- 02 April, 2021
- 0 Comment(s)
- 829 view(s)
- লিখেছেন : সেখ রাকিবা রহমান
ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান ও সমানাধিকার। এমন কথা মুরুব্বীদের মুখে ছোট থেকেই শুনে এসেছি। বইয়ের পাতাতেও গোটা গোটা অক্ষরে বহু দেখলাম। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে- পুরোটায় কথার কথা। উদাহরণস্বরূপ ইসলামে নারীর সম্পত্তির অধিকার কিংবা বহুবিবাহজনিত আইন ও অবস্থাগুলোয় বৈষম্যের পরিষ্কার রূপরেখা তুলে ধরে।
প্রসঙ্গত, শুধু ইসলাম না। সময়, কাল, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষেই পুরুষ নারীকে ইচ্ছাধীন ভোগ্য বস্তু ভেবে এসেছে। এই ভাবনার নিদর্শন দেয় আর এক সহজলভ্য উপায়। ধর্মকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান। হিন্দু ধর্ম মতের কন্যাদান ও ইসলামের দেনমোহর প্রথা। কিছু হিন্দু মহিলা ও মাতাপিতারা এই সব আচার নিয়ে সরব হচ্ছেন। বিবাহে মহিলা পুরোহিত নিয়োগ করছেন। কন্যাসন্তানকে গলার কাঁটা বা বোঝা জ্ঞান করে যেসব আচার তা নির্দ্ধিধায় বাতিলের কথা ভাবছেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও মহিলা কাজির যাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু মুসলিম নারীরা সমাজের অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিয়ে কথা বলতে গিয়েও পিছপা হচ্ছেন ও অবশেষে হারিয়ে যাচ্ছেন। অন্ধত্বের বেড়ি ভেঙে কয়েক লক্ষ গুণ জোর নিয়ে সামনে আসছেন যারা তাদেরকেই সমাজ বহিষ্কার করে দিচ্ছে। শিক্ষিতের মধ্যে বড় চাকরি, গাড়ি, বাড়ির অভাব না থাকলেও অভাব থেকে যাচ্ছে বোধের।
কন্যাদানের সাথেই আর এক ইসলামীয় আচারের কথা উল্লেখ করেছি প্রথমেই। দেনমোহর বা মোহরনা বা কাবিন। দুইয়ের মধ্যে মিল একটা- আচার দুটো সরাসরি মহিলাদের পণ্য জ্ঞান করায়। 'দেনমোহর' শব্দটা মূলত আরবি, যা বাংলায় নিযুক্ত হয়েছে। দেনমোহর নারীকে স্বাবলম্বী করে তলার অভিনব প্রচেষ্টা এমন কথাও শুনেছি বহু জায়গায়। কিন্তু কারোর থেকে টাকা নিয়ে আজীবন স্বাবলম্বী থাকা যায় কীভাবে! এই ভাবনাটা ভাবিয়েছে আমায়। টাকার বিনিময়ে মানুষ পাওয়া গেলে শারীরিক ও মানসিক সব ব্যর্থতায় ঝেড়ে ফেলা যায় অন্যের উপর।
অনেকেই বলবেন- সব মানুষ এক রকম হন না। আলবাত হন না। যারা হন না, তাদের কাছে প্রশ্ন আজ এই শতাব্দীতে দেনমোহরের প্রয়োজনীয়তা ঠিক কতটুকু? যেসকল নারী স্বাবলম্বী ও ট্রেন্ড বজায় রাখতে গুচ্ছের টাকা খরচ করে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং করছেন, তারা কী এটুকু আয়ডেন্টিফাই করতে পারছেন না?
দেনমোহর অত্যন্ত রিগ্রেসিভ প্রথা ও দেনমোহরের ভাবনা অপমানজনক বার্তা এনে দেয়। ধর্মমতে দেনমোহর প্রাপ্ত হলে কিংবা নারীর পক্ষ থেকে মকুব হলে তবেই স্বামী-স্ত্রীর মিলন বৈধ ভাবা হবে।
সম্পর্কের সাথে মোহরনার এই সমীকরণ সমাধান করলে দেখা মিলবে- পুরুষের একনায়কতান্ত্রিক প্রবৃত্তি। যে প্রবৃত্তি যুগ যুগ ধরে অন্তর্নিহিত পুরুষের মধ্যে-- নারীকে ভোগ্যপণ্যের বাইরে আলাদা স্বাধীন সত্তা হিসেবে ভাবতে পারে না তারা। দেনমোহরের টাকার অঙ্ক তা অধিক হোক কিংবা কিঞ্চিৎ কখনোই সম্মান এনে দিতে পারে না। এই প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ ‘শাস্ত্র, সমাজ ও নারীমুক্তি’ (সেলিনা হোসেন ও মাসুদুজ্জামান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের নারী ও সমাজ’) প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মুসলিম নারী জানে, মুসলিম নারীর দাম্পত্য একটা জাগতিক চুক্তিমাত্র এবং নারী যে পুরুষভোগ্যা সে-স্বীকৃতির প্রমাণ কাবিন। কাবিন হচ্ছে সম্ভোগের দামস্বরূপ আর্থিক মূল্যের দলিল, এ জেনেও উচ্চ দক্ষতার চাকুরে নারীও কাবিন যে লক্ষ লক্ষ মুদ্রার বিনিময়ে সম্ভোগ্যারূপে আত্মবিক্রয়ের অবমাননাকর দলিল মাত্র, তা আজো মনে করে না। এ-ও মনে করে না যে শাস্ত্রানুসারে নারী পুরুষভোগ্যা প্রাণীমাত্র, তাই এক পুরুষের একাধিক স্ত্রী অনুমোদিত।’
নারীকে একমাত্র স্বাধীন করতে পারে শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আনতে সমাজের গোঁড়ামির আগাছা কেটে সাফ করতে হবে। সমাজের নারীদের এগিয়ে এসে প্রতিবাদ জানাতে হবে। স্বাধীনতা কিংবা সম্মান কেউ কাউকে হাতে ধরে দিয়ে যেতে পারেনি। তা নিজেকেই অর্জন করে নিতে হবে-- নিজের জন্য।
ছবি সৌজন্য নেট
লেখক : সমাজকর্মী ও প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment