রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

  • 08 December, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 2018 view(s)
  • লিখেছেন : মালেকা বেগম
বিশ শতকের প্রথম দশকে বাংলার সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে, নারীশিক্ষার বিস্তারে, নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলনে, নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায়, সংগঠন প্রতিষ্ঠায়, নারী আন্দোলনের নেত্রী সংগঠক ও কর্মী তৈরি করার কাজে, নারীর ভোটাধিকার-আন্দোলনে এবং সাহিত্যচর্চায় যাঁরা ব্রতী হয়েছিলেন; তাঁদের মধ্যে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অনন্য। বড়ই অমর্যাদাকর-বেদনাদায়ক-মর্মপীড়াদায়ক বাধার মধ্য দিয়ে তিনি জীবনব্যাপী সাধনা করেছেন সমাজপ্রগতির জন্য। ৯ ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিন উপলক্ষ্যে দ্বিতীয় প্রবন্ধ।

বিশ শতকের প্রথম দশকে বাংলার সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে, নারীশিক্ষার বিস্তারে, নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলনে, নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায়, সংগঠন প্রতিষ্ঠায়, নারী আন্দোলনের নেত্রী সংগঠক ও কর্মী তৈরি করার কাজে, নারীর ভোটাধিকার-আন্দোলনে এবং সাহিত্যচর্চায় যাঁরা ব্রতী হয়েছিলেন; তাঁদের মধ্যে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অনন্য, বিশিষ্ট মর্যাদাসম্পন্ন স্বীকৃতি ও অবস্থান অর্জন করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতির জন্য তিনি আগ্রহী ছিলেন না। বড়ই অমর্যাদাকর-বেদনাদায়ক-মর্মপীড়াদায়ক বাধার মধ্য দিয়ে তিনি জীবনব্যাপী সাধনা করেছেন সমাজপ্রগতির জন্য।

জন্ম ও বংশপরিচয়

১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর (২৫ অগ্রহায়ণ ১২৮৭) বৃহস্পতিবার* রোকেয়ার জন্ম হয় অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানাধীন পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত জমিদার পরিবারে। পিতা মৌলবী জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের চৌধুরী (মৃত্যু ১৯১৩), মাতা মোসাম্মাৎ রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী (মৃত্যু ১৯১২)। এঁদের চতুর্থ সন্তান ছিলেন রোকেয়া। তাঁর অগ্রজা করিমুন্নেসা খানম (১৮৫৫-১৯২৬), দুই অগ্রজ আবুল আসাদ মোহাম্মদ ইব্রাহিম সাবের** ও খলিলুর রহমান।

* মহিলা-র সম্পাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন রোকেয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে রোকেয়ার পরিচিতি দেন নানা প্রসঙ্গে (দ্র. পরিশিষ্ট ১-৩)। সেখানে বয়সের যে হিসেব দিয়েছেন তাতে জন্মসাল ১৮৮০-ই দাঁড়ায়। রোকেয়া নিজে লিখেছেন তাঁর সমবয়সী ভগ্নীপুত্র হালু তাঁর থেকে এক বছরের বড়। (অবরোধ-বাসিনী ২৩) হালু অর্থাৎ আবদুল হালিম গজনভীর জন্ম ১৮৭৯-তে। সে হিসেবেও রোকেয়ার জন্মসাল ১৮৮০।

** ইব্রাহিম সাবের ১৮৮৫-তে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি-এ পাস করেন। মতিচুর ১ম খণ্ডের ২য় সংস্করণ প্রকাশের (৩০ মার্চ ১৯০৮) পূর্বে এঁর মৃত্যু হয়। আবু জায়গাম সাবের (মৃত্যু ১৯২৪) এবং অনুজা হোমায়রা তোফাজ্জল হোসেন (১৮৮৩-১৯৬২)।

রোকেয়ার তিনজন বিমাতা—সাফিয়া, সোনবর, সালমা (নিঃসন্তান) এবং ছয়জন বৈমাত্রেয় ভাই—আবুল মাজহার, আবুল ফাজেল জর্জেস, সেকান্দার, সোলেমান, ইসমাইল ও মসিহুজ্জামান এবং তিনজন বৈমাত্রেয় বোন—বদররুন্নেসা, আসিয়া ও সফুরা। রোকেয়া বিমাতা ও বৈমাত্রেয় ভাইবোনদের কথা লেখেননি। বৈমাত্রেয় ভাই মসিহুজ্জামান রচিত বংশপরিচয় ও পারিবারিক ইতিহাসবিষয়ক একটি পাণ্ডুলিপি (১৯৬৯) থেকে বিভিন্ন গবেষক এই সকল তথ্য জেনেছেন।

‘বেগম রোকেয়া’ নামে সর্বজন সম্বোধিত, পরিচিত ও লিখিত হলেও এটি তাঁর বাল্যকালের বা জন্মকালের নাম নয়। নিজ পরিবারে নাম রাখা হয়েছিল রোকেয়া খাতুন। তিনি নিজে ইংরেজি অক্ষরে স্বাক্ষর করেছেন ‘ Roquiah Khatun’ নামে। বিয়ের পর তাঁর  লেখা প্রবন্ধ, চিঠি এবং বইয়ে রোকেয়া সাক্ষাওয়াৎ হোসেন অথবা মিসেস্ আর এস হোসেন, ইংরেজিতে  Mrs. R.S. Hossein নামে স্বাক্ষর করেছেন। তাঁর অগ্রজা কবি করিমুন্নেসা খানম নিজের একটি আলোকচিত্র বোনকে (বিয়ের পরে) ১৮৯৬ সালে উপহার দিয়ে নিজ হাতে লিখে দিয়েছিলেন:

অসীম স্নেহের চিহ্ন স্বরূপ

স্নেহ প্রতীমা প্রাণাধীকা

অনুজা শ্রীমতী রকেয়া খাতুন হোসেনের

সুকোমল কর কমলে

অর্পিত হইল।

৩১। ৫। ৯৬।

তোমার সহোদরা

শ্রী ‘ক’।

অফিসিয়াল লেখায়, চিঠিতে তিনি স্বাক্ষর করেছেন  R.S. Hossein নামে। ব্যক্তিগত চিঠিতে প্রধানত ‘রোকেয়া’ নাম স্বাক্ষর করেছেন, ঘনিষ্ঠজনকে লিখেছেন ‘রকু’ স্বাক্ষর করে।

শিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে রোকেয়া নিজে বলেছেন যে, অগ্রজা করিমুন্নেসাই তাঁকে (বাংলা) বর্ণ পরিচয় পড়তে শিখিয়েছিলেন। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান সাধনার শিক্ষা তিনি শৈশবে পেয়েছিলেন অগ্রজ ইব্রাহিম সাবেরের কাছ থেকে। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি পাননি। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতার তালতলায় অবস্থানকালে এক মেম শিক্ষিকার কাছে কিছুদিন পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অগ্রজ দুই ভাই সে সময় কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়তেন। সমাজের বিরোধিতার ভয়ে এবং নিজের মায়ের স্ত্রীশিক্ষাবিরোধী কুসংস্কারের চাপে মেম সাহেবের কাছে রোকেয়া পড়াশোনা চালাতে পারেননি।

তাঁর শিক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠেছে—বাল্যকালে-শৈশবে, কৈশোরে এবং তারুণ্যে। ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, পারসি ভাষার বই পড়ে। ইংরেজি, বাংলা, উর্দু পত্রিকা নিয়মিত পড়ে। সেসব বইপত্র থেকে জীবনের রস ও মর্মবাণী গ্রহণ করেছেন।

ভাই-বোনের সহযোগিতায় ইংরেজি-বাংলা শিক্ষা চর্চার ফলে এবং বিয়ের পর শিক্ষিত স্বামীর সর্বাত্মক সহযোগিতার ফলে স্বশিক্ষিত রোকেয়া ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, পারসি ভাষায় পড়া, লেখা ও ভাষণদানে চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিলেন।

তবুও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় আকর্ষণ এবং স্বপ্ন। বিভিন্নজনের কাছে পড়ে, বিভিন্ন নারী শিক্ষাকেন্দ্রে যুক্ত থেকে, গ্রন্থাগারে পড়ে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করেছিলেন। কিন্তু নানা ব্যক্তিগত অসুবিধায় পরীক্ষা দিতে পারেননি। তিনি ১৯১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে লেখেন: ‘আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা কেয়ামতের পরদিন দেওয়া হইবে। এখন পড়া তৈরী করিতেছি।’ ডিগ্রিলাভের জন্য, অন্তত, ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাসের জন্য (নিজের এবং অন্যের) তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন:

 “শামসুন নাহার মাহমুদকে, বেগম রোকেয়া দুঃখ করে আমার কথা বললেন যে, ওই মেয়েটিও যদি ম্যাট্রিকটা পাশ করত, তবে ওতো কবি হয়ে গেছে—ওতো ফুল কবি।...ম্যাট্রিক পাশ করেছে নাহার, সে বি-এ পড়বে, এম এ পড়বে, জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে, যাই হবে সেটাই আমরা আশা করি।”

কবিতা লেখার প্রতিযোগিতায় গ্র্যাজুয়েট বিদুষীদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে তিনি প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১.১০.১৯১৩ তারিখ মৌলভী মো. ইয়াসিন সাহেবকে লিখেছেন: 

‘No, I am not unfortunate provided this school works well and I can achieve my literary talents. Only the other day I became very happy when I won the first prize in a rhyme competition. There were some under-graduates and graduates and above all some English lady graduates too among the lady competitors.'

গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জনকারী শিক্ষিতদের তিনি সমীহ করতেন— সেই তুলনায় নিজেকে নগণ্য মনে করতেন। প্রাসঙ্গিক বিষয়টি ১৯২৬ সালে তাঁর লেখা একটি চিঠিতে উল্লিখিত আছে:

কল্যাণীয়া মেরী,

...আলীগড়ে মাত্র তিনদিন ছিলাম। শহর দর্শনের সৌভাগ্য ঘটে নাই। তিনদিনই সভা-সমিতি লইয়া দৌড়াদৌড়ি করিতে হইয়াছে। সেখানে কত মুসলমান গ্র্যাজুয়েট ও আন্ডার গ্র্যাজুয়েট মহিলা উপস্থিত ছিলেন। তাহাদের সম্মুখে কি আমি মুখ খুলিতে পারি? কেহ তামাসা করিয়া সংবাদপত্রে আমার বক্তৃতার কথা লিখিয়া থাকিবে। আমি শিক্ষিত মহিলাবৃন্দকে দেখিয়া পুণ্য অর্জন করিয়াছি। আমার চক্ষুকর্ণ ধন্য হইয়াছে।...

তোমার স্নেহের আপা

রোকেয়া

গ্র্যাজুয়েট বিদুষীদের কথায় তিনি মর্মাহতও হয়েছেন। তিনি তাঁর শেষ অসমাপ্ত লেখায় লিখেছেন: ‘কতিপয় বিদুষী গ্র্যাজুয়েটের কথাবার্তা শুনিয়া আমি মর্মাহত এবং একটু হতাশ হইয়াছি।...’

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্থাৎ ডিগ্রীর শিক্ষা ব্যক্তিকে যেভাবে শিক্ষিত করে তোলে তার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই রূপই তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সে বিষয়ে আলোকপাতও করেছেন। নিজে ডিগ্রী অর্জন করার সুযোগ পাননি বলে যেমন মর্মবেদনায় আপ্লুত হয়েছেন, তেমনি ডিগ্রী না থাকলেও উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ধরনের বিষয় যেমন সাহিত্য, ভাষা চর্চা, বিজ্ঞান, ভূগোল, ধর্মীয়শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজবিজ্ঞান, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান, কৃষিবিদ্যা, আইন, শিক্ষানীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাজনৈতিক মানবাধিকার প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা তিনি করেছেন শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, মানবকল্যাণে ও সমাজ প্রগতির কর্মসাধনায় নিয়ত নিবেদিত থাকার জন্য।

ধর্মীয় বাধার নামে সমাজে বিতর্কিত ও প্রগতিবিরোধী নানা ধর্মীয়-প্রচারণা নারীসমাজকে অবরোধে রেখেছে, শিক্ষা-বিয়ে-সম্পত্তি-রাজনীতি বিষয়ে অধিকার, ভোটাধিকার, মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে—এই চেতনায় রোকেয়ার উত্তরণ ঘটেছে পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে।

নিজের জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি ‘রক্ষণশীল’ মা রাহাতুন্নেসা  অগ্রজ ইব্রাহিম সাবের, অগ্রজা করিমুন্নেসা খানম এবং স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। ধর্ম বিষয়ে তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার মধ্যেও ধর্মানুভূতিকে আঘাত না দেওয়ার বিচক্ষণতা তিনি এঁদের কাছ থেকেই অর্জন করেছেন।

রোকেয়া মায়ের কাছে ছেলেবেলায় কোরআন শরীফের ঢাল হয়ে রক্ষা করার কথা শুনে শিখেছেন, ‘কোরআন শরীফের বিধান অনুযায়ী ধর্ম্মকর্ম, আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করবে।’

রোকেয়ার মায়ের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘তিনি রক্ষণশীল’, ‘অবরোধ প্রথার পক্ষপাতিনী’ শিক্ষার জন্য আগ্রহী রোকেয়াকে প্রহার করেছেন, ইত্যাদি। সেই সঙ্গে উল্লেখ্য যে, মায়ের স্নেহশীল দরদের কথা তিনি বলেছেন ‘নার্স নেলী’ লেখায়—

‘চাচিজান একমাত্র তিন বৎসরের কন্যা রাখিয়া পরলোক গমন করিলেন। চাচাজান চক্ষে আঁধার দেখিতে লাগিলেন। কন্যার প্রতিপালনই তাঁহার প্রধান সমস্যা। আমার মাতা তাঁহাকে আশ্বাস বাক্যে বলিলেন, “তুমি অত ভাবছ কেন? নয়ীমার মা মরেছেন, আমি ত মরি নাই। যে কোলে আমার তিন মেয়ে... সে কোলে কি নয়ীমার জায়গা হবে না?” পিতৃব্য যেন অকূল সাগরে ডুবিতে ডুবিতে কূল পাইলেন।’

কলকাতায় বাস করার সময়ে মা ছিলেন তাঁর সঙ্গে। মায়ের মৃত্যুতে রোকেয়া একাকী হয়ে যান।

‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসটি (রচনা ১৯০২, প্রকাশ ১৯২৪ সালে) অগ্রজ ইব্রাহিম সাবেরকে উৎসর্গ করে তিনি নিবেদনে লিখেছেন:

আজি মনে পড়ে, আমার ভক্তিভাজন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধর্ম্ম ও সমাজ সম্বন্ধে একটি গল্প বলিয়াছিলেন; সমস্ত গল্পটি মনে নাই, এটুকু কেবল স্মরণ হয়: একজন ধর্ম্ম-পিপাসু ব্যক্তি জনৈক দরবেশের নিকট যোগ শিক্ষা করিতে চাহিল। তাহাতে দরবেশ বলিলেন, “চল আমার গুরুর নিকট।” সে গুরু একজন হিন্দু। হিন্দুসাধু বলিলেন, ‘আমি কি শিখাইব, আমার গুরুর নিকট চল।” তাঁহার গুরু আবার একজন মুসলমান দরবেশ! শিক্ষার্থী দরবেশকে এই হিন্দু-মুসলমানে মিশামিশির কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন: ধর্ম্ম একটী ত্রিতল অট্টালিকার ন্যায়। নীচের তলে অনেক কামরা, হিন্দু-ব্রাহ্মণ, শূদ্র, ইত্যাদি বিভিন্ন শাখা; মুসলমান,—শিয়া, সুন্নী, হানাফী, সাফী প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়; ঐরূপ খ্রীস্টান,—রোমান-কাথলিক, প্রোটেষ্টান্ট, ইত্যাদি। তাহার উপর দ্বিতলে দেখ, কেবল মুসলমান; হিন্দু,—সবই হিন্দু, ইত্যাদি। তাহার উপর ত্রিতলে উঠিয়া দেখ,—একটি কক্ষ মাত্র, কামরা বিভাগ নাই, অর্থাৎ মুসলমান, হিন্দু, কিছুই নাই—সকলে এক প্রকার মানুষ এবং উপাস্য কেবল এক আল্লাহ্‌। সূক্ষ্মভাবে ধরিতে গেলে কিছুই থাকে না—সব ‘নাই’ হইয়া কেবল আল্লাহ থাকেন।...

অগ্রজ ভাইয়ের কাছে শিক্ষা পেয়ে শাণিত হয়েছিল তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। ধর্ম বিষয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা না করার জন্য স্বামীর পরামর্শ সম্পর্কে তাঁর শুভানুধ্যায়ী মোহাম্মদ ইয়াসিন সাহেবকে লেখা একটি চিঠিতে লিখেছেন ১৯১৯ সালে:

Dear Sir,

...As I do not understand any refined riddle of religion I had better avoid that matter. My late husband advised me not to discuss religion with anybody...

 তিনি জীবনভর শিক্ষা অর্জন করেছেন পরিবারের কাছ থেকে— মা, বাবা, ভাই-বোন-আত্মীয়দের উপদেশ, সহযোগিতা ও বিরোধিতা থেকে, সমাজ থেকে, পরিবেশ থেকে, শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে, স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের কাছ থেকে, বৈবাহিক সম্পর্কিতদের কাছ থেকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নারীআন্দোলন-সংগঠন-সমাজসেবা-রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে। শিক্ষার এই ব্যাপক ভিত্তি তাঁর চেতনা ও মানসজগতের বিকাশ সাধন করেছে, শিক্ষা সাধনায় তাঁকে ব্যাপৃত রেখেছে, সাহিত্য সাধনায় প্রবন্ধ, রসরচনা, গল্প, উপন্যাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে; পশ্চাৎপদ অবরোধবাসিনীদের সংগঠিত করার কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে, নারীর শিক্ষাগত, সামাজিক-পারিবারিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন কাজে আন্দোলনে যুক্ত হতে ও সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

নারীর অধিকার বিষয়ক

রোকেয়ার সমগ্র জীবনই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান রূপে সার্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে। তাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক-মানবাধিকার আন্দোলনের কোনো ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল না। এক এবং অদ্বিতীয় বিষয় ছিল নারীর মানবাধিকার অর্জনের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছেন আন্দোলন হিসেবেই; ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেছেন আন্দোলন হিসেবেই; সাহিত্য চর্চা ও (চিঠিপত্রসহ) সাহিত্য সাধনা করেছেন বা লেখনী ধরেছেন তিনি আন্দোলনের লক্ষ্যেই; ভোটাধিকার অর্জনের কমিটিতে অন্তভু‌র্ক্ত হয়েছেন, কাজ করেছেন, অন্যতম প্রতিনিধি রূপে ইংরেজ সরকারের কাছে বা মন্টেগু-চেমসফোর্ড কমিটির কাছে নারীর ভোটাধিকারের দাবি পেশ করেছেন—আন্দোলনের লক্ষ্যেই। এই আন্দোলন হচ্ছে নারীর সমকক্ষতা, সমতা, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে।

রোকেয়া যেমন স্কুল চালিয়েছেন তেমনি কলকাতায় ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি নারীসমিতি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১৬ সালে।

ইসলাম ধর্মে অনুমোদিত নারীর অধিকার থেকে মুসলিম নারীদের বঞ্চিত করে রাখার বিরুদ্ধে এই সমিতি সংগ্রাম করেছে এবং যৌতুক প্রথার অবসান, নারীর শিক্ষা, সামাজিক অধিকার নিয়ে এই সমিতি বহু কাজ করেছে। মুসলিম মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লাঞ্ছিত নিপীড়িত নারী ও শিশুর সাহায্যে, নারী শিক্ষার প্রসারে, নারীকে অবরোধ থেকে মুক্ত করতে এই সংগঠন উল্লেখযোগ্য নারীদের মুক্তির জন্য শিক্ষা ও কাজের ব্যবস্থা করা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নারীকল্যাণে এই সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অবরোধের বাধা দূর করে মহিলাদের সমাজের কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি তৎপর ছিলেন।

তিনি বলতেন, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে, যেন নিন্দা-গ্লানি, উপেক্ষা-অপমান কিছুই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে, মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে, যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্রবিদ্যুৎ সকলই প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।’ সমিতির কাজ করতে গিয়ে, নারী শিক্ষার প্রচেষ্টা নিতে গিয়ে, স্কুল চালাতে গিয়ে তিনি সমাজদ্রোহিনী ও ধর্মদ্রোহিনী বলে সমাজের কাছে হেয় হয়েছেন। কিন্তু তাতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি।

রোকেয়া নারী জাগরণের কর্মী ও প্রেরণাদাতা। নিজে অবরোধের যে যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন তার মধ্যে নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে দেখেছিলেন। তাঁর বক্তব্যে, বিভিন্ন লেখায় এই খেদোক্তি ফুটে উঠেছে যে, দাসব্যবসা নিষিদ্ধ কিন্তু ঘরে ঘরে নারীদের অবস্থা ক্রীতদাসীদের থেকে কোনো অবস্থায় ভালো নয়; দাসরা তো তবু মুক্তির স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু নারীসমাজ সেই স্বপ্ন দেখার কথা ভাবতেও পারে না—এমনি জড়ত্ব প্রাপ্ত হয়েছে তারা। সমাজের তৈরি নারীর এই দাসত্বের প্রশ্নে রোকেয়া যথেষ্ট মর্মাহত ছিলেন। ১৯০৪ সালে তাঁর লেখায় মেয়েদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মূল বাধা লক্ষ করেছেন সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে। তিনি বলেছেন:

প্রবল সব বাধা অগ্রাহ্য করে যখনই কোনো ভগ্নি মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।...আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।...এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন।...ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় করিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর ওপর প্রভুত্ব করিতেছেন।

রোকেয়ার সমাজ বিশ্লেষণ অত্যন্ত চমৎকার। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর নির্যাতন বন্ধের জন্য পারিবারিক আইন সংশোধন ও বাস্তবায়নে বাধা হয়ে আছে এই ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই।

রোকেয়া নারীর উপার্জনের বা কাজের ক্ষেত্র সীমিত বলে মনে করেননি। কৃষিকাজ, ব্যবসা, চিকিৎসাবৃত্তি, শিক্ষকতা সব কিছুই মেয়েরা করতে সক্ষম বলে তাঁরা মনে করেন। রোকেয়া ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন:

সাংসারিক জীবনের পথে পুরুষের পাশাপাশি চলিবার ইচ্ছা অথবা দৃঢ় সংকল্প আবশ্যক এবং আমরা যে গোলাম জাতি নই, এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদের যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয় তবে তাহাই করিব। উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যবহার করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?

সে সময় শিক্ষকতা ও চিকিৎসাবৃত্তিকেই মেয়েদের পেশা হিসেবে সমাজে গ্রহণীয় করার আন্দোলন চলছিল। রোকেয়া বললেন, এই ধরনের পেশায় সীমিতসংখ্যক শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়ে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে কিন্তু গ্রামবাংলার নিরক্ষর কৃষক পরিবারের বা শহরের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত স্বল্পবিত্ত পরিবারের মেয়েদের পেশার কথাও তো ভাবতে হবে। সে ক্ষেত্রে তিনি কৃষিকাজ ও ব্যবসাকে মেয়েদের পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য গুরুত্ব দিয়েছেন।

প্রথম নিখিল ভারত মুসলিম নারী সম্মেলন হয়েছিল ১৯১৫ সালে। মুসলিম সমাজের প্রগতিবাদী শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের স্ত্রী এবং আত্মীয়া মহিলারাই মূলত এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনের মূল আলোচনা ছিল মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও প্রসার ঘটানো। এর দুই বছর পরে ১৯১৭ সালে লাহোরের ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’-এর উদ্যোগে নারী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রচারিত হয়। লাহোরের মুসলিম পুরুষ সমাজ এর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

মুসলিম নারীসমাজের জন্য প্রগতিবাদী মুসলিম পুরুষদের উদ্যোগ লক্ষ করে রোকেয়া বলেন:

আজ ১০/১২ বৎসর হইতে দেখিতেছি আমাদের মুসলমান সমাজে জীবনীশক্তি সঞ্চারিত হইয়াছে, চারিদিকে বেশ জাগরণের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে, নানা প্রকার সভাসমিতি গঠিত হইয়াছে। এখন মুসলিম সমাজ বুঝিয়াছেন স্ত্রী শিক্ষা ব্যতীত এ অধঃপতিত সমাজের উন্নতির আশা নাই। তাই তাঁহারা আর শুধু ভ্রাতৃসমাজ লইয়াই ব্যস্ত নহেন। চতুর্দিকে স্ত্রী শিক্ষার আলোচনা হইতেছে ও জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হইতেছে। এখানে মুসলমান মহিলা সমিতি সেখানে মহিলা ক্লাব প্রভৃতি নানাবিধ সদনুষ্ঠান আমাদের শ্রুতিগোচর ও নয়নগোচর হইতেছে। এমনকি গত বৎসরের (১৯১৭) ‘অল ইন্ডিয়া এডুকেশনাল কনফারেন্সের’ অধিবেশনে পর্দানশীন মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান রাখিয়া তাঁহাদের নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল, ইহা দ্বারা প্রতিপন্ন হয় যে, ভ্রাতৃগণ এখন ভগিনীদের চিনিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এখন তাহারা বুঝিয়াছেন, ‘না জাগিলে সব ভারত ললনা, এ ভারত আর জাগিবে না’।

তিনি ১৯২৫ সালে ‘আলীগড় মহিলা সমিতি’র সম্মিলনে আমন্ত্রিত অতিথিরূপে ভাষণ দিয়েছেন। ‘নিখিলভারত মুসলিম মহিলা সমিতি’র আজীবন সদস্যা ছিলেন তিনি।

১৯২৬ সালে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির সম্মেলনে (বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশনাল কনফারেন্সে) রোকেয়া সভানেত্রী হিসেবে যে ভাষণ দেন সেটি সে যুগের মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার অবস্থা বিষয়ে করুণ একটি চিত্রও বটে। তিনি খুব দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়’—স্ত্রী শিক্ষার কথা বলতে গেলেই সমাজকে দোষ দিতে হয় আর সমাজের দোষ ধরতে গেলেই মুসলিম নারীর প্রতি ভাইদের অবহেলা, ঔদাস্য এসবের নিন্দা করতে হয়। আরো কঠোরভাবে তিনি বলেছেন:

স্ত্রী শিক্ষার বিরোধীগণ বলে যে, শিক্ষা পাইলে স্ত্রীলোকেরা অশিষ্ট ও অনম্যা হয়। ধিক! ইহারা নিজেকে মুসলমান বলেন, অথচ ইসলামের মূল সূত্রের এমন বিরুদ্ধাচরণ করেন। যদি শিক্ষা পাইয়া পুরুষগণ বিপথগামী না হয়, তবে স্ত্রীলোকেরা কেন বিপথগামিনী হইবে?

মুসলিম সমাজের প্রতিকূল মনোভাব ও অবরোধ প্রথার ক্ষতিকারক পরিণতির বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন। রোকেয়া নারীমুক্তির জন্য যে সুস্পষ্ট চিন্তাধারাকে লিপিবদ্ধ রেখে গেছেন তা বর্তমান যুগের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। তিনি দৃঢ়ভাবে এই স্লোগান তুলেছেন যে, দাসত্ব থেকে নারীকে মুক্তি পেতেই হবে। গৃহকর্ম, সন্তান পালন ইত্যাদি চিরাচরিত কাজে যুক্ত আদর্শ মা এবং স্ত্রী হিসেবে নারীসুলভ মহিলার ভূষণে ভূষিত নারীদের উল্লেখ করে বলেছেন, এরা আত্মবিকাশের মর্ম বোঝে না, বোঝে ঐতিহ্য মেনে সমাজের নামে আত্মবলিদানের গৌরব। তিনি তীক্ষ্ণভাবে সমাজের সমালোচনা করে বলেছেন যে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে যে নারী নিজের অগৌরব মেনে নিয়ে অপমান ও নির্যাতন সহ্য করেন, স্বামী ও সংসারের দাসত্ব যে নারী বিনা প্রতিবাদে পালন করে যান, সমাজের চোখে সেই নারীই আদর্শ।

তাঁর কাছে নারীমুক্তির অর্থ সম-অধিকার অর্জন ও প্রতিষ্ঠা। সমাজের নারী ও পুরুষের সমকক্ষতার জন্য যদি নারীকে অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হতে হয় তবে সেটাই করতে হবে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি যে যুগে এমন স্পষ্ট দাবি জানান তখন মুসলিম সমাজে এমন কথা ভাবাও যেত না। সে সময় নবজাগরণে উদ্বুদ্ধ মুষ্টিমেয় শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজের নারী যেমন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, কামিনী সেন, কৃষ্ণভাবিনী দাস, সরলা দেবী প্রমুখ স্ত্রী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর সার্বিক বিকাশের প্রয়োজনে অবরোধমুক্তির দাবিও জানিয়েছেন। কিন্তু মুসলিম নারীসমাজের পক্ষে রোকেয়া যখন মেয়েদের অবরোধমুক্তি ও চাকরি করার বিষয়ে জোর দেন তখন সমাজে তিনি নিন্দিত হন অথচ এ দেশে তখন (১৯০৪) বহু ব্রাহ্ম ও খ্রিস্টান মহিলা চাকরিরত ছিলেন। নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বেগম রোকেয়া। তাঁর  Sultana's Dream বইটিতে (রচনা ১৯০৫, প্রকাশ ১৯০৮) তা স্পষ্ট। এই বই পড়ে মনে হয় বাংলার অবরোধবাসিনীদের মনে আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তির বীজ বপন করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, বেগম রোকেয়ার মধ্যে এ প্রেরণা জাগিয়েছে বিভিন্ন দেশের মুসলিম নারী জাগরণের আদর্শ। তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের কাছ থেকেও প্রাচ্য-এশীয়-পাশ্চাত্য সমাজ ও শিক্ষার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন। রোকেয়ার নিজের উল্লেখ থেকেই জানা যায় যে, বিভিন্ন বাংলা-ইংরেজি-উর্দু পত্রপত্রিকা ও বই তিনি পড়তেন। প্রাচ্য, এশীয় ও পাশ্চাত্য সাহিত্য ও ভাবধারা থেকেই নারীমুক্তির আদর্শ তিনি গ্রহণ করেছেন এমন ধারণা অনেকেই সঙ্গত মনে করেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও তো মিথ্যা নয় যে, বিদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই তিনি নিজ জীবনের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকেই অবরোধবাসিনীদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করেন। তিনি  অবরোধবাসিনী  বই-এ লিখেছেন:

কবির ভাষায় বলিতে ইচ্ছা করে:

‘কাব্য উপন্যাস নহে, এ মম জীবন

নাট্যশালা নহে, ইহা প্রকৃত ভবন।’

...অবরোধবন্দিনীদের পক্ষ হইতে বলিতে ইচ্ছা করিল,

‘কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,

কেন জন্ম লভিলাম পর্দা-নশীন ঘরে।’

তাঁর  অবরোধ-বাসিনী-র মধ্যে সে যুগের নারীসমাজের যে জীবন কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে তা এ যুগের নারীসমাজের অবরুদ্ধ নির্যাতিত জীবনের এক ঐতিহাসিক দলিল এবং তা এখনো প্রকৃতপক্ষে এ যুগের গ্রামবাংলার নারীসমাজের কাছে একটি আয়নার মতো যার মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায় হুবহু একই প্রতিবিম্ব।

রোকেয়ার মাত্র ৫২ বছরের জীবনের সমগ্র সময়টুকুই ছিল সংগ্রামমুখর। প্রথম জীবনে অবরোধ প্রথার নিদারুণ নির্যাতন ভোগ করেছেন তিনি। মাত্র ১১ বছর স্বামীর সহযোগিতাপূর্ণ সুখী-সুন্দর জীবন যাপন করেছেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি যেমন কর্মব্যস্ত ছিলেন তেমনি কঠোর সংগ্রামী ছিলেন। নারীসমাজের প্রতি সকল বৈষম্য ও শোষণ বন্ধের জন্য যেমন লেখনী ধরেছিলেন, তেমনি সংগঠন গড়েছেন, প্রতিবাদ, আন্দোলন এবং বাস্তব কাজও করেছেন।

তাঁর সমগ্র সাহিত্য সাধনা ও লেখালেখির মূল বিষয় ছিল সমাজের গলদ তুলে ধরা, নারীর প্রকৃত শক্তির উদ্ঘাটন করা ও নারীকে অধিকার সচেতন করে তোলা। ১৯০২ থেকে ১৯৩২ এই সময়কালের মধ্যে তাঁর লেখালেখির বিষয়ে তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে যেমন ভালো তেমনি মন্দ প্রতিক্রিয়া জেগেছিল।

রোকেয়াকে মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় এই জন্য যে, তাঁর আগে আর কোনো মুসলিম নারী এভাবে নারীসমাজের শোষণ ও বৈষম্যের বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে সমাজে আলোড়ন জাগাননি, নারীসমাজকে সচেতন করার বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে আত্মনিবেদন করেননি এবং এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের দোষ-ত্রুটি দেখিয়ে সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে জোর দেননি। তাঁর সমসাময়িক অনেক মহিলা প্রথানুগ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন (অবশ্য আগেই বলেছি, তৎকালীন সময়ের রীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত মেয়েদের পড়া কিছুটা সহজ হয়ে আসছিল।) কিন্তু তাঁদের মধ্য থেকে কেউ এমনভাবে অগ্রণী ভূমিকা নিতে এগিয়ে আসেননি।

রোকেয়ার নারীশিক্ষা, পেশা, মুসলিম পারিবারিক আইন এবং বিবাহ, বহুবিবাহ, পর্দা, অবরোধ ইত্যাদি বিষয়ে নারীবাদী তত্ত্ব মূলতঃ মানবাধিকারের ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি থেকে উৎসারিত। তিনি যা ভেবেছেন তা বলেছেন, যুক্তি-বিশ্লেষণ-সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি যা বলেছেন তা নারী-ব্যক্তির উন্নতির জন্য বা বিকাশের জন্য বলেননি, সামাজিক বিকাশের জন্য বলেছেন— যা নারী ও পুরুষ উভয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি যা বলেছেন তা ব্যক্তিগত জীবনে পালন করেছেন এবং সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক জীবনের বিকাশের লক্ষ্যে বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করেছেন প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে।

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ফেলার কয়েক ঘণ্টা আগে ৮ ডিসেম্বর রাতে অকালপ্রয়াত রোকেয়া লিখছিলেন ‘নারীর অধিকার’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ। অসম্পূর্ণ হলেও এই প্রবন্ধও বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের জন্য নির্দেশিত করেছে একটি তত্ত্ব এবং ইস্যু:

আমাদের ধর্ম্মমতে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় পাত্র-পাত্রীর সম্মতি দ্বারা। তাই খোদা না করুন, বিচ্ছেদ যদি আসে, তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে। কিন্তু এটা কেন হয় এক তরফা, অর্থাৎ শুধু স্বামী দ্বারা?...বৃদ্ধ পুরুষদের বালিকা-বিবাহে কত আগ্রহ ও সাধ, সেই সম্বন্ধে উত্তর-বঙ্গে এই একটি ছড়াও প্রচারিত রয়েছে:

হুকুর হুকুর কাশে বুড়া

হুকুর হুকুর কাশে।

নিকার নামে হাসে বুড়া

ফুকুর ফুকুর হাসে।।

রোকেয়ার স্বপ্ন-সংগ্রাম অব্যাহত রইলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত-পরিচালিত স্কুলের ছাত্রী, শিক্ষয়িত্রী ও আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম সংগঠনের সদস্যা-সংগঠকদের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে। তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের ভাবধারায় তাঁর প্রভাবিত ও উজ্জীবিত হওয়ার তথ্য থেকে বলা যায় তিনি পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিরূপে সকল কর্মকাণ্ড-সাধনায় নিবেদিত ছিলেন। স্বদেশী আন্দোলন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, বিপ্লবীসন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম-ব্রাহ্ম নারী সমাজের যোগাযোগ, সরাসরি অংশগ্রহণ, সহযোগিতা, সহমর্মিতার ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে নানা বইয়ে। রোকেয়া ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছিলেন, স্বেচ্ছাসেবী নারী বাহিনীতে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। রোকেয়ার স্বদেশ ভাবনা, স্বাধিকার, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্য জানা যায় নিম্নলিখিত প্রবন্ধ ও কবিতায়: চাষার দুক্ষু, এন্ডিশিল্প, বলিগর্ত্ত, আপীল (কবিতা), নিরুপম বীর (কবিতা; কানাইলালের বীরত্ব) ইত্যাদি।

সমকালীন  Bengalee  পত্রিকায় ১৯২১ সালের ২৮ আগস্ট প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, ‘বঙ্গীয় নারী সমাজ’ সংগঠনের উদ্যোগে গড়ে ওঠা নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের সাফল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের সকল ধর্মাবলম্বী সমাজের কাছে উদাত্ত সহযোগিতা আহ্বান করেছিল। নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের প্রতি ব্রাহ্ম সমাজের মুক্তমনা প্রগতিশীলদের সমর্থন প্রথম থেকেই পাওয়া গিয়েছিল। রোকেয়ার এবং বেগম সুলতান মুয়াইদজাদাসহ অন্যান্য প্রখ্যাত মুসলিম মহিলাদের সমর্থন বঙ্গীয় নারীসমাজ পেয়েছিল। কিন্তু আইন পরিষদের মুসলিম সদস্যদের সমর্থন পাওয়া সম্ভব হয়নি।

১৯২১ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত বহু চেষ্টা সত্ত্বেও ‘বঙ্গীয় নারী সমাজ’ সংগঠনটি নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনে ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় নারী সংগঠক ব্যতীত সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠীর নারী সংগঠকদের সংগঠিত করতে পারেনি। মুসলিম নারীদের সমর্থন কর্মকাণ্ড ১৯২১ সাল পর্যন্ত পত্রিকায় চিঠি ও বিবৃতি প্রকাশের মধ্যেই সীমিত ছিল।

রোকেয়ার ভূমিকাও ১৯২১ সাল পর্যন্ত সীমিত ছিল চিঠি ও বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানকারীরূপে। আইন পরিষদের সভায় শ্রী সুরেন্দ্রনাথ মল্লিক এবং জনাব এ কে ফজলুল হক বলেছিলেন, নাগরিক হিসেবে নারী ও পুরুষের সমান ভোটাধিকার দিতে হবে। তবে সমাজে ও রাজনীতিতে বিতর্ক অব্যাহত থাকে। ১৯২১ থেকে উত্থাপিত দাবিতে স্থানীয়ভাবে নারীর ভোটাধিকারের দাবি ১৯২৩ সালে সরকারের সম্মতি পেয়েছিল। কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনী এলাকায় নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন গভর্নর লর্ড লিটনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারীর দলে কামিনী রায়ের নেতৃত্বে মিসেস মাযহারউদ্দিন এবং মিসেস লতিফ মুসলিম নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

১৯২৫ সালে ‘বঙ্গীয় নারী সমাজ’ সংগঠন থেকে নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন শুরু হয়। তখন কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে নারীরা ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন। রোকেয়া ১৯২৫ সালে ‘বঙ্গীয় নারী সমাজ’ সংগঠনের সভায় উল্লেখযোগ্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

১৯২৬ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতির সম্মেলনে সভানেত্রীর অভিভাষণে রোকেয়া নারীশিক্ষার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে ভোটাধিকার প্রয়োগে মুসলিম মহিলাদের অনীহা বিষয়ে তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন:

এখন স্ত্রীলোকেরা ভোটদানের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছে, কিন্তু মুসলিম মহিলাগণ এ অধিকারের সদ্ব্যবহারে স্বেচ্ছায় বঞ্চিতা রহিয়াছেন। গত ইলেকশনের সময় দেখা গেল কলিকাতায় মাত্র ৪ জন স্ত্রীলোক ভোট দিয়াছে। ইহা কি মুসলমানের জন্য গৌরবের বিষয়? তাঁহারা কোন্ সুযোগের আশায় বা অপেক্ষায় বসিয়া আছেন?

রোকেয়া নারীর ভোটাধিকার বিষয়ে এভাবেই সোচ্চার ছিলেন এবং ঐ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।

রোকেয়া সমসাময়িক যুগে ধর্মীয় মতবাদের রক্ষণশীল লেখকদের বিরুদ্ধতার ও বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁর নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাঙালি মুসলিম ছাত্রী না পাওয়ায় কলকাতার উর্দুভাষী মুসলিম ছাত্রীদের নিয়ে উর্দু শাখা পরিচালনা করতে হয়েছে কয়েক বছর। তদুপরি কলকাতায় দাঙ্গার জন্য স্কুলে ছাত্রী কমে যাওয়া, পর্দা না থাকায় ফতোয়া দেওয়া, স্কুল পরিচালনায় অর্থ না পাওয়া, সরকারি সাহায্য অনুমোদনের জন্য নিজে ‘বোরখা’ পরা শুরু করা— ইত্যাদি সমস্যা প্রতিকূল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এসব সত্ত্বেও লেখনীর তরবারিতে তাঁর মরচে পড়েনি বরং খরধার হয়েছে, স্কুল বন্ধ হয়নি অদ্যাবধি চলছে কলকাতায়। কাজেই আমরা সর্বাঙ্গীনভাবে পেয়েছি নারীমুক্তির তাত্ত্বিক ও বাস্তবায়নকারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে।

সৃজনশীল সাহিত্যিক মেধা, ব্যক্তিত্ব, নারী শিক্ষা প্রসারে আন্দোলন রূপী-বিদ্রোহী রূপী জেহাদ বাস্তবায়নের নিষ্ঠা, নারীর মানবাধিকার, পারিবারিক বিবাহ প্রথার বৈষম্য-নিপীড়ন-নির্যাতন-শোষণকে চ্যালেঞ্জ করা, ঔপনিবেশিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান, পুরুষের প্রাধান্য না মেনেও স্বচ্ছন্দে নারী যে তার কাজ করতে পারে, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অনুশীলনে কৃতিত্ব দেখাতে পারে। সেই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠা করা, সর্বোপরি শতবছর পরেও অবিসংবাদী নেত্রীরূপে বাংলাদেশের জনগণের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে আছেন রোকেয়া। রোকেয়া বিশ্বের নারী আন্দোলনের অগ্রদূতদের অন্যতম, বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের তথা মানবাধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত।

সমসাময়িক সামাজিক-সাংস্কৃতিক কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ধর্মশিক্ষা, সততা, জ্ঞান ও সাহস অর্জন করেছিলেন তিনি। লেখনী মাধ্যমে, সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মাধ্যমে, আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং ১৯২২ সালে সমসাময়িক ‘নারীতীর্থ’ প্রতিষ্ঠানের (ডা. লুৎফর রহমান কতৃ‌র্ক প্রতিষ্ঠিত) সভানেতৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে, নারীশিক্ষয়িত্রীদের প্রশিক্ষণের সরকারি সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে, নারীর সমানাধিকার বিষয়ে অব্যাহতভাবে প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা লেখা ও তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন-সংগ্রাম করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি নারীশিক্ষা, কাজ, পেশা, গার্হস্থ্য, মাতৃত্ব, সাহিত্যচর্চা, মানবাধিকার, পারিবারিক নির্যাতন বন্ধের পথিকৃৎ হয়ে আছেন।

পুনঃপ্রকাশ

সৌজন্য  * সংকলিত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ

লেখক : অধ্যাপক (সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভারসিটি, ঢাকা)  গবেষক, প্রাবন্ধিক।

0 Comments

Post Comment