শাপিতপুরুষ (তৃতীয় কিস্তি)

  • 05 December, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 468 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্বকথা : দ্বিধা-ভয় এবং অমীমাসিংত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ায় সুমন-রিমার প্রেম ও বিশ্বাস। আমি অন্ধ লোভে পড়েছি, আমি কি পথ হারিয়ে ফেলেছি প্রভূত প্রশ্নবাণে জর্জরিত রিমার আত্মজিজ্ঞাসা, আমি কি তাহলে সুমনের প্রেমে পড়েছি? এরই নাম কি প্রেম? এখান থেকে ফেরার পথ নেই? এরপর কী? বিয়ে? সর্বনাশ! কোন সর্বনাশা পথে হাঁটছি আমি! ...জ্বরের প্রকোপ বেড়ে গেল কিনা, অস্পষ্ট স্বরে মাকে ডাকে রিমা, মা, মাগো, তোমার মেয়ে দেখো সর্বনাশা প্রেমে পড়েছে? তুমিই পারো বাঁচাতে।

[৬]

আমি সংসার পেতেছি : রিমা

দ্বিধা, ভয়, সংকোচ, বিশ্বাস ধীরে ধীরে থিতু হয়ে আসে। দু-জনের বিশ্বাসের বন্ধন বড় ও মজবুত হয়ে ওঠে। মাস্টার্সে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়ে বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় সুমন। রিমার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষের দিনেই টানা দু-বছরের প্রেমের অবসান ঘটিয়ে সংসার বন্ধন ও দৈহিক বন্ধনের সিদ্ধান্তে পৌঁছায় ওরা।

কিছুই করেনি। বসন্তের সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের মুখোমুখি বসে দু’জন। খেলার মাঠে ঠিক সেই জায়গায় বসেছে, যেখানে দু’বছর আগে প্রথম কাছে এসেছিল, ভয়-আর আতঙ্কে নিজেদের হাত ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে ছুটেছিল এবং  পথ খুঁজে ছিল। আজ ওদের মুখের উপরে সূর্যাস্তের রক্তিম আলো পড়েছে। দু’জনে হাত রাখে হাত।  তিনবার শপথ করে—

আমরা একসাথে বাঁচব এবং মরব।
আমরা একসাথে বাঁচব এবং মরব।
আমরা একসাথে বাঁচব এবং মরব।
 

প্রফেসর চৌধুরীর ঘরে ফেরার সময় হয়নি। অসময়ে তিনি ঘরে ফিরছিলেন মাঠের মধ্যপথে। তাকে আসতে দেখে সুমন-রিমা দুজনেই উঠে দাঁড়াল। কাছে আসার পরে প্রথমে রিমা এবং পরে সুমন উপগত হয় পা স্পর্শের জন্য। দুই হাতে দুই জনকে প্যাঁচিয়ে ধরেন প্রফেসর চৌধুরী। কী করছো! উঠে দাঁড়াও। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াও, দাঁড়াও শির উঁচু করি, তুমি মানুষ। শান্ত আকাশ দেখে ভেবো না, ঝড় উঠবে না। ঝড় উঠবেই, এটিই প্রকৃতি। এবার দু’জনের  মাথা বুকের দুই অলিন্দে টেনে নিলেন। রিমার চোখে তার বাবার ছবি। প্রফেসর চৌধুরী গাঢ় একটা শ্বাস ফেললেন, তোমরা সুখি হও। বিরুদ্ধ বাতাসে দাঁড়িয়েছো। বড় বিশ্বাস নিয়ে ঘর বাঁধছো। প্রস্তুত থেকো, তোমাদের জীবননৌকা একদিন ঝড়ের মুখে পড়বেই। সেদিন সর্বনাশ ডেকে আনবে এক মুহূর্তের একটি ভুলে; সেদিন কালবৈশাখী ঝড় উঠবে বিশ্বাসের একবিন্দু ভাঙনে। একবার তলিয়ে গেলে আর উঠতে পারবে না। সতর্ক থেকো, প্রস্তুত থেকো, ঝড় আসবেই, দু’জনকে মৃদু ধাক্কায় সরিয়ে সামনে লম্বা পদক্ষেপ ফেললেন প্রফেসর চৌধুরী।

সুমনের প্রবল আপত্তি টেকেনি। রিমার জেদাজেদিতে এক উকিল বন্ধুকে ধরে কোর্ট রেজিস্ট্রি করিয়ে নিল। 

আর লুকোছাপা নেই। রিমা-সুমন এখন স্বামী-স্ত্রী। তিনরুমের একটি বাসা ভাড়া নিল শহরে। উঠে গেল এক সপ্তাহের আয়োজনে। দু’জন শোবার মতো ছোট্ট একটি খাট, তার উপরে বিছানার চাদর, দুটো বালিশ, কিছু হাড়ি-পাতিল দিয়ে শুরু হয় ওদের সংসার ধর্ম।

সুমনের মনে সে কী আনন্দ! একটা সংসার, একটা বউ এখন আমার, বলেই হি হি করে হেসে শূন্য ঘর মাতিয়ে তুলে। রিমাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে লুটিয়ে ফ্লোরের এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি খেয়ে একশেষ। আহা কী স্বাদ!  রিমা ভাবে, জীবনের এই দিনটার অপেক্ষায় অজস্র বিনিদ্র প্রহর কেটেছে । ছেলেরা কত কিছু আবদার করে, আবার লুট করেও নেয় নাকি তার প্রেমিকার শরীর। সুমন কিন্তু কখনই চায়নি এমন কিছু। কালেভদ্রে দু’চারটে উদ্ভ্রান্ত চুমুই কেবল সুমনের পাগলামি ছিল। যেদিন করত এ পাগলামি সেদিন ওর কী লজ্জা! গুটিয়ে থাকত লজ্জায়। সুমনের এই লজ্জা উপভোগ করত রিমা।

[৭]

আমি সব পেয়েছি সর্বস্ব হারিয়ে : রিমা

বাইরে শান্ত স্বাভাবিক রিমা, কিন্তু ওর ভেতর রাজ্য চরম অস্থির। বুকের মধ্যে খচখচ করে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে, বাবার কথা, মা’র কথা, ছোট ভাইটার কথা। ওদের ভয়ঙ্কর কী সর্বনাশটাই করলাম! কিন্তু আমি কী করতে পারি? জীবন তো একটাই। এক জীবনের চরম সত্যটাকে তো অস্বীকার করতে পারি না। সুমনকে ছাড়া আমার জীবন এখন আর কল্পনাতেও নেই। এছাড়া আমি একজন আলাদা মানুষ। মেয়েকে তো বিয়ে দিয়ে পর করেই দিতে হয়। এখন না হয় চিরদিনের জন্যে পর হলো।

রিমার বাবা ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সরল সাদাসিধে মানুষ। মেয়ের কথা বরাবরই মান্য করতেন। ভার্সিটিতে ভর্তির কিছুদিন পরেই মেয়েকে অচেনা ঠেকে বাবার। বাড়ি আসে খুব কম। উল্টা-পাল্টা কথা বলে। নিজের বিষয়ের চাইতে বেশি পড়ে অন্যান্য বই। ধর্মগ্রন্থ পড়ে। সমাজ, দর্শন ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় বই পড়ার দিকে মেয়ের ঝোঁক বেশি। কেন এসব পড়ে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন মেয়েকে। সাত পাঁচ বুঝিয়ে বাবাকে ভড়কে দিয়েছিল মেয়ে। এই সময়ে ছেলেমেয়েদের সব কিছুই জানতে পড়তে হয়। অলরাউন্ডার হতে হয় যে। বাবার মনে শঙ্কা থেকেই গেছে। মেয়ে কোন বিপ্লবী দলেটলে যোগ দিল না তো? রাজনীতি-টাজনীতিতে নাম লেখায়নি তো?

