শাপিতপুরুষ (একাদশ কিস্তি)

  • 06 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 420 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্বকথা- চৈতির ভেতরে ভয় বরফ হয়ে ওঠে। চৈতি কী বলবে, কী করবে বুদ্ধিতে কুল পাচ্ছে না। জীবিত এক মানুষ নিজেই বলছে সে খুন হবে! সেটা আবার নিজের স্ত্রী-বন্ধুর হাতে, এ কি বিশ্বাস করা যায়? এত নির্লিপ্তভাবে কেউ কখনও কাউকে নিজের আসন্ন মৃত্যুর সংবাদ দিতে পারে নাকি? অবিশ্বাস-বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে চৈতির মাথার ভেতরে বিপরীত চিন্তার কুরুক্ষেত্র চলছে। সুমনের একটি কথা মুহূর্তেই চৈতিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অন্য দিগন্তে।

[১৮]

বাঁচার পথ নেই, চারদিকে দেয়াল : চৈতি

চৈতির মনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল চলছে। ভয়-বিস্ময় কাটিয়ে আপাত শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে যায়। দু’জনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। তাই সুমনদা ভুলভাল বকছে। জেদের বশে, টগবগে তারুণ্যের উন্মাদনার তোড়ে যে প্রচলিত সমাজ সত্যকে পায়ে পিষে ছুঁড়ে ফেলেছিল; সে সমাজ কী নিষ্ঠুরভাবেই তার বিষদাঁত বসিয়ে বিষাক্ত করে তুলছে ওদের জীবন! যেন আর কোনকালে ছক বাঁধা পথের বাইরে পা ফেলতে সাহস না পায় কেউ। বৃথা প্রয়াস। কালে কালে সুমনরা থাকবেই। চৈতিরাও এই রকম অতৃপ্তির দাহে পতঙ্গের মতো মরবেই। মানুষটি ভেতর-বাইরে কেমন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ওর ভেতর রাজ্যের সরকারি দল বিরোধী দলের মতো ক্ষমতার লড়াই চলছে কি না? বিপ্লবী বিদ্রোহী প্রচলিত ধারাকে অস্বীকারকারী বা ত্যাজ্যকারী বৃত্তভাঙা জীবন, আর বৃত্তের ভেতরের জীবন—এ দুই জীবনে মধ্যে লড়াই এবং রক্তারক্তি এখন ওদের নিয়তি। জীবন একবার নিষ্ঠুর শোধ নেবেই। অমীমাংসিত অপ্রতিরোধ্য অচিহ্নিত হয়ে আসে কতগুলো আঘাত। এক জীবনে বুক পেতে কতক্ষণ আর লড়াই করবে? তখনি সুপারশক্তি বা নিয়তির প্রশ্নটি জোরালো হয়ে ওঠে। আর তখন স্বীকৃতি-অস্বীকৃিত বা গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্নটি অবান্তর হয়ে ওঠে।

চৈতি এবার খেয়াল করে, সুমনের চোখ দুটি গাঁজারুর চোখের মতো লাল হয়ে আসছে। রক্তমাংসলোভী ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো নেশাভারাক্রান্ত চোখ চৈতির শরীর প্রদক্ষিণে বেরিয়ে পড়েছে। চৈতির বুক কেঁপে ওঠে ভয়-ত্রাসে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটে সুমন। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। চৈতির পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠছে। নেশাগ্রস্ত চোখে ফের একবার তাকায় সুমন। যেন বাঘের চোখে হরিণী পড়েছে। পালানোর জন্য উদ্ধত চৈতি ত্রস্ত হয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢেকুর গিলে বলে, দম আটকে আসছে সুমনদা। বাইরে চলুন কোথাও।

আর বাঁচার পথ নেই। চৈতির দিক ধেয়ে আসে আদিম সুমন। চৈতি পেছনে হাঁটে। ভেতর থেকে উঠে আসা ভয়ার্ত ভয়ঙ্কর চিৎকারে কণ্ঠনালী ছিঁড়েফেঁড়ে যাচ্ছে; কিন্তু চিৎকার বাইরে বের হচ্ছে না। দুই পা হাঁটার পরেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল। বাধা দেবার জন্য দুই হাত বাড়ায়, কিন্তু নারীর কোমল হাত এত শক্তি পাবে কোথায় যে, রমণোদ্ধত এক দানবকে ঠেকাবে? সুমনের দুই হাত হাতির শুঁড়ের মতো প্যাঁচিয়ে ধরে চৈতির শরীর। ঠোঁটে, গালে, বুকের উপরে সমানে পাগলের মতো মুখ ঘষতে লাগল সুমন। ভয়ানক উৎকট একটা দুর্গন্ধ সুমনের মুখ থেকে বের হয়ে চৈতির নাড়িভুঁড়িকে জাগিয়ে তোলে। চৈতি শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে যতই নড়ে উঠতে চায়, ততই নাট-বল্টু টাইট করার মতো আরও শক্ত করে পিষে ফেলে সুমন। চৈতির নিশ্বাস ফেলতে ভয়ানক কষ্ট হয়। শরীরের সবগুলো হাড়জোড় যেন ভেঙে গুড়িয়ে ফেলবে। আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় না। বসে পড়ল। এবং আরও ভয়ানক বিপদ ডেকে আনল। এক ধাক্কায় চৈতিকে বলির পাঁঠার মতো ফেলে দিল সুমন।  হিংস্র জন্তুর মতো বুকের উপরে থাবা ফেলে চৈতির পায়ের কাছে উপগত হয়। চৈতির শরীর ধনুকের মতো বাঁকা করে জমিয়ে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে সম্পূর্ণ গিলে ফেলার জন্যে। মুহূর্তের মধ্যে চৈতির তলপেটে ভয়ানক তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা ও টাটানি শুরু হয়ে গেল। নির্মম পীড়ন যন্ত্রণার কাতরানির শব্দ যেন মুখ থেকে বের হয়ে রুমের বাইরে বের হতে না পারে—এ দায়িত্ব চৈতিকেই নিতে হয় এবং সতর্ক হতে হয়। কিন্তু চোখের কোণে উছলে পড়া জল আটকাতে পারেনি। ধীরে ধীরে শরীর বোধহীন হয়ে পড়ে।

ডাকাতের হাতে জীবনের সর্বসঞ্চয় লুট হওয়া মানুষের মতো বুকের ভেতরে বোবা চিৎকার, নিঃস্ব অসহায় মন, আখের ছোবড়ার মতো দলিত দেহ নিয়ে চৈতি উঠে বসে কুষ্টিয়াগামী বাসে। কী বিশ্বাসের কী ফল! চৈতি টের পায় ওর শরীরে সুমনের বিষ ঢুকেছে। বেহুঁশের মতো পড়ে থাকে চলন্ত বাসের সিট লেপটে। বাম কানের দুল পড়ার শব্দ উলটপালট মুহূর্তেও শুনতে পেয়েছিল। শরীরের চেয়ে শত ব্যথা চৈতির বুকে ও মনে। সুমন ওর প্রত্যাশিত পুরুষ। কামনা-বাসনার পুরুষ। সুমনের শরীর ভয়ানক আকর্ষণের বস্তু চৈতির কাছে। তাই বলে এভাবে বলাৎকার করে দস্যুর মতো লুটে নেবে একজন নারীর দেহ! ছি! ঘৃণা, লজ্জা ও নারীত্বের অপমান চৈতির বুকে গিয়ে বিঁধছে। সুমনের প্রতি এতদিনের বিশ্বাসটাই টাল খেয়ে ওঠে। যে পুরুষকে ভালোবেসে ঘর-বর-সংসার তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। অপেক্ষা, প্রতীক্ষা, অপ্রাপ্তিই সুখ ভেবেছে। তার দেহলিপ্সা, দেহভোগ এমন পশুর স্টাইলে! নিজের মধ্যে থরে থরে সাজানো অনুভূতিগুলো একটি একটি করে দক্ষ গবেষকের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আবিষ্কার করবে সুমন, তারপর পুরোটা গ্রাস করবে, ঠিক সূর্যগ্রহণের মতো, সেদিনের সন্ধ্যের মতো শৈল্পিক হবে, শৈল্পিকভাবে গ্রহণ করবে দেহটাকে, এমন স্বপ্নই দেখে আসছে চৈতি।

প্রায় সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমেছে। চৈতি মজমপুর গেটে নামল। বাসায় ঢুকতেই মোবাইল বেজে ওঠে। স্ক্রিনে শ্যামলের নাম্বার দেখে আঁতকে ওঠে। কানাডা থেকে খবর নিচ্ছে বউয়ের। চৈতির ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি। হায়রে বিশ্বাস! বেচারা নিশ্চয় ভাবছে তার সীতার মতো সতী স্ত্রী সান্ধ্য প্রণাম সেরে স্বামী দেবতার ধ্যানে মগ্ন। মোবাইল ননস্টপ বেজেই চলছে। ক্রিং ক্রিং। ধরতে গিয়ে হাত সরিয়ে আনল। মন্ত্রের অসম্মান হবে যে! অপবিত্র শরীর! শ্যামলের জন্য আচানক মোচড় দেয় চৈতির বুক। ব্যথায় টনটন করে ওঠে। দেহে-মনে এতকাল দুই পুরুষের বসবাস, কিন্তু সংঘাত বাঁধেনি কখনো। এবার প্রকাণ্ড একটা প্রলয়ের বিপদ সংকেত বেজে উঠল। মোবাইল বেজে বেজে থেমে গেল। ব্যথাক্লান্ত শরীর টেনেহিঁচড়ে বাথরুমে গেল। উদোম শরীরে সুমনের হিংস্রতার দাগগুলোতে হাতের পরশ বোলায়। হাতে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। অতঃপর সুমনের ঘৃণ্য স্পর্শ মুছে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠে শরীর ঘষে। কিন্তু ভেতরে সুমনের যে বীজ ঠিকানা করে নিয়েছে। এখন কী উপায়?

মোবাইল ফের ক্রিং ক্রিং শব্দ করে বেজে ওঠে। ভেজা শরীরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে খাট থেকে মোবাইলটা হাতে নিতেই আর এক দফা চৈতির শরীর কেঁপে ওঠে। রিসিভ করে কানে তুলতেই শ্যামলের কণ্ঠস্বরে ক্রোধ, তোমার কী হয়েছে শুনি? কোথায় গিয়েছিলে? মোবাইল নিয়ে যাওনি কেন? বাসায় এভাবে ছেলেটাকে একা রেখে গেলে! মা হয়ে তোমার বিবেক দেখে আমি তাজ্জব হই। চৈতির মুখে ভাষা নেই। ফোনে যেন হত্যার হুমকি দিচ্ছে আততায়ী, ভয়ে ঠোঁট-মুখ কাঁপছে। অস্পষ্ট স্বরে শুধু বলল, জরুরি কাজ ছিল। তারপরেই লাইন কেটে দিল। মোবাইল ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। 

[১৯]

আমার ভয়ানক শ্বাসকষ্ট, সুমন তুমি কোথায় : রিমা

গভীর রাত অবধি রিমা অস্থির সময় কাটায়। গলা শুকিয়ে কাঠ। গ্লাসের পর গ্লাস পানি চলছে, তৃষ্ণা বাড়ছে বৈ ছিটেফোঁটাও কমছে না। দু’বার করে ড্রইংরুমে গিয়েও কোন কথা না বলেই ফিরে আসে। সুমন রিমোট টেপায় মত্ত। ইদানিং কোন অনুষ্ঠান দেখে না। রিমোট টেপে হরদম। এক চ্যানেলে দুই সেকেন্ডও থির থাকে না। আগে খবর দেখত বুঁদ হয়ে। এখন তাও দেখে না। শেষরাত পর্যন্ত ড্রইংরুমে কী যে করে! রিমার সামান্য অস্থিরতায় সুমন অস্থির হয়ে এমন তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলত যে, ছোট খাটো অসুখকে লুকিয়ে ফেলত। রিমা এখন ভেতর-বাইরে সম্পূর্ণ নিঃসহায়। মরণ যেন দুই হাত দূরে। নিশ্বাস আটকে বুকের ভেতরে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই বাইরে আসছে না। গভীর সমুদ্রে জাহাজ ডুবি মানুষের মতো গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে রিমা। বাঁচার জন্যে হাত বাড়িয়ে কাছেধারে একটি খড়কুটোও পায় না সুমন ছাড়া। বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে রিমার শরীর। নিথর অনুভূতিহীন পুরার্কীতির মতো বসে থাকা সুমনকে ঘিরে রিমার মন ঘুরপাক খাচ্ছে ড্রইংরুমে। আমার ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, বুকের ভেতরে ভয়নক ফাঁপর, তুমি আমাকে ধরো সুমন। খুব ইচ্ছে হয় রিমার, এখনি উঠে যায়, ঘুর্ণিপাক খেয়ে লুটিয়ে পড়ে সুমনের বুকের উপরে। আমাকে তুমি শক্ত হাতে ধরো সুমন, আমাকে বাঁচাও তুমি, আমার বুকের ভেতরে শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে গেছে, আমার দু’চোখে অন্ধকার পর্দা নেমে আসছে! তুমিই তো করবে সুমন। আমার চোখের অন্ধকার দূর করে দাও, আমার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে দাও, দোহাই তোমার, দোহাই...। বিরল চোখের জলে রিমার বালিশ ভিজে যায়। ভয়, অতঙ্ক, আর্তনাদ বুকে নিয়ে রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত জেগে রইল।

[চলবে...]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

0 Comments

Post Comment