- 25 July, 2023
- 0 Comment(s)
- 652 view(s)
- লিখেছেন : রুমেলিকা কুমার
আগের দিন ক্লিনিকে বসে আছি। রোজ এক দুই করে বাড়ছে পেশেন্টের সংখ্যা। পুরোটাই মেয়ে। সময় লাগে বেশি। হয়তো শোনার মানুষ পায় না তাই। পাশে লিয়াদির সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে চলে পরের জনকে ডাকা। তারই মধ্যে খুচরো সওয়ালে জীবন বোঝার চেষ্টা। ডাক্তারি করার থেকে গল্প চুরির ধান্দা বেশি।
মাঝেমধ্যে বাংলাতেই লিখতে বসে যাই। আগের লেখাতে বলছিলাম না বাংলায় মেডিসিনের একটা-দুটো বই থাকলে মন্দ হতো না। তেমনি বাংলায় উত্তর দিলেও বা মন্দ কী। ইংরাজিতে ডেলি এক্সারসাইজ লিখে লাভ নেই। বাংলাতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন লিখেও লাভ কত হয় জানি না। অ্যাভয়েড সল্টের থেকে বিশুদ্ধ না হলেও কমপক্ষে চলিত বাংলায় গোটা হরফে কাঁচা লবণ খাবেন না লিখলে যদি কাজ দেয়। কিছু হোক বা না হোক বাংলা লেখার অভ্যেস থাকে। যদিও তারপরে নুন খাওয়া বন্ধ হবে না। রিসেন্টলি তো আরেক তত্ত্ব কাম তথ্য আবিষ্কার করেছি। আগেরদিন সুন্দরবনে একটার পর একটা রোগীকে এরকম বলে যাচ্ছি কাঁচা নুন খাবেন না। খানিক শুনে একজন এসে বলল— এখানে কাঁচা নুন খাবেন না বলিস না। বলিস ভাজা নুন না খেতে। মুখ অর্ধেক হাঁ হয়ে গেছে দেখে বাকি ব্যাখ্যাটা জারি হল। আমি কাঁচা নুন খেতে বারণ করছি— তো— শুকনো কড়াইতে নুনটা ভেজে নেওয়া যায়। তাতে নুনের প্রেশার বাড়ানোর ক্ষমতা মাঠে মারা যাবে। মাঠে মানে কড়াইতে। তারপর সেটা খাওয়া চলে। তার থেকে তুই বরং ভাজা নুন খাবেন না বলিস। রসায়নবিদ্যার এই অভিনব আবিষ্কার শুনে অস্থির হয়ে তারপর থেকে বলতে শুরু করেছিলাম কাঁচা-পাকা-ভাজা কোনও নুনই খাবেন না।
যাই হোক। পরের জনকে ডাকা হল। মেয়েটা ঢুকল। পারভিন। কাগজ হাতে জিগ্যেস করলাম— বলো কী সমস্যা।
— মাথায় নারকোল পড়ে গেছে।
— অ্যাঁ?? কী পড়ে গেছে?
— নারকোল।
— মানে? মাথায় নারকোল কীভাবে পড়ল? কোথায়? কীভাবে? কেন??
র্যাপিড ফায়ার দেখে নিজেই হেসে ফেলল।
— না পুকুর ধারে বসেছিলাম। মাথায় নারকোল পড়ে গেছিল। এখন মাথায় লাগে খুব মাঝেমধ্যে।
— কতদিন আগে।
— হয়েছে বছর খানেক।
— বছর খানেক? এখন কেন মাথায় লাগছে? কোথায় পড়েছিল?
মাথার পিছন দিকটা দেখিয়ে দিল।
— আর লাগছে কোথায়।
মাথার সামনে থেকে দুদিকের রগ ধরে হাত ঘুরতে লাগল।
— উঁহু। নারকোলের জন্য হয়নি এটা। কিছু করলে ব্যথা বাড়ে কি? আলোতে, শব্দে, চেঁচামেচি করলে??