যেদিন রিমার বাবা শুনলেন তার মেয়ের বিয়ের খবর, সেদিন কোনো বাড়তি প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়নি তার মধ্যে। তাতেই বোঝা গেল তীরটা বিঁধেছে কতটা গভীরে। মেয়ের মা কিন্তু কাঁদল ঘরদোর ফাটিয়ে। ভাইটা ঘর থেকে বের হয়নি। আশেপাশের গ্রাম রাষ্ট্র হয়েছে বিয়ের কথা। বাড়িতে হিড়িক পড়েছিল মেয়ের বাবাকে দেখতে। যে মেয়ে পরকাল বিশ্বাস করে না, আল্লাহ রসুল মানে না, কলমা না পড়েই বিয়ে করেছে, সেই মেয়ের বাপ তো গাঁয়েগঞ্জে ভুরি ভুরি মেলে না।

মেয়েকে কিছুতেই কিছু বলে একটা চিঠিও লিখলেন না বাবা। একটা ফোনও করেননি। কিন্তু যে দিন স্কুলের গভর্নিংবডির সভাপতি ডেকে বললেন, সকলেই চায় তুমি হেডমাস্টারের পদটা ছেড়ে দাও। কিন্তু নেহায়েৎ ভালো মানুষ বলে মুখ ফুটে কেউ কিছু বলছে না। তোমার মেয়ে যদি ঐ মালোয়ান স্বামী লয়ে গ্রামে আসে তবে তাদের মুখ তো আর আমি তুলো দিয়ে আটকাতে পারবো না।

অপমানে-আতঙ্কে দিশেহারা রিমার বাবা যেন দূর হতেই মেয়েকে ডেকে বলছেন, তুই এ কী করলি মা! 

গাঢ় একটা শ্বাস ফেলে রিমা। এই মুহূর্তে আমার মতো সুখি পৃথিবীতে কেউ নেই। আবার, আমার মতো এমন করে কেউ সর্বস্ব হারায়নি।

এসবের কিছুই সুমনকে বলেনি রিমা। ওকে বুঝতেও দিল না যে, কত বড় বিনিময় করতে হয়েছে তাকে। তারপরেও রিমা খুশি। অমন দশ বিশটা বেহেস্ত-টেহেস্ত ছাড় দিয়ে হলেও সুমনকে চাই তার। বললেও সুমন যে সবটা বুঝতো তাও মনে হয় না রিমার। কেননা সুমন এমন একটা পরিবারের ছেলে, ওর বাবাই মাত্র বেঁচে আছেন। জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর চৌদ্দপুরুষের টিকিটিও নেই এদেশে। আত্মীয়-স্বজন সবাই কলকাতায়। যুদ্ধের সময় নাকি পালিয়েছে। আর ফেরেনি। কেন ফেরেনি? এ প্রশ্ন সুমনকে করেছিল রিমা। সুমন তখন খিস্তখেউড় করে একশেষ। ওদের কথা বলো না। ওরা দেশের শক্র। নইলে এভাবে কোনদিন কাপুরুষের মতো দেশ ছাড়ে! কেন? তোরা জোয়ান-মরদ মানুষ ছিলি, তোরা যুদ্ধে যেতে পারলি না? দেশের মনুষ যখন লাশ হচ্ছে, ওরা তখন দেশ ছাড়ছে। ছি! ঘৃণায় থুতু ছিটায় সুমন। রিমা তখন প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। বাদ দাও এসব। তুমি নিয়মিত বাড়ি যাও না কেন? সুমন তখন চুপসে যায়।

[৮]

আমি হারবো না, কারো কাছেই হারবো না : সুমন

নাটোরে এলো সুমন। ছোট্ট শহর। এ শহরটার নাকি এক সময় খুব জৌলুস ছিল। রানী ভবানী, রাজা দয়ারামের বাড়িঘর এখনো আছে। কথায় কথায় সুমন একদিন রিমাকে বলেছিল, রানী ভবানীর সাথে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার খুব জানাশোনা ছিল। পলাশি যুদ্ধে হেরে নাকি রানীর কাছে আসতে চেয়েছিল নবাব। ভীষণ দাপটের সাথে এই নারী বিশাল রাজ্য চালিয়েছে। তার নাটোর রাজ্য প্রদক্ষিণ করতেই নাকি পঁয়ত্রিশ দিন সময় লাগত। সুমনের পূর্ব পুরুষ রানী ভবানীর এস্টেটের হর্তাকর্তা দয়ারামের সহকারী ছিলেন। এসব শুনে রিমার মনে কৌতূহল জন্মেছে শহরটার প্রতি। বিশেষ করে রানী ভবানীর মেয়ে তারাসুন্দরীর কথা ভাবলে সে রোমাঞ্চিত হয়। নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার নজর পড়েছিল নাকি মেয়েটির উপরে।

সুমনের বাবার নাম শংকর গাঙ্গুলি। শহরের পুরাতন জীর্ণ, নোনাধরা একটি বাড়িতে তিনি একা নিঃসঙ্গ দিনযাপন করেন। ছেলের যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে তার মধ্যে তেমন কোন বাড়তি ফিলিংস নেই। বিয়ের ছ’মাস হল। সুমন বাড়ি যাওয়ার নামটিও মুখে নেয় না। কেন নেয় না? রিমা ধীরে ধীরে আঁচ করতে পারে। ওর জেদের কারণেই এবার আসা।

ইতোমধ্যে রিমা একটি চাকরি নিয়েছে। প্রাইভেট কলেজে শিক্ষকতা। 

গোয়েন্দা স্টাইলে প্রশ্ন করে সুমনের মুখ হতে কিছু তথ্য বের করতে পারে রিমা। ওর বাবা নাকি কবিতা লেখে। দুটি কবিতার বইও আছে। রিমা ভাবে, তাইতো বলি, লোকটা নিঃসঙ্গ থাকতে ভালোবাসে কেন? সুস্থ সবল সামর্থ্যবান ছেলে থাকতে এ বয়সে একা থাকে কেউ? কবিতা দেবীর সাথে ঘরগেরস্থি বলেই সম্ভব। 

লালবাজারের রাস্তা লাগোয়া কাঠের দরজার বাড়িটা পথচারীর চোখ আকর্ষণ না করে পারে না। কী করে টিকে আছে এখনো? বে-ওয়ারিশ বোধ হয়। বলাবলি করে লোকে। জরাজীর্ণ দরজা পঁচে পঁচে খসে উপরের অংশ ঝুলছে। বাহির হতেই বাড়ির কিয়দংশ দেখা যায়। আগাছা ধরনের গাছপালা লতাপাতা গজিয়েছে নোনাধরা বিল্ডিং এর ফাঁকে ফাঁকে। দেয়ালের কিছু অংশ ধ্বসে পড়েছে। কোথাও কোথাও দেয়ালে সেঁটে আছে কালচে সবুজ রঙের শেওলা। বাইরে থেকে পথচারীরা পরিত্যক্ত বাড়িই মনে করে সাধারণত। কেউ আবার ভূতের বাড়িও ভাবে।

বিশাল একটি বাড়ি। নয়টি রুম। প্রশস্ত উঠোন। একটি রুমে মানুষ থাকে। তাই একটি রুম ছাপছোপ। বাকি সবগুলোই পরিত্যক্ত। বাড়িটি একান্নবর্তী গাঙ্গুলি পরিবারের জৌলুসের স্বাক্ষরও বটে। পরিত্যক্ত রুমগুলোয় রকমারি ধরনের আগাছা জন্মেছে। কালেভদ্রে নাটোরে আসে সুমন। তখন আগাছা ছেটেছুটে দেয়। সাপ-বেজি তাড়াতে হয়। সপ্তাহ দুই-এর মধ্যে ফের আগের মতো জঙ্গল, আগের মতো সাপ-বেজির খামার হয়ে ওঠে।

সুমনের বাবা সাপ-বেজি তাড়ায় না। বরং ওদের সাথে তার একটা নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছে। প্রায়শ দুধভর্তি বাটি উঠানে রাখেন ওদের জন্যে। দুধের বাটি রাখার সাথে সাথে সাপ আসে দেহ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। একই সাথে আসে বেজিও। তখনই ঘটে মহাপ্রলয়। সাপে-নেউলের যুদ্ধ দূরে দাঁড়িয়ে দেখেন সুমনের বাবা। কোনদিন বেজি জেতে। সাপ দেহ গুটিয়ে পালায়। আবার সাপ জিতলে বেজি ফোঁস ফোঁস করতে করতে যুদ্ধের মাঠ ছাড়ে লেজগুটিয়ে।

বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই গা ছমছম করে ওঠে রিমার। কেমন ভূতুড়ে ভূতুড়ে সব কিছু। ভূতের বাড়ি নাকি রে বাবা! ভেতরে প্রবেশ করে গা ছমছম ভাবটা আরও বেড়ে গেল। মানুষজনের সাড়াশব্দ নেই। ঘরগুলোর কিছু তালা দেওয়া। কিছু দরজা পঁচে গেছে, বিধায় খোলা। ঘরের ভেতরে গাছ-গাছালি। এরমধ্যে একটা বেজি দৌড়ে উঠোনের এ মাথা-ও মাথা চক্কর মারে। রিমা ভয়ে সিটকে যায়। এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে সুমন! এখানে মানুষ থাকে বলে তো মনে হয় না। সুমন রিমার মুখ চেপে ধরে, আস্তে সোনা, বাবা শুনবে?

শংকর গাঙ্গুলি বিছানায় শামুকের মতো গুটিসুটি হয়ে ঝিমুচ্ছেন। প্রথমে সুমন প্রবেশ করে ঘরে। সুমনের পেছনে ছায়ার মতো প্রবেশ করে রিমা। ওদের আগমনে শংকর গাঙ্গুলির মধ্যে তেমন বাড়তি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। রিমা যারপরণাই বিরক্ত। এ আবার কেমন কথা! জলজ্যান্ত দু’জন মানুষ সামনে এসে দাঁড়াল, অথচ জীবিত মানুষটির কোন হেলদুল নেই। বোবা প্রাণীও লেজ-মাথা নেড়ে জানান দিত। মানুষটা পাথরের মতো নিশ্চুপ! রিমার ভয় ভয় ঠেকে। সুমনের বাবা কাপালিক-টাপালিক টাইপের কিছু না তো? বোধ হয় এই ভয়েই সুমন আসতে চায় না। কাপালিকরা নাকি নিজের ছেলেকেও বলি দিতে পারে। মিনিট দশেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। অসহ্য ঠেকলে মুখে কুলুপ আঁটা সুমনকে চিমটি কাটে রিমা। বোবা যেন কথা বলে ওঠে, বাবা! তারপর চুপ সুমন। অতঃপর পার হয়ে গেল আরও মিনিট পাঁচ। রিমা সশব্দে ঢেকুর তুলে।

সুমন শরীর ঝাঁকিয়ে বলে, বাবা, ও তোমার বউ মা।

এক পলক তাকিয়ে পূর্ববৎ ঝিমুচ্ছেন শংকর গাঙ্গুলি। 

সুমন ফের বলে, বাবা, ও তোমার বউ মা। এবার তাকালেন শংকর গাঙ্গুলি। অবাঞ্চিতের উৎপাতে দিবানিদ্রা টুঁটে যাওয়া বাঘের মতো ভয়ানক ক্ষ্যাপা তার চোখ। ভয়ে রিমার নাড়িভুঁড়ি পাক খেয়ে ওঠে। ডুবন্ত সূর্যের মতো টকটকে লাল চোখ দু’টো হতে যেন আগুনের হল্কা ছিটছে। নুয়ে পড়া দেহের এই মানুষটাকে ছোট্ট গোলাকার পাতিলের মতো দেখাচ্ছে। হাত-পাগুলো যেন বহুকাল রোদে পড়ে আছে, সিঁটকে লাগা কাঁঠাল গাছের ডাল-পালার মতন। চামড়া যেন আলগা চাদরের মতো শরীরে ফেলে রাখা। ভারবাহী জীবন টেনে টেনে এত দূর কেন? কেনই বা এমন করে বেঁচে থাকা। কী লাভ আছে এই বেঁচে থাকার মধ্যে? হায় রে জীবন! জীবন বড় লোভনীয়। হতে পারে ছেলের বউ দেখবে বলে এভাবে টিকে আছে।

মাথা নিচু করে নখ খুঁটছে সুমন। চটপটে সুমন, কবিতা আবৃতি করেও দারুণ বিপ্লবী বক্তৃতা দিত, সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিল, দাবড়িয়ে বেড়াত ক্যাম্পাসে, প্রেম করে গেল চুটিয়ে, কই, ওর মুখে, হাবে-ভাবে মুহূর্তের জন্যও বাবার প্রতি কোন সহানুভূতি টের পায়নি রিমা। এমনকি ‘বাবা’ শব্দটি  কখনো মুখ দিয়ে বেরিয়েছে কি না মনে করতে পারে না। ঘরে জীর্ণ-শীর্ণ-মরণোন্মুখ একজন মানুষ রেখে কী করে পারল সুমন! জোরে নিশ্বাস ফেলে রিমা। শংকর গাঙ্গুলির স্থির চোখ। শরীরের ঝুলে থাকা চামড়া কাঁপছে তির তির করে। ফের সুমন মুখ খোলে, বাবা, ও তোমার বউ মা। আশীর্বাদ করবে না।

বুক ফেঁড়ে শ্বাস বের হয়ে আসছে শংকর গাঙ্গুলির। দেয়ালে টাঙানো তার মৃত স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন ঠোঁট কাঁপিয়ে মাথা নাড়িয়ে হাসছেন। ক্ষণে ছবিটির দিকে, ক্ষণে রিমার দিকে, ক্ষণে ছেলের দিকে চোখ ফেরান। প্রাণান্ত চেষ্টায় যেন কথা বললেন, কী নাম তোমার, মা? এমন মমতার কণ্ঠে ‘মা’ শব্দটি শুনে বাবার কথা মনে পড়ে গেল রিমার। ওর বুকের ভেতরে ঝুলে থাকা ভারি পাথর খণ্ড যেন সুতো ছিঁড়ে দপ করে পড়ে গেল। মুখ ফসকে বেরোয়, বাবা! তারপরেই নববধূর লজ্জা ঠাঁই করে নিল রিমার চোখেমুখে। ঠোঁট  কাঁপিয়ে বলে, আমার নাম ফারাহ মেহজাবিন রিমা।

শংকর গাঙ্গুলির শরীরের চামড়া কেঁপে ওঠে। ক্ষিপ্রগতিতে চোখ ফেরালেন সুমনের দিকে। গভীর এক জিজ্ঞাসাচিহ্ন চোখে? এই জিজ্ঞাসাচিহ্ন যেন সুপ্রাচীন কালের। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল সুমন ।

ওড়নার আঁচল মাথায় টানতে টানতে উপগত হয় রিমা। পরম আদরে কাঁপা হাতে রিমার মুখ উঁচিয়ে ধরলেন শংকর গাঙ্গুলি, মা, এমন করে মাথা নোয়াতে নেই মা। পরাজয়ের ফাঁদ পাতা তোমার চারপাশে। কক্ষচ্যুত নক্ষত্র তুমি, তোমার বুকের বিশ্বাস আর সাহসটাই বাঁচাবে।

শংকর গাঙ্গুলির চোখ থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপ টপ করে জল পড়ছে। মুখের কুঁচকানো টকটকে লাল চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে জলে ভরে উঠছে। কঙ্কাল হাতে জল মোছার চেষ্টা করেন অতিকষ্টে। জলভরা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, মুসলমান হলে নাকি?

সুমন দৃঢ় কণ্ঠে জানায়, না ।

কেন? 

ওসব আমি মানি না। সুমনের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।

বয়োচিত গভীর গাঢ় নিশ্বাস ফেলে ফের মাথা নোয়াতে নোয়াতে শংকর গাঙ্গুলি বললেন, পারবে? প্রথমে শ্লেষের, পরে নিষ্ঠুর হাসি ঠোঁটে টেনে এনে কিছু একটা বলার ভাব করে বাতাস বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেলেন।

হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সুমন। সমগ্র শরীর কেঁপে ওঠে রেল ইঞ্জিনের মতো। ঘামছে। ফাঁদে অটকেপড়া গরিলার মতো গর্জন করে ওঠে সুমন, বিজয়! বিজয়!! আমি বিজয় চাই বাবা।

বিজয়! কার বিরুদ্ধে জয় হবে তোমার? যার বিরুদ্ধে লড়বে তাকে তুমি চেনো না, দেখো-ই নি।

আমি জেনেশুনে করেছি বাবা। আমার কোন ভয় নেই।

তোমার নেই বলে আর কারও নেই এটা ভাবছো কেন? তুমি কি একা? মানুষ কি কখনো একা? তোমার বিশ্বাসই কি সব? তোমার চারপাশে তাকিয়ে দেখো, প্রতি মূহর্তে কতগুলো চোখ তোমাকে ঘিরে খেলা করে।

সুমন অধৈর্য হয়ে ওঠে, আমি এসব কিছুই তোয়াক্কা করি না।

যে আঘাত দেখতে পারবে না, ছুঁতে পারবে না, যার লক্ষ অপ্রতিরোধ্য, স্থির—তার বিরুদ্ধে বুক পেতে দাঁড়াবে কী করে? নির্মম আঘাতের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলেন শংকর গাঙ্গুলি।

নীরব ঘর কাঁপিয়ে ভয়ঙ্কর গর্জন করে ওঠে সুমন, আমিও আঘাত করব, আমিও ছোবল দেব। এই তো দিলাম... হেঁচকা টানে রিমাকে বুকে টানল। তুমি পারোনি। মা পারেনি। আমি পারব-ই। আমি-ই হব বিজয়ী।

বিষাক্ত নিষ্ঠুর ছোবল ঠেকাবে তুমি! শংকর গাঙ্গুলির ঠোঁট জুড়ে বিদ্রুপের হাসি।

রিমাকে ছেড়ে দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সুমন। জিরজিরে চামড়ার ভাঁজে মুখ লুকিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠা ভয়ার্ত শিশুর মতো মা মা বলে ডেকে ওঠে। দু-তিনবার ডেকে বাবাকে ছেড়ে দিল। অসহ্য রকমের নীরব এখন।

এদিকে রিমার ভেতরে শুকিয়ে কাঠ। আড়াই বছর ধরে সুমনের পাশে ছায়ার মতো আছে। এ সুমনকে দেখেনি। কী উত্তুগ্র কষ্টের ভার বইছে সুমন! এ কষ্ট  ওর উত্তরাধিকার হতে পাওয়া। রিমার মনে বিস্ময়ের ঘূর্ণি পাক খেয়ে ওঠে, কেন সুমন একবারের তরেও ভুলেভালেও বলেনি তার কষ্টের কথা? তবে কি অতীত ক্ষোভ থেকেই এই প্রেম? তারপর তড়িঘড়ি করে বিয়ে। ও কি নির্দিষ্ট ছক কষেই এত দূর এগিয়েছে? ওর ভেতরে কি জেগে আছে ঈর্ষা? অথবা ঘৃণা? অথবা প্রতিশোধ? এ কারণেই কি ওর মধ্যে কোন প্রকার বিকার কিংবা সংকোচের ছিটেফোঁটাও ছিল না?  

রিমার কাছে বিষয়টা জলের মতো স্বচ্ছ। সুমনের মা অথবা বাবা কিংবা উভয়ের বিপন্ন জীবন ছিল। দেয়ালের ছবিটির দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিলেন বাবা। কেমন রহস্যময় হাসি ছিল ঠোঁটে। এমন সবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী শক্ত মনের মানুষ সুমন বাবাকে জড়িয়ে ধরে এভাবে পাগলের মতো কাঁদল কেন? এসব সংঘর্ষময় চিন্তার মধ্যে পড়ে গেল রিমা।

[চলবে...]

লেখক  : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)

0 Comments

Post Comment