- 29 December, 2023
- 0 Comment(s)
- 230 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
ক্ষমতা হলো এমন একধরনের অবস্থা, যে অবস্থা তৈরির জন্যে ব্যক্তি তার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে স্বাধীন ও মর্যাদাকর জীবনের সুবিধা পাবে। ক্ষমতা তখনই আসে যখন নিজের ভেতর শক্তি তৈরি হয়। সশক্তিকরণের জন্যে দরকার শিক্ষা, সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা, আর্থিক স্বনির্ভরতা, লিঙ্গবৈষম্যহীন ভাষা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এই সুবিধাগুলি নারীর প্রতি কতটা প্রযোজ্য সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সচেতন মানুষের চর্চার বিষয় হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিধি অবদমিত করেছে নারীকে। নারী জাগরণের কর্মী, সামাজিক বিধিবৈষম্য-সচেতন রোকেয়া প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে মেয়েদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার মূল কারণগুলি লক্ষ করেছেন। তাঁর মতে-‘...আমাদিগকে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে “ঈশ্বরের আদেশপত্র” বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। কোন বিশেষ ধর্মের নিগূঢ মর্ম বা আধ্যাত্মিক বিষয় আমার আলোচ্য নহে—ধর্মে যে সামাজিক আইনকানুন বিধিবদ্ধ আছে, আমি কেবল তাহারই আলোচনা করিব, সুতরাং ধার্মিকগণ নিশ্চিন্ত থাকুন। পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশজনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই ঈশ্বর প্রেরিত দূত কিংবা দেবতা বলিয়া প্রকাশ করিয়া অসভ্য বর্বরদিগকে শাসন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ক্রমে যেমন পৃথিবীর অধিবাসীদের বুদ্ধি বিবেচনা বৃদ্ধি পাইয়াছে, সেই রূপ পয়গম্বরদিগকে (ঈশ্বর প্রেরিত মহোদয়দিগকে) এবং দেবতাদিগকেও বুদ্ধিমান হইতে বুদ্ধিমত্তর দেখা যায়। একবার সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতাটি সংস্কৃত ভাষায় সনাতন ধর্ম সম্বন্ধীয় গ্রন্থ রচনা করিলেন। তাই হিন্দু রমণীকে শিক্ষা দিলেন,--
“স্বামী বনিতার পতি, বনিতার গতি
স্বামী বনিতার যে বিধাতা।
স্বামী বনিতার ধন, স্বামী বিনে অন্য জন,
কভু নহে সুখ মোক্ষদাতা।।”
আর হতভাগী মূর্খ নারী তাই মানিয়া লইল।
ক্রমে জগতের বুদ্ধি বেশী হওয়ায় সুচতুর প্রতিভাশালী পুরুষ দেখিলেন যে, ‘পয়গম্বর’ বলিলে আর লোকে বিশ্বাস করে না। তখন মহাত্মা ঈশা আপনাকে দেবতার অংশবিশেষ (ঈশ্বরপুত্র) বলিয়া পরিচিত করিয়া ইঞ্জিল গ্রন্থ রচনা করিলেন। তাহাতে লেখা হইল, “নারী পুরুষের সম্পূর্ণ অধীনা...”। ...এই ধর্মশাস্ত্রগুলি পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পাও, কোনো স্ত্রী মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতে। ধর্মগ্রন্থ সমূহ ঈশ্বর প্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে।...”ধর্ম”ই আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ হইতে দৃঢতর করিয়াছে, “ধর্মে”র দোহাই দিয়া পুরুষ রমণীর ওপর প্রভুত্ব করিতেছেন।’ (‘অলঙ্কার না Badge of Slavery’ রোকেয়া রচনা সংগ্রহ, বিশ্বকোষ পরিষদ,কলকাতা, পৃ ৬২৬-৬২৭) সমাজে কেন সীতাকে আদর্শ নারী বলে দেখানো হয়েছে এই প্রশ্নের সূচনা করেই এর উত্তরও তিনি দিয়েছেন 'অর্দ্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে। সীতা রামচন্দ্রের অর্দ্ধাঙ্গী, রানি, প্রণয়িনী অন্যদিকে রামচন্দ্রও প্রেমিক এবং ধার্মিক। কিন্তু সীতার প্রতি রামের ব্যবহার দেখে মনে হয় বালকের সঙ্গে একটা পুতুলের সম্বন্ধ। বালক ইচ্ছে করলে পুতুলকে প্রাণপণে ভালবাসতে পারে। পুতুল হারিয়ে গেলে বিরহে অধীর হতে পারে। পুতুল ফিরে পেয়ে আনন্দে আটখানা হতে পারে। আবার বিনা কারণে রাগ করে পুতুলটাকে কাদায় ফেলে দিতে পারে। বালক পুতুলকে নিয়ে মনের মতো খেলতে পারে। কিন্তু পুতুল বালকের কিছুই করতে পারে না। তার হাত, পা, থাকলেও সে অচেতন পদার্থ। ‘রাম বেচারা অবোধ বালক, সীতার অনুভব শক্তি আছে, ইহা তিনি বুঝিতে চাহেন নাই, কেন না, বুঝিয়া কার্য্য করিতে গেলে স্বামিত্বটা পূর্ণমাত্রায় খাটান যাইত না।’ (‘অর্দ্ধাঙ্গী’, রোকেয়া রচনা সংগ্রহ, বিশ্বকোষ পরিষদ, কলকাতা, পৃ. ৩০-৩১) সব ধর্মের মহিলারাই ধর্মীয় বিধানে বৈষম্যের শিকার। তাই হিন্দু, খ্রিস্টান বা মুসলিম বলে আলাদা বিশেষ সুবিধে নেই। এই বক্তব্য একই প্রবন্ধে জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। মুসলিম সমাজের লিঙ্গ বৈষম্যের কথা বলেছেন তীব্র প্রতিবাদী ভাষায়। এখানে দুজন নারীকে একজন পুরুষের সমান ভাবা হয়। পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যার ভাগ পুত্রের অর্ধেক। সেই অর্দ্ধেক ভাগ থেকেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নানা কৌশলে নারীকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে তাই ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের 'অর্দ্ধেক' নহি। তাহা হইলে এইরূপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইত- পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ মাস! পুত্রের জন্য যতখানি দুগ্ধ আমদানী হয়, কন্যার জন্য তাহার অর্দ্ধেক! সেরূপ ত নিয়ম নাই!’ (‘অর্দ্ধাঙ্গী’, রোকেয়ারচনা সংগ্রহ, বিশ্বকোষ পরিষদ, পৃ ৩৫) তাঁর বলিষ্ঠ বক্তব্যে বিশ শতকের প্রথমদিকের সমাজে, সেই সময়ের রক্ষণশীলদের মনে আলোড়ন উঠেছিল। আইন সংস্কারের কথা বললে এখনও কি রক্ষণশীলদের মন তোলপাড় হবে না? মুসলিম পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়ে ও ছেলের সমান অংশ দাবি করলে প্রতিরোধের পথে যাবেন রক্ষণশীলরা। না, শুধু রক্ষণশীল মনের মানুষরাই নন, এতদিন দ্বিগুণ অংশের অধিকার ভোগ করা প্রগতিশীলরাও সম্পত্তির সমভাগের আইনকে আটকাতে নানা অজুহাত তৈরি করবেন। সমাজ মাধ্যমে মেয়ের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে বাদপ্রতিবাদ চোখে পড়ে বৈ কি! বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান-অনুষ্ঠান-প্রথাতে মেয়ের বিয়ে ভয়ানক ব্যয়বহুল। তাই সম্পত্তিতে মেয়ের যতটুকু অংশ আছে সেটাও নাকি ছেড়ে দেওয়া উচিত! মেয়ের বিয়ে একটা ভয়ানক আর্থিক চাপের বিষয় করে ক্রমশ যে সামাজিক অপরাধ বেড়ে চলেছে তাকে নির্মূল না করে, মেয়ের সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া কতটা যৌক্তিক? মূলত মুসলিম আইনগুলির উৎস কোন ঘটনার প্রেক্ষিত। রয়েছে যৌক্তিক পারম্পর্য। তবে ঘটনাগুলি পৃথিবীব্যাপী ঘটে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিত নয়। মরুদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থানের ঘটনা। মুসলিম পৈতৃক সম্পত্তি আইনও সেইভাবেই এলো। আরব দেশের একটি যুদ্ধে মুসলিম সৈনিকদের ব্যাপক পরাজয়ের প্রেক্ষাপটে। কাজী আব্দুল ওদুদ কোরান অনুবাদে লিখেছেন, কোরান শরীফের চতুর্থ সুরা আন-নিসা মদিনায় অবতীর্ণ এবং টীকাকারদের মতে চতুর্থ হিজরি এর অবতরণ কাল। চতুর্থ হিজরি মানে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ। মুসলিম নারীদের সম্পত্তিতে হক পাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘ওহোদের যুদ্ধে ৭০০ মুসলমান যোদ্ধার মধ্যে ৭০ জন নিহত হয়। এর ফলে নারী আর অভিভাবকহীন ছেলে- মেয়ে একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এই সূরায় বিবাহের বিধি- নিষেধ সম্বন্ধে আর নারীদের ও অনাথদের সম্পত্তির অধিকার সম্বন্ধে অনেক কথা আছে।— প্রাচীন আরবীয় সমাজে নারীদের আর অনাথদের সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হত না, কেন না, তারা যুদ্ধ করতে অপারগ।’ (কাজী আব্দুল ওদুদ রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৫, পৃ ২৪১) প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নারীর সামাজিক- আর্থিক নিরাপত্তার দিকে তাকিয়ে যখন সম্পত্তিতে অধিকার এল, বর্তমান সমাজের অগ্রগতির দিকে তাকিয়ে তাহলে সম্পত্তিতে সমান অধিকার আসবে না কেন? ধর্মবিধির জন্ম অতীত ব্যাখ্যা এবং সামাজিক পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারলেই আইন সংস্কারের যুক্তি তৈরি হয়। তারজন্য প্রথম দরকার, ধর্মের নামে ক্ষমতাভোগকারী পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা মুক্ত অবস্থান। এমন ঘটনাও যে বাস্তব সত্য। এক নাস্তিক পুত্র, পিতার মৃত্যুর পর বোনের দ্বিগুণ সম্পত্তির অধিকার নিলেন। বোনের সঙ্গে সমান ভাগ না করার কারণ হিসেবে তাঁর যুক্তি হল, ‘আমি নাস্তিক হলেও আমার পিতা ইসলাম ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। তাই তাঁর বিশ্বাসকে সম্মান জানিয়ে শরিয়ত আইনেই সম্পত্তিভাগ হল।’ এভাবেই লিঙ্গীয় রাজনীতি সমঅধিকারের দাবিকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে ধর্মীয় আইনের ছত্রছায়ায়।
এটা তো স্পষ্ট, পারিবারিক আইনের উৎসেই রয়েছে পিতৃতন্ত্রের আধিপত্য। এইসব পারিবারিক আইন আবার ধর্মকে কেন্দ্র করেই গঠিত। আমাদের দেশের কোন সম্প্রদায় ধর্ম আইনের সংস্কার করেছে, কোন সম্প্রদায় এখনও করেনি। তবে পারিবারিক আইন সংস্কার হলেও বহুদিনের দখলদারি মানসিকতা থেকে পুরুষ ভাবনার মানুষরা মুক্ত হতে পারছে না বলেই বৈষম্য নিয়ে লাগাতার বিরোধিতা দরকার। ইসলামি আইনের উৎস যে কোরান তার চতুর্থ সুরা নিসার ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘পুরুষরা স্ত্রীলোকদের রক্ষণাবেক্ষণকারী (অভিভাবক), যেহেতু আল্লাহ এদের একশ্রেণীর অন্য শ্রেণীর উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছেন। আর যেহেতু তারা তাদের সম্পত্তি থেকে খরচ করে (স্ত্রীদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য); সেজন্য ভালো স্ত্রীলোকেরা অনুগতা, তারা গোপনীয়ের (দাম্পত্য শুচিতার) রক্ষয়িত্রী যেমন আল্লাহ রক্ষা করেছেন; আর যাদের ক্ষেত্রে বিদ্রোহ আশঙ্কা করো তাদের উপদেশ দাও আর তাদের শোবার জায়গা ভিন্ন করে দাও আর তাদের (মৃদু) প্রহার করো, তারপর যদি তারা তোমাদের অনুগতা হয় তবে তাদের সম্বন্ধে অন্য পথ খুঁজো না;…।' (পবিত্র কোরান, অনুবাদ -কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী, ষষ্ঠ খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৫) নারীকে কেন অনুগত থাকতে হবে? একটা মানুষ আর একটা মানুষের উপরওয়ালা হয় কী করে? বাইরের কাজে শ্রম না দিলেও, ঘরের কাজে কি নারী শ্রম দিত না? তাহলে নারী অন্যের সম্পত্তি ভোগ করত এই যুক্তিটাই তো অসার প্রতিপন্ন হয়। অথচ এই যুক্তিতে পুরুষকে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেণি বলে ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাই সামাজিক পরিবর্তন হলেও, আইন সংস্কার করলেও নারীকে পুরুষের অনুগত থাকতে হবে এই মানসিক ব্যাধি থেকে সমাজ-মনের পুরো নিরাময় ঘটছে না।
মুসলিম পুরুষের বহুবিবাহ করার আইন এসেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত মুসলিম সমাজের সংকটকালীন অবস্থায়, চতুর্থ হিজরিতে (৬২৫ খ্রিস্টাব্দে)। তবে বহুবিবাহে পারিবারিক সমস্যা আছে তাই অনুমোদন থাকলেও উৎসাহ দেওয়া হয়নি এই আইনে। এমনকী বহু বিবাহ না করার জন্য সাবধানবাণীও রয়েছে। অথচ ক্ষমতালোভী পুরুষরা বহুবিবাহে অধিকারের ঘোষণা দিয়ে সামাজিক মান্যতা তৈরি করেছে। কোরানে আছে, ‘আর যদি আশঙ্কা করো যে অনাথদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে পারবে না তবে স্ত্রীলোকদের (অনাথদের মা’দের) মধ্যে তাদের বিয়ে করো যাদের পছন্দ হয়— দুইজন ও তিনজন ও চারজন, কিন্তু যদি আশঙ্কা করো যে তাদের সম্বন্ধে ন্যায়বিচার করতে পারবে না তবে একজনকেই (বিয়ে করো),’ (আন— নিসা, প্রথম অনুচ্ছেদ, অনুবাদ- কাজী আবদুল ওদুদ, পৃ ২৪১)। ঐ একই সুরাতে আবার আছে, ‘স্ত্রীদের মধ্যে সমান ব্যবহার তোমরা করতে পারবে না, যদিও তোমরা চাও।’ (আন— নিসা, উনবিংশ অনুচ্ছেদ, ঐ, পৃ ২৫৫)। এখানেই রয়েছে বহু বিবাহজনিত কারণে পারিবারিক জটিলতার মুখ্য ইঙ্গিত। তবু বহুবিবাহ আইনসিদ্ধ হয় কী করে? এদেশের মুসলিম সমাজে বহুবিবাহ তেমন আর ঘটে না। কিন্তু একদম হয় না একথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না। যে পরিবার বহু বিবাহজনিত কারণে সমস্যায় জর্জরিত তাদের আইনের সাহায্য পাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এদেশের আইনে মুসলিম বহুবিবাহ বন্ধ হয়নি। আইন করে বন্ধ হলেই যে ক্ষমতাভোগকারী পুরুষদের আটকানো যাবে তেমনটাও নয়। হিন্দু আইনের দিকে তাকালেই তা প্রমাণ হয়ে যায়। আইন করেও হিন্দু সম্প্রদায়ে বহুবিবাহ পুরো রোধ করা যায়নি। তবে হ্যাঁ, আইনের কাছে আবেদন করা যাচ্ছে সেই আইনভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে। খেসারত দিতে হচ্ছে বা শাস্তি পেতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু লিপিবদ্ধ আইন না করে, বহুবিবাহ সম্পর্কে শুধু নেতিবাচক কথা বললেই কি বহুবিবাহ বন্ধ হবে? ধর্মের বাণী ভঙ্গকারীদের শাস্তি কি সেই সম্প্রদায় বা নাগরিক সমাজ দিতে পারে? তবু কেন চুপ থাকছি আমরা? দেশের ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন জরুরি। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানের সঙ্গে, নারীর নিজ নিজ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চিহ্ন বহনের প্রবণতা আরও বাড়ছে। তবে একইসঙ্গে যে সম্প্রদায়ের রক্ষণশীলরা নারীকে অবদমিত করে রাখার আইন টিকিয়ে রাখতে চাইছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করা জরুরি।
বিধিব্যবস্থার ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ। নানা উপদেশ এবং সতর্কবাণীসমেত তালাক দেওয়ার মৌখিক ক্ষমতা কিন্তু পুরুষের হাতেই ন্যস্ত। তালাক হয়ে যাওয়ার পর সেই তালাকপ্রাপ্ত পূর্ব স্ত্রীকে বিয়ে করতে চাইলে আর সরাসরি বিয়ে করা যাবে না। এখানে বৈধ- অবৈধের নির্দেশবাণী রয়েছে। যা শুধু সেই তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকেই পালন করতে হবে। ‘তারপর ঐ স্ত্রীকে যদি সে তালাক দেয় তবে যে-পর্যন্ত না ঐ স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করছে তারপক্ষে সে বৈধ হবে না। তারপর যদি সে (দ্বিতীয় স্বামী) তালাক দেয় তবে তাদের আবার মিলনে কারও কোনও দোষ নেই।’ (সুরা বাকারা, কোরানসূত্র, অনুবাদ-মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ ৪০২) পূর্ব স্ত্রী অন্য আর একজনকে বিয়ে করে আবার দাম্পত্যের নামে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন কাটিয়ে পূর্ব স্বামীর জন্য শুদ্ধ ও বৈধ হয়ে ফিরে এল। কিন্তু স্বামীকে বৈধ করা হল কী দিয়ে? বৈধ করার নামে মধ্যবর্তীকালীন বিয়ে (হালালা বা হিল্লা বিয়ে) নামক অশ্লীলতা ভারতবর্ষে এখনও আইন করে বন্ধ হয়নি। এই বিয়ে-বন্ধের আইন না হলে, কোথাও এই অশ্লীলতা ধর্মবিধির সমর্থনে ঘটাতে চাইলে তা রোধ করা কঠিন হবে। অথচ ১৯৬১ সালে পাকিস্তানে হালালা বিয়ে বন্ধের আইন হয়ে গিয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে আইন সংস্কারের দাবি না উঠলে সংস্কার হবে কী করে? নারীর প্রতি শোষণ, বঞ্চনা, অপমান আর বৈষম্য যে আইন ধারণ করে আছে তা সংস্কার করা জরুরি বুঝেই তো স্বাধীন ভারতবর্ষ হিন্দু কোড বিল পাস করেছে এবং পাকিস্তান মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার করেছে। যদিও আইন সংস্কারের কাজে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁদেরও। তাই প্রতিরোধ ভেঙ্গে আমাদেরও আইন সংস্কারের পথে এগোতে হবে।
নারীকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে, অবদমনের জন্যে আবার তৈরি হয়েছে লিঙ্গরাজনীতির ভাষাও। এই কৌশলের শুরু প্রাচীন ভারতের সমাজ ও তাঁদের রচিত সাহিত্য থেকেই। তবে সে কেবল ভারতে নয়, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় নারীর জীবনে ভাষার আধিপত্য সর্বত্র এক। ‘বৈদিক সমাজে নারীর স্থান’ প্রবন্ধে সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন, যাযাবর পশুচারী আর্যরা ভারতে প্রবেশ করার পর ধীরে ধীরে তারা কৃষিজীবী হয়ে ওঠে। ‘ক্রমে ক্রমে “কুল" -এর প্রবর্তন হয়, অর্থাৎ একটা বাড়িতে তিন চার পুরুষের পল্লবিত বৃহৎ পরিবার। তারপর আসে যৌথ পরিবার, পুরুষের সম্পর্ক ধরে দু-তিন পুরুষের পরিবার, সবশেষে একক পরিবার, এক পুরুষের সংসার। এসবের সঙ্গেই উৎপাদন ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, কিন্তু একটি ব্যাপার ক্রমশ পরিণতির দিকে এগোচ্ছিল : সমাজে শূদ্র ও নারীর স্থানের অনিবার্য অবনমন, অর্থৎ ক্রমেই নারীর স্থান সমাজে ও পরিবারে নেমে যাচ্ছিল। উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশ ক্রমেই কমে যাচ্ছিল, যদিও গৃহকর্মে তার পরিশ্রম ও দায়িত্ব যথেষ্টই ছিল তবু তাকে "ভার্যা" অর্থাৎ অন্যের দ্বারা ভরণীয়া, স্বামীর অন্নে প্রতিপালিত এই সংজ্ঞা দেওয়া হল। মনে রাখতে হবে "ভৃত্য" আর “ভার্যা" শব্দ দুটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ একই : যাকে ভরণ করতে হয়।’ (সুকুমারী ভট্টাচার্য - প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা) ভাষা হলো সংস্কৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্রত্যেক সংস্কৃতির মানুষ নিজস্ব ভাষা- প্রয়োগ ভাবনায় চালিত হয়। তাই নারীর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনে, পিতৃতান্ত্রিক মস্তিষ্ক থেকে কেবল নারীদের জন্যই কিছু শব্দ, প্রবাদ- প্রবচন, হাস্যকৌতুক তৈরি হয়েছে। ভাষার রাজনীতিতে এভাবেই নারী-বৃত্ত, নারী- পরিসর গঠন করে নারী-পুরুষের ক্ষমতার প্রবল দ্বন্দ্বের সূচনা করেছে। পিতৃতান্ত্রিক ভাষার অভিসন্ধি বুঝতে আবার উদাহরণ নিচ্ছি সুকুমারী ভাট্টাচার্য থেকেই- ‘বিধবা বেঁচে থাকলেই সব সময়ে তার জীবন সুখের হত না, তাই প্রার্থনা শুনি, "যেন ইন্দ্রাণীর মত অবিধবা হই।” [তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩/৭/৫/৫১] বলা বাহুল্য, সমস্ত ভারতীয় সাহিত্যে “যেন বিপত্নীক না হই” এমন প্রার্থনা কোথাও নেই। বরং এখন এর উল্টো কথাই শোনা যায়, “ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গোরু।” সম্পত্তি হিসেবেও স্ত্রীর স্থান গরুর নিচে, কারণ নতুন গরু কিনতে টাকা লাগে, আর নতুন বৌ আনলে টাকা পাওয়া যায়।’ (‘বৈদিক সমাজে নারীর স্থান’ - প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য)
ফরাসি নারীবাদী সমালোচক, তাত্ত্বিক, ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার 'হেলেন সিক্সাস খুঁজে বের করেছেন এই ভাষার এক দ্বিমাত্রিক কৌশল, তুলনামূলক বৈপরীত্যের এক ছক, যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় পুরুষের সক্রিয়তা ও মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তা।
সূর্য : চন্দ্র
সংস্কৃতি : প্রকৃতি
দিবস : যামিনী
মেধা : আবেগ
বুধিমত্তা : অনুভূতিশীলতা
প্রজ্ঞা : বেদনা
সক্রিয় : নিষ্ক্রিয়
পুরুষ : নারী
ভাষার সূক্ষ্ণ কৌশলে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কে যন্ত্রী আর কে যন্ত্র। প্রথম লিঙ্গ পুংলিঙ্গ, যে প্রত্যক্ষ, ইতিবাচক, শক্তিমান, বিজয়ী আর স্ত্রীলিঙ্গ দ্বিতীয়, যে সব সময়েই অবলা, অপ্রত্যক্ষ, নেতিবাচক, পুরুষের জয়ে গরবিনি।’ (মল্লিকা সেনগুপ্ত- গদ্যসমগ্র -‘স্ত্রী লিঙ্গ নির্মাণ’, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা)। অর্থাৎ পুরুষ শব্দের সঙ্গে জুড়ে আছে সূর্যের প্রখরতা, দিনের মুখরতা, বীরত্ব, মেধা, বুদ্ধি, জ্ঞান। পুরুষ শব্দের প্রচুর অর্থ আছে অভিধানে যা সত্যিই অবাক করার মতো । নর, ঈশ্বর, পরব্রহ্ম, মানুষ, আত্মা, বংশের ধারা ইত্যাদি শব্দগুলোর সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতা আর শক্তির জোট। উল্টোদিকে নারীর সঙ্গে জুড়ে আছে সুখ-দুঃখের অনুভূতিতে, কোমলে-কাতরে, গৃহপরিসরে, আবেগীশ্রম (emotional labour) নিংড়ানো শোষণের ভাষা। নারী শব্দ নরের বিপরীতে পেয়েছে অবলা, ললনা, রমণী, অঙ্গনা, মানবী, কামিনী ইত্যাদি। অবলা মানে বলহীন। তারমানে নারী অক্ষম, তার বল নেই। শব্দ এক একটা প্রতীক। সেই প্রতীক জায়গা নেয় মানুষের মস্তিষ্কে। প্রভাবিত করে ভাবনাকে।
অপুত্রকং গৃহং শূন্য। এর অর্থ পুত্রের জন্ম দিতে না পারলে সেই বাড়ি শূন্য। অনেক কন্যা সন্তান থাকলেও সে বাড়ি পূর্ণ হবে না, যদি না একটি অন্তত পুত্রের জন্ম না হয়। ‘যুগ যুগ ধরে পরিবারে ছেলে -শিশুর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য এমন অসংখ্য শ্লোক, প্রবাদ-প্রবচন অনবরত রচিত হয়েছে। পুত্রসন্তান জন্ম না দিতে পারার অপরাধে বিড়ম্বিত, বিপর্যস্ত হয়েছে নারীর জীবন। শুধু একটি পুত্রসন্তানের জন্য একাধিক বিয়ে করেছে পুরুষ। কারণ এই শ্লোককে বৈধতা দেওয়ার জন্য যে অপর শ্লোকটি রচিত হয়েছিল তা হলো ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’। অর্থাৎ নারীর দায়িত্ব হচ্ছে অনবরত পুত্র উৎপাদন করা। নইলে তাকে লাঞ্ছিত, নিগৃহীত হতে হবে। এভাবে পুরুষ নিজের পক্ষে যোগ করেছে নানা শাস্ত্র, শ্লোক, বচন।’ (সেলিনা হোসেন- ঘরগেরস্থির রাজনীতি, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা, বাংলাদেশ)। স্বামী শব্দের মধ্যেও অধিপতির দাপট রয়েছে। তাই বিবাহিত পুরুষকে কারো স্বামী শব্দের সম্ভাষণের ঘোর বিরোধী ছিলেন রোকেয়া। স্বামী মানে ঈশ্বর, অধিপতি, প্রভু বা মালিক। আমরা যখন বলি ভূস্বামী অর্থাৎ ভূমির (জমির) প্রভু বা মালিক। গৃহস্বামী মানে গৃহের প্রভু, ঈশ্বর বা মালিক। আর বিবাহিত স্বামী মানে কোন স্ত্রীর ঈশ্বর, প্রভু বা মালিক। ‘আর প্রভু কিংবা ঈশ্বর এমনিই অধিষ্ঠান করেন এক উচ্চ স্থানে, আর তাই যে- বিবাহে একজনকে স্বামীর চরিত্রে অবতীর্ণ হতে হবে, সেই বিবাহ প্রতিষ্ঠান যে-সাম্যের বিপরীতগামী তা বুঝতে কোথাও অসুবিধা হয় না।’ (সম্রাজ্ঞী বন্ধ্যোপাধ্যায়- মেয়েদের ছেলেধরা, ধানসিড়ি, কলকাতা) পতি শব্দের অর্থও প্রভু, পালক। পতি শব্দের বিপরীতে তৈরি হয়েছে পত্নী। অর্থের দিক থেকে পত্নী শব্দ নারীর সামাজিক অবস্থানকে ক্ষমতার উচ্চতায় নিয়ে যায় না। যেকোনও ক্ষমতা পাওয়ার অধিকার একমাত্র পুরুষদেরই। ফলে তৈরি করা হলো আধিপত্যের শব্দ রাষ্ট্রপতি, সমাজপতি, সভাপতি, দলপতি। আর নারীর জন্য তৈরি শব্দ পতিব্রতা। তাই রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যিনি থাকবেন তিনি পুরুষ হোন বা নারী হোন তাঁকে আমরা রাষ্ট্রপতি হিসেবেই সম্বোধন করি। প্রতিভা পাটিল বা দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রের ক্ষমতাপ্রধান হলেন প্রচলিত পুংলিঙ্গ শব্দ ‘পতি' (রাষ্ট্রপতি) ধারণ করে। ‘পতি' বা প্রভু পুংলিঙ্গ শব্দ যুক্ত না করলে নারীর ক্ষমতা যে গৃহীত হবে না পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয়। তাই পতি হটিয়ে লিঙ্গ নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রধান অর্থবহ কোন শব্দের আমদানি আজও করে উঠতে পারেনি। কোনও নারী সভা পরিচালনার দায়িত্ব পেলে তাঁকেও সভাপতি হয়েই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। 'সভামুখ্য' হওয়ার চল শুরু করেছেন কিছু সভার সচেতন আয়োজকগণ। কিন্তু ‘সভামুখ্য' বা ‘সভাপ্রধান' শব্দটি এখনও বহু সভার বাইরে চালু হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।
লিঙ্গরাজনীতি থেকে সৃষ্ট নারীর শরীরকেন্দ্রিক কিছু শব্দ যা মানুষকে আচ্ছন্ন ও প্রভাবিত করে রেখেছে। সামাজিক- অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে নারীর শরীরের দখলদারি নিল পুরুষ। সম্পত্তিতে গোষ্ঠীগত স্বত্বাধিকার লোপ করে যখন ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো তখন থেকেই শুরু নারীকে অবদমন। পিতা তার সম্পত্তি রেখে যাবে পুত্রের জন্য। ‘...ব্যক্তিগত মালিকানার দিনে সম্পত্তি যখন একান্ত ও নিশ্চিতভাবে নিজেরই সন্তানের জন্যে রেখে যাবার উগ্র বাসনা জাগল, তখন যাতে ঔরসজাত সন্তানটিকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করতে পারা যায় তাই স্ত্রীকে অন্য সব পুরুষ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখার এমন প্রয়োজন বোধ হল। তাছাড়া স্ত্রীও তো তখন সম্পত্তি, অতএব সে যাতে অন্যের ভোগ্যা না হয়, তার ওপরে ব্যক্তিগত মালিকানা তাই ষোলআনা জাহির করা চাই।… তাই তার স্ত্রীর সম্বন্ধে তার পাহারা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গেল যখন নারী হল কয়েদি এবং স্বামী তার প্রহরী। এই হল উত্তর-বৈদিক যুগের সমাজচিত্র। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল কিন্তু সে ব্যতিক্রমই। পরবর্তী দুটি সহস্রাব্দে সেকলগুলো দৃঢতর হয়ে নারীকে পাকে পাকে ফেরে ফেরে বেঁধেছে, জোর তালা আরও মজবুত হয়েছে।’ (সুকুমারী ভট্টাচার্য- ‘বৈদিক সমাজে নারীর স্থান’, প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা)। তৈরি হল নারীর শরীর পবিত্র রাখা বা অপবিত্র হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত কিছু শব্দ মস্তিষ্কে গুঁজে দেওয়ার ছক। সতী, সাধ্বী, অসতী, পতিতা, বেশ্যা, ছিনাল প্রভৃতি শব্দ নারীর শরীরের সঙ্গে যুক্ত। যৌন দুর্নীতি সম্বন্ধে সমাজে দুরকমের বিধান। পুরুষের জন্যে একরকম, নারীর জন্যে একরকম। যৌন অপরাধে নারীই কেবল অভিযুক্ত। তাই সতী, সাধ্বী শব্দের পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। যৌন অপরাধে সমাজ পুরুষকে যে প্রশ্রয় দিয়েছে তা প্রমাণ হচ্ছে পুরুষের জন্যে এধরনের শব্দ তৈরির উদাসীনতা দেখে।
অসতী, পতিতা, গণিকা, নটী, ভ্রষ্টা, বেশ্যা, দ্বিচারিণী প্রভৃতি শব্দগুলি দিয়ে নারীদের শারীরিক অপবিত্রতা ঘোষণা করা হয়। শরীর যদি অপবিত্রই হয় এবং অপবিত্র হওয়ার কাজে যারা যুক্ত সেই পুরুষদের শরীর কিন্তু পবিত্র রইল তাই এই জাতীয় শব্দ তৈরির দরকার হয়নি। সৎ বা অসৎ একটি লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দ। পুরুষ সততার জন্যে প্রশংসিত এবং অসততার জন্যে ধিকৃত হয় এটা সমাজের পরিচিত ছবি। কিন্তু সতী বা অসতীর পুরুষার্থক কোনও দেহকেন্দ্রিক শব্দের ভার তাকে বহন করতে হয় না। পতিছাড়া পুরুষগামিণী নারীকেই বলা হয় দ্বিচারিণী। কিন্তু পত্নীছাড়া নারীগামী পুরুষদের জন্যে এধরনের কোনও শব্দ তৈরি হয়নি। বাংলা ভাষায় দ্বিচারী বলে কোনও শব্দ নেই। নারীকে কেবল শরীর সর্বস্ব করে গড়ে তোলার অভিসন্ধি থেকেই একতরফা নারীর বিরুদ্ধে শব্দ নির্মাণ করা হয়েছে। ‘বুদ্ধি ও কাজ দিয়ে পুরুষদের বিচার করা হয়। সিন্দুকে তুলে রাখা গুরুগম্ভীর শব্দ দিয়ে তাদের আখ্যায়িত করা হয়। কোটিপতি, লাখপতি, সভাপতি, বীরপুরুষ, লিডার, জ্ঞানতাপস, বলবান, শক্তিমান এই শব্দগুলি নারীদের ক্ষেত্রে কখনও সংযুক্ত করা হয় না। …নারীদের দেবী, মমতাময়ী, সতী, কোমলমতি ইত্যাদি শব্দের মোড়কে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে।’ (তামান্না এমি- ‘নারীদের শব্দ দিয়ে জব্দ করার রাজনীতি’- লিঙ্গছকের থাবা, চরাচর প্রকাশনী, কলকাতা)। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে সংরক্ষিত করার কূটচাল চেলেছে। উপেক্ষিত হয়েছে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা, জ্ঞানের ক্ষেত্র, মেধার বিকাশ। ‘নারীর শরীরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সৌন্দর্য বাণিজ্য, বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা, ফ্যাশন ডিজাইন প্রদর্শনী, পতিতালয় ইত্যাদি।’ (সেলিনা হোসেন- ঘরগেরস্থির রাজনীতি)।
যে সমাজে ‘কন্যাদাগ্রস্ত' শব্দের আর্ত ধ্বনিকে আত্মস্থ করেছি। ‘পুত্রদায়গ্রস্ত' শব্দের চেহারা দেখিনি। স্ত্রীকে ভালোবাসার রাশ টেনে ধরার জন্যে স্ত্রৈণ শব্দ নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়ে, সেই ভাষারাজনীতির বিরুদ্ধে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ কমলা ভাসিনকে তো শুরু করতেই হয় ‘জেন্টললেডিস অ্যান্ড ম্যান' বলা। সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘মেয়েদের ছেলেধরা’ ( ধানসিড়ি, কলকাতা) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষার সংস্কারের দাবি বড়ো একটা ওঠেনি, এমনকি ভাষাবিদরা লিঙ্গের এই পক্ষপাতের দিকে তেমন একটা নজরও দিতে চাননি। কিন্তু আশার কথা এই যে খানিক অজান্তে, খুব ধীরে যেন এক আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। অজান্তে কারণ আন্দোলনের কথা মাথায় নিয়ে কেউ করছেন না কাজটা। কিন্তু ধরা যাক, নতুন করে লক্ষ্মীর পাঁচালি লেখা হচ্ছে, লিখছেন আধুনিক কবি যশোধরা রায়চৌধুরী ও সাহিত্যিক তৃষ্ণা বসাকরা। সতী-অসতীর বেড়াজাল ভেঙে আধুনিক কবি অঞ্জনা চক্রবর্তী নিজের একটি কবিতার বইয়ের নাম দিচ্ছেন ‘অসতী কথন’, কিংবা রাকা দাশগুপ্ত নাম দিচ্ছেন 'অলক্ষ্মীর ঝাঁপি’, আমার নিজের একটি বইয়ের নামও ‘বেহায়া একুশই’ অর্থাৎ এই অলক্ষ্মী, অসতী আর বেহায়ারা পুনর্নিমিত হচ্ছে সমাজে, মেয়েদেরই হাতে। শুরু হচ্ছে এক কাউন্টার ন্যরেটিভ।’
হরমোনজনিত কারণে পুরুষ আর নারী আলাদা। আলাদা তাদের জৈবিক ক্ষমতাগুলিও। কিন্তু নারী- পুরুষ উভয়েই সুযোগ পেলে জ্ঞানী হতে পারে, বুদ্ধিমান হতে পারে, সৃষ্টিশীল হতে পরে, সাহসী হতে পারে, নেতৃত্ব দেওয়ার উপযোগী হতে পারে। এসব গুণের জন্যে শরীরের জোর লাগে না, আলাদা কোনও হরমোনও নেই। পুরুষ উচ্চাসনে বসবে বলেই নিজের পক্ষে নিয়েছে ধর্মীয় আইনের সুবিধে। এই সুবিধেজনিত কারণে সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। আর লিঙ্গরাজনীতির ভাষা দিয়ে সমাজ-মননকেও কুক্ষিগত করেছে। লিঙ্গবৈষম্য দূর করার চর্চা ব্যাপকহারে বাড়ানো দরকার। আইনে নারীপুরুষের বিভাজন দূর করে, ভাষার দাসত্ব মুছে, লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজের দাবিতেই আমাদের পথ চলা জারি থাক।
0 Comments
Post Comment