  :‌ স্কুল শিক্ষ‌ক

0 Comments

Post Comment