— নাহ সেরকম না। তবে রাতে ঘুম হয় না। আরো বেশি ব্যথা করে রাতের দিকে।
— রাতে ঘুম হয়না কেন? সারাদিন কী করো? কখন শোওয়া হয়?
— কিছু করিনা। ঘরের কাজকর্মই। শুতে যাই ১১টা করে। তবে ঘুম আসে না। ওই ভিডিও দেখি, ফেসবুক করি এসবই।
এবার বয়সের দিকে চোখ গেল। ১৭ বছর।
— স্কুলে পড়িস না?
— না।
— কতদূর পড়েছিস?
— মাধ্যমিক অবধি। আগের বছরেই তো পাশ করলাম। তারপর স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। আর ভর্তি হওয়া হয়নি।
— তো যা। এখন তো আবার খুলেছে? ভর্তি হয়ে পড়াশোনা কর।
কোন উত্তর এল না। আমিও লিখতে শুরু করলাম ফোনের ব্যবহার কমাতে হবে। লেখা শেষ হলে শাবল হাতে নামি আবার সিঁধ কাঁটতে।
— স্কুলে ভর্তি হবি না? আর পড়াশোনা করবি না?
অস্বস্তিতে পড়ছে বুঝতে পারছি। তবুও বলা।
— যা ভর্তি হ। কেন? বাড়ি থেকে মানা করছে?
— না না, মা তো বলছে ভর্তি হতে। আমারই আর ইচ্ছে নেই।
— মা বলছে তুই যাচ্ছিস না? এ কেমন কথা? যা স্কুলে ভর্তি হ। আর সারাদিন একেবারে ঘরে বসে থাকিস না। স্কুলে যা। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প কর। পড়াশোনা কর।
হালকা মিষ্টি হাসি হেসে উঠে পড়ে। কথাগুলোর প্রতিসরণ, প্রতিফলন, বিচ্ছুরণ কিছুই যে হল না বুঝি। সরলরেখায় চলে যায়। অসীমে …
পরের জন এল। নাজনীন। ১৮ বছর।
— দিদি?
— হ্যাঁ, বল। কী হয়েছে?
— দরজায় মাথা ঠুকে গেছে।
— হ্যাঁ? কীভাবে? কী করিস তোরা? একজনের মাথার নারকেল পড়ছে। আরেকজন দরজায় মাথা ঠুকছে? কী করছিলি?
হেসে ফেলে— ভাইদের সঙ্গে খেলছিলাম। খেলতে খেলতে ঠুকে গেছে। কিছু হয়নি তেমন। খানিক ব্যথা হয়েছে। তবে আমারও বোনের মতন মাথায় লাগছে। পিঠেও ব্যথা করে।
— কী করিস? তুইও স্কুল ছেড়ে দিয়েছিস?
— হ্যাঁ ওই লকডাউন হল। আর যাওয়া হয়নি।
— কেন?
— বোতামের কাজ করি।
— স্কুলে যাস না কেন?
— বাবার কাজটা চলে গেল যে। বোতামের কাজ করি তাই আমি আর বোন।
— বাবা কী করতেন?
— ওই জামাকাপড়ের কাজ করতেন।
— আর তোরা।
— বোতাম লাগাই। মেশিন দিয়ে যে বোতাম লাগানোর কাজ হয় না। তাই করি।
পারভিনের স্মিত হাসিতে উঠে যাওয়ার উত্তর নাজনীন দিয়ে দিয়েছে। তবু জিগ্যেস করি।
— আর পড়বি না?
— কী করে করব?
জানিনা। এ এক অদ্ভুত না জানা। ভাইভার উত্তর জানা না থাকলে কষ্ট হত না। এই না জানা কষ্ট দেয়।
— কত করে পাস।
— দুহাজার মতো হপ্তায়।
— আর সারাদিন কী করিস এ বাদে।
— কিছুই না। ভাইরা বড্ড ছোট তো। ওদের সামলাই।
— কত ছোট ভাইরা।
— একজন ১২, আরেকজন ১৪।
— বিশাল বড় হয়ে গেছিস বল? নিজে পুঁচকে মেয়ে আর ভাইদের সামলাচ্ছে— বলে থেমে যাই।
সত্যি বড় হয়ে গেছে ওরা। বড় হতে বাধ্য হয়েছে তো। নইলে আর উপায় কী। এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়া যায়নি। শিশুগুলো বিশ্বের বাসযোগ্য হয়ে যায় ঠিকই। তাতে শৈশব না থাকলেও বা কী।
কয়েকদিন আগের একটা খবর খুব মনে পড়ে। স্কুলে ফেরত আনতে গিয়ে দেখা গেছে বাচ্চা বিয়ে করে বাবা হয়ে গেছে। খুব পাকাপাকা গলায় বলছে সংসারের দায়িত্ব নেবার কথা। শুনে হাসি পায়। তবু এরকম রোজই তো আনাচেকানাচে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সংসারের ভার তুলে নিচ্ছে এরকমই ছেলেমেয়েগুলো। পৃথিবীর ভার তুলে নিচ্ছে এরা।
খবরের কাগজে দেখি। বন্ধ হয়ে যায় একের পর এক স্কুল। ৬৪টা স্কুলের তালিকায় চোখ পড়ে যায়। আট, সাড়ে আট লাখ ছেলেমেয়ে স্কুলছুট। স্কুলে ফিরবে না ওরা। কেউ বিড়ি বাঁধছে, কেউ ভ্যান চালাচ্ছে, কেউ চাষ করছে, কেউ বোতাম আঁটছে, কেউ স্রেফ ঘরে বসে আছে। ওরা আর ফিরবে না। সারাদিন খাটুনির পর একটু ফেসবুক দেখে, টিকটকের ভিডিও দেখে আনন্দ খুঁজবে ওরা। সেই ভিডিও দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিই আমরা। ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে অবজ্ঞা। তাতেই আনন্দ ওদের। বিকল্পই বা কী আছে? হয়তো চোখে পড়ে যাবে কিছু ছেলেমেয়ে। ফেরত আনার চেষ্টায় তারা ফিরবে স্কুলে। কিন্তু বেশিরভাগই জালের ফাঁক গলে নেমে পড়েছে বৃহত্তর দুনিয়ার টালমাটাল জলে সাঁতরাতে। বড়ো হবার অনেক আগেই। ছোটছোট হাত-পা চালিয়ে সামাল দিচ্ছে প্রত্যেকটা ঢেউ। পরিণত হবার অনেক আগেই। আরও কিছু ছেলেমেয়ের মুখ মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় ১৪ বছরের বাচ্চার জন্য মা ঘুমের ওষুধ চাইছিল কয়েকদিন আগে। যাদের স্কুলে ফেরার রাস্তা নেই। পিছুডাকারও কেউ নেই।
সাদা শার্ট কালো প্যান্ট। লাল সোয়েটার। লালপাড় সাদা চুড়িদার। পিঠে ব্যাগ। রাস্তায় আবার দেখছি। কোচিংয়ে যাওয়া একসাথে। স্কুলের গেটে ভিড়। বইপাড়ায় ভিড় বাড়ছে। প্রথম যেদিন স্কুল খুলেছিল মনে হচ্ছিল রাস্তাটা আরেকটু বেশি সবুজ। ব্যাগের গুঁতো, ধীরপায়ে গল্পে মশগুল দল— আগে যেগুলো বিরক্ত লাগত, এখন আর অতটাও লাগে না। মনে হয়েছিল পৃথিবীটা একটু হলেও বেশি রঙিন। তবু জানিনা। যারা ফিরল না তারা?? তাদের ফ্যাকাশে দুনিয়া কাটবে কী ভাবে?
প্রেস্ক্রিপশনে কী লিখব?
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২১ ডিসেম্বর ২০২১
লেখক: চিকিৎসক, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment