- 04 December, 2023
- 0 Comment(s)
- 759 view(s)
- লিখেছেন : মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
বছর কয়েক আগে ৯ ডিসেম্বর বিদ্যালয়ে পালনীয় দিন করার আবেদন জানিয়েছিলাম সরকারি শিক্ষা দপ্তরে। তবে সে আবেদন কেউ পড়েছিলেন কি না জানা নেই। বরাবর মনে হয়েছে সারা বছর শিক্ষাঙ্গনে যে কয়েকটি পালনীয় দিন আছে, যেমন নেতাজি জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বিদ্যাসাগর জয়ন্তী, তার সাথে রোকেয়া দিবসকে যুক্ত করলে তা যথাযথ সার্থকতা পেতো। আজ যখন নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে দুনিয়া জুড়ে এত হুড়োহুড়ি তখনও বাংলার নারী জাগরণের পথিকৃৎকে আমরা এই বাংলায় স্থান দিতে পারিনি এ আমাদের দুর্ভাগ্য। এ আমাদের পাপ।আমাদের দপ্তরগুলিতে বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ নিবেদিতা হয়ে মার্কস এঙ্গেলসও শোভা পেয়েছেন, কিন্তু রোকেয়াকে কোথাও দেখা যায় না।
এবছর ২৩ সেপ্টেম্বর উত্তর স্পেনের একটি ছোট্ট গোষ্ঠী বাস্ ক Basque জাতির ভাষায় ৮৬ মিনিটের একটি অ্যানিমেশন ছবি তৈরি করেছেন ইসাবেল হেগোয়েরা যেটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে। জার্মানির একটি উৎসবে সেটি সর্বশ্রেষ্ঠ বাস্ ক চলচ্চিত্র হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। এই ছবিটির নাম সুলতানাস ড্রিম। রোকেয়ার সেই বিখ্যাত নারীবাদী গল্প যা নিয়ে আজ সারা দুনিয়া জুড়ে চর্চা চলছে। ছবিটিতে দেখানো হয়েছে একটি মেয়ের কথা যে নিজের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ভারতে আসে এবং একটি বইয়ের দোকানে রোকেয়ার বইটি পায়। সমান্তরালে রোকেয়ার জীবন, মেয়েটির গল্প এবং সুলতানার স্বপ্ন নিয়ে ছবিটি ।
এবার এদেশের একজন মানুষের কথা জানাতে চাই যিনি রোকেয়ার লেখা পড়ার জন্য বাংলা ভাষা শিখেছেন। লক্ষ্ণৌর সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন হায়দার খান। ইংরেজিতে তিনি রোকেয়ার ‘সুলতানাস ড্রিম’ এবং ‘পদ্মরাগে’র অনুবাদ পড়েছেন, তারপরেই তিনি খুঁজতে থাকেন এই নারী জাগরণের পথিকৃৎ এর অন্যান্য লেখা এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে সেগুলিকে হিন্দিতে অনুবাদ করতে শুরু করেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি তিনি ‘অবরোধবাসিনী’ অনুবাদ করেছেন এবং কয়েকজন বন্ধুর সাথে একটি পাঠচক্র করেছেন যেখানে নিয়মিত রোকেয়ার লেখা পড়া হয়। রোকেয়ার সন্ধানে নাসিরউদ্দিন কলকাতা এসেছিলেন এবং বাংলাদেশেও গিয়েছেন। তিনি মনে করেন আজকের সময় রোকেয়াকে জানা গোটা দেশের জন্য জরুরি।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে প্রাদেশিক সংকীর্ণতার কারণে আমরা বাইরের দুনিয়ার চর্চাকে খেয়াল করি না। আমাদের নিজের চর্চাতেও রোকেয়ার জায়গা নেই। যদিও তার কর্মকাণ্ডে বিস্তৃত পরিসর হল এই দেশ এই বাংলা। বাংলাদেশে তিনি একজন আইকন কিন্তু এদেশে তার লেখা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর কোন স্তরেই তেমন পড়ানো হয় না, এর চেয়ে বিস্ময়কর আর কি হতে পারে! নাসির উদ্দিন “স্ত্রী জাতির অবনতি” এবং “অবরোধবাসিনী” পড়ে উচ্ছ্বসিত কিন্তু আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি মেয়েরা রোকেয়ার নামটুকু অনেকে শোনেননি। অথচ ভগিনী নিবেদিতাকে নিয়ে আমাদের বিরাট উৎসাহ।
আজকে গোটা দুনিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু মুসলমান সমাজের জন্য নয় সামগ্রিক নারী সমাজের জন্য রোকেয়ার পাঠ অত্যাবশ্যক। রোকেয়াকে শুধুমাত্র মুসলমান মেয়েদের জন্য আলাদা করে দেখা আর এক ভ্রান্তি।
আধুনিক কালে মেয়েদের শিক্ষার জন্য এই দেশে বরাবরই কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাচীন অথবা মধ্যযুগের সুবর্ণ সময় বা অন্ধকারের বিতর্কে না গিয়ে আমরা মোটামুটি দেখেছি বাংলায় মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে রোকেয়ার আগেও বহু মানুষ চেষ্টা করেছেন। নারী শিক্ষা সংক্রান্ত ধর্মীয় কুসংস্কারগুলি যারাই পেরোতে পেরেছেন এবং যারা মানবাধিকারের কথা ভেবেছেন তাদের অনেকেই স্ত্রী শিক্ষার কথা বলেছেন, প্রধানত তার সূত্রধর থেকেছেন বিদগ্ধ পুরুষেরা যারা কঠিন লড়াই করেছেন সমাজের সাথে এবং মেয়েদের লেখাপড়ার পথটি প্রশস্ত করেছেন। কিন্তু মেয়েদের মধ্য থেকে এই তাগিদ যারা অনুভব করেছেন এবং এগিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে রোকেয়া ভিন্ন। ১৮৬৩ সালে লিখিত কৈলাসবাসিনী দেবীর ‘হিন্দু মহিলাগনের হীনাবস্থা’ বাঙালি নারী রচিত দ্বিতীয় প্রবন্ধ গ্রন্থ, সেখানে নারীর শিক্ষার কথা বলা হলেও তার বিদ্যালয়ে যাওয়াকে লেখিকা অনুমোদন দিতে পারেননি।
“যে কাল পর্যন্ত বালিকাগনের পাঠোপযোগী হিন্দু অন্তঃপুর তুল্য বিদ্যামন্দির প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাবৎতকাল আর তাহাদিগকে উক্ত বিদ্যালয় প্রেরণ করা কখনোই বিধেয় নহে।“
এই অন্ত:পুরের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত মেয়েদের বিবাহ উপযোগী করে তোলা এবং তদানীন্তন সমাজে শিক্ষিত স্বামীর যোগ্য সহধর্মিনী হওয়ার প্রয়াস।
১৮৬৫ সালে বামাবোধিনী পত্রিকায় তাহেরুন্নেসার নিবন্ধে দেখা যাচ্ছে
‘এই অসার সংসারে মূর্খ হইয়া কোন কামিনী গনের কলেবর ধারণ করা কেবল বিড়ম্বনা মাত্র। বিদ্যোপার্জন দ্বারা যদি স্ত্রীগণের হৃদয় আকাশ জ্ঞান সুশীল আলোকে আলোকিত হয়, তবে তাহারা এই নিখিল ভূমন্ডলে সুশৃঙ্খলার সহিত সংসার ধর্ম প্রতিপালন পূর্বক আপনার ও স্বীয় পরিবারের যে কত অনির্ব্বচনীয় আনন্দ উৎপত্তি করিতে পারে তাহা বর্ণনা করিয়া শেষ করা যায় না।" এখানেও শিক্ষার দ্বারা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সংসার সুখী করার কথাই আছে। স্বামী বিবেকানন্দের প্রেরণায় সিস্টার নিবেদিতার তৈরি স্কুলেও গার্হ্যস্থ শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে, নাহলে ছাত্রীই হয়তো মিলতো না।
১৮৮৭ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী যিনি বাংলার বাইরে পণ্ডিতা রমাবাঈ প্রমুখের উদ্যোগ দেখেছেন, 'স্ত্রী শিক্ষা ও বেথুন স্কুল’ নামক প্রবন্ধে বেথুন স্কুলের সিলেবাস আলোচনা করে বলছেন যেহেতু অল্প বয়সে অনেকেরই বিয়ে হয়ে যাবে, তাদের ইংরেজি না পড়িয়ে বাংলাতেই সবকিছু পড়ানো উচিত। সেখানে পাঠ্যবিষয় হিসাবে তিনি রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি দেশীয় পুরাতন কাহিনির কথা ভাবছেন।
একজন নারী শিক্ষাব্রতী হিসেবে এই ধারণায় প্রথম যিনি হাতেকলমে জোরালো বদল আনেন তিনি রোকেয়া। “গোটা কতক পুস্তক পাঠ করিতে বা দু ছত্র কবিতা লিখিতে পারা শিক্ষা নয়।“ তিনি শিক্ষাকে অধিকার অর্জনের উপায় হিসেবে দেখতে শেখান। তার কাছে শিক্ষা অর্থাৎ অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতা আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার উপায়। মেয়েদের জন্য শিক্ষার সাথে অর্থ উপার্জনকে যুক্ত করেছেন তিনি। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যে কথাটি আমরা এখনো বারবার মেয়েদের বলে থাকি তার ভাবনার বীজ লেখার ছত্রে ছত্রে বুনে দিয়েছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
এই ২০২৩ সালেও মেয়েদের লেখাপড়ার সাথে বিবাহ বিষয়টিকে এমন ভাবে জড়িয়ে রাখা হয়েছে যে কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প এনে মেয়েদের বিয়ে ঠেকিয়ে তাদের বিদ্যালয় ধরে রাখার প্রয়াস নিতে হয়েছে। অন্যদিকে সেই মেয়েরই বিবাহ কালে অর্থসাহায্য করার যে ভাবনা সেটি কিন্তু এখনো সমাজে কন্যাদায়ের বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ কারণেই রোকেয়ার লেখা সমস্ত স্তরে পাঠ্য হওয়া উচিত। রোকেয়ার নিজের বাল্যবিবাহ হয়েছিল, কিন্তু তাঁর স্বপ্নের নারীস্থানে ২১ বছরের আগে কারো বিবাহ হয় না। ১২০ বছর লেগে গেল এই একুশে পৌঁছতে।
রোকেয়ার কমবয়সে লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’, বাংলা তথা পৃথিবীর অন্যতম প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার গদ্য হিসাবে যা আজ গোটা দুনিয়ায় চর্চিত সেখানে তরুণী রোকেয়া, লেখালেখির জগতে সদ্য পদার্পণ করেই উদাত্ত কণ্ঠে বলছেন, মেয়েদের মস্তিষ্ক ছেলেদের চেয়ে দ্রুত চলে। ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে মাদ্রাজের ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিনে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয় ‘সুলতানাস ড্রিম’ যেটি পরবর্তীকালে রোকেয়া নিজেই অনুবাদ করেন। স্বপ্নের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া সেই কল্পিত স্বর্গে যার নাম লেডিল্যান্ড, সেখানে রানির নির্দেশে সমস্ত মেয়েরা সুশিক্ষিত হয়ে বিজ্ঞানের যথাযোগ্য প্রয়োগে এক আশ্চর্য দেশ তৈরি করেছেন যেখানে হিংসা নেই, আছে অভাবনীয় আবিষ্কার। এটা স্পষ্ট করে যে মেয়েদের শিক্ষার অভিমুখ কত বৃহৎ পরিসরে ঘোরাতে চেয়েছেন রোকেয়া।
১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতায় তাঁর স্কুল তৈরি হয়েছে মাত্র ৮ জন মেয়ে আর দুটি বেঞ্চ নিয়ে , সে বছরই এপ্রিলের দু তারিখে স্কুল পরিচালনার জন্য কমিটি তৈরি হলে পর্দা মানার আশ্বাস দিয়ে মেয়ে পাওয়া গেল। ১৯১৫ সালে সেখানে ৮০ জন ছাত্রী। রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ এরা কিন্তু স্কুলে পড়ার প্রত্যক্ষ অনুভব নিয়ে নিজেদের কাজ করেছেন সেখানে রোকেয়া কখনো স্কুলে যাননি। তাই পদে পদে তাকে স্কুল তৈরির পাঠ নিতে হচ্ছে এবং সারাদিনের সমস্ত কাজের পর নিজেকেও পড়াশোনা করতে হচ্ছে।
চিঠিতে লিখছেন “খোদার ফজলে পাঁচটা ক্লাস এবং ৭০ টি ছোট বড় মেয়ে দুইখানা গাড়ি দুই জোড়া ঘোড়া সইসেরা ঘোড়া মলে কিনা সেটাও দেখতে হয় অথচ সমাজ ভুল ভ্রান্তির অন্বেষণ করিতেই বদ্ধপরিকর।" ১৯৩০ সালে দশম শ্রেণি পর্যন্ত উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় হয়ে ১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় শতকরা ৭৫ শতাংশ মেয়েরা সফল। মাতৃভাষায় শিক্ষা দিতে গিয়ে রোকেয়া বাধা পেয়েছেন কেননা তখন ধীরে ধীরে পরিচিতি রাজনীতি জন্ম নিচ্ছে, মুসলমান অর্থাৎ উর্দুভাষী এই ভাবনা চেপে যাচ্ছে মগজে, রোকেয়া দুঃখ করে লিখছেন “ এখানকার মুসলমানেরা মাতৃহীন -অর্থাৎ তাহাদের মাতৃভাষা নাই। পরে অবশ্য রোকেয়ার স্কুলে বাংলা বিভাগ চালু হয়।
চলে আসি আজকের সময়ে। স্বাধীনোত্তর ভারতে মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে ইদানিং কালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল ২০০৬ সালের সাচার কমিটির রিপোর্ট। এই রিপোর্ট সরকারি তথ্য সংগ্রহ করেই দেখিয়ে দেয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চাকরি ক্ষেত্রে মুসলমানের করুণ অবস্থা যা তাকে তপশিলি জাতির থেকেও প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। সমাজের ভিতর থেকেই একদিন মহীয়সী রোকেয়া যেমন উদ্যমী হয়েছিলেন সেইভাবেই আল-আমীন মিশনের মত বহু উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ছেলেদের সাথে মেয়েরাও বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতায়ণের পথে সাফল্য পেতে থাকে। এ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিকে দশম স্থানাধিকারী আঞ্জুমা দিলরুবার বাবা মুদির দোকান চালান, বাড়ি নদীয়ার তেহট্টের হাঁসপুকুরিয়া গ্রামে। তিনি ৯৭.৪ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন। এবং তিনি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে আইআইটি তে গবেষণা করতে চান। এই কাল খণ্ডে দাঁড়িয়ে রোকেয়াকে কুর্নিশ জানানো ছাড়া উপায় নেই কেননা তিনি মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তার কল্পিত নারীস্থানে মেয়েরা বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে সমাজের বহু কিছুকে পরিবর্তন করতে পেরেছে এবং প্রকৃতির সাথে সুসম্পর্ক রেখে আজকের দিনের সুস্থায়ী পরিবেশ ভাবনা মাথায় রেখে সমাজ তৈরির কথা ভেবেছে।
রোকেয়া বলছেন,”আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে। তাহারা যেন অন্নবস্ত্রের জন্য কাহারো গলগ্রহ না হয়।“ নারীর ক্ষমতায়নের ধাপ হিসাবে স্বনির্ভরতাকে এতখানি গুরুত্ব হিন্দু মুসলমান কোনখানেই তার আগে কেউ দিয়েছেন কি না জানা যায় না। রোকেয়া মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান কিন্তু তাঁর সুযোগ্য উত্তরসুরীরা পদে পদে প্রমাণ করেছেন যে নারীর স্বনির্ভরতা কতদূর যেতে পারে। আমরা স্মরণ করছি সামসুন নাহার মাহমুদকে যিনি রোকেয়ার আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামের সম্পাদিকা হয়েছিলেন, যিনি ছিলেন ব্রাবোর্ন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান, পেয়েছিলেন রবীন্দ্র সান্নিধ্য, লিখেছিলেন রোকেয়া জীবনী। এনাকেই আমরা দেখেছি ১৯৩৫ সালে মেয়েদের ভোটাধিকারের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। আবার আছেন সুফিয়া কামাল যিনি ১৯৪৭ সালে বেগম পত্রিকা প্রকাশ করছেন, আছেন ফজিলাতুননেসা যিনি ১৯২৮ সালে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিদেশে পড়তে যান অংক নিয়ে। সমাজের অর্ধ অঙ্গ পড়ে থাকলে কী হয় তা নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছিলেন রোকেয়া। আজকের সময়ও আমরা দেখছি যে কোনও সমাজের এগিয়ে চলার পথে মেয়েদের শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। তাঁর ১১ বছর বয়সে বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ ঘটে। বলা যেতে পারে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের সুযোগ্য উত্তরসুরী রোকেয়া। নারী মুক্তিকে তিনি সরাসরি আর্থিক স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তিনি বলছেন ‘যে পরিশ্রম আমরা ‘স্বামী’র গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?....... আমরা লেডি কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার লেডি জজ -সবই হইবো। পঞ্চাশ বৎসর পরে লেডি ভাইসরয় হইয়া এদেশের সমস্ত নারীকে ‘রানি’ করিয়া ফেলিব।“
যে সময় এদেশের প্রগতিশীল মানুষেরা (পড়ুন পুরুষেরা) ধর্ম সমন্বয়ের মহান কথা বলছেন, রোকেয়া দেখছেন প্রত্যেক ধর্মেই মেয়েদের ছোট করা হয়েছে। কোথাও সে নরকের দ্বার। কোথাও বা সে পুরুষের অর্ধেক বুদ্ধিধারী। “আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থ গুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ......এই ধর্মগ্রন্থ গুলি পুরুষ রচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।“নারীর ক্ষমতায়নের পথে ধর্ম যে অন্তরায় সেকথা স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন রোকেয়া। শতাব্দী পেরিয়ে আজকের ভারতে এই কথা বলা রীতিমতো বিপজ্জনক।
রোকেয়া দেখছেন পুরুষের মন যুগিয়ে চলার জন্যই যেন নারীর জীবন। তার জন্য সে মজুরি হিসেবে পায় দাসত্বের চিহ্নগুলি, রোকেয়ার ভাষায Badges of slavery হল অলংকার। এমন তীব্র ভাষায় মেয়েদের সাজসজ্জা অলংকার প্রীতি ইত্যাদি বাহ্যিকতাকে তিনি আক্রমণ করেছেন যা এখনো সমানভাবে প্রযোজ্য। রোকেয়া নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মত করেই বলবেন এই নথ এই ভারি হার, চুড়ি সমস্তই পুরুষের নারীকে বন্দী করে রাখার পন্থা মাত্র। গরুর মত তাকে ভারী নথ পরিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে রোকেয়া দেখাচ্ছেন “পুরুষেরা ইহা পরাজয়ের নিদর্শন ভাবেন। তাঁহারা কোন বিষয়ে তর্ক করিতে গেলে বলেন ‘আমার কথা প্রমাণিত করিতে না পারিলে আমি চুড়ি পরিব’। আমাদের পোশাক পরিলে তাহাদের অপমান হয়।" আবার বলছেন, “যদি অলংকারকে দাসত্বের নিদর্শন না ভাবিয়া সৌন্দর্য বর্ধনের উপায় মনে করা যায় তাহাই কি কম নিন্দনীয় সৌন্দর্য বর্ধনের চেষ্টাও কি মানসিক দুর্বলতা নহে।" আজ যখন ধনতেরাসের দিনে অতি সুশিক্ষিতকেও গহনার দোকানে লাইন দিতে দেখা যায়, তখন রোকেয়াকেই মনে পড়ে।
এইখান থেকেই অবরোধবাসিনীর বেদনার কথা রোকেয়া তুলে ধরছেন। ৪৭টি অনুগল্পের মত ঘটনাকে দিয়ে তিনি দেখাচ্ছেন কিভাবে মুসলমান ও হিন্দু সমস্ত সমাজে মেয়েদের অদৃশ্য করে রাখার প্রয়াসে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে এবং মনুষ্যত্বের কিছু মাত্র মেয়েদের জন্য অবশিষ্ট থাকছে না। আজকের সময় আমরা আবার নতুন করে পরিচিতির রাজনীতিতে জড়িয়ে মেয়েদেরকে অদৃশ্য করে দেওয়ার বিবিধ প্রয়াস নিয়ে চলেছি। সংস্কারের নামে আবারো নানান ব্রত উপবাস ঘাড়ে চাপছে, হিজাব এবং ঘোমটা স্টাইল হয়ে উঠছে। শিক্ষিত হলেও নিজের পরিচিতি আবারও বাহ্যিকতায় আটকে ফেলা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় মেয়েদের মধ্যে হিজাব বোরখা তিলক ইত্যাদি পরা বেড়ে গেছে। একমাত্র রোকেয়াই এদের মুক্ত করতে পারতেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি পাঠ্য বইতে জায়গা পাননি।
‘সুলতানার স্বপ্নে’র নারীস্থানে রোকেয়া পুরুষদের অবরোধে রাখছেন জেনানার বদলে মর্দানায়, সেখানে মেয়েরা নিরাপদে পথে ঘুরে বেড়ায়। শুরুতে যে চলচ্চিত্রটির কথা বলেছি তার পরিচালক ভারতে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নিয়ে মেয়েদের সাথে একটি কর্মশালা করেন সেখানে প্রত্যেকটি মেয়ের মধ্য থেকে যে কথাটি উঠে আসে সেটি হল নারীস্থানে তারা নিরাপদ থাকতে পারবে। নিরাপত্তার প্রশ্নটি আজকের দুনিয়ায় বিশেষ করে ভারতে মেয়েদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিহারের ভাগলপুরে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে অনুষ্ঠিত মেয়েদের ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলার সময় মেয়েদের অন্যতম দাবি ছিল যাতে তারা রাত পর্যন্ত নির্ভয়ে পথে-ঘাটে চলাফেরা করতে পারে। এইতো সেদিন উত্তরপ্রদেশের কাশি স্টেশনের সামনে বেশ রাতে একদল মেয়ে অভিনয় করছিল “আমাদের রাত আমাদের রাস্তা”। এক শতাব্দী ধরে অবরোধ মুক্ত হওয়ার আন্দোলনে রোকেয়া আমাদের সহায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে বিজ্ঞানে দু দুবার নোবেল জয়ীর নাম মারিকুরি হলেও (১৯০৩ ও ১৯১১) সমাজ মনে করে বিজ্ঞানের মত বিষয়ে মেয়েদের মাথা তেমন খোলে না, তাই আজও পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের বিজ্ঞান চর্চাটি অত্যন্ত অবহেলিত। যারা একটু লেখাপড়ায় ভালো তারা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দিকে যান, বিশুদ্ধ বিজ্ঞান চর্চার দিকে যাওয়ার মতো প্রেরণা খুব কম মেয়ে পেয়েছেন। গ্রামাঞ্চলে এই মুহূর্তে বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবেশটি অত্যন্ত সংকুচিত । বালিকা বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শাখা খুলতে গেলে অনেক বেগ পেতে হয়। রোকেয়ার কল্পিত নারীস্থানে বিজ্ঞানের ব্যবহার এতটাই উজ্জ্বল যে আজকের দিনে পরিবেশ নিয়ে ভাবনার ক্ষেত্রে রোকেয়ার লেখাটি অন্যতম প্রামাণ্য টেক্সট হিসেবে ধরা হয়। এখানে রোকেয়া বলছেন মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে দুটি বিশ্ববিদ্যালযয়ে যার একটি সৌর শক্তি নিয়ে কাজ করে তৈরি করছে দূষণ বিহীন রন্ধনশালা ও হাওয়া-গাড়ি। অন্যটির গবেষণা বৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সৌরশক্তির ব্যবহার নিয়ে রোকেয়ার ভাবনা তাকে ইকোফেমিনিজমের পথিকৃৎ হিসেবে দুনিয়ায় স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সমান্তরাল পৃথিবীতে অতিমারী হয় না, এখানে জনপরিসরে মেয়েরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ান এবং সারা দিনে দু’ঘণ্টা কাজ করলেই হয়। দুনিয়ার শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কাজের জন্য একদা আন্দোলন করেছিলেন। আটই মার্চ নারীদিবস পালন করা হয় এমনই একদল বয়ান শিল্পের নারী কর্মীদের আন্দোলনের স্মরণে। ইদানিং কর্পোরেট জগৎ থেকে ৭২ ঘণ্টা কাজ করার নিদান দেওয়া হচ্ছে। আর রোকেয়া মুনাফা ও পুঁজির ত্রাসমুক্ত একটি আশ্চর্য দুনিয়া আমাদের উপহার দিয়েছেন। রোকেয়া জানতেন একমাত্র বিজ্ঞান পারে দৈহিক শক্তির পৌরুষকে অগ্রাহ্য করতে।
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি সভ্যের বর্বর লোভ আজ জাতিপ্রেমের নাম ধরে বিশ্বব্যাপী নরসংহারে প্রবৃত্ত। হিংসা আজ আমাদের হাতের মুঠোয় বিকশিত হয়ে চলেছে। যে বিজ্ঞানের হাত ধরে মানুষের অজ্ঞানতা দূর হয়েছিল, সে ত্রিভুবনের খবর পেয়েছিল, যে বিজ্ঞান সবচেয়ে বেশি মুক্তি দিয়েছে নারীকে অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব ও পাকশালার বন্দীদশা থেকে, আজ সেই বিজ্ঞানই দুনিয়া জুড়ে বীভৎস মারণাস্ত্র ব্যবসার প্রধান সহায়। ঠিক এই সময়ে এই চূড়ান্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দিনেও আমরা কিন্তু পারি না ফিলিস্তিনের একটি হাসপাতালকে রক্ষা করতে। গোটা দুনিয়ার সমস্ত শক্তি আমরা চালিত করতে পারি না হাজার হাজার শিশুকে বাঁচানোর জন্য। রোকেয়া আণবিক বোমা দেখে যাননি, তার ওপরে আজকের এই যুদ্ধবাজ পৃথিবীতে রোকেয়ার কথা বারবার মনে পড়ে। রোকেয়ার নারীস্থানে শান্তিই শেষ কথা। সেখানে মানবীরা পাপ ও আঘাত থেকে মুক্ত। হিংসার প্রবেশ নেই সেখানে। রোকেয়ার অনেক পরে আর এক বাঙালি ধর্মে মুসলমান লেখক, শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর শহর্ ইয়ার উপন্যাসের নায়িকাকে দিয়ে বলেছিলেন গোটা দুনিয়াটা যদি কখনো মেয়েদের অধীনে আসে, তাহলে নয় মাস দশদিনেই তারা বিশ্বশান্তি প্রসব করবে। শান্তির সাথে সম্প্রীতির যে যোগ রোকেয়া মেয়েদের তার অনুশীলন করতে বলেন। তাঁর আদর্শ গৃহিনী শুধু সংসার ধর্মে নিমজ্জিত নয়, ......তার “প্রতিবেশীনির বিপদকে নিজের বিপদ বলিয়া মনে করা উচিত। আর প্রতিবেশীর পরিধি বৃহৎ হওয়া চাই – অর্থাৎ প্রতিবেশী বলিলে আমাদের দ্বারস্থিত গৃহস্থ না বুঝায়। বঙ্গদেশের প্রতিবেশী বলিতে পাঞ্জাব, অযোধ্যা, উড়িষ্যা এসবই যেন বুঝায়।" তিনি আবার জাতি বর্ণ ধর্ম এসবের ঊর্ধ্বে উঠে বলছেন “আমরা সর্বপ্রথমে ভারতবাসী তারপর মুসলমান, শিখ বা আর কিছু।“ সংকীর্ণ পরিচিতির যে সংকট আজ বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেছে রোকেয়া তার বিপ্রতীপে চিরকাল। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ এ দেখা যাচ্ছে ‘যৎকালে এদেশের রমনীবৃন্দ নানাবিধ বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের নিযুক্ত ছিলেন, পুরুষেরা তখন সৈনিক বিভাগের বল বৃদ্ধির চেষ্টায় ছিলেন।‘
কিন্তু নারীস্থানে জমিজমার জন্য বা কোহিনূরের লোভে কেউ যুদ্ধ করেনা , “আমরা অতল জ্ঞান সাগরে ডুবিয়া রত্ন আহরণ করি।“
রোকেয়া সেই শিক্ষাব্রতী যিনি বলেছিলেন, “কবরে শুইয়াও যেন আমি আমার মেয়েদের কলকোলাহল শুনিতে পাই।" আমাদের দুর্ভাগ্য এই পশ্চিমবঙ্গ যেটি তাঁর ৫২ বছরের জীবনের প্রধান কর্মক্ষেত্র, সেখানে শিক্ষাঙ্গনে তাঁর অবদানকে প্রায় বিস্মৃত করে রাখা হল। মুসলমান হিন্দু সকল ছাত্রীর জন্য তিনিই যথার্থ দিশারী, কিন্তু তাঁকে আমরা সীমিত নারীবাদী চর্চাতেই আবদ্ধ করে রেখেছি।
লেখক : প্রধান শিক্ষিকা, প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment