- 01 November, 2020
- 0 Comment(s)
- 838 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
- ‘কী রে সুশী খুব কষ্ট হচ্ছে?'
-'না-আ-আ কাম্মা'
-'দেখ তোর কী সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে'।
সুশীলা কোনো উত্তর দেয় না। সুশীলার কাকিমা অনামিকা আবার বলেন, ‘মেয়ে হয়েছে শুনে মুখটা অমন গম্ভীর কেন হ্যাঁ? তুই খুশি হোস্নি?'
-'না কাম্মা তা নয়, কিন্তু...'
-'আর কোনো কিন্তু না। তুই না-পারিস আমি ওকে মানুষ করবো। ও আমার নাতনি হয় বুঝলি?'
একটা নিঃশ্বাস ফেলে অনামিকা আবার বলেন, 'মেয়ে হয়েছে শুনে ওরা কেউ আসেনি। গাড়ি দিয়ে দেব, একা যেতে পারলে চলে যাস্। আমি যেতে পারবো না, আমার কাজ আছে।' অনামিকা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বাল্যকাল থেকেই সুশীলার ভাগ্য বড়োই বিড়ম্বিত। অনেক ছোটো বেলাতেই সে মাকে হারায়। বাবা কন্যাকে ফেলে রেখে উদাসীন হয়ে গৃহত্যাগী হন। তখন এই অনাথা শিশু কন্যাকে তার নিঃসন্তান কাকিমাই পুত্রীরূপে আশ্রয় দান করেন। অনামিকা দেবী নামকরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের একজন গাইনোকোলজিস্ট। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁর বহুদিনের। সংসার ভাগ্য বড়োই দুর্বল তাঁর। এমন একজন মহিলার শুষ্ক হৃদয়ে কী করে যে সুশীলার প্রতি করুণার স্নেহলতা গজিয়ে উঠেছিল তা বলা মুশকিল। কাকিমার তত্ত্বাবধানে সুশীলা ফিজিক্সে মাস্টার ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা গড়গড়িয়ে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু হঠাৎই একদিন অনাথার একমাত্র পিতার স্মৃতিপটে তার মুখ ভেসে ওঠাতে তিনি কন্যার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সুশীলার মনে হয়েছিল তার বাবা তার কাছে অপরাধী। এ অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় না। ফলে সুশীলা কোনোদিনই পিতার প্রতি কোমল হবে না। কিন্তু দীর্ঘদিন পর এই পিতৃদর্শন যে কেবলই ভালোবাসার নয়, তা সুশীলা বুঝতে পারেনি। আমাদের সমাজে এখনও পিতৃকুলের অধিকাংশই কন্যা সন্তানের ভরণপোষণ অপেক্ষা তার জীবনের অন্তিম পরিণতি নিয়ে অধিক চিন্তাশীল। বিবাহের কথা বাবার মুখ থেকে শোনামাত্র সুশীলার অন্তঃকরণ হাপুস নয়নে কেঁদে ওঠে। এই অনভিপ্রেত প্রস্তাবে অনামিকা মোটেও রাজি ছিলেন না। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে - তার মেয়ে ছোটো, বিবাহযোগ্যা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘সুশীলা আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক, তারপর যদি নিজে চায় তবেই সে বিয়ে করবে। নাহলে নয়।' কিন্তু সুশীলা এই বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। কাকিমার একপ্রকার অনিচ্ছাতেই বাবার পছন্দের পাত্রের সঙ্গে সুশীলার বিয়ে হয়ে যায় মহা ধুমধাম করে। চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে সুশীলা চলে যায় শ্বশুরবাড়ি। যে বাবা কোনোদিন তাকে সন্তান স্নেহে পালন করলো না, কোনো স্বীকৃতি দিল না, সেও মহানন্দে কাঁধের বোঝা হালকা করে দেশান্তরে দিল পাড়ি। এত সমারোহের মধ্যেও যিনি গোটা কর্মকাণ্ডের মূল খরচকর্তা, তিনিই কেবল থেকে গেলেন অন্ধকারে।
সুশীলাকে আজ একাই কোলে সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে রওনা দিতে হল শ্বশুরালয়ের উদ্দেশে। কাকিমার সঙ্গে চলতে থাকা দীর্ঘ মান-অভিমানের পালা সমাপ্তির দিন এখনও নির্ধারিত হয়ে উঠতে পারেনি। সুশীলা পা রাখতেই তার শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় একেবারে হইহট্টগোল পড়ে যায়। একে বাইরে চলছে করোনা পরিস্থিতি। সমস্ত সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালই প্রায় করোনা হাসপাতাল হয়ে গেছে। বিক্ষুব্ধ জনতার উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছে। সুশীলাদের শ্বশুরবাড়ির পাড়া তস্য পাশ্ববর্তী পাড়া এবং তস্য পাশ্ববর্তী পাড়ার লোকজন সামাজিক দূরত্ব শিকেয় তুলে ছোট্ট গলির মুখে জমায়েত করে সুশীলার পথ অবরোধ করেছে। এ ছাড়া বাকি বেঁচে যাওয়া শূন্যস্থাণ পুরণের জন্য কিছু পথ চলতি উৎসাহী জনতারও অভাব ছিল না। এদের প্রত্যেকের চোখমুখে হিংসাত্মক ভাবভঙ্গিমার ছাপ একেবারে স্পষ্ট। এই বিকট পরিস্থিতিতে সুশীলা একা। পাশে নেই কেউ। না তার শ্বশুরবাড়ির কেউ এমনকি তার স্বামীও সেখানে অনুপস্থিত। প্রতিবেশীদের দাবি বুঝতে পেরে সুশীলা তার নিজের ও সন্তানের কোভিড নেগেটিভ রিপোর্টের প্রমাণপত্র দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে কাগজও এই জনতার কল্লোলে খড়কুটোর মতো ভেসে চলে যায়। ভাদ্র মাসের চড়া রোদ যত মাথার উপর উঠতে লাগল সুশীলার শরীর ততই দুর্বল হতে থাকল। কাকিমার আশ্রয়ে থাকাকালীন তাকে কোনোদিন কোনো ঝুটঝামেলাতে পড়তে হয়নি। মারমুখী মাস্কবিহীন জনতা এক পা এগোতেই সুশীলা আরও পাঁচ পা পিছিয়ে যায়। সুশীলার মনে পড়ে তার কাকিমার কথা। অনতিবিলম্বেই তার ডাক পৌঁছে গেল অনামিকার কাছে। যথাসময়ে অনামিকা ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার করলেন সুশীলাকে। তাগড়াই গলা বার করে সকল আওয়াজ থামিয়ে শান্ত কণ্ঠে সুশীলাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'পুলিশ ডাকবো?'
-'না'
-'তাহলে এখন কোথায় যাবি?'
-'যেখানে আমি আর আমার মেয়ে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবো। নিজেদের ইচ্ছানুসারে চলতে পারব, স্বাধীন ভাবে থাকতে পারবো আমরা সেই বাড়িতেই যাবো।'
লেখক : ছাত্রী, গল্পলেখক।
ছবি : প্রতীকী
0 Comments
Post Comment