- 01 March, 2023
- 0 Comment(s)
- 512 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
“জান শেষ আর গান শেষ, তো একই কথা হইল রাজামশাই!”
নেহা সিং রাঠোর অবশ্য এই ভাবে ভেঙে পড়েননি। দৃপ্ত কন্ঠে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন নাগরিক হিসেবে তাঁরও অস্ত্র সংবিধান। সেই সংবিধানকে মান্যতা দিয়েই গান গাওয়া বন্ধ করা অথবা সামাজিক মাধ্যমগুলি থেকে তাঁর গাওয়া গানগুলির রেকর্ডিংকে নামিয়ে নেওয়া, এর কোনওটাই তিনি করবেন না। উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা নেহা সিং রাঠোর গত বেশ কিছুদিন ধরেই খবরের শিরোনামে। একবার সেই ঘটনাকে ঝালিয়ে নেওয়া যাক চলুন। নেহা লোকসঙ্গীতশিল্পী। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি এই লোকসঙ্গীতশিল্পী বলেই থেমে যাওয়া উচিত নয়। নেহা লড়ছেন ভোজপুরি ভাষার অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনে। বাউল অথবা ঝুমুর গান নিয়ে আমরা অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে থাকি। কিন্তু শহুরে জনগণ, তাঁদের অধিকাংশের কাছেই ভোজপুরি গান মানে এখনও ধাপধাড়া হলগুলোর ম্যাটিনি শো’য়ে চলা বি-গ্রেড সমস্ত সিনেমার রগরগে জগঝম্প বাজনা-সহযোগে চটুলস্য চটুল গান মাত্র। বড়জোর ‘বিহারি’দের ‘বিয়ের গান’ হিসেবেই আমরা ভোজপুরিকে মান্যতা দিয়ে এসেছি। কিন্তু বিগত দুই-তিন বছরে একলাটি নেহাই ভোজপুরি ভাষার যে একটা বিশেষ অন্তর্গত ঝংকার রয়েছে, তাকে ব্যবহার করে সেই ভাষাতেই কেবল যে গান লিখেছেন বা গেয়েছেন তাই নয়, বিশেষ ভাবে সেই গানের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তুলতে চেয়েছেন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের বিষয়ে। তাঁর গানে উঠে এসেছে বিহার, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন, মরবি সেতুতে দুর্ঘটনার কারণে অগণিত মানুষের মৃত্যুর খবর, যোগীরাজ্যে একের পর এক অনাচার, দেশজোড়া বেকারত্ব সমস্যা, ইত্যাদি সবকিছুই। এই গানের মাধ্যমে বহুকাল আগের সেই চারণসঙ্গীতের মতোই যেন বা দেশের প্রত্যন্তের চেয়েও প্রত্যন্ত একেকটি অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠবার খবর। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে সেগুলি মানুষকে ওয়াকিবহাল করে তুলছে। এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা যখন নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার খেয়োখেয়িতে ব্যস্ত সেই সময়ে দাঁড়িয়ে অন্ততপক্ষে মানুষকে সচেতন করে চলা, তাঁদের ভাষায়, তাঁদের বাচনভঙ্গিতে দেশের সঠিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁদেরকে শিক্ষিত করে তোলা, এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার কারণে নেহার জন্য আগে থাকতেই অনেক সাধুবাদ বাকি পড়ে ছিল। আমাদের কাছে সবসময় নেহাদের খবর পৌঁছয় না। আমরা ভাষা দিবস পালন করি বটে, কিন্তু অনেক সময়ে আমাদের অনেকের কাছেই সেটা ভাষাগত আভিজাত্য প্রদর্শনেরও একটি উপলক্ষ হয়ে ওঠে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন একেকটি ভাষার সদর্থক প্রচার ও প্রসারে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের বিষয়ে আরও বেশি করেই আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু নেহার বিষয়ে আলোচনার উপলক্ষটিও ঘটতে পারল অনেক দেরিতে, এবং তদুপরি ভাষা ভিন্ন সম্পূর্ণ অন্য একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই।
যেমনটা সত্যজিতের জটায়ু বলেছিলেন, “কোনও প্রশ্ন নয়, নো কোয়েশ্চেনস!” এদেশের অবস্থাও যে অনেকাংশেই তেমন। বেশি প্রশ্ন-টশ্ন করতে গেলে পরেই কি না যেখানে লালমুখো সাহেবদের দেশ ইংল্যাণ্ডের বিবিসিকেও ‘লাল চক্ষু’র কটাক্ষ থুড়ি, ভ্রূকুটি সামলাতে হচ্ছে, সেখানে নেহা অথবা সিদ্দিক কাপ্পানেরা তো নেহাতই মনুষ্য মাত্র। নেহা অবশ্য এখনও অবধি জেলের বাইরেই রয়েছেন। কিন্তু যোগীরাজ্যে বুলডোজার-রাজ চালানোর প্রতিবাদে তিনি কি না প্রশ্ন করে ফেলেছিলেন, “ইউপি মে ক বা!” বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় কি না, “বলি, হচ্ছেটা কি এই ইউপিতে!” জবাব আসেনি। তার পরিবর্তে নোটিশ এসেছে। প্রশ্ন করার জন্য সরকারি আরক্ষা দপ্তরের নোটিশ। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, সেই গানের লেখিকা কি তিনিই? ভিডিওতে যাঁকে গান গাইতে দেখা যাচ্ছে, তিনিও কি নেহা সিং রাঠোর নিজেই? এবং নেহা কি এই নোটিশ পাওয়ার পরেও এই গান অথবা তার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে চলবেন? তিনদিনের মধ্যে তাঁকে এই নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এরই জবাবে শিল্পী নেহা প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, গানের বক্তব্যের সঙ্গে তিনি সহমত এবং কোনও ভাবেই তিনি গানটিকে প্রত্যাহার করবেন না। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ ইতিমধ্যেই নেহাকে সমর্থন জানিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা অখিলেশ যাদব ‘ইউপি মে ক বা’ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। কিন্তু লড়াইটা বোধহয় নেহাকে একলাটিই লড়তে হচ্ছে।
বিতর্ক শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শাসক দল বিজেপির তরফে নেহার বিষয়ে বাঁকা মন্তব্য করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এমনকি একটি সর্বভারতীয় হিন্দি নিউজ চ্যানেলে ‘নেহার সঙ্গে তাঁর প্রাক্তন বয়ফ্রেণ্ডের কেমন সম্পর্ক ছিল’ এমনই শিরোনামে বিশেষ এক অনুষ্ঠানের সম্প্রচার অবধি করা হয়েছে। দেশজোড়া সংবাদমাধ্যমের যে চরমতম দৈন্যের অবস্থা এভাবে ক্রমেই সর্বসমক্ষে বেআব্রু রকমে উন্মোচিত হয়ে চলেছে, এই সময়ে এই দেশে আজ চতুর্থ স্তম্ভের সার্বিক অস্তিত্ব নিয়েই তাই আশঙ্কা প্রকাশ করতে হয়। এহ বাহ্য, যোগী-রাজ্যের বুলডোজার তার অদৃশ্য শরীরে নেহার ঘর-সংসার অবধিও পৌঁছিয়ে যেতে পেরেছে। নেহার স্বামী হিমাংশু সিং, পেশায় তিনি স্থানীয় এক কোচিং ইনস্টিটিউটের সামান্য শিক্ষক ছিলেন, তাঁকেও সেই পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছে। কিন্তু গান এখনও থামেনি। নেহাও বোধহয় হীরক রাজার দেশের সেই চরণদাস গায়কের মতোই মনে মনে নিজেকে শুনিয়ে নিয়েছেন, “জান শেষ আর গান শেষ, তো একই কথা হইল রাজামশাই!” রাজামশাইয়েরা যে চিরকাল চিরসময়েই গান, কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, অক্ষর এই সবকিছুকেই ভয় পেয়ে এসেছেন। কোথায়, কখন, কে’ই বা তাঁদের লজ্জাবিহীন নগ্নতার বিষয়ে সটান লিখে দেবে হঠাৎ, রাজামশাইদের তো চিন্তা সেই নিয়েই। নেহা যেমনটা নোটিশ পাবার পরেপরেই, এতটুকুও ভয় না পেয়ে নতুন একটি গান আপলোড করেছিলেন। যার কি না প্রথম দুখানি পংক্তি ছিল,
“ভিখ নাহি হক সরকার মাঙ্গিলা!
বেরোজগার-বানি সাহব রোজগার মাঙ্গিলা!”
অর্থাৎ কি না, “ভিক্ষা তো চাইছিনে মশাই – চাইছি কেবল অধিকারটুকুই, বেরোজগারের কারবারি সাহেব, সরকার এবং তোমার কাছ থেকে আমরা যে কেবল রোজগারেরই প্রত্যাশা করি!”
নেহার লড়াই কতদিন অবধি জনসমক্ষে থাকবে জানি না। রাতের অন্ধকারে যোগীর সেনানীরা কিইবা অত্যাচার নামিয়ে আনবে, তাও জানি না। প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী রাজনৈতিক দল, তারাও বা কতটুকুও যে পাশে থাকবে, তাও বলতে পারি না। কেবল ফিসফিস করে নিজেরাই নিজেদেরকে চরণদাসের কথা বলতে পারি। নেহার কথা বলতে পারি। আর উচ্চকণ্ঠে গাইতে পারি কেবল,
“যব তক হ্যায় বাকি / সিনে মে দম / গায়েঙ্গে ইয়ে জালিম ওয়াপস যাও যাও যাও!
ফির লহরায়েগি / লাল গগন মে / তেরে ইরাদোঁ কি রাখ ওয়াপস যাও!”
বেলা সিয়াওয়ের সুর, জালিম-ভাগানোর গান – নেহার মতো মেয়েরাই যে লড়াইতে পথ দেখান!
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার
নেহা সিং রাঠোররে ছবি সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment