- 27 September, 2022
- 0 Comment(s)
- 536 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
বীভৎস দাবানলের মত
আমি এগোতে থাকবো! আর আমার এগিয়ে যাবার পথের দুপাশে
মুণ্ডহীন অসংখ্য দেহ ছটফট করতে থাকবে-
সভ্যতার দেহ
প্রগতির দেহ-
উন্নতির দেহ-
সমাজের দেহ
হয়ত আমিই সেই মেয়ে! হয়ত! হয়ত বা। (আমিই সেই মেয়ে, শুভ দাশগুপ্ত)
সামাজিক মাধ্যমে চাচা, খালা, চাচিরা খুব লম্ফঝম্প শুরু করেছেন। কারণ 'জাত-কুল-মান-সম্মান' মুসলিম নারীদের সবই চলে গিয়েছে, ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকা, ফিসফিস করে কথা বলা, মাথায় দোপাট্টা দিয়ে গরমে দরদর করে ঘামতে ঘামতে বিরিয়ানি রাঁধতে থাকা; নারীরা প্রতিবাদ শুরু করেছেন। বিভিন্ন অভিনব পন্থা অবলম্বন করে প্রতিবাদে নেমেছে ইরানের পুরুষ-মহিলা। তাঁরা রাস্তায় হিজাব পোড়ানো থেকে শুরু করে মাথার চুল কেটে ফেলে প্রতিবাদ করছেন। চুল কেটে, টপলেস হয়ে ইরানের নারীরা তাঁদের চুল ও শরীরের একচ্ছত্র অধিকার কেবলই তাঁহার, কোনো নানা, চাচা, দাদা, আব্বাদের নহে এই কথায় জানান দিচ্ছেন। তা এহেন অবস্থায়, মাহসার মৃত্যুকে কিছু চাচ্চু 'ডাল-ভাতের' মত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন। এমন মৃত্যু তো খুব স্বাভাবিক। কোনও বেটাচ্ছেলে তো আর মরেনি বাপু! সুতরাং এত লাফালাফির কী আছে! মাহসার মাথার সামনের কিছু চুল হাওয়ায় উড়ছিল, সেই জন্য তাঁর প্রাণপাত হয়েছে। নারীর চুল হাওয়াতে উড়বে, ভারি অন্যায় কথা!
ইরানে এখন তুমুল প্রতিবাদ চলছে, দেশটি রোষানলে পুড়ছে। "সরকারের পক্ষ থেকে এই বিদ্রোহকে এখনই সমূলে উৎখাতের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও মনে করা হচ্ছে। প্রতিবাদপ্রবণ এলাকাগুলিতে মোতায়েন করা হয়েছে বিশাল পুলিশবাহিনী। বহির্বিশ্বের কাছে ইরানের বর্তমান পরিস্থিতির চেহারা ধামাচাপা দিতে ইন্টারনেট ব্যবহারের উপরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত পর পর তিন দিন ইরানে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছে সে দেশের সরকার। বিক্ষোভকারীদের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস এবং গুলিও চালাচ্ছে পুলিশ। সমাজমাধ্যমের সুবাদে সেই দৃশ্য ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে।" ((তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২)
স্বেচ্ছায় কতজন নারী 'হিজাব' ভালবেসে পরিধান করেন সেই যুক্তি-তক্কো-গপ্পে না গিয়ে, খুব সাধারণ ভাবে আমরা বিষয়টা যদি দেখি তাহলে কিন্তু বুঝতে পারছি, পিতৃদেবদের চাপানো মহামন্ত্র জপ চলছে। হুজুরদের হুকুম তামিল করতে মরিয়া হয়ে তোতা পাখির বুলি আউড়িয়ে মিনমিন করে আপনি বলছেন—'মাই হিজাব মাই চয়েস'! খুব ভাল কথা। তাহলে 'মাই চয়েস'-কে প্রাধান্য দিয়ে যে সব নারীরা 'হিজাব' পরছেন না, তাঁদেরকে কেন আপনারা রেহাই দিচ্ছেন না? কয়েকটি চুল উড়ছিল তাই এত অত্যাচার। ধর্মে সইবে তো? যার যা খুশি পরিধান করুক, সেখানে আমি, আপনি বাদ সাধতে যাব কেন?
ইরানের প্রতিবাদ ভিডিওগুলিতে বঙ্গসন্তানদের মন্তব্য দেখে রীতিমতো শিহরণ জেগে উঠেছে। কয়েকটি মন্তব্য দেখে চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করা যাক—
"শেষ জামানায় এক শ্রেণির মেয়ে বের হবে!
দাজ্জালের অনুসারী যারা কাপড় পরেও নগ্ন থাকবে!''
"ইরান বেহায়পনা উলঙ্গতাকে প্রমোট করতেছে না, এটাই কি ইরানের নেতাদের দোষ?
আর বেহায়াপনাকে ইরান প্রমোট করতেছে না তাই কি আপনাদের গা জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে?"
"আপনারা ভাই এইসব দেখাই মেয়ে জাতিকে ধ্বংস করতেছেন, ধর্ষণের কারণ আপনারাই করে দিচ্ছেন।"
"প্রতিবাদের নামে রাস্তায় নেংটা হওয়া!"
"এটা ইরানের হতেই পারেনা ...নিশ্চয়ই এটা কোনো fucking ফ্রি দেশের ভিডিও"
এখানে কিছু কথা কওয়া আবশ্যক। এই যে ইরানিয়ান নারীরা প্রতিবাদ করছেন তাঁরা কিন্তু ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি। তাঁরা তাঁদের মৌলিক অধিকার নিয়ে সরব হয়েছেন। তাঁরা বিবাহ বিচ্ছেদ চান, সন্তানের অধিকার চান, নিজের পছন্দের কাপড় পরতে চান, গ্রেফতার হলে ধর্ষণের মতো নোংরা ঘটনার শিকার হতে চান না, বাক স্বাধীনতা চান, তাঁরা তাঁদের পুরনো ইরানকে ফিরে পেতে চান, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের জন্য একটি সুস্থ সুন্দর দেশের স্বপ্ন দেখেন।
সবকিছু সহ্য করার একটা সীমা আছে। সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেলে সত্যিকার অর্থে, আপনারা যাকে বেলেল্লাপনা বলছেন, অর্থাৎ 'ন্যাংটা নাচন' তাহাই কিন্তু দিকে দিকে শুরু হয়ে যাবে। আপনাদের দাবিয়ে রাখার প্রবণতাকে একদিন কিন্তু সকল নারীরা দমিয়ে দেবে। এই যে পিতারা বহুত বড়ো বড়ো বুলি আওড়াচ্ছেন, আপনাদের বলছি— নারীদের এইভাবে অত্যাচার করতে থাকলে অতি সত্বর আপনাদের দুর্দিন হাজির হবে। আপনাদের তৈরি করা পৃথিবীর মিথ্যা সংজ্ঞাগুলি নারীরাই উল্টিয়ে দেবে এক লহমায়!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment