মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের ব্যবহারিক বাস্তবতা : কিছু তথ্য

  • 29 October, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 876 view(s)
  • লিখেছেন : গার্গী     
মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে শ্বশুর বেঁচে থাকাকালীন কোনও মহিলার স্বামীর মৃত্যু হলে তার সন্তানদের উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, ক্রমশ আন্দোলনের চেহারা নিচ্ছে এই অভিযোগ ।    

বাঁকুড়া জেলার বাসিন্দা সাগেরুন্নেসা বিবি, রাজিনা, নূর আফসান, ইদ মহম্মদ এবং আরও কেউ কেউ— যাঁরা সম্পত্তি সংক্রান্ত উত্তরাধিকার আইনের জালে, হকের পাওনা থেকে বঞ্চিত বলে অভিযোগ করছেন। তাঁদের মুখোমুখি বসে যে বিষয়গুলো জানতে পেরেছি তারই কিছু নমুনা—

সাগেরুন্নেসার বয়স সাতাশ। বাবা মারা যান। দাদু তখনও জীবিত। তাই তিনি এবং তাঁর মা দাদুর কোনও সম্পত্তি পাননি। সব সম্পত্তি পেয়েছেন তাঁর জ্যাঠা। সাগুরুন্নেসার মা তাঁর বাবার বাড়ি থেকে পাঁচকাঠা জায়গা পান। সেটাই মূলত ছিল তাঁদের দিন কাটানোর অবলম্বন। সাগেরুন্নেসার কথায়— আমার স্বামীও আবার বিয়ে করেছে। আসলে এই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আমাকে বিয়ে করেছিল। আমার দুই সন্তান হওয়ার পর আবার আগের তালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিয়ে করল। তাকে বিয়ে করার পর শুরু হল আমার ওপর অকথ্য অত্যাচার। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত তালাক নিতে বাধ্য হই। দুই সন্তান নিয়ে আমি ফিরে আসি মায়ের কাছে। মা তাঁর পাঁচ কাঠা জমি আমাকে লিখে দিলেন। দাদুর আগে বাবা মারা গেলেন বলে বঞ্চিত হলাম। স্বামীর অত্যাচারে তালাক নিয়েছি বলে আমার সন্তানরাও বঞ্চিত হচ্ছে। ওদের বাবা ছেলেদুটোর খাওয়া-পরার কোনও দায়িত্ব নিচ্ছে না। এর বিচার কেন হবে না?

নাসরিমার বয়স সাতাশ। তাঁর ছেলের বয়স এক বছর আট মাস। স্বামী মারা গেলেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। বাচ্চার বয়স এখন তিন বছর। বাবার বাড়ি থাকেন। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন। পাড়ার ছোট বাচ্চাদের পড়ান। আর সেলাই শেখেন। বাচ্চাকে তো বাঁচাতে হবে। গ্রামের লোকজন নাসরিমার  স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে চেষ্টা করছেন তাঁর শ্বশুরকে বুঝিয়ে বাচ্চার নামে কিছু সম্পত্তি লিখে দিতে। কিন্তু এখনও তা সম্ভব হয়নি। নাসরিমা বললেন, বিয়ের সময় নগদ এক লাখ টাকা, সোনা, মোটর সাইকেল আর আসবাব মিলিয়ে তিন লাখ টাকার জিনিস দিতে হয়েছে। ওদের অবস্থা ভালো। আমার ছেলেটাকে যদি কিছু একটু লিখে দেন শ্বশুর সেই অপেক্ষায় আছি। শ্বশুরের অবর্তমানে সব সম্পত্তি অন্য ছেলেদের হয়ে যাবে। তখন তো আর চাইতে পারব না।

বাঁকুড়া জেলার ইদ মহম্মদ। তাঁর ছ মাস বয়সে বাবা মারা যান। তিনি এবং তাঁর দিদিকে নিয়ে মা শ্বশুর বাড়িতেই থেকে গেলেন। কিন্তু কোনও দাবি রইল না। দাদু কোনও সম্পত্তি লিখে দেননি। ইদ মহম্মদ দাদুর বাড়ির একটা ঘর ব্যবহার করেন মাত্র। শুধু দয়ার দানে। কোনও অধিকার নেই। মা মারা গেছেন। দিদির বিয়ে হয়েছে। ইদ মহম্মদের ছেলেরাও বড় হয়েছে। কিন্তু বঞ্চনা আর অসম্মানের জ্বালা তাঁর বুকে মোচড় দেয়। দাদুর কোনও সম্পত্তিতে তাঁর অধিকার বর্তালো না। খুব আর্থিক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। ভবিষ্যতে কারো যেন আর এই দুর্দশা না হয়। তাই ইদ মহম্মদ মনে করেন বাবা মারা গেলেও বাবার পুরো সম্পত্তি যেন তাঁর সন্তানদের ভাগে যায়, দেশে সেইরকম আইন হওয়া দরকার। নূর আসমান বিবির বিয়ে হয় চৌদ্দ/পনেরো বছর বয়সে। বিয়ের সময় দিতে হয়েছিল নগদ টাকা, গয়না। তিন সন্তান। দশ বছর যৌথ জীবন কাটানোর পর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেন। স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাঁকে ঘর ছাড়তে হয়। স্বামীর কাছ তিনি তাঁর সন্তানদের ভরণপোষণ আদায়ের জন্য আইনের সাহায্য চান।

হুগলি জেলার যে অঞ্চলটিতে সমীক্ষার কাজে যায় সেখানেও একই অভিজ্ঞতা হয়। গ্রামের ওই মহিলারাও ক্ষোভ উগরে দিয়েই বলেন, সন্তানদের কি বাপের বাড়ি থেকে মেয়েরা আনে? স্বামীর মৃত্যু হলে দাদুর সম্পত্তি কেন বাচ্চারা পাবে না? শরিয়তের কথা বলে যারা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে, তাদের মধ্যেই দেখা যায় অনেককে পণ নিতে। অথচ পণ নেওয়া হারাম। সে ব্যাপারে কোন প্রতিবাদ নেই। অভিযোগের পাশাপাশি নানা  অভিমতও পাওয়া গেছে। তা সদর্থক পদক্ষেপেরই ইঙ্গিত  দেয়। সেই পদক্ষেপ যা প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেখায়।

সৌজন্য সাম্প্রতিক

প্রতীকী ছবি

লেখক সমাজকর্মী

 পুনঃপ্রকাশ।  প্রথম প্রকাশ ২৯ মে, ২০২০

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